স্থান ~ শিবপুর গঙ্গাবাবুর বাড়ি । সময় ~ ১৯৮৬ । উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ গঙ্গাবাবু, রত্না, পূর্ণানন্দ মহারাজ, এনাঙ্কবাবু ইত্যাদি ।
জিজ্ঞাসু :– মহারাজ, আপনার বয়স কত? আপনার শরীর ধারণের উদ্দেশ্য কি? আপনার শরীর ধারণের ফলেই কি জীবের মুক্তি ঘটবে?
গুরুমহারাজ :– যেভাবে আপনারা বয়সের বিচার করেন, আমার বিচার ঐভাবে হয় না। তবে শরীরের কথা যদি বলেন তাহলে আমি এটুকু বলব যে, আমার এটি ৬০,৪১৮-তম শরীর এবং এরপরও আমাকে বহুবার শরীর নিতে হবে। ৬৪,০০০ বার শরীর ধারণ করলেই পৃথিবী গ্রহে আমার কাজ শেষ হবে।
আমার শরীর ধারণের জন্য আমি দায়ী নই। মায়ের ইচ্ছায় আমি এখানে শরীর ধারণ করে থাকি, কখনই আমার কোন স্বাধীন ইচ্ছা নেই। তবে শরীর ধারণ করার পর জীবের দুঃখে বা কষ্টে আমার দুঃখ বা কষ্ট হয়। তখন ‘তাদের মঙ্গল হোক’ এই ইচ্ছা জাগে। আর সঙ্গে সঙ্গে মা তা Accept করেন এবং তা মা জগদম্বার ইচ্ছায় রূপ নেয়, ফলে আমি যে Free — সেই Free ই থাকি। এই শরীরে আমার ইষ্ট ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা আমার প্রেরণা, আর স্বামী বিবেকানন্দ আমার আদর্শ। আধুনিক বিশ্বে স্বামীজী হচ্ছেন একজনDynamic মানুষ। আর এই Dynamic মানুষেরাই পারেন সমাজের প্রকৃত কল্যাণ করতে। সাধারণ মানুষ আর কি করবে — নিজের কল্যাণই করতে পারে না। শুধু নিজের আর পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেখতে দেখতেই জীবনটা ব্যয় করে ফেলে, ফলের সমাজের মঙ্গল বা দেশের মঙ্গল করা দূরের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাহলে মহামায়ার বাঁধনে আবদ্ধ, মোহযুক্ত — স্বামীজীর ভাষায় hypnotized মানুষদের প্রকৃত কল্যাণ কে করবে, কে তাদের পথ দেখাবে? এই কাজের জন্য আসেন স্বামীজীর ন্যায় Dynamic মানুষেরা। মানুষের অজ্ঞানতা আর অসহায় অবস্থা দেখে তাঁদের প্রাণ কাঁদে আর তাঁরা ভাবেন ‘জীবের দুঃখ দূর করার জন্য যদি বারবার শরীর নিতে হয় তাও তাঁরা নেবেন — আসবেন।’ এটা মহাপ্রেম। এতে মা জগদম্বা দারুণ প্রসন্ন হন। ইচ্ছাময়ী সবার ইচ্ছা পূর্ণ করেন, তাই এই ইচ্ছা তো পূর্ণ হবেই। এ জগৎ-সংসার যেমন, তেমনি সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও এক নিখুঁত Balance এ রয়েছে। Positive শক্তি যতটা, Negative শক্তিও ঠিক ততটাই। জগতে যেমন ভুরি ভুরি স্বার্থান্বেষী, আত্মসুখ-সর্বস্ব মানুষ আছেন, তেমনি অপরদিকে সর্বত্যাগী মহান মানুষও শরীর ধারণ করেছেন। এঁরা জীবৎকালে মহাপ্রেমের বন্যায় শত শত স্বার্থান্বেষীর মনোজগতের পরিবর্তন ঘটান। শুধু দু-একটা জগাই-মাধাই উদ্ধার বা দস্যু রত্নাকরকে বাল্মিকীতে রূপান্তর করেই ক্ষান্ত হননা, সত্য, ত্যাগ, প্রেম ও শান্তির আদর্শ নিজজীবনে আচরণ করে তাঁরা জগতব্যাপী ছড়িয়ে দেন আর তা অনুসরণ করে মানুষ সুফল পেয়ে থাকে — আনন্দ ও শান্তি প্রাপ্ত হয়। সুতরাং আমার জীবনের উদ্দেশ্য যদি বলো তো এটাও একটা উদ্দেশ্য। আমি মানুষকে উদ্দীপ্ত করি বা প্রেরণা জোগাই। তোমরা যারা শুনছ তারা এক-একটা স্বামী বিবেকানন্দ হও। যারা বলে স্বামী বিবেকানন্দ একটাই হয় আমি তাদের দলে নই। আমি জানি প্রতিটি মানুষের মধ্যেই অনন্ত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে — পূর্ণত্বের বীজ নিহিত রয়েছে। প্রতিটি শরীরই পরমাত্মার প্রকাশ আর শুধু শরীর কেন সবকিছুই তাঁর প্রকাশ। তাহলে তোমার শরীরেও তো স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা-যুক্ত ‘জিন’ রয়েছে — প্রয়োজন শুধু সেটাকে বিকশিত করার, ক্রিয়াশীল করে তোলার। তা যদি পারো তাহলে তোমার মধ্যেই সেই শক্তির প্রকাশ ঘটবে। এইভাবে গোটা পৃথিবীতে ৪০০-৫০০ কোটি মানুষের মধ্যে ৫/৭ জন বীরহৃদয় — সিংহহৃদয় যুবক নিজেদেরকে কি বিবেকানন্দের ন্যায় নিঃস্বার্থভাবে সমাজের বুকে মেলে ধরতে পারবে না! ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যো’ বলহীনের দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। সুস্থ-সবল দেহ ও মনের অধিকারীরাই পারে পরম উদ্দেশ্য সফল করতে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলতেন “রোক্”। তাই ঐরূপ “রোক্” থাকলেই হবে। তবে সাবধান, মন-মুখ যেন এক থাকে, না হলে হবার নয়। ‘আমার দ্বারা হবে না’ — এইরূপ ম্যাদাটে ভাব থাকলে সত্যিই কিছু হবে না। ‘আমি পারবোই’ — ‘আমার দ্বারা হবেই’ এইরকম রোক্ করে একবার নামোতো, দেখ হয় কি না হয়! সত্যকে আবিষ্কার করার এর চাইতে সহজ পথ আর কি আছে। এতেই পরমেশ্বরের করুণা লাভ হয়, কারণ ‘আনন্দ প্রতিষ্ঠিত পরমেশ্বরের করুণা অপার’।
জিজ্ঞাসু:– বর্তমানে তারকেশ্বরের মাথায় জল ঢালার একটা ব্যাপক রেওয়াজ শুরু হয়েছে, এর আধ্যাত্মিক কি কিছু রহস্য রয়েছে?
গুরুমহারাজ :— হ্যাঁ রয়েছে। তবে ঠিকই বলেছ বর্তমানে তারকেশ্বরের মাথায় জল ঢালার একটা রেওয়াজ প্রচলন হয়েছে। এটা অবশ্য হয়েছে ‘বাবা তারকনাথ’ নামক সিনেমাটা চালু হবার পর। এখন এমন অবস্থা যে, বিশেষ বিশেষ তিথিতে বা শ্রাবণ মাসের সোমবারে তুমি আর মন্দিরে গিয়ে জল দিতে পারবে না – বাইরে একটা চোঙা মত রয়েছে, তাতেই জল ঢেলে চলে আসতে হয়। ভিড়ের ধাক্কাধাক্কিতে, কষ্ট করে সারারাত হেঁটে শেওড়াফুলির গঙ্গা থেকে নিয়ে যাওয়া মাটির ভাঁড় ভেঙে কতজনের যে জল মাটিতে পড়ে যায় – তার ঠিক নেই! বেশ কয়েক মাইল পথ। এখনকার ছেলেমেয়েদের হাঁটা অভ্যাস নেই, তার উপর আবার খালিপায়ে হাঁটা, জলঢালার পরদিন বেচারারা আর হাঁটতেই পারে না। তবে রাস্তাঘাটে কোন অসুবিধা যাতে না হয় সেদিকে সরকারী এবং বেসরকারী প্রচেষ্টায় নানারকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যাত্রাপথে ছেলে-মেয়েরা ‘ভোলেব্যোম্-তারকব্যোম্’ ‘ভোলে বাবা পার করেগা’ ইত্যাদি কিছু শ্লোগান ছন্দে ছন্দে উচ্চারণ করতে করতে এগিয়ে চলে। এটা ভালো – bore হতে হয় না। যে কোন ভারী কাজ বা দীর্ঘস্থায়ী একঘেয়ে কাজ করার সময় এই ধরনের ছন্দোবদ্ধ শ্লোগান দেওয়া হয় বা গান গাওয়া হয়।কোন ভারী জিনিস উপরে তোলার সময়_ টিউবওয়েল বসানোর সময় শ্রমিকেরা এই ধরনের ছন্দোবদ্ধ গান গায়। পালকির বেহারারাও এই একই পদ্ধতি অবলম্বন করে। সে যাই হোক, তারকনাথের জন্য জল নিয়ে যাবার সময় কিন্তু আজকালকার ছেলেরা খুব বদ্, এসব বলতে বলতেই এমন সব শ্লোগান দেয় যা স্বয়ং বাবা তারকনাথও কখনও শোনেননি!
এই শিবলিঙ্গে জল ঢালার রেওয়াজটা বহুকালের প্রাচীন। শিবপূজার বিধিই রয়েছে নিত্য দুধ-গঙ্গাজল দিয়ে শিবলিঙ্গকে স্নান করানো বা দধি ঘৃত মাখানোর। দক্ষিণের রামেশ্বর, বিহারের বৈদ্যনাথ অথবা বাংলার তারকেশ্বর - সর্বত্রই সাধারণ মানুষ বা সাধকেরা শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালতে যায়। এছাড়াও অন্যান্য শিবলিঙ্গ যেগুলি স্থানীয়ভাবে মাহাত্ম্যযুক্ত সেগুলির মাথায়ও মানুষ জল ঢালে। আরও দেখবে বৈশাখ মাসভর শিবের মাথায় 'ঝাড়া' দিতে হয়। 'ঝাড়া' হচ্ছে একটা মাটির পাত্র যার মাঝখানে একটা সূক্ষ্ম ছিদ্র থাকে, সেইটি জলপূর্ণ করে দড়ি দিয়ে শিবলিঙ্গের মাথার উপর টাঙিয়ে দিতে হয় যাতে করে ফোঁটা ফোঁটা জল সারাদিন শিবের মাথায় পড়তে পারে।
এই যে শিবলিঙ্গকে স্নান করানো বা জল ঢালা এগুলির বিজ্ঞানসম্মত কারণও রয়েছে। শিবলিঙ্গ সাধারণত এমন দুষ্প্রাপ্য নরম পাথর থেকে তৈরি হত - যেগুলি অত্যধিক গরমে ফেটে যাবার সম্ভাবনা থাকত। তাই শিবলিঙ্গকে ঘি মাখানো, নিত্য স্নান করানো বা গর্ভগৃহে ঠাণ্ডা জায়গায় রাখার ব্যবস্থা অথবা কোথাও কোথাও জলে ডুবিয়ে রাখাও হত - যাতে করে ঐ দুর্লভ দুর্মূল্য শিবলিঙ্গটি নষ্ট না হয়।
এবার সাধারণ মানুষ, এর মধ্যে include হবার কারণটা হচ্ছে যে_ শিব সবার দেবতা, শিবপূজা করার জন্য কোন জাতপাতের বাঁধন কোনকালেই ছিল না। এইজন্যই শিবকে আর্য্য, অনার্য উভয়েরই দেবতা বলা হয়েছে। যাইহোক, যেখানে অন্য দেবদেবীর মন্দিরে নিম্ন বর্ণের লোকেরা যেতে পারে না_সেখানে শিবজীকে ছোঁয়া যায়, , পূজা করা যায়,মাথায় জল ঢালা যায়। তাই সাধারণ মানুষ স্বভাবতই এদিকে ঝুঁকে পড়ল। ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের কিন্তু একটা চালাকি করে সাধারণকে এই সুযোগটা দিয়েছিল_ সারাবছর পূজার ও শিবলিঙ্গের স্নানের জন্য অত গঙ্গাজল পাবে কোথা থেকে? তাই লোকে যে গঙ্গাজল আনতো, তার খানিকটা করে রেখে দিলেই সারাবছরের পূজার কাজটা চলে যেত। গ্রামাঞ্চলে এমন অনেক ঠাকুরের জন্যই দেখবে কোন এক বিশেষ তিথি-নক্ষত্রে গ্রামের মানুষ জল আনে। বিশেষত সেই সব গ্রামেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল _যেখান থেকে গঙ্গা অনকে দূরে অবস্থিত। এখানেও পুরোহিত বা ব্রাহ্মণরা সারাবছরের গঙ্গাজল সঞ্চয় করার জন্যই আপামর জনগণকে অন্তত বছরে একদিনের জন্যও ঠাকুরকে স্নান করানোর সুযোগ করে দিত।
তবে ঐ যে বলছিলে তারকেশ্বরে বাঁকে করে জল নিয়ে যাওয়া হয়, দুদিকে দুটি ভাঁড়ে জল থাকে - ইত্যাদি। এসবের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য আছে। এই জল নিয়ে যাওয়াটা বহির্জগতের তো নয় অন্তর্জগতের ব্যাপার। এখানে ভ্রুযুগল হচ্ছে 'বাঁক', আর নয়নদ্বয় হচ্ছে ঘট, যা অশ্রু দ্বারা পূর্ণ। তাই নয়নজল যদি দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসারিত হয় _তাহলেই তা হয় ভগবানের শ্রেষ্ঠ আরাধনা! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন - লোকে মাগছেলের জন্য ঘটি ঘটি কাঁদে, ঈশ্বরের জন্য আর কজন কাঁদে? ঈশ্বরের জন্য চোখের জল_ প্রকৃত আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ছাড়া কি অন্যে ফেলতে পারে, আর যদি কেউ ফেলেও সেটা অভিনয় হয়ে যাবে অথবা কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ তা ধরেও ফেলবে! এইজন্য তপস্যা বা উপাসনা নয় - আরাধনাই শ্রেষ্ঠ। 'যা আরাধয়তে সা রাধা' বা 'যা রাধিকা সা রাধিকা'। ভক্তিযোগের শেষ সোপানে পৌঁছানো যায় এই আরাধনায়।
দ্যাখো, পার্থিব ভোগ-সুখ তো স্থায়ী নয়_ অকারণ মানুষ ঐ মায়ামৃগের পিছনে ছোটে! শাস্ত্রে আছে স্বর্গাধিপতি ইন্দ্রেরও পতন হয়। সবকিছুই শাস্ত্রে উদাহরণ দিয়ে বোঝানো আছে, তবু মানুষ এমনই মোহগ্রস্ত যে, মাথায় মুগুর না মারা পর্যন্ত মোহ কাটেনা। এইজন্যই আচার্য শংকর লিখলেন "মোহমুদ্গর"। যাই হোক যা বলছিলাম, ঋষিবাক্য সিদ্ধান্ত করল - 'যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমাহং তেন কুর্যাম্'। এই যে আর্যঋষিদের চিন্তা, তা জীবন-গবেষণার মহামন্ত্র, আমি চাই সমস্ত মানুষের মধ্যে এই চিন্তার ব্যাপ্তি ঘটুক, অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে মানুষ আলোয় আসুক, উঠে আসুক মৃত্যুর গহ্বর থেকে অমৃততত্ত্বে।
কতকগুলি প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান ও পুরাতন বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থেকে মনে মনে সন্তুষ্টিলাভ করা যে, ‘আমি ধর্ম করছি’ অথবা সেই অহংকারে আবার অন্যদের ঘৃণা করা – এগুলিকে বিদায় দেবার সময় এসে গেছে! স্বামী বিবেকানন্দ শরীর ছেড়েছেন প্রায় ১০০ বছর হতে চলল, আজও তোমাদের মত শিক্ষিত যুবকদের এই গড্ডালিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে-দেওয়া সাজে না। এখনও যদি তোমরা না ওঠো – না জাগো_ তাহলে এবার সত্যিই তোমাদের মাথায় মা মহামায়ার মুগুর পড়বে। জানবে তোমাদের হাজার বছরের পরাধীনতার প্রকৃত কারণ ছিল এইরকমই মহামায়ার দেওয়া punishment। প্রকৃতিতে দেখা যায় – সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সবকিছুই পরিবর্তন হয়। দ্যাখোনা, আজ থেকে ১০০বছর আগের তুলনায় এখন আবহাওয়া পাল্টে গেছে, মানুষের Lifestyle, food habit সব বদলে গেছে। শিল্প, সাহিত্য, কলা, বিজ্ঞান কেউ কি ১০০ বছর আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে? তাহলে তুমি তোমার মনজগৎকে আটকে রাখছো কেন? তোমার বাবা যে বাড়িতে বাস করতো, সেটা বদলে ফেলেছো, যে থালায় খেতো সেটা আর নেই, বাবা যেভাবে জীবন কাটাতো তুমি তা পালন করোনা – তাহলে শুধু বাবা ঐ ঠাকুরকে ফুলজল দিতো অথবা ‘অমুক’ বাঁকে করে শিবের মাথায় জল ঢেলেছে _অতএব তুমিও তাই করবে – এটা আত্ম প্রবঞ্চনা নয়কি? আগামী পৃথিবী যদি কৈফিয়ত চায় কি উত্তর দেবে তুমি? ভণ্ডামি ধরা পড়বে না কি?
পুরাতন বিশ্বাসকে বিচারের ধারায় ফেলে যেখানে যেটুকু প্রয়োজন বদলে নাও, এটাই Survival of the fittest (যোগ্যতমের উদবর্তন)। একটা ঘটনা ঘটেছিল কিছুদিন আগে এখানেই। আশ্রমের একজন ভক্ত ধাত্রীগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে একঘড়া জল নিয়ে সকাল বেলা এসে হাজির। আমি সিটিং করছি, ও এসে বলল_ "বাইরে আসুন আপনার মাথায় জল ঢালবো!", আমিতো শুনে হতবাক! বলে কি_ মাথায় জল ঢালবে! আমি যত বোঝাই যে, "আমি স্নান করেছি - আবার স্নান করলে শরীর খারাপ হবে! তাছাড়া তুই আমার একা ভক্ত নোস, এই যদি একবার শুরু হয়ে যায় তো এটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়াবে। কাজেই তুই এটা করতে পারিস না!" কিন্তু কে শোনে কার কথা - সে মাথায় জল ঢালবেই। তখন আমি তাকে বললাম,_" জল টা বাথরুমে রেখে দে, পরে স্নান করে নেব।" এইসব কথার মাঝে মুরারী মহারাজ এসে তাকে অনেক বুঝিয়ে তাতে রাজী করিয়েছিল।
বোঝ ব্যাপারটা! কারও মাথায় কিছু একটা খেয়াল চেপেছে, সেইটা চরিতার্থ করার জন্য মূর্তিমান গুরুকে কষ্ট দিতেও বিবেকে বাধল না – এমনি সব ভক্ত আর তাদের তেমনি ভক্তি! তাহলে এবার চিন্তা করো_ পাষাণমূর্তি ঠাকুর-দেবতার ক্ষেত্রে কি অত্যাচারটাই না হয় – কারণ ঐ ঠাকুরেরা তো আর প্রতিবাদ করে না! তাহলে তোমরা জীবিত অবস্থায় মহাপুরুষদের মেরে ফেলো, আবার মৃত্যুর পর ফুল, বেলপাতা, জল দিয়ে আরও অত্যাচার করো – এই যে অসহজতা __ এর থেকে কি করে মুক্তি পাবে মানুষ? মুক্তি পেতে পারে একমাত্র সহজতাকে আশ্রয় করে। কারণ সবচেয়ে সহজই ঈশ্বর। চোখকে ট্যারা করলে সবকিছুই যেমন অন্যরকম লাগে – বস্তুটা প্রকৃত যা, তা মনে হয় না। সেইরূপ আমাদের অসহজতার দরুণই জগৎকে আমাদের অসহজ বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে ‘জগৎ য্যায়সা কা ত্যায়সা’। তুমি ঠিক হলেই সব ঠিক আছে।
তাই আমি সকলকে বলি – সৎ হও, সুন্দর হও, প্রেমিক হও – তাহলেই জীবনে সহজতা আসবে। আরসহজতা এলেই সহজ ঈশ্বরের সন্ধান পাবে। বাহ্য আচার-অনুষ্ঠান দিয়ে কি হবে আর লোকের অনুকরণ করতে গিয়েই বা কি হবে? দ্যাখো, দল বেঁধে চুরি ডাকাতি করা যায়, অথবা সেবামূলক কাজও করা যায় – কিন্তু দল বেঁধে ঈশ্বরলাভ হয় না। কখনও কোন কালে হয়ও নি। তাই অন্তর্মুখী হয়ে অন্তর্জগতে ডুব দিয়েই নিজেকে জানতে হয় বা বোধে বোধ করা সম্ভব।