স্থান:— বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন | সময়:—? উপস্থিত ব্যক্তিগণ:— পূর্ণানন্দ মহারাজ, সিঙ্গুরের ভক্তবৃন্দ ও আশ্রমস্থ মহারাজগন।

জিজ্ঞাসু(একজন মহারাজ) :– আমরা তোমার ব্রহ্মচারী শিষ্য হিসাবে তোমার শরীরের একটু সেবা-যত্ন করতে চাই_ কারণ সেটা আমাদের কর্তব্য বলে মনে হয়! কিন্তু তা করতে গেলে অনেক সময় দেখেছি, তুমি আপত্তি কর_ এটা কেন কর?

গুরু মহারাজ :– তোমাদের ‘কর্তব্য কর্ম’তো!! তোমরা নিজেরা ‘আমার প্রতি কর্তব্য কর্ম’ বলে যেটা মনে করছো আমি অধিকাংশ সময়ই দেখি_ সেবা কার্য করতে গিয়ে সেটা অত্যাচারে পরিণত হয়! তাই তোমাদের এই ধরনের কাজ করতে আমি নিষেধ করি। দ্যাখো, আমি আমার নিজের কাজটা নিজেই করতে অধিক পছন্দ করি। আর এই শরীরটার আরামের কথা ভেবে হয়তো তুমি কথাগুলো বলছে_ কিন্তু তুমি (ঐ মহারাজ) তো জানোআমার জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই, পথে-ঘাটে-পাহাড়ে-জঙ্গলে-হিমালয় পর্বতের বিভিন্ন প্রান্তে কেটে গেছে! কত রাত উন্মুক্ত আকাশের নিচে, পাথরের উপর অথবা জমির উঁচু আলের উপর শুয়ে শুয়ে কেটেছে! আজ হয়তো তোমরা এই শরীরটার সেবা করতে চাইছ, আরামের জন্য বালিশ-বিছানা দিচ্ছোএটা তোমাদের satisfaction ! কজন আর আমার satisfaction অনুযায়ী আমার সেবা করতে পারে বল? এইজন্যেই আমি এগুলো এড়িয়ে চলতে চাই।

বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভক্তদের বাড়ি আমাকে যেতেই হয়! অনেক ভক্তের বাড়ি গিয়ে দেখি আমার থাকবার বা খাবার জন্য এলাহি ব্যাপার করেছে_ অথচ আমার সাথে যারা গেছে তাদের দিকে নজর দেয় না!এতে আমি কি করে সন্তুষ্ট হই বল? গৃহস্বামীকে ডেকে আবার আমাকে বলে দিতে হয়_ যাতে আমার সঙ্গে আসা লোকেদের একটু বিশ্রামেরর জায়গা করে দেয় বা ঠিক সময় মতো জলখাবার বা অন্য খাবার দেয়। বেশিরভাগ মানুষের common sense বা কাণ্ডজ্ঞানের ভীষণ অভাব!

এইসব সমস্যার জন্য, আমি অধিকাংশ সময় একা একা ঘুরতে ভালোবাসি! এতে ভক্তদের কর্তব্যের আতিশয্য বা অত্যাচারও সহ্য করতে হয় না, আবার এর ফলে মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাই_ তাদের প্রকৃত মানসিকতার স্পর্শ পাই_ ভালো লাগে! রাস্তাঘাটে অনেকে সাধু সন্ন্যাসী দেখে মজা করে টিটকারী দেয় বা টন্টিং করে! আমি অনেক সময় তাদের সাথে মিশে যাইতাদের মতো হয়েই কথা বলি! আবার অনেক সময় ইচ্ছে করে তর্ক জুড়ে দিই_ এরকম ভাবে enjoy করি! কিন্তু আমার সাথে পরিচিত কেউ থাকলে আর এসব করতে পারিনা__ কারণ ঐ ব্যক্তি তো মনের মধ্যে আমাকে “গুরুদেব বানিয়ে বসে আছে!

একদিনকার একটা ঘটনা বলছি শোন_ কাটোয়া লোকালে চেপে একা একা আজিমগঞ্জ যাচ্ছি! ট্রেনে উঠে জানালার ধারের সিটে বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাচ্ছি। ট্রেনের অন্যান্য যাত্রিরা নিজেদের মধ্যে খোশগল্পে মশগুল! এইগল্প- সেইগল্প শেষ করে, সাধুবেশী আমাকে দেখে এবার ওরা আমাকে নিয়ে পড়ল! ভারতবর্ষের সাধুসন্তদের অত্যাচার অনাচারের কত কাহিনী ওদের মনে পড়ে গেল! সমসাময়িক সাধু-সন্তরা কে কত খারাপ কাজ করেছে বা করে চলেছে_ তার পরিসংখ্যানের ফোয়ারা ছুটতে লাগল! আমি চুপচাপজানালার দিকে তাকিয়ে ওদের বক্তব্যগুলো enjoy করছি_ কিন্তু কোন response

করছি না! কিছুক্ষণ এভাবে চালানোর পর, ‘আমি রেগে যাচ্ছি না’_ দেখে ওরা আর ইন্টারেস্ট পেল না_ফলে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল।

এদিকে ততক্ষণে আর একটা কান্ড ঘটতে শুরু করেছে_ আমার পাশেই বসে ছিলেন একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক, যিনি বনগ্রাম চরৈবেতি কার্যালয় থেকে প্রকাশিত “সহজতা ও প্রেম” বইটি পড়ছিলেন! কোথা থেকে পেয়েছেন কে জানেকারণ উনি বনগ্রাম আশ্রমের ভক্ত ননতাহলে তো আগেই চিনে নিতো! আমি আড়চোখে একবার দেখে নিয়েছিলাম যে ভদ্রলোক ওই বইটি মনোযোগ সহকারে পড়ছিলেন। ভারতীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবান,ফলে সাধু-সন্তদের প্রতি ডেইলি-প্যাসেঞ্জারদের করা কটুক্তি গুলি_ তার খুব একটা ভালো লাগেনি! হয়তো উনি নিজেই প্রতিবাদ করতে চাইছিলেনকিন্তু সাহসে কুলোচ্ছিল না, অথবা উনি ভাবছিলেন যে, সাধু হিসেবে আমি প্রতিবাদ করব! কিন্তু আমি তা করলাম না দেখে, অনেকটা বিরক্ত হয়েই ঐ বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বুঝলেন মশাই! গেরুয়া কাপড় পরলেই সাধু হওয়া যায়না! এই নিন এই বইটা পড়ুন! আর এই বইটা যিনি লিখেছেন_ তাঁর মত জ্ঞানী বা তাঁর মত সাধু হবার চেষ্টা করুন! তাহলে আর রাস্তাঘাটে আপনাকে পাবলিকের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ শুনতে হবে না!”

আমি নিরীহ ব্যক্তির মত তার কাছ থেকে বইটা নিয়ে দু-চার পাতা ওল্টাতে শুরু করলাম। কি আর করি_ পড়বই বা কি! যাইহোক, কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে আবার ওনাকে বইটা ফেরত দিয়ে দিলাম। ফেরত দিতেই ভদ্রলোক আবার রেগে-মেগে বললেন “জানতাম ধৈর্য নেই! এই জন্যই তো দেশটা রসাতলে গেল! আর হিন্দু জাতিকার বারোটা বাজল!” আমি জানালার ধারে মুখটা যথাসম্ভব লুকিয়ে মুখ টিপে টিপে হাসছিলাম দেখে ভদ্রলোক আরো জ্বলে উঠছিলেন!

এমন সময় ট্রেনটা কাটোয়া স্টেশনে থামলো। আজিমগঞ্জ ষ্টেশনের হেড TXR_ মানিক ব্রহ্ম (আমাদের আশ্রমের একজন ভক্ত) ঐ কম্পার্টমেন্টেই উঠে পড়ল! অফিসিয়াল কাজে ও হয়তো এসেছিল কাটোয়ায়! যাইহোক, ও ট্রেনে উঠেই আমাকে দেখে ফেলেছে!কারুকে কোন information না দিয়ে, সেবার আমি আজিমগঞ্জ আশ্রম যাচ্ছিলাম_ ফলে ওখানকার কোন ভক্ত-ই আমার যাবার ব্যাপারটা কেউ জানতো না। তাই আমাকে ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে দেখেই তো মানিক(ব্রহ্ম) প্রথমটায় অবাক হল, তারপর ভিড় ঠেলে একরকম ছুটে এসে_ “গুরুদেব! আপনি!” বলে পায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়ে প্রণাম করে একেবারে অস্থির কান্ড! আমি যত বলছি “মানিক! থাম্- থাম্”! চোখ টিপে শান্ত হবার জন্য, ইঙ্গিত ও করছিলাম! কারন তার আগে আমাকে নিয়ে বহু ঘটনা ঘটে গেছে এগুলো সব মাটি হয়ে যাক্, এটা আমি চাইছিলাম না! কিন্তু কে শোনে কার কথা!!

কিন্তু, এরপর যেটা হলো সেটা ছিল আরও মারাত্মক! আমার সাথে কথা বলতে বলতেই তো মানিকের চোখ পড়েছে_ পাশের ভদ্রলোকের হাতে থাকা “সহজতা ও প্রেম” বইটির দিকে! এইটা দেখেইমানিক(ব্রহ্ম) তাকে উদ্দেশ্য করে বলে ফেলল” সহজতা ও প্রেমব‌ইটা পড়ছেন?পড়ূনপড়ুন! দারুন ব‌ই_ আমাদের গুরুদেবের লেখা! এই যে ইনি, পরমানন্দ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা আমাদের গুরুদেব_স্বামী পরমানন্দ!”

এরপর পরমানন্দের সাতকাহন বলতে শুরু করলআশ্রমে কতগুলো অনাথ ছেলে মানুষ হচ্ছে,দেশে বিদেশে কতগুলো আশ্রমের শাখা রয়েছে, “সহজতা ও প্রেম” ছাড়াও আর কি কি ব‌ই রয়েছে, এমনকি বইটির যে ইংরেজিতে অনুবাদ‌ও হয়েছে ইত্যাদি নানা কথা গড়গড় করে বলে গেল_ আমার কোনো নিষেধ মানল না!!এর ফলে হলো কি, যে কম্পার্টমেন্ট-টা একটু আগে হৈ-হুল্লোড়ে, গাল গল্পেসবাই একেবারেমশগুল হয়ে ছিল, সেটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল! আমার পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ ভদ্রলোক খুবই লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলেন!ডেইলি প্যাসেন্জারেরা মানিক (ব্রহ্ম) কম্পার্টমেন্টে উঠেই আমাকে দেখে অতটা উচ্ছাস প্রকাশ করার পর থেকে ঘটনাপ্রবাহ গুলো লক্ষ্য করছিল! সবকিছু দেখে-শুনে তারাও লজ্জিত হল ! আমি আর কি করি _ পরের স্টেশনে মানিক কে নিয়ে অন্য কম্পার্টমেন্টে চলে গেলাম!

জিজ্ঞাসু :– আচ্ছা গুরুজী! খাদ্য সম্পর্কে আমাদের ধর্মে যেসব বিধিনিষেধ আছে_ সেগুলি মেনে চলা টা কি সঠিক?

গুরু মহারাজ :– তোদের “ধর্ম”-টা কি সেইটা আগে বুঝিয়ে বল দেখি? ধর্ম সম্বন্ধে সঠিক ধারণা না থাকায়, তোর মতো, বেশিরভাগ লোকই_ এই ভুলটা করে বসে! কিছু যুক্তি, কিছু আচার বা কিছু নিয়ম পালন করলেই_ সেটা ‘ধর্ম’ হয়ে গেল? প্রকৃতপক্ষে “ধর্মে”-র সংজ্ঞা বা তার অনুশীলনের কথা তো আমি বহুবার তোদের কাছে আলোচনা করেছি_ তবুও তোদের জিজ্ঞাসার স্তর একই জায়গায় রয়ে গেল! দ্যাখ্, আচার-নিয়ম,খাদ্যাখাদ্যের বিধান, এসব বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র অনুযায়ী সমাজে চলে! এক এক জায়গায় বা সমাজে এক-একরকম বিধান! এক জায়গার বিধান, অন্য জায়গার সঙ্গে _ এইজন্যই মেলে না! যাইহোক, বাংলায় “মনুসংহিতা” এবং রঘুনন্দনের “স্মৃতিশাস্ত্রে”-র বিধান অনুযায়ী এখানকার মানুষেরা দশবিধ বা অষ্টাদশবিধ সংস্কারাদি কর্ম পালন করে থাকে। তাছাড়া রয়েছেঅনেক ‘দেশাচার’, বা ‘লোকাচার’! কারণ মনুসংহিতা বা স্মৃতিশাস্ত্র তো সাধারণ লোকে পড়ে না বা সেই অনুযায়ী চলেও না! তারা তাদের পারিবারিক ধারা অর্থাৎ পূর্বপুরুষেরা যেভাবে চলেছে, যে কাজ(সংস্কার) যেভাবে করত বা কোনগুলি করত না_ পরবর্তী জেনারেশন সেগুলোকেই মেনে চলার চেষ্টা করেএকে বলা হয় কুলাচার! এই ভাবেইদেশাচার, লোকাচার,কুলাচার‌ ইত্যাদি নামে সামাজিক অনুশাসন চলে আসছেবহুকাল ধরে। কিন্তু কালের নিয়মেযুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে সবকিছুই পরিবর্তন হয়, আর হওয়াটাও দরকার!

  আদিমকাল থেকে মানুষের খাদ্যাভ্যাস-ও এভাবেই পরিবর্তন‌ হয়েছে! আমরা সবাই তো দেখতেও পাচ্ছি  _সমাজ ব্যবস্থার দ্রুত কেমন পরিবর্তন ঘটছে! সবকিছুই আগের থেকে এখন অনেকটাই বদলে গেছে! তবে আমাকে যদি কেউ খাদ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে _ তাহলে আমি তাকে, তার শরীরে যা সয়, বা যা খেলে তার মঙ্গল হবে, তার শরীর ভালো থাকবে _ সেই খাদ্যের বিধানটি দেবো। কারণ, আমি কোন বিশেষ 'মতে'র লোক ন‌ই, আবার সব 'মতে'ই আছি।

এখানকার দীক্ষিত অনেক বিধবা মহিলারা আমিষ খায় না। কিন্তু যখন ঐ ধরনের কেউ কোন শারীরিক অসুবিধা নিয়ে  আমার কাছে আসে, তখন  তার শরীরের অবস্থা দেখে আমি তাকে আমিষ খাবার বিধান দিই। কেউ কেউ তা মেনে নেয় এবং অনেকটা সুস্থ হয়ে যায়। আবার অনেকে আমার এই কথা শুনে জিভ কেটে বলে, "ছিঃ, ছিঃ, বাবা! আমি বামুনের বিধবা_ ও কথা শোনাও যে পাপ!"  ফলে সে খাদ্যাভ্যাস পাল্টায় না এবং শারীরিকভাবে নানা রকম কষ্ট পায়‌। তবু সংস্কারকে ছাড়তে পারে না। তাছাড়া দেশাচার, লোকাচার ইত্যাদি রয়েছে_হয়তো সেই ভয়ে আমার কথা অগ্রাহ্য করতে বাধ্য হয়।

আমি তো সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে মিশি তাই অনেক কিছুই আমার চোখে পড়ে। তোমাদেরই কলকাতায় কোন বড় ভাড়াবাড়িতে হয়তো বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করে! তাদের কেউ নিরামিষ খায়, কেউ খাসি বা মুরগির মাংস খায়, কেউ শুয়োরের মাংস খায়, আবার কেউ গরুর মাংস খায়! এরা একই জায়গায়,এক‌ই ছাদের নিচে বাস করে। এদের জীবন যাত্রার মান প্রায় একইরকম, ভাষা একই,পোশাক প্রায় একই কিন্তু খাদ্য ভিন্ন ভিন্ন বলে একে অপরকে ঘৃণা করে! এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার! “আপ রুচি খানা” যার যা পেটে সয়,আর যার যে খাদ্যে রুচি _ খাক না সে সেই খাদ্য! তোমার ঘৃণা করার তো কিছুই নেই! আরে এখন কলকাতার বড় বড় হোটেল বা রেস্টুরেন্টে মুসলমানদের থেকে হিন্দুরা beef বেশি খাচ্ছে! তাছাড়া গরুর চর্বি দিয়ে বিভিন্ন ক্রিম বা খাদ্যবস্তু,ভোজ্যতেল, মাখন ইত্যাদি তৈরি হয় সেগুলো কিনে খায় সব ধর্মের মানুষ! টিনের দুধ বা কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে তৈরি হয় উটের দুধ, শুয়োরের দুধ এইসব দিয়ে! তোমরা সেগুলিকে তো বেশ ব্যবহার করো! দেখতে পাচ্ছো নাবলে অসুবিধা হচ্ছে না,তাই তো!!

আমি একটা কারখানায় দেখেছিলাম যেখানে গরুর বড় বড় হাড় ফাটানো হচ্ছে, ঠিক করাতকলে যেমন কাঠ চেরাই করে _ঠিক তেমনিভাবে! তারপর  আধখানা ফাটানো হাড়গুলি পাশের মেশিনে চলে যাচ্ছে, সেখানে হাড়ের মাঝখান থেকে কাল অংশটি(মজ্জা) বের হয়ে এক জায়গায় জমা হচ্ছে! হাড়গুলো চলে যাচ্ছে সার কারখানায়, আর ওই কফির গুঁড়োর মতো কালো অংশটি চলে যাচ্ছে ওষুধ কারখানায়! ওগুলো দিয়ে ক্যাপসুলের উপরিভাগের অংশ বা coating তৈরি হয়। এই মজ্জা, অন্যান্য ওষুধ তৈরির কাজেও লাগে। এছাড়া গরু বা কুকুরের লিভার, কিডনি অথবা অন্যান্য অংশ থেকে ওষুধ তৈরি হয়। তার বেলা,সব ঠিক আছে, যেহেতু _ ওসব না জেনে গ্রহণ করছে মানুষ, তাই কোন রকম ঘেন্না হয় না!

সুতরাং বাবা! শুধু শুধু কতকগুলো কুসংস্কারকে ধরে রেখে লাভ কি? দেহরক্ষার প্রয়োজনে খাদ্য _ খাদ্য গ্রহণের জন্য তো আর দেহ নয়! ফলে অতো সংস্কার রেখে লাভ টা কি হবে?

এজন্যই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, “যার পেটে যা সয়,সে সেটাই খাবে।”। ঠিকমতো watch করতে পারলে_

শরীর‌ই বলে দেবে, সেই ব্যক্তির কোন্ খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজন বা কোনটি নয়! কিন্তু তা জানতে গেলে তো শরীরবিজ্ঞান সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে অর্থাৎ জানতে হবে Language of the body(শারীরবিজ্ঞান)! তন্ত্র- মন্ত্র- যন্ত্র! তনু_ মন প্রত্যয় করে তন্ত্র! “শরীরম্ আদ্যং খলু ধর্মসাধনং” ধর্ম সাধনার মূল হচ্ছে শরীর! শরীরকে এইজন্যেই সমস্ত শাস্ত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তাই শরীর সুস্থ রাখার জন্য যে খাদ্য তোমার পক্ষে উপযুক্ত _ তাই গ্রহণ করো। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এর পরিবর্তন হতেই পারে, তার জন্য চিন্তিত হয়ো না |

জিজ্ঞাসু :–নাগা সন্ন্যাসীরা কুম্ভ মেলায় আসেন শুনেছি! ওনারা কোন পরম্পরার সাধু?

গুরু মহারাজ :– কথাটা ‘নাগা’ সন্ন্যাসী নয়,নাঙ্গা সন্ন্যাসী। ‘নাগা’ কথাটার অন্য অর্থ নাগাল্যান্ডের লোকেদের কে নাগা বলা হয়। এরা “নাঙ্গা” – অর্থাৎ উলঙ্গ! সর্বত্যাগী শংকর-ই এদের আদর্শ ও উপাস্য! “সর্বত্যাগী”এই অর্থে উলঙ্গ, শুধু পোশাক না থাকা অর্থে নয়! যাইহোক, অপভ্রংশ হয়ে বাংলায় নাঙ্গা থেকে নাগা হয়েছে। এই পরম্পরা শংকরাচার্যের দশনামী সম্প্রদায়ের ই অন্তর্গত! তবে কিছু ‘আখড়ার সাধু ও রয়েছে”! দ্যাখো, কথাতেই রয়েছে _ ‘নানা মুনির নানা মত’! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে,এরা শৈব সাধু। বৈদিক পঞ্চশাখাহোল _সৌর, শাক্ত, শৈব, গানপত্য ও বৈষ্ণব। ফলে পরম্পরাগতভাবে কোনো বিরোধ নেই তো!

 তবে, বর্তমান যে নাঙ্গা পরম্পরা দেখছো__এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন বাঙালি। তার নাম ছিল মধুসূদন সরস্বতী। বিদেশী শাসকরা যখন ভারতবর্ষের প্রাচীন পরম্পরাগুলো ধ্বংস করছিলো, তখন ওই শক্তিশালী সাধক উত্তর ভারতের বিভিন্ন শৈব সাধুদের একত্রিত করেন এবং অস্ত্রশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন, যাতে করে প্রয়োজনে বা দেশরক্ষায় এরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এরা অস্ত্রনিয়েই ঘোরাফেরা করে। এদের মধ্যে এমন কিছু গোপনবিদ্যা জানা আছে, যা জানলে বিজ্ঞানীরাও চমকে উঠবে।'কিমিয়া বিদ্যা'_বা রসায়নবিদ্যায় অসাধারণ পারদর্শী এরা! পারদকে জমিয়ে এতোভাবে ব্যবহার করেছে এরা _যে, চিন্তাও করতে পারবে না! কিমিয়া-বিদ্যার সাহায্যে এরা যে কোনো material-কে change করে দিতে পারে!এক একজন নাঙ্গা সম্প্রদায়ের মন্ডলেশ্বরের শরীরে, যে পরিমাণ সোনা বা রূপার গহনা, হীরা,জহরৎ সহ অন্যান্য রত্নরাজি, স্বর্ন-সিংহাসন ইত্যাদি থাকে, __তা দেখলে যে কোন লোকের মাথা ঘুরে যাবে!  নাঙ্গা সন্ন্যাসীরা সাধারণত নিজেদের সাধন-ভজন,আচার-অনুষ্ঠান নিয়েই ব্যস্ত থাকে__ সামাজিক কোনো ব্যাপারে কখনো নাক গলায় না। সাধারন সংসারী জীব সম্বন্ধে বা বর্তমানের রাজনীতি এবং সমাজ-ব্যবস্থা সম্বন্ধে ওদের কোন ধারনাই নেই! আর এইসব নিয়ে ওদের কোনো মাথাব্যথাও নাই! এইজন্য, অনেকসময় শুনবে যে, বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে নাগা সাধুদের পায়ের চাপে কিছু সাধারণ মানুষ মারা গেছে বা তাদের অস্ত্রের আঘাতে কিছু লোক আহত হয়েছে! এমনটা হওয়া কিন্তু অসম্ভব কিছু নয়, কারণ ওরা সাধারণ সংসারী মানুষদেরকে_অজ্ঞানান্ধকারে ডুবে থাকা মৃতবৎ-ই মনে করে! তাই এইরকম কোন দুর্ঘটনা ঘটলেও_ এরা ভাবে যে, সাধারণ মানুষগুলো মরে গিয়ে_ মুক্তি পেয়ে গেল! এতে ওদের কোন পাপবোধ বা মায়া-মমতার বোধ কাজ করে না। উত্তর ভারতে, মধ্যভারতে অর্থাৎ যেখানে যেখানে নাঙ্গাদের আশ্রম বা আখড়া আছে(নিরঞ্জনী,জুনা ইত্যাদি), সেই সব স্থানের পাহাড়ী অঞ্চলের অধিবাসীরা শিবের কাছে মানত করে একাধিক সন্তান লাভ করে এবং সেই মানত করা একটি ছেলেকে সাধুর আশ্রমে দিয়ে আসে! এরূপ বহু সন্তান ও নাঙ্গা-সন্ন্যাসীদের আশ্রয়ে থেকেই বড় হয় এবং পরে তারা আবার 'নাঙ্গা সন্ন্যাসী' হয়। এছাড়াও শৈব সাধকেরা সরাসরি আখড়ার সাথে যুক্ত হতে পারে। এভাবেই "নাঙ্গা-সাধু" পরম্পরা চলে আসছে! কুম্ভমেলা, সাগরমেলা ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে, বিশেষ তিথি-নক্ষত্রে এরা দলবদ্ধভাবে পুন্যস্নানের নিমিত্ত গিয়ে জড়ো হয়। সেই সময়েই সাধারণ মানুষ এদেরকে একসাথে দেখতে পায় অন্যথায় এরা লোক সমাজে বড় একটা আসে না ।।