স্থান ~ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন । সময় ~ ১৯৯০ সাল । উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ সব্যসাচী মান্না ,রন্জন,নগেন, আশ্রমস্থ কতিপয় সন্ন্যাসী ও ভক্তজন ৷

জনৈক যুবক :– বর্তমানে যে যুগ চলছে, তাতে আমরা কিভাবে চলব?

গুরুমহারাজ :– সোজা পথে চলবি ! সত্যকে আশ্রয় করে – সহজতাকে অবলম্বন করে এবং বিবেকযুক্ত বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে কাজ করবি, তাহলেই দেখবি তোর দ্বারা কোন অন্যায় কাজ হবেনা। আমিও তো এটাই করে থাকি। এই আশ্রম প্রতিষ্ঠার সময় কত বাধা এসেছে, যারা প্রথম থেকে দেখেছে_ তারা অনেকটা জানে। মনে হচ্ছিল আশ্রম করা বোধহয় আর হয়েই উঠবে নাএতো বাঁধা, কিন্তু এখন দ্যাখো সবকিছুই তো ঠিকঠাক ভাবেই চলেছে। এখন এসব দেখে আর কি কেউ বুঝতে পারবে যে আশ্রম একদিন কত বাধার সম্মুখীন হয়েছিল! এই ভাবেই কার্যসিদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা ঠিক নয়। জীবনে চলার পথে বাধা আসবেই, প্রথমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তা মেটানোর চেষ্টা করতে হবে, না-হলে fight করবি। ভালো কাজের জন্য fight করে মরে যাওয়াও ভালো। কিই বা হল জীবনে? খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, বংশবৃদ্ধি – এরপর একদিন মরে যাওয়া। এইভাবে চরম স্বার্থপরতার জীবন না কাটিয়ে পরহিতে জীবনপাত করা অনেক গুণে ভাল। এতে পরবর্তী জন্ম ভাল হয়, কারণ মৃত্যুকালীন ভাবনাই তো পরের জন্মে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।

     পূর্বে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণের সময়ে এবং বিভিন্ন কর্মের মধ্যে আমাকে জীবনের ঝুঁকি (Risk) নিয়ে এমন অনেক অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিকার করতে হয়েছে যে, সে সব কথা বললে এখন গল্পকথা মনে হবে। যাক্ সেসব কথা, তোকে মা বলছিলাম সেখানে ফিরে আসি, কোথাও কোন আন্যায় ঘটতে দেখলে সাধ্যমত তার প্রতিবাদ করবি। তোকে দেখেই তো আর পাঁচজন শিখবে! প্রতিকার করতে না পারিস তো প্রতিবাদ করবি বৈকি! আর এটা নতুন কিছু নয়, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই এটা, কিন্তু ভয়ে বা দুর্বলতায় মানুষ এটাকে কার্যকরী করতে পারে না - এই যা। তবে এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, নিজে কোন অন্যায় না করে অপরের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয় - অন্যথায় কার্যসিদ্ধি ঘটে না।।

জিজ্ঞাসু :– মহাপুরুষগণ যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তাঁরা নানাবিধ জ্ঞান বা শিক্ষা না দিয়ে তো জীবকে সরাসরি মোক্ষদান করতে পারেন, এটা করেন না কেন? আর স্বামী বিবেকানন্দ এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মতো অবতারাদি যখন শরীরগ্রহন করা সত্ত্বেও ভারতবর্ষ পরাধীন ছিল এবং ভারতীয়রা ইংরেজদের বুটের লাথি খাচ্ছিল ! আবার দেখা যাচ্ছে_এইসব মহাপুরুষদের শরীর চলে যাবার পরও ভারতের স্বাধীন হতে ৫০/৬০ বছর লেগে গেল – এটাই বা হোল কেন?

গুরুমহারাজ :– তোমার দুরকম জিজ্ঞাসারই উত্তর একইরকম হবে, মন দিয়ে শোন এবং বোঝার চেষ্টা করো।

ঈশ্বরই সবচেয়ে সহজ, তাই বলা হয় “সহজ”-ই ঈশ্বর। এই জগতসংসারের সব কিছুই ঈশ্বরেরই প্রকাশ, তবে সাধারণতঃ মহাপুরুষের মধ্যেই ঈশ্বরের মহিমা অধিক প্রকাশ হয়ে থাকে। কিন্তু মহাপুরুষগণ “সহজতা”-র মধ্য দিয়েই জীবসকলকে এগিয়ে চলার জন্য সাহায্য করে থাকেন – কোন কৃত্তিমতার মধ্য দিয়ে নয়! আর দ্যাখো, জ্ঞানী-ব্যক্তি বা মহাপুরুষ যাঁদের কথা তুমি বলছ, তাঁদের দৃষ্টিতে জগৎ কেমন – তা তোমার দৃষ্টি দিয়ে কি করে বিচার করবে? জ্ঞানীর কাছে আবার “তোমার-আমার”এই ব্যাপারটা আছে নাকি? সমগ্র বিশ্ববাসীর প্রতি তাঁদের সাদর আহ্বান ‘শৃণ্বন্ত্ু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’। গোটা বিশ্বটাই তাঁদের আপনার – এই বোধ হয়েছে বলেইতো তাঁরা জ্ঞানী। তাঁরা এই জন্যই তো বলেছেন_”বসুধৈব কুটুম্বকম্”! এই জ্ঞান-দৃষ্টিতে ইংরেজ-বাঙালীর মধ্যে তো কোন পার্থক্য নেই। সারদা-মা বেঁচে থাকাকালীন কোথায় ঝামেলা হয়ে কয়েকজন ইংরেজ মারা গিয়েছিল, মা তা শুনে কেঁদেছিলেন এবং বলেন – “আহা! তারাও তো আমারি….!”।

“বিশ্বজগৎ আমারে মাগিলে কে মোর আত্মপর” – এই ধরণের কবিতায় উপনিষদের ভাবই কবি রবীন্দ্রনাথও ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তাঁদের এই ভাবগুলো তো বুঝতে হবে! শুধু তোমার নিজের ভাব দিয়ে তাঁদের বিচার করতে যাওয়া ঠিক নয়।

তাছাড়া, জীবজগতে এগিয়ে চলার যে সাধারণ নিয়ম – যাকে তোমরা evolution theory বলছো, সেটা তো সহজভাবেই নিজের নিয়মে চলছে। জড়জগৎ এবং জীবজগৎ, উভয়েরই যে গতি_ভারতীয় শাশ্ত্রাদি তাকে “ঈশ্বরের লীলাবিলাস” বলে বর্ণনা করেছে। আর এর মধ্যেই জীবের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না থেকে যাচ্ছে, কিন্তু এগুলি কি ঈশ্বরের গোচরের বাইরে? কর্মবিপাক-জনিত যার যা পাওনা – এর মধ্যে থেকেই সে তা পেয়ে যাচ্ছে – এর জন্য অন্যকে দোষারোপ করছ কেন? ভারতবর্ষের যে প্রায় হাজার বছরের পরাধীনতা, তার জন্য ভারতবর্ষের রাজনীতি দায়ী ছিল। রাজতন্ত্র এবং পুরোহিতন্ত্রের আঁতাতের ফলে এখানকার সাধারণ মানুষের অসহনীয় কষ্ট ছিল। ইতিহাস পড়ো, সব জানতে পারবে। ‘সাতখুন মাপ’ – কথাটা জানতো? জমিদাররা সাতটা খুন করতে পারত, তার জন্য কোন বিচার হোত না। তাহলে ভাবো রাজারা অথবা মহারাজারা কত খুন করতো! আর ছোট-বড় রাজ্যে এইরূপ কত রাজা ছিল এই ভারতবর্ষে! সাধারণতঃ নিজেদের শখ মেটাতে পরস্পরের মধ্যে তারা ঝগড়া-বিবাদ বা যুদ্ধ লাগিয়েই রাখতো, আর প্রাণ যেত সাধারণ মানুষের। তাছাড়া যুদ্ধ মানেই তো বুঝতে পারছো – শুধু প্রাণই নয়, ধনে-প্রাণে মরতো নাগরিকরা। ইংরেজ শাসনের সময় যখন জমিদারদের বা অত্যাচারী জমিদার পুত্রদের ধরে লালমুখো সাহেবরা চাবুক মারতো, তখন সাধারণ মানুষের কি আনন্দ! জানো এসব ইতিহাস? সাধারণ জনগণ তো সার্বিকভাবে কখনোই বিদেশীদের বিরোধ করেনি বরং welcome জানিয়েছে! তবেই না বিদেশীরা হাজার বছর থেকেছে ভারতবর্ষে। আবার দ্যাখো, যখন বিদেশীদের শাসন এবং শোষণে অতিষ্ট হয়ে আপামর জনসাধারণ ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল, তখন তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ সংগ্রামে নামল। আর তার কয়েক বছর পরই ভারতবর্ষ স্বাধীন হল। এইভাবে কোন ঘটনাকে বিশ্লেষণ করবে – তাহলেই উত্তর পাবে – বুঝেছো!

যাইহোক যা বলছিলাম, জগৎসংসারে জীব-জগৎ Evolution theory অনুযায়ী এগিয়ে চলেছে। এমনকি সতত পরিবর্তনশীল জড়জগৎও নির্দিষ্ট সহজ নিয়মেই তার পরিণামের দিকে চলেছে ! কিন্তু জগতের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ_ পমহাপ্রকৃতির সেই অমোঘ নিয়মকে লঙ্ঘন করে “অসহজ” হয়ে পড়ে এবং কষ্ট পায়। আবার কোন কোন উন্নত মানুষ_ সেই নিয়মকে অতিক্রম করে এবং সহজতাকে আশ্রয় করে Evolution কে Revolution এ পরিবর্তন করে নেয়। এইজন্যই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সহজ ভাষায় বলেছিলেন_”তোমরা যদি তাঁর দিকে এক পা এগোও, তিনি তোমার দিকে দশ পা এগিয়ে আসবেন”,অর্থাৎ অসহজ জীবনযাত্রা থেকে যদি সহজ জীবনযাত্রায় আসতে পারা যায় – তাহলে জীবনের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়ে যাবে। ‘এই জনমে ঘটালে কত জন্ম-জন্মান্তর’ – এটা সম্ভব নিশ্চয়ই হতে পারে।

ঈশ্বর সবই পারেন। মায়ের জগৎ, মা কি পারেন না_ ‘হয়’কে ‘নয়’ করতে? নিশ্চয়ই পারেন কিন্তু কেন করবেন তিনি? আর অন্য কেউ চাইলেই বা কেন করতে দেবেন তিনি? বিশ্রামিত্র চেয়েছিলেন আর একটা Parallel জগৎ সৃষ্টি করতে কিন্তু সম্ভব হয়েছিল কি? মানুষ তো কত কিছুই ভাবে – বাস্তবে তা রূপায়িত করতে পারে কি?_ পারে না – কারণ মানুষ ভুলে যায় যে √রীমায়ের ইচ্ছাতেই সব হয়। আর যে একথা জেনে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কাজ করে – তার কাজ ষোলআনাই সিদ্ধ হয়, সে-ই সফল হয়_ এটাই আধ্যাত্মিক জগতের রহস্য! এই যে তোমার মনে হল, মহাপুরুষরা ইচ্ছা করলেই তো মানুষকে মোক্ষলাভ করাতেও পারেন। হ্যাঁ, তা পারেনই তো, দু’একটা এমন উদাহরণও রয়েছে! কিন্তু Mass- কে কখনোই করবেন না, কেন করবেন নাতার কারণ √রীমায়ের এই লীলা জগতে যে লীলা চলেছে তা ভেঙে যাবে। এই লীলা বা খেলা যখন ভাঙার দরকার হবে তখন ‘মা’ নিজেই তা ভেঙে দেন। এভাবেই চলে জগৎসংসার। কত মনুর রাজত্বকাল শেষ হল, এখনও কত মনু আসবে -জগজ্জননী মা’ই তা জানেন। তাই বলা হয় ‘কাল জানেন কালী’। বাবা, ক্ষুদ্র বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এসব রহস্য মাথায় ঢোকানো বড় মুশকিল। আচ্ছা-আচ্ছা সর্বত্যাগী সাধকও মায়ের রহস্য বুঝতে গিয়ে খ্যাপা-পাগল হয়ে গেছে – তা সংসারী স্বার্থবুদ্ধিসর্বস্ব মানুষ কি করে এসব বুঝবে বল?

তবে একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করছিশোনো! ধরো, তোমার লন্ডন শহর দেখার খুব ইচ্ছা। তার জন্য তুমি প্রাণপণ খেটে পয়সা রোজগার করছো লন্ডণ যাবার জন্য, কারণ সেখানে কিছুদিন থাকার খরচা তো অনেকতাই অনেকদিন ধরে প্রচেষ্টার পর ধরে নাও তোমার টাকার জোগাড় হল !এবার পাশপোর্ট, ভিসা ইত্যাদি জোগাড় করার জন্য এ অফিস, সে অফিস ঘোরাঘুরি করে নানা ঝামেলা পুইয়ে অবশেষে একদিন সব কাগজ যোগাড় করে লণ্ডন যাবার জন্য প্লেনের টিকিট কেটে ফেললে এবং যথাসময়ে তোমার জন্য নির্দিষ্ট flight এ গিয়ে গদি-চেয়ারে আরাম করে বসলে! বন্ধু-বান্ধবের দল বিমান বন্দরে see off করতে এল, তখন তোমার কি আনন্দ! তারপর হাওয়ায় যখন প্লেন উড়ল, তখন তোমার আনন্দের সীমা নেই, মনে হচ্ছে তুমি কত উঁচু আর নিচের সবকিছু যেন কত নিচু, তাই না? এরপর লণ্ডন শহরে নেমে সেখানকার সবকিছু দেখে তোমার কতদিনের স্বপ্ন, কতদিনের প্রচেষ্টার ফল সার্থকরূপ পেল, হৃদয় ভরে গেল আনন্দে!

আবার দ্যাখো অন্য একজনকে অজ্ঞান করে ধরে-বেঁধে ঐ একই প্লেনে লণ্ডনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হোল। তার পূর্ব-প্রস্তুতি নেই, অর্থ-সামর্থ্য নেই, প্রচেষ্টাও ছিল না – কিন্তু লণ্ডনে সে পৌঁছে গেছে! এবার তার কি অবস্থা হবে বলোতো! সেখানকার ভাষা সে জানেনা – কোথায় এসেছে জানেনা, এরপর কোথায় কি করবে তাও জানেনা – তার তখন নিদারুণ করুণ অবস্থা! হাত-পা নেড়ে ব্যাকুল হয়ে সে তখন শুধু একটা চেষ্টাই করবে, কি করে তার দেশে ফেরা যায় অর্থাৎ তার পূর্বের অবস্থায় ফেরা যায় – তাই না?

গল্পের মাধ্যমে বলা উদাহরণের তাৎপর্যটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো। জীবের উদ্দেশ্যই তো আনন্দলাভ।আনন্দ থেকেই তার উৎপত্তি, আনন্দেই তার স্থিতি এবং আনন্দেই তার লয়। জীবের চরম উৎকর্ষলাভ হল অথচ তার পরিণতি হবে অত্যন্ত দুঃখজনক, এটা হয় নাকি? প্রচেষ্টার দ্বারা অভিজ্ঞতার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে মানুষ একদিন পৌঁছবে চরম লক্ষ্যে, যেখানে শুধুই আনন্দ আর আনন্দ!এটাই মায়ের ইচ্ছা, আর এই কাজেই সাহায্য করেন মহাপুরুষেরা! বুঝতে পারছো, তোমার মাথায় একটা কিছুর উদয় হোল_ অমনি ভাবতে শুরু করলে, মহাপুরুষরা কি মূর্খ আর তুমি কি জ্ঞানী – এটা ঠিক নয়। দ্যাখো, স্বামী বিবেকানন্দের কথা মনে রেখো – “চালাকির দ্বারা কোন মহৎ কাজ হয় না”। তাই অলসতা ত্যাগ করে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলো – প্রচেষ্টার দ্বারা পরম ও চরম প্রাপ্তিলাভ কর আর মা জগদম্বার কাছে প্রার্থনা করো :

‘দেবি প্রপন্নার্তিহরে প্রসীদ

প্রসীদ মাতর্জগতোহখিলস্য।

প্রসীদ বিশ্বেশ্বরি পাহি বিশ্বং

ত্বমীশ্বরী দেবী চরাচরস্য’।

কৃপা হবে বৈকি? কত জনের উপর মায়ের কৃপা হোল, আর তোমার হবে না? ঠিকই হবে। সহজ হও, সৎ হও – সুন্দর হও, নিষ্কপট হও – তাহলেই মা প্রসন্ন হবেন।।