স্থান ~ পরমানন্দ মিশন, বনগ্রাম । সময় ~ ১৯৮৬, এপ্রিল । উপস্থিত রয়েছেন ~ আশ্রমস্থ ও বহিরাগত ভক্তবৃন্দ ৷
জিজ্ঞাসু :– আপনি বনগ্রামকে কেন বাছলেন আপনার কর্মযজ্ঞের স্থান হিসাবে?
গুরুমহারাজ :– এখন তো আশ্রমের কাজ শুধু আর বনগ্রামেই সীমাবদ্ধ নয় – বহু জায়গায় আশ্রমের কাজ চলছে। তবে বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন মূল কেন্দ্র, আর এই স্থানকে নির্দিষ্ট করার পিছনে এখানকার স্থানমাহাত্মের ভূমিকা আছে বই কি? বনগ্রাম আশ্রমের এই স্থানটিতে বহু প্রাচীনকালে ঋষিদের তপোবন ছিল, কিছুটা মাটি খুঁড়লেই তার নানা নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহাপুরুষেরাও এই স্থানে এসেছেন এবং রাত্রি কাটিয়েছেন। শুনতে অবাক লাগলেও এগুলো সত্য যে, আজ থেকে প্রায় দশহাজার বছর আগে_ ভগবান শ্রীরামচন্দ্র এসেছিলেন এখানে। তাছাড়া ভগবান বুদ্ধ, যীশু, চৈতন্যদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের পদধূলিও পড়েছে এই স্থানে। ফলে স্থানটির এমন ভাইব্রেশন যে, এখানে যদি কেউ পায়খানায় বসেও ধ্যান করে তার মন সহজে একাগ্র হবে। অর্থাৎ স্থান-মাহাত্ম তাকে সাহায্য করবে। কূর্মপৃষ্ঠ আকৃতি বিশিষ্ট স্থান এটি। শাস্ত্রে আছে কূর্মপৃষ্ঠ বিশিষ্ট স্থান সাধনভূমির পক্ষে উপযুক্ত। ফলে বহুকাল ধরে এই স্থানে অন্য কিছু হয়নি – যেন আশ্রম হবে বলেই নির্দিষ্ট ছিল। আমি প্রথম যখন এখানে আসি _তখন জায়গাটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ, পরিত্যক্ত একটা ভাগাড় (যেখানে মৃত জীবজন্তুর দেহ ফেলা হত)। আশ্রমের যে বটগাছটি দেখছেন, ওটাও ছিল মৃতপ্রায় – শ্রীহীন, ভূত প্রেতের বাসা ছিল ওটাতে। সন্ধ্যার পর ডাকাতের দল ছাড়া সাধারণ মানুষ এদিকে বড় একটা ঘেঁষতো না।
আমি এখানে প্রথম আসার পর থেকেই মা জগদম্বার ইচ্ছায় স্থানমাহাত্ম প্রকটিত হতে লাগল এবং এখন দেখছেন তো আশ্রমের বিকাশের কাজ চলছে। ভবিষ্যতে আরও কত কি হবে! কত অনাথ ছেলেরা মানুষ হবে, কত সংসারক্লিষ্ট মানুষ শান্তির সন্ধান পাবে। √রী মায়ের ইচ্ছায় আরও কত কি যে হবে – মা জগদম্বাই জানেন। আবার আমি যখন থাকব না, তখন যারা এই আশ্রমে থাকবে – তারা নতুন নতুন পরিকল্পনা করবে, নতুন নতুন কাজ হবে। আবার আরও পরে আশ্রমের মূল আদর্শ থেকে আশ্রমিকরা বিচ্যুতও হবে – পরমানন্দকেই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করবে_ এই হল জগৎ! এইভাবেই √রী মায়ের জগতে মা লীলা করে চলেছেন। ভাঙা-গড়া যা কিছু মায়ের ইচ্ছায়। আপনি আমি যারা আছি_ তাদেরও এই লীলায় এক একটা রোল আছে মাত্র। সেইটা সঠিকভাবে প্লে করতে পারাটাই “কাজের কাজ”! আর বাকী যা কিছু করা হচ্ছে বা করা হবে_ সেসব কর্মের কর্মফল ভোগ করতে হবে। তাই কথা হচ্ছে – মায়ের জগতে কর্মরহস্য বুঝে “কাজের কাজ”-টি করুন, তাহলে সব কাজেই লীলার আস্বাদন হবে। আপনার নিজের অন্তর্জগতে যদি আপনি ডুবে যেতে পারেন, তাহলে “কোন্ স্থান”-কে √রী মা ‘কাজের জায়গা’ হিসাবে বেছে রেখেছেন অথবা তিনি কোন “কাজ”-টি কখন এবং কেন করেন – এই সমস্ত রহস্য আপনি নিজেই জানতে পারবেন।
জিজ্ঞাসু :- আপনি তো শুনেছি আশ্রম করার আগে শ্মশানে রাত্রি কাটাতেন। এর কারণ কি? আর সেখানে ভয় লাগত না আপনার?
গুরুমহারাজ :- কার কাছে শুনেছেন এসব ? বোধহয় রায়নার জগাদার কাছে ! – হ্যাঁ, শ্মশানে বা গোরস্থানে আমার অনেক রাত্রি কেটেছে। রাত্রির নির্জনতাকে কাজে লাগাতে হলে এইসব স্থানই উপযুক্ত। কেননা ঘরে বা লোকালয়ের মধ্যে – যেখানেই আপনি নির্জনতা পেতে চান না কেন মানুষের ডিসটারবেন্সের (disturbance) হাত থেকে আপনি রেহাই পাবেন না। রাত্রিতে কতরকমের মানুষ যে ঘোরাফেরা করে সে অভিজ্ঞতা তো আপনার নেই, তাহলে বুঝতে পারতেন। আর ঘরে থাকলে পরিবারের অন্যান্য মেম্বারদের অসুবিধা হতে পারে। এইসব চিন্তা করেই আমি রাত্রি গভীর হোলে শ্মশানে বা গোরস্থানে চলে যেতাম। তোমরা যে সময়ের কথা শুনেছোতখন আমি “রুরাল ইলেকট্রিফিকেশনে” কাজ করতাম, ফলে সেটা ছিল ক্যাম্প-লাইফ। আমার সাথে তখন অনেকগুলো যুবক ছেলে থাকত ঐ ক্যাম্পে, তাদের যাতে অসুবিধা না হয় – তাই বাইরে থাকতাম।
শ্মশানেও কুকুর, শেয়াল ইত্যাদির অত্যাচার আছে, এছাড়া মশাও রেহাই দেয় না! এইজন্যই বোধ হয় সাধু-সন্তরা গায়ে ছাই-ভষ্ম মাখে, তাতে শীতটাও কম লাগে আর মশার উৎপাতও কমে। যাইহোক, শ্মশানে কাটানোর সময় একবারকার ঘটনা তোমাদের বলি শোন! সেদিন হয়েছিল কিগভীর রাত্রে শ্মশানে বসে আছি , এমনসময় একদল লোক এল হৈচৈ করতে করতে একটা মৃতদেহ নিয়ে! তখন ঐসব ছোটখাটোশ্মশানে সৎকার করার জন্য কাঠ ইত্যাদি যাবতীয় সামগ্রী সঙ্গে করে আনতে হয়,ওরাও সেসব এনেছিল। কিন্তু ওরা মৃতদেহটি চিতায় চাপাবার পরেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসে গিয়েছিল। ফলে দেহটি ভালো করে না পুড়তেই চিতা নিভু নিভু হয়ে গেল। মৃতদেহের সঙ্গের লোকগুলো মদ খেয়েছিল, তারপর ভিজেও গেছিল – ফলে ওরা আর ঝামেলা না বাড়িয়ে, মৃতদেহটি আধপোড়া অবস্থায় রেখে দিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই মৃতদেহটি শেয়াল-কুকুরে টানাটানি করতে লাগল এবং শুরু হয়ে গেল তাদের মধ্যে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি-মারামারি-ও! আমি দেখলাম মৃতদেহটি যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে ততক্ষণ তো শেয়াল-কুকুরের ঝগড়া শেষ হবে না, তাছাড়া মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটা মায়া হোল – আহা! শ্মশানে এসেও সৎকার হোল না! ভাবলাম‘একটু আগিয়ে গিয়ে দেখি তো চিতায় আগুন আছে কি না – তারপর যা হয় হবে’। আসন থেকে উঠে এসে দেখলাম – চিতায় আগুন রয়েছে, তবে উপরের কাঠ ভিজে গেছিল বলেই চিতা নিভে গেছিল। শেয়াল-কুকুরগুলো সরিয়ে দিয়ে মৃতদেহটি টানতে টানতে নিয়ে এসে আবার চিতায় তুললাম, তারপর কাঠগুলো ফের চাপিয়ে চিতাটাকে ভালো করে সাজালাম। এইবার ছোট ছোট কাঠ কুড়িয়ে এনে যেখানটায় আগুন ছিল সেখানটায় দিয়ে ফুঁ দিতে শুরু করলাম। কিন্তু গলগল্ করে শুধু ধোঁয়াই বেরোতে লাগল – আগুন আর জ্বলে না! কতক্ষণ যে চেষ্টা করছি তার ঠিক নেই, একান্ত নিষ্ঠাভরে আগুন জ্বালানোর প্রযত্নে ধোঁয়ায় চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে তখন, তবু ফুঁ দিয়েই চলেছি। অবশেষে আগুন জ্বলল। পাতলা কাঠগুলো আগে দিয়ে যাতে ভালোভাবে চিতাটা জ্বলে তার চেষ্টা করছি – ঠিক তখনই দেখি চিতার অপরপ্রান্তে একজোড়া বিশাল পা। ভয়ে ভয়ে উপর দিখে চেয়ে দেখি – ত্রিশুল হাতে বিশালকায় জটাজুটধারী এক মূর্তি – আমার দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে! আমি ওনাকে প্রণাম করলাম। উনি বললেন – “আমি শ্মশান-ভৈরব, তোমার সেবায় প্রসন্ন হয়েছি, বর প্রার্থনা করো”। আমি আর কি বলব, বললাম “আশীর্বাদ করুন”। উনি আরও প্রসন্ন হয়ে আমাকে খুব করে আশীর্বাদ করলেন। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেলেন! এই ঘটনার পর থেকে তাঁর আশীর্বাদ আমার জীবনে খুবই কার্যকরী হয়েছিল, কোন শ্মশানে বা গোরস্থানে কখনোই কোন ভয় লাগেনি বা কোন অসুবিধা বোধ হয়নি। বরং সেই সময় আমার যা কাজ ছিল ঐসব স্থানে তা আমি ভালভাবেই সম্পন্ন করতে পারতাম।
যাইহোক, আমার জীবনের একটা ঘটনা বললাম। কিন্তু এই ঘটনা থেকে শিক্ষা হল এই যে, নিষ্ঠাভাবে যাই করা হোক না কেন তা ‘সেবা’ হয়ে যায়! জগতে কোন কিছুই নষ্ট হয়না বা বলা যায় সব কিছুরই কিছু না কিছু কাজ আছে। দেখ না শবদেহটা যদি না পুড়তো_ তাহলেও শেয়াল-কুকুরের খাদ্য হোত। গোরস্থানে দেখেছি মৃতদেহ অনেকটা গভীরে পোঁতা হয় বলে শেয়াল-কুকুরে বড় একটা খেতে পায় না, কিন্তু অজস্র কীট দেহটাকে খাদ্য করে। সে কত বিচিত্র রকমের কীট তা না দেখলে বুঝতে পারবে না যে, মাটিতে কত রকমের কীট থাকে। আবার “শব” দাহ করলেও এমন আকাশচারী জীব আছে যারা ধোঁয়ার সাথে শবদহনের যে গ্যাসীয় অংশ, তা গ্রহণ করেশুনতে অবাক লাগলেও কথাটা সত্যি জানবে! কিন্তু এসব সত্ত্বেও আসল রহস্যটা হচ্ছে – তুমি যে সংকল্প করে কাজ শুরু করেছ, তা নিষ্ঠাপূর্বক শেষ করা তোমার উচিৎ। মৃতদেহটি যেহেতু হিন্দুর, সেই শরীরটির সংস্কারে রয়েছে শব দাহ করা, সুতরাং সেটিও পূর্ণ করা লোকগুলির উচিৎ ছিল। তাদের অসমাপ্ত কাজটাই আমি করে দিয়েছিলামআর এতেই শ্মশানভৈরবের কৃপা হয়েছিল।
এবার কথা হচ্ছে, মা মহামায়ার স্থূলজগৎ সকলের কাছেই পরিদৃশ্যমান, কিন্তু সূক্ষ্ম এবং কারণ-জগতও তো রয়েছে! সাধারণতঃ মানুষ স্থূল বা দৃশ্যমান জগতের কার্য দিয়েই সবকিছু বিচার করতে যায় তাই ভুল হয়! মনুষ্যদেহ পৃথিবীগ্রহে এমনই এক উন্নত আধার যা দিয়ে এই ত্রিজগতের সমস্ত রহস্যই জানা যায়। ভগবান লীলা করেন মনুষ্যদেহেই, আর দেহধারী ভক্তরাই তা আস্বাদনও করেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই মনুষ্যদেহ পেয়েও তাকে অযত্নে অবহেলায় উপযুক্ত করে তুলতে পারে না। তাই জগতের অনেক রহস্যই তাদের অজ্ঞাত থেকে যায়। দেহ এমনই একটা ফীল্ড(field) যেখানে অনন্তশক্তিকে ক্রীয়াশীল করা যায় বা অনন্তশক্তির খেলাকে ধরতে পারা যায়। সূক্ষ্ম শরীরের অস্তিত্ব অনেকে অস্বীকার করেন বলেই কথাগুলো বললাম।
আর আপনি ভয়ের কথা বলছিলেন, ভয় তো মনের ক্রিয়া_ এও সূক্ষ্মভাব! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন – “লজ্জা, ঘৃণা, ভয় তিন থাকতে নয়”_ তাই ভয়কে তো জয় করতেই হবে। শুধু নির্ভয় হওয়া নয়, ‘অভয়’ হতে হবে। সর্বক্ষণ যার ইষ্টে মতি থাকে – কোন ভয় তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আর জানবেন সকল ভয়ের মূল কারণ হোল মৃত্যুভয়! যিনি অমৃততত্ত্বের সন্ধানে নেমেছেন তাঁর তো মৃত্যুভয় থাকে না। এই মৃত্যুভয়কে অতিক্রম করার জন্য তাই উপনিষদে প্রার্থনা করা হচ্ছে – ‘মৃত্যোর্মামৃতংগময়’ – আমাকে মৃত্যু হতে অমৃতে নিয়ে চলো। তাছাড়া ভক্তের আবার ভয় কি, মায়ের ছেলের আবার মৃত্যুরূপা কালীকে কি ভয়!
তেমনি ‘লজ্জা’কেও অতিক্রম করতে হয়। অনেকে দেখবে বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছে কিংবা বামপন্থী রাজনীতি করে, তারা সম্মানীয় ব্যক্তিদেরকে সম্মান করে না অথবা ঠাকুরস্থানে মাথা নোয়ানো বন্ধ করে দিয়েছে! কেউ কেউ হয়তো লুকিয়ে লুকিয়ে হরিবাসরে যায় কিন্তু সেখানে চন্দনের ফোঁটা দিলে তা ভিজে থাকতে থাকতেই মুছে ফেলে যদি বাইরে এসে লোকে জানতে পারে! তা __ভক্ত কেন এইসব অহেতুক লজ্জার দাসত্ব করবে? ভক্তিমান মানে সেকি শক্তিমানও নয়? ভক্ত মানে দীন-হীন দূর্বলতার প্রতিমূর্তি নয়, ‘মহাবীর হনুমান’- হোক ভক্তের আদর্শ, তাহলেই সমস্ত দুর্বলতা কেটে যাবে।
এখানে অনেকেই আমার কথা শুনছে, কিন্তু বাইরে গেলেই যে কে সেই! প্রশংসায় বিগলিত হয় না অথবা নিন্দায় বিচলিত হয় না – এমন ক’জন আছে? কত রাজা, জমিদার শুধু প্রশংসা শোনার জন্য গোটাকতক করে মোসাহেব পুষতো, আর তাদের পিছনে হাজার হাজার টাকা ফালতু খরচা করতো, সভাপন্ডিত পুষে তাদের নিজেদের প্রশস্তিবচন লেখানো হোত। দ্যাখো_ কাল কি মনে রেখেছে তাদের কথা? কিন্তু ‘কালী’কে যাঁরা প্রসন্ন করেছেন _তাঁরা আজও মানুষের কাছে সমাদৃত হয়ে আসছেন – এটাই রহস্য জানবে! তাই পান্ডিত্যাভিমান, জাত্যাভিমান, ঐশ্বর্যাভিমান এ সবই আত্মসাক্ষাৎকারের পথে অন্তরায়। লজ্জা, ভয়, মান-অভিমান সবই পাশ বা বন্ধন, এগুলি কাটিয়ে উঠতেই হবে – তবেই তো হবে চরৈবেতি।
স্ব-স্বভাব বা প্রকৃতি অনুযায়ী সদগুরু সাধককে কর্মপন্থা বলে দেন, সাধনপথ নির্ধারিত করে দেন! শিষ্যের একমাত্র কর্তব্য – সেটিতে অটল থাকা, নিষ্ঠাভরে, যত্নসহকারে তার অভ্যাস করে যাওয়া, ব্যাস্ তাহলেই হল। বাকীটা মায়ের উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন – অভীষ্ট পূরণ হবেই হবে।৷
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।৷