জিজ্ঞাসু :— গুরু পরম্পরায় আধ্যাত্মিক শক্তি বাহিত হয় — এরূপ শোনা যায়, তাহলে অনেক শিষ্যদের মধ্যে থেকে গুরু সুযোগ্য উত্তরসূরিকে নির্বাচন করেন কিভাবে?
গুরুমহারাজ :— ফুল যখন ফোটে_ তখন ফুলকে কি বলতে হয়,_ ‘দ্যাখো আমি ফুটেছি’ অথবা সূর্য উদীয়মান হলে কি হারিকেন জ্বেলে তাকে দেখতে হয় ? তেমনি লোকোত্তর গুরু-পরম্পরার যিনি গুরু, তাঁর মধ্যে ভগবত্তার স্বতঃপ্রকাশ হয় ! আর পুস্পের সৌগন্ধে আকৃষ্ট মধুলোভী মৌমাছির ন্যায়_ ভক্তকুল জড়ো হয়ে যায় তাঁর চারিদিকে, শুরু হয়ে যায় কর্মযজ্ঞ! আর সেই কাজে অর্থাৎ বহুজনের হিত ও সুখকর কর্মে তাঁদের অনেকেই আত্মনিয়োগ করেন — আত্মনিবেদনও করেন কেউ কেউ। সদগুরু শিষ্যের পূর্ব পূর্ব কয়েক জন্ম দেখে নিতে পারেন আর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি কে হবেন তা জানতে পারেন না? প্রথমদিন আসার পরই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন সম্বন্ধে এমন সব কথা বলতে শুরু করেছিলেন যে, তাঁকে সঠিকভাবে চিনতে না পারলে কোন মতেই সে সব বলা সম্ভব ছিল না। সেইসময় অনেকেই তো ওই সব কথাবার্তাকে পক্ষপাতিত্বমূলক বা পাগলের প্রলাপও বলতো। কেননা তৎকালীন সমাজে মাস্টারমশাই কেশব সেন, বিজয় গোস্বামী, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রমূখ সব বিদগ্ধ পন্ডিত লোকেদের — যাঁরা সব ঠাকুরের সকাশে আসতেন,_ তাঁদের কি প্রভাব প্রতিপত্তি! কিন্তু ঠাকুরসদ্য সদ্য আসতে থাকা B.A. পাঠরত একটি যুবক সম্বন্ধে যা সব মন্তব্য করতেন, তা শুনতে অনেকেরই ভাল না লাগাই তো স্বাভাবিক! কিন্তু সত্য তো সত্যই — কালে ঠাকুরের মন্তব্যগুলিই সঠিক হয়েছিল। জগত পেল এ যুগের একজন শ্রেষ্ঠ মহামানবকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের উত্তরসূরি রূপে। নরেন্দ্রনাথকে মেনে নিতে তেমন কোন বিরোধ তো হয়নি রামকৃষ্ণ সংঘে। ছোটখাটো মনোমালিন্য যা ছিল, তা স্বামীজীর অসাধারণ ব্যক্তিত্বে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিল। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে গুরুকে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হয়,যাতে অন্য শিষ্যরাও যোগ্য উত্তরসূরিকে মেনে নেন, যেমনটা করেছিলেন গুরু নানক! ঘটনাটা বলছি শোনো।
গুরু নানক তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অঙ্গদকে একটু অধিক স্নেহ করতেনএই নিয়ে অন্যদের মনে কিছুটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। সেইটা গুরু নানক কিভাবে দূর করেছিলেনসেই কাহিনীটাই বলছি। একবার নানকজী তাঁর শিষ্যদের নিয়ে নদীর ধার ধরে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। গুরু আগে হাঁটছেন, শিষ্যরা পিছনে। গুরু ক্লান্তিহীন ভাবে হাঁটছেন তো হাঁটছেনই — শিষ্যরা যেন পারছেন না। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, ক্লান্তিতে তাঁরা অবসন্ন হয়ে পড়েছেন। দিনের শেষে অপারগ হয়ে শিষ্যেরা গুরু নানককে বললেন তাঁদের অসামর্থ্যের কথা — ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথাও। গুরু নানক শুনে যেন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং তাড়াতাড়ি নদীর ধারে একটি গাছের তলায় সকলকেই বিশ্রাম নিতে বললেন। বিশ্রামের ব্যবস্থা তো হলো কিন্তু আহার্য কোথায়? সবাই গুরুর মুখের দিকে তাকিয়ে, গুরু কিন্তু উদাসীন। হঠাৎ দেখা গেল নদীর স্রোতে একটি কুকুরের গলিত মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। গুরু নানক বলে উঠলেন “ওই মৃত পশুটিকে নিয়ে এসো আর ওটাই আমাদের আজকের আহার্য হবে।” দূর থেকেই যে জিনিসটার দুর্গন্ধ উঠছিল — তাকে আনাই তো দুর্বিষহ, তাতে আবার কুকুরের পচে যাওয়া মৃতদেহ! কিন্তু কি আর করা যায়, গুরু আজ্ঞায় ওটাকেই খেতে হবে! কিন্তু যাহোক করে ঐ খাদ্যকে এড়িয়ে যাবার মানসিকতায়_ কেউই আর অগ্রসর হোতে চাইছিল না। গুরু নানক সকল শিষ্যের দিকেই দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন_ আর একে একে সবাই মস্তক অবনত করতে থাকল। শেষকালে গুরুদেব অঙ্গদের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই অঙ্গদ বিনা দ্বিধায় উঠে পড়লেন। গুরুদেবের চরণ বন্দনা করে অনায়াসে নদীতে নেমে সেই পূতি-গন্ধময় পশুর মৃতদেহটি তুলে আনলেন গুরুর নিকট। দুর্গন্ধে বাকি শিষ্যরা তো নাকে কাপড় দিয়ে সরেই গেলেন খানিকটা। গুরুদেব অঙ্গদকে আদেশ করলেন — “আহার্য সমানভাবে ভাগ করো”। অঙ্গদ আদেশ মাত্রই কৃপাণ বের করে “ওয়া গুরুজিকে ফতে” বলেই মারলেন কোপ। কোপ মারার সাথে সাথেই কোথায় দুর্গন্ধ? দেখা গেল একটি সুন্দর পাত্রে রক্ষিত আছে সুগন্ধী গরম ‘সুরুয়া’ (এক ধরনের সুজির মত পায়েস যা পাঞ্জাবি লোকেরা খেতে খুব ভালোবাসে)! নানকবাকি শিষ্যদের খাদ্যে অংশগ্রহণে আহ্বান জানালেন। লজ্জিত বাকি ভক্তরা বুঝলেন যে, গুরুজী কেন অঙ্গদকে বেশি ভালোবাসেন। তাঁর তুলনায় তাঁদের গুরুভক্তি বা যোগ্যতা সত্যিই নগণ্য। এই ভাবেই পরবর্তী গুরু হিসাবে অঙ্গদকে মেনে নিতে বাকিদের কোন অসুবিধা হলো না!
গুরু নানকের এই কাহিনীটি শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারলে — ঈশ্বর যে 'আধার'-কে কেন্দ্র করে কাজ করাবেন, তাঁর বিশেষত্ব স্বতঃ প্রকাশিত হয়, মুখে সবসময় তা বলে দিতেও হয় না — আপনা-আপনিই নির্ধারিত হয়ে যায়।
জিজ্ঞাসু :– শিখদের দশম গুরু ছিলেন গোবিন্দ সিং, এরপর তো আর কোনো গুরু আসেননি ?
গুরুমহারাজ :– না, তবে নেতা অনেকেই হয়েছিলেন। যাইহােক, গুরু গােবিন্দ সিংও “প্লাস ওয়ার্ল্ডে”-র লােক ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ৯ বছর বয়সে গুরু গােবিন্দ সিং “গুরু”-র আসনে বসেন। অভিষেক হয়ে যাবার পর সিংহাসনে বসেই নয় বছরের বালক গােবিন্দ সিং ধীরে ধীরে কোষ থেকে তাঁর তরবারিটি বের করলেন এবং সেটিকে উপরে তুলে ধরে সামনে উপবিষ্ট রাজন্যবর্গ ও সভাসদদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “আমার তরবারি তৃষ্ণার্ত,– এর রক্তপানে পিপাসা মিটবে, তােমাদের মধ্যে শির দিতে কে প্রস্তুত আছো ?– আমার কাছে উঠে এসাে।” গুরু গােবিন্দ সিং এর কথা শেষ হতে না হতেই এক বৃদ্ধ যােদ্ধা উঠে বললেন “আমি প্রস্তুত”। গােবিন্দ সিং তাকে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই রক্তাক্ত তরবারির রক্ত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন। এসে বললেন “আমার তরবারি এখনও অতৃপ্ত, তােমাদের মধ্যে আর কে আছে শির দার? এক্ষুনি উঠে এসো।” সঙ্গে সঙ্গে আর একজন উঠে গেল । তাকেও পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পর রক্তাক্ত তরবারি হাতে বেরিয়ে এলেন বালক গােবিন্দ সিং। এইরূপে বালক “গুরুজী”-র আহ্বান মাত্রই এক এক করে শিখ বীরেরা “যে বােলে সো নিহাল, সতশ্রী অকাল”–ধ্বনি তুলতে তুলতে পাশের ঘরে চলে গেল শির দান করতে। পরপর ৫ জনের এইরূপ হয়ে যাবার পরও যখন গুরু গােবিন্দ সিং দেখলেন, আরো অনেকেই শিরদানের জন্য প্রস্তুত রয়েছে তখন তিনি বললেন, “ঠিক আছে! বুঝতে পেরেছি যে, শিখেরা গুরুর আজ্ঞায় প্রাণ দিতে প্রস্তুত। অতএব তােমরা গুরুসেবা তথা দেশসেবার যােগ্য”। এই বলে তিনি হাততালি দিলেন এবং পাগড়ি পরিহিত পাঁচ জন বীরই পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আসল ব্যাপারটা ছিল, গােবিন্দ সিং প্রত্যেকবারই এক এক জনকে ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটা করে ছাগল বলিদান দিয়েছিলেন– মানুষ নয় । এইভাবেই দেশের প্রতি এবং নেতার প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষা নিয়েছিলেন নয় বছর বয়স্ক বালক গােবিন্দ সিং। আর ঐ পাঁচ জন শিখ বীরকে বলেছিলেন ‘পঞ্চ পেয়ারা’ (সর্দার)_ ‘যো শিরদার ও সর্দার!’
এই ঘটনাটা থেকেই প্রমাণিত হয়েছিল যে, গুরু গোবিন্দ সিং ছিলেন ঈশ্বরকোটির লােক! নাহলে ঐ বয়সে এই ধরণের পরীক্ষা নেবার ক্ষমতা_ কখনোই কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না !
জিজ্ঞাসু:– নারীকে ‘অবলা’ বলা হয়েছে, তার মানে নারীর দেহের বল কম! এইজন্যেই সমাজে নারী নির্যাতনও খুবই হয়! তবুও আজকাল দেখা যাচ্ছে অনেক নারী বিদ্যায়-বুদ্ধিতে-জ্ঞানে অনেকক্ষেত্রে পুরুষদের থেকেও কম্পিটিশনে অনেকটাই এগিয়ে গেছে_ তা সত্বেও সমাজে নারীকে ছােট করে দেখার বা দেখানোর কারণ কি ?
গুরুমহারাজ :–নারীকে “ছােট” করে দেখতে গিয়েই তাে যত গণ্ডগােল পাকিয়েছে সমাজ। পাখী যেমন দুটো ডানার সাহায্যেই সাবলীল–সহজ ও স্বচ্ছন্দে উড়তে পারে, তেমনি সমাজের অগ্রগতিরও দুটো মৌলিক অবলম্বন—নারী এবং পুরুষ ! কেউ ছােট-বড় নয়, ফলে যে দেশের মানবসমাজে নারীকে যত অবহেলা করা হয়েছে, দুর্বল ভাবা হয়েছে_ সেই সমাজেরই তত অধঃপতন হয়েছে—এটা ঘটনা। ইতিহাসেও এর ভূরি ভূরি নিদর্শন পাবে ।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস দেখ – নারীকে কখনই অসম্মান বা অবহেলা করা হয়নি তো! বাক্, অপালা, ঘোষা, বিশ্ববারা প্রভৃতি নারীরা তাে বেদের বিভিন্ন সূক্তের প্রণেতা। ঋষিদের সাথে একাসনে বসানাে হয়েছে–নারীজাতির সন্মান প্রদর্শনের কি অপূর্ব নিদর্শন রয়েছে সেখানে! পৌরাণিক যুগেও অনেক তেজস্বী নারীর চরিত্র পাবে, যাঁরা বিভিন্ন প্রয়ােজনে নিজেদেরকে বিভিন্ন ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ৷ অন্য ভাবে বিচার করলে দেখতে পাবে, সীতা বা দ্রোপদীর ন্যায় মহীয়সী নারীদের লাঞ্ছনা বা অপমান করার জন্য লাঞ্ছনাকারীদের কি ভয়াবহ পরিণতি হােল ! এইসব থেকেও ভবিষ্যৎ মানব-সমাজ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলো না। নারীজাতিকে “মাতৃ”-জাতি বলা হয়, এবার ভাবো, এই মাতৃজাতির অসন্মান করলে কি করে সমাজের উন্নতি হবে ? কোন সংসারের “মা” যেমন সংসারের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল সাধন করে থাকেনতেমনি সমাজের ক্ষেত্রেও মাতৃজাতির একই ভূমিকা পালন করতে দেওয়া উচিত ছিল সমাজপতিদের, কিন্তু তার হয়নি ! কোন সংসারে মা যদি সন্তানদের শিক্ষা দিতে পারেন, তাহলে সেই সন্তান শিক্ষিত হবেই এবং মায়ের দেওয়া শিক্ষা সন্তানের কাছে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযােগ্য ও আদর্শ হয়ে উঠবে। জাপানের মায়েরা সন্তানদের Mathematics শিক্ষা দেয়, ফলে একাডেমিক বা টেকনিক্যাল যে কোন শিক্ষাজগতে জাপানীদের অংক কোন সমস্যাই হয়না, অন্যদিকে ভারতীয় সমাজের দিকে চেয়ে দেখো কি অবস্থা ! কোন সন্তান সু-সন্তান হয়ে ওঠে তখনই, যখন “মায়ের মমতা” এবং “পিতার স্নেহ” ঐ সন্তানের উপর বর্ষিত হয়! কিন্তু ভারতীয় সমাজে মায়েরা অশিক্ষায়, দারিদ্র্যে ও সংস্কৃতি শিক্ষার অভাবে জরাজীর্ণ, তাই তারা কি করে সন্তানকে সুশিক্ষিত করবে বল ?
যাইহােক দ্যাখো, প্রকৃতপক্ষে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন ভেদ নেই _শুধু বায়ােলজিক্যাল বৈচিত্র্য রয়েছে। যদি জন্মান্তর মানো, তবে নারী যে চিরকাল নারী শরীরেই থাকে তা নয়। সেই জন্যই দেখবে কোন মহাপুরুষ কখনও নারী-পুরুষের ভেদ দেখেননি, কিন্তু সমাজ সবসময়েই ভেদ দেখেছে। প্রাচীন ভারতে আর্য ঋষিদের শিক্ষা যতদিন সমাজ মেনে চলেছে ততদিন এই সমস্যা ছিল না। কিন্তু বিদেশীদের আক্রমণে ভারতের শিক্ষা, সংস্কৃতি এমনকি মানুষের মান-সম্মান যখন চলে যেতে বসল, তখন চরম লাঞ্ছিত হল সমাজের নারীরাও। ফলে নতুন পরিস্থিতিতে নতুনভাবে সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে নিতে হােল, নারীকে পরদানশিন করতে বাধ্য হল ভারতীয় সমাজ। কিন্তু আজকের ভারতে তাে সেই পরিস্থিতি নেই_ তাই আবার খােলস ছেড়ে বেরিয়ে আসুক আজকের নারীরা—শীর্ষস্থান গ্রহণ করুক সমাজের বিভিন্ন শাখায়, আর তাকে স্বাগত করুক পুরুষ সমাজ_ এটাই তাে কাম্য হওয়া উচিত, তাই নয় কি ? কিন্তু আজও পুরুষ শাসন করতে চাইছে নারীকে ৷ কিন্তু এখন আর বিদেশীরা নয়, স্বদেশীরাই বিদেশী মানসিকতায় আক্রান্ত হয়ে রয়েছে অথবা বহুদিনের চলে আসা সিষ্টেমকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে। এটা কিন্তু নির্বুদ্ধিতা, আর এটাও জানবে নারীদেরকে এইভাবে আটকে বা ধরে রাখতে পারবেও না। কারণ জীবন, জগৎ সবই গতিশীল । এগিয়ে চলাই জীবনের, সমাজের, পৃথিবীর বেঁচে থাকার লক্ষণ। নারীকে অবলা বলে ঘরে বেঁধে রাখার চেষ্টা তো সমাজকে মেরে ফেলা, সেটা কখনই সম্ভব নয়।
তবে হ্যাঁ, নারী জন্মদাত্রী ! সৃষ্টিকে এগিয়ে নিয়ে যায় বা সৃষ্টির ধারাকে অব্যাহত রাখে নারী। তাই নারীর গর্ভধারণ। আর এই গর্ভধারণের সময়ই নারী “অবলা”। এই সময় পরিবারের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে, রাষ্ট্রেরস্বার্থে, সমাজের সকলের উচিত গর্ভকালীন নারীকে যত্ন করা, পরিচর্যা করা, সুসন্তান প্রসবে মা-কে সম্পূর্ণ ভাবে সাহায্য করা। এটা না করে যে সমাজে গর্ভবতী মায়েদের উপর অত্যাচার হয় অথবা তাকে অভাব-অনটন সহ্য করতে হয়, বলােতাে সেই সমাজ সুসন্তান আশা করেই বা কি করে, আর সেই সমাজের উন্নতির আশাই বা করে কি করে? তাই ‘হচ্ছে না-হচ্ছে না’ করে শুধু চেঁচালে হবে না, চিন্তার গভীরে প্রবেশ করতে হবে, তবেই সমাজের বিভিন্ন সমস্যার প্রকৃত সমাধান কি করে হবে _তা নিজেরাই জানতে পারবে।
যাইহােক যা বলছিলাম, নারীকে শক্তি বলা হয়েছে, তাই গর্ভকালীন সময় ছাড়া নারী "অবলা" হয় কি করে ! সংসারে নারীকে অসম্মান বা অবহেলা করে দ্যাখােতাে_ সেই সংসারের কি হাল হয়! চরম দুরবস্থা হবে, থাকতে খেতে পাবেনা সেই সংসার। সংসারে অভাবের ও অশান্তির এটা একটা অন্যতম কারণটা তোমাদেরকে আজ বলে দিলাম! পৌরাণিক কাহিনীতে রয়েছে যে, যখনই দোর্দণ্ড প্রতাপ অসুরের আবির্ভাব হয়েছে, দেবতারা তাকে সামাল দিতে অসমর্থ হয়েছে, তখনই অবস্থার সামাল দিয়েছে দেবী শক্তি। অসুর-নিধন একমাত্র নারী-শক্তিই করতে পারে। আর তাকে "অবলা" বলছো? কথা হচ্ছে_ পুরুষও নারীর শত্রু নয়, নারীও নারীর শত্রু নয়, কেউই কারও প্রতিবন্ধকও নয়। নিজের আত্মশক্তি জাগ্রত করেই কোন ইণ্ডিভিজুয়্যালকে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়। তবে পুরুষের সমানাধিকার ইত্যাদি যে সব আন্দোলন চলছে_ এসবও ঠিক নয়। কারণ পুরুষ ও নারী প্রাকৃতিক ভাবেই নির্দিষ্ট। পুরুষ পুরুষের মতো, নারী নারীর মতো_ কেউ কারও মতো নয়। বলতে পারাে নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক! কোন কিছু লাভ করার ভাবনাটাই যদি সঠিক না হয় _তাহলে ফল-প্রাপ্তিতেও গণ্ডগােল হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই ভাবনার পিছনে থাকা উচিত কোন উন্নত আদর্শের অনুপ্রেরণা বা শিক্ষা, নাহলে গণ্ডগােল তো হবেই! সমাজে পুরুষের আদর্শ হােক শিব_ সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েও যিনি শান্ত, সমাহিত মহেশ্বর। আর নারীর আদর্শ হােক উমা। রাজনন্দিনী, সমস্ত শক্তির মূলভূতা হয়েও যিনি স্বামীর অনুগামিনী । সংসারে তোমরাও উমা-মহেশ্বর হয়ে ওঠো । কে ছোট- কে বড় এই নিয়ে কোনো সমস্যাও দেখা যাবে না, বরং সুন্দর পরিবার, সেই সমাজের আদর্শ হয়ে উঠবে । এক-একটা এই ধরনের ইউনিটকে দেখে সমাজের অন্যান্য পরিবারগুলিও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে । আর এইভাবেই সুন্দর সমাজ গড়ে উঠতে পারে, অন্য কোনোভাবে নয়– এটাই রহস্য বলে দিলাম ৷ যাও তোমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ সংসারে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করো –তাহলে দেখবে, তোমরা না পেলেও _তোমাদের উত্তরসূরীরা তার সুফল পাবে ।