স্থান ~ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন । সময় ~ ১৯৮৯, এপ্রিল ৷ উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ সব্যসাচী মান্না, আশ্রমের মহারাজগণ এবং অন্যান্যরা ।

জিজ্ঞাসা :— যীশুর মত ব্যক্তির crucifixion হোল কেন?

গুরুমহারাজ :— রাজশক্তি মেনে নিল না তাই। আজ থেকে ২ হাজার বছর আগে জেরুজালেম নগরীরপরিবেশ বা পরিস্থিতির কথা ভাবো। আর শুধু ওখানকারই বা কথা কেন, যে কোন জায়গাতেই তখন রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র ইত্যাদি systemছিল। এ ছাড়া রাজতন্ত্র এবং পুরোহিততন্ত্রের আঁতাত যে কোন নতুন চিন্তাকে বাধা দিত। তাদের মনের মতনটি না হলে গ্রহণযোগ্য হবে না — এই ছিল পরিস্থিতি। যীশু নিজেকে “ঈশ্বরের পুত্র” বলে ঘোষণা করতেন — তাছাড়া তিনি বলতেন,_ “আমি ইহুদীদের রাজা”। যীশুর উত্তরোত্তর খ্যাতি এবং বহু মানুষের মনে তাঁর প্রভাবের খবর রাজন্যবর্গ রাখতো। তারপর ওই ‘রাজা’ — ‘ঈশ্বরের পুত্র’ এইসব শব্দ যখন উনি ব্যবহার করতে শুরু করলেন — মূর্খ রাজা (হেরড) ভাবল হয়ত যীশু একদিন রাজ-সিংহাসন দখল করবে। অতএব গুপ্তচর লাগিয়ে যীশুর সব খবর জোগাড় করতে লাগল তারা। আর একদিন সুযোগ বুঝে যীশুকে ধরা হোল এবং বিচারে তাঁর crucifixion সাজা ঘোষনা করল। যেটা অবধারিত ছিল এবং যীশু আগেই তার ভবিষ্যৎবাণী জানিয়ে রেখেছিলেন শিষ্যদের কাছে।

কিন্তু দ্যাখো — সহজ মানুষ যীশু, তাঁর দৈহিক নির্যাতনের সময় তাই_ মহাপ্রকৃতি বিক্ষুব্ধ হয়েছিল, শুরু হয়েছিল ভয়ংকর মরুঝড়। বলা হয় লক্ষ লক্ষ Angel প্রতিশোধ নেবার জন্য Ready ছিলেন। কিন্তু সৃষ্টি ধ্বংস হবে — মা মহামায়ার জগতে যে নিয়ম চলে আসছে তার ব্যতিক্রম হবে — তাই যীশু সেই সময়েই প্রার্থনা জানালেন ঈশ্বরের কাছে এবং অত্যাচারীদের ক্ষমা করার জন্য আবেদন জানালেন!তাই প্রকৃতিও ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গিয়েছিল। করুণা ও ক্ষমার অপূর্ব নিদর্শন ভগবান যীশু! আজও “crucified যীশু”_ যেন সমগ্র পৃথিবীর করুণতম Art! ভগবানের ক্ষমা ও করুণা, অন্যদিকে মানুষের স্বার্থপরতা ও নিষ্ঠুরতা — এটাই crucified যীশু।

জিজ্ঞাসা :— যীশু কি crucifixion-এ মারা যান?

গুরুমহারাজ :— বেশিরভাগ মহাপুরুষের মৃত্যু নিয়েই পৃথিবীতে বিতর্ক রয়েছে। সেই সময়কার মানুষ তো যীশুকে নিয়ে এত বেশি মাতামাতি করেনি। অনেক পরে যখন যীশুর প্রচারিত মত, সাধারণ মানুষ গ্রহণ করল_ এমনকি রাজারাও গ্রহণ করতে থাকলো, তখন যীশুকে নিয়ে research শুরু হলো — যেটা আজও চলেছে। বিভিন্ন অনুসন্ধান ও প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, যীশুর crucifixion-এর সময় যে ভয়ংকর মরুঝড় উঠেছিল, তার প্রভাবে নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য রাজার সৈন্যরা যীশুকে ক্রুশকাঠে ঝোলানো অবস্থাতেই পালাতে বাধ্য হয়েছিল। যীশুর সঙ্গে অপর দুজন সাধারণ চোরকেও crucified করা হয়। ঝড় থামলে সৈন্যরা ফিরে এসে যীশুকে আর দেখতে পায়নি। ওরা চোর দুটোকেই কফিনবন্দী করে কবর দিয়েছিল কিন্তু যীশুর জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা ফাঁকা কফিনটাকেই মাটি চাপা দিয়ে চলে যায়। কেননা পরদিন মাতা মেরী যীশুর জন্য রাখা কফিন খুলেও তার মধ্যে যীশুর মৃতদেহ পাননি।

এই সব থেকে ধারণা করা হয় যে, যীশুর শিষ্যরা ক্রুশকাঠ থেকে ওই ঝড়ের মধ্যেই যীশুর শরীরকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছিল। ৭ দিন পর যীশুর ভক্তদের কাছে দেখা দেবার রহস্য এটাই। অর্থাৎ আহত যীশু ৭ দিন পর শেষবারের মতো ভক্তদের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন। এরপর যীশুর শিষ্যরা আহত যীশুকে শুশ্রূষা করার জন্য জেরুজালেম ত্যাগ করে মরুপথে পালিয়ে আসেন অন্যদেশের অভিমুখে। সাধুদের মুখে শোনা যায় যে, ভগবান যীশুর স্থায়ী চিকিৎসা হয়েছিল তিব্বতে। সেখানে যে গৃহে যীশুর চিকিৎসা হয়েছিল সেখানে এখনো নাকি যীশুর ব্যবহৃত কিছু জিনিস সযত্নে রক্ষিত আছে। এমনও শোনা যায় এখান থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর যীশু ভারতবর্ষ পরিক্রমা করেন এবং তাঁর দেহরক্ষা হয় কাশ্মীরে। কেউ কেউ বলেন যীশুর ছোটবেলাটাও কেটেছিল হিমালয়ে, যার জন্য ‘ছোট বেলা থেকে যুবক বয়স পর্যন্ত’ যীশু কি করেছিলেন, সেটা জানা যায় না — কেননা ইতিহাস থেকেজানা যায় জেরুজালেমের লোক, হঠাৎ করে “ঈশ্বরের পুত্র” বলে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছে এমন একজন যুবকের সন্ধান পায়। ইনিই মেরীমাতার পুত্র যীশু।

  এখন কথা হচ্ছে_ এসব গবেষণা থেকে তথ্য যাই পাওয়া যাক না কেন, সত্য তো সত্যই। যীশুর জীবন, যীশুর শিক্ষা এগুলিই গ্রহণযোগ্য হোক মানুষের কাছে। দু হাজার বছর ধরে গলায় ক্রুশ ঝোলানো অনেক তো হোল, এবার নিজেদের জীবনেই "যীশুর জীবন" প্রকাশিত হয়ে উঠুক — তবেই যীশুর ন্যায় মহামানবের আগমনের সার্থকতা।

জিজ্ঞাসু :– এখনও বর্তমানে অনেক সাধুসন্ত আছেন, যাঁরা নিজেকে ভগবান বলে প্রচার করেন_ বলেন তিনিই যীশুর ন্যায় মহাপুরুষদের পাঠিয়েছিলেন। —এরা কি ঠিক বলেন ?

গুরুমহারাজ :– দ্যাখাে, যদি কেউ নিজেকে ভগবান বলে, তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই, কারণ ভগবানই তাে সব হয়েছেন। তাই সবাই ভগবান। তােমাদের তাে অনেকবারই বলেছি যে, মানুষ কি বলে সেটা বড় কথা নয়_ মানুষ কি করে সেটাই বড় কথা। ভগবান কৃষ্ণ যদি গীতা না বলতেন, তাহলে কি মানুষ তাঁকে ভগবান বলতো না? ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনটাই তাে গীতা! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন,_ গীতার অর্থ ত্যাগী। তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনটা দ্যাখাে, সমস্ত কিছুর মধ্যেই “তিনি”, অথচ কোন কিছুতেই তিনি আসক্ত নন। নিরাসক্ত হয়ে সমগ্র জীবনে কত কাজ, কত লীলা করে গেলেন! তাঁর জীবন নিয়ে কত পুরাণ-মহাভারত রচনা হয়ে গেল, কিন্তু তিনি সর্বক্ষেত্রেই যেন দ্রষ্টাস্বরূপ, সাক্ষীস্বরূপ হয়ে রয়ে গেছেন। ফলের আশা না করে যেখানে যে কাজ করা দরকার তাই তিনি করে গেছেন_ এটাই তাে কর্মযোগ বা কর্মরহস্য! সুতরাং ঐ সব নিয়ে মাথা ঘামিও না। যিনি নিজেকে ভগবান বলেন—তিনি তাঁর মতাে থাকুন, তুমি তোমার মত হও। যে আদর্শ তােমার ভাল লাগে_ সেটাকে জীবনে গ্রহণ ও অনুসরণ করে এগিয়ে চলো—চরৈবেতি-চরৈবেতি! মানবজীবন লাভ ক’রে উন্নত আদর্শকে জীবনে গ্রহণ ও অনুসরণ ক’রে এগিয়ে চলতে চলতেই একদিন অভীষ্ট লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছে যাবে ।

“হরিসে লগন্‌ লাগাতে রহরে ভাই।

তেরি বনত বনত বনি যাই” ।।

জিজ্ঞাসু :– আচ্ছা মহারাজ–যােগবিজ্ঞানে রয়েছে যে, বিনা খাদ্যে শরীর রক্ষা করা সম্ভব, তাহলে আপনি সকলকে ঐ বিদ্যাটা শিখিয়ে দিচ্ছেন না কেন–এতে তো অনেক ঝামেলা মিটে যায় !

গুরু-মহারাজ :– ঝামেলা জিনিসটা কি মেটার_ সব্য ? সব লােকের কথা এখন বাদ দাও– তােমাকেই জিজ্ঞাসা করছি, বলতো– যদি তােমাকে এমন করে দেওয়া হয়, যাতে তোমার আর খাদ্য গ্রহণের দরকার হবে না, কিন্তু তাহলেই কি তুমি অন্যান্য সমস্ত ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে পারবে ? সব্য, দেহের ক্ষুধা মিটলেও_ কি মনের ক্ষুধা মেটে? তারপরেও থাকে প্রাণের ক্ষুধা! জগতে ঝামেলা তাে পেট ভরে খেতে পাওয়া লােকগুলােই বেশী পাকায়। খালি পেটে যেমন ধর্ম হয় না, তেমনি খালি পেটে খুব বেশি খারাপ কাজও তাে হয় না–তাই নয় কি ?

   তােমাকে তাে বুদ্ধদেবের সেই গল্পটা বলেছি আগে–যাতে তিনি পূর্ণকে শিক্ষা দিচ্ছেন যে, অন্নে-বস্ত্র-বাসস্থানে-পুত্রে-ধনে—কিছুতেই দুঃখ মোচন হয় না। এক "ভূমা"ই সুখ- "ভূমা"ই আনন্দ। আর এই জানাটাই জ্ঞান, বাকী সবই অজ্ঞান। তবে সাধারণ ক্ষেত্রে এবং সার্বজনীনভাবে প্রাথমিক জীবনধারণের শর্ত নিশ্চয়ই অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান।

আচ্ছা সব্য, কি ভাবো তুমি—যােগবিজ্ঞানে যে বিনা খাদ্যে জীবন ধারণের কথা বলে—তা মিথ্যা? তুমি স্বামীজীর সাথে গাজীপুরের যােগী পওহারী বাবার সাক্ষাতের কথা পড়োনি? তিনি তাে পও-আহারী অর্থাৎ বায়ুভুক্ ছিলেন। আমার সাথে দেখা হয়েছিল–অন্ধ্রপ্রদেশের একজন যােগীর, যিনি এখনও(১৯৮৯) শরীরে আছেন ( রচনা প্রকাশিত হবার সময় তিনি আর জীবিত নেই– ২/১ বছর আগে তার মহাপ্রয়াণ ঘটেছে ) তাঁকে “বালযােগী” বলা হয়। উনি ৮/১০ বছর বয়স থেকে আজ পর্যন্ত ( প্রায় ৬৫ বছর বয়স) একই আসনে বসে আছেন। খাওয়া তাে দূরের কথা, পায়খানা-প্রস্রাবও কোনদিন করেন নি। অন্ধ্রপ্রদেশের একটা নামকরা Magazine-এ ওনার জীবনী এবং বিভিন্ন বয়সের ফটো ছেপেছিল। আমাদের আশ্রমেও পত্রিকাটির একটি কপি রয়েছে–দেখে নিও। এর থেকেই বুঝতে পারবে ঐ যােগীর বিভিন্ন বয়সে শরীরের যে normal growth তা কিন্তু খাদ্য ছাড়াই বেশ সুন্দরভাবে অব্যাহত রয়েছে। তুমি ইচ্ছা করলে ওনার সাথে দেখা করেও আসতে পারাে। তবে বর্তমানে শিবরাত্রির দিনই ওনার দর্শন পাওয়া যায়। কারণ দর্শনার্থীর এত ভিড় হয় যে, পুলিশ ও প্রশাসনকে হিমসিম খেয়ে যেতে হয় তা সামলানাের জন্য। তুমি আরও শুনলে অবাক হবে যে, সারা বছর নাকি ওনার শরীরে Heart beat বা Blood-circulation-ও থাকে না—শুধু শিবরাত্রির আগের দিন থেকে ঐ গুলি সব শুরু হয় এবং দু-একদিন ঠিকঠাক চলার পর আবার বন্ধ হয়ে যায়।

জিজ্ঞাসু :– আপনার সাথে দেখা হ’ল কিন্তু কিছু কথা হয়েছে কি ?

গুরু-মহারাজ :– স্থূল কথাবার্তা কি হবে ? বালযোগী মহারাজ সারাজীবনে(আসনে বসার পর) বার পাঁচেক মুখ খুলেছিলেন। ৮/১০ বছর বয়সে এক নারকেল বাগানে ঘাস কাটতে গিয়ে ওনার আত্মদর্শন হয় এবং সেখানেই তিনি বসে পড়েন। রাত্রিতে ছেলে বাড়ী ফিরল না দেখে মা-বাবা খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে হাজির হন এবং বাড়ী ফেরার কথা বলেন। প্রথমবার তখন বালযােগী মুখ খােলেন এবং পিতামাতাকে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করেন। এরপর ধীরে ধীরে সেখানে ভিড় জমতে থাকে। দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় দু-একটি দোকান‌ও বসে যায়। নারকেল বাগানের মালিক ভাবে বাগানটি হয়তাে পরে বেদখল হয়ে যাবে, তাই তিনি গুণ্ডা লাগিয়ে তাদের রাত্রে ছেলেটিকে মেরে বাইরে ফেলে দিয়ে আসতে বলেন। গুণ্ডারা গেলে দ্বিতীয়বার বালযােগী মুখ খােলেন এবং নারকেল বাগানের মালিকের সঙ্গে কথা বলেন। তার কথায় কি যাদু ছিল কে জানে–এর পরই ঐ মালিক বালযােগীর চারিদিকে ছাউনি তুলে একটি ঘর বানিয়ে দেন। পরবর্তী কালে অবশ্য দর্শনার্থীদের প্রণামীর টাকায় বড় মন্দির এবং এখন সব এলাহি ব্যাপার গড়ে উঠেছে। ওর ঠিক পাশেই আবার ওর এক ভাইও একই ভাবে বসে আছেন—তিনিও উন্নত যােগী। পরবর্তীকালে কিছু বিদেশী গবেষক বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে ওনার শরীরে কিছু পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালান। সেই সময় উনি একবার ধ্যানভঙ্গ করে তাদের সাথে কিছু কথা বলেছিলেন।

     এই রকম আরও ২/১ বার কথা হয়তাে তাকে বলতে হয়েছে কিন্তু বর্তমানে ঐ যোগীকে আর কোন অসুবিধায় পড়তে হয় না। এখন কমিটি হয়ে গেছে। শিবরাত্রির দিন ছাড়া ওনাকে দর্শনের অনুমতিই কাউকে দেওয়া হয় না। আমি সত্যমজীদের সাথে যেবার গিয়েছিলাম, সেবাব অন্তত ৩ লাখ লােক ছিল দর্শনার্থী। D. M , S. P, D. S P সমস্ত তাবড় তাবড় পুলিশ অফিসাররা উপস্থিত থেকে ভিড় সামলাচ্ছিল এবং দেখলাম নানারকম সরকারী ব্যবস্থা করা হয়েছে দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য।

যাইহােক সব্য, তুমি একবার যেতে পারো সেখানে! বিনা খাদ্যে যে জীবনধারণ করা যায়, সেটা অন্ততঃ নিজের চোখে দেখে আসতে পারবে।