জিজ্ঞাসু:– বৈষ্ণব ধর্মে যে ‘তৃণাদপি সুনীচেন’-ভাব রয়েছে তা কি বেদান্তের ‘অহম ব্রহ্মাস্মি’-ভাবের বিরােধী নয় ?

গুরুমহারাজ :– দ্যাখাে, বিরােধ রয়েছে মানুষের মনে মানুষের স্বভাবে, তাই তারা সবেতেই বিরােধ করে। সমাজে দেখা যায় যার কিছুই নেই, সে ঘটি-বাটিটার সঙ্গেও বিরােধ করে! হয়তো চলতে গিয়ে ঘটিতে পায়ে একটু আঘাত লেগেছে_ তারজন্যই একঘণ্টা ধরে ঘটিকে গালাগালি দিচ্ছে! কত বৃদ্ধ বা বৃদ্ধারা রয়েছেযাদের রাত্রে ভালো ঘুম হয় না, তাই সারারাত ধরে ইঁদুরদের সাথেই ঝগড়া করে—এমন বহু ঘটনা ঘটে থাকে! সেই জন্যই বলছিলাম, বিরােধ রয়েছে মানুষের অন্তর্জগতে তাই নিজের জীবনে, সংসারে, সমাজে, ধর্মজগতে, রাজনৈতিক জগতে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শুধু বিরােধ আর বিরােধ ! কিন্তু নিজেকে বিরােধমুক্ত তো করতেই হবে__ তবে তো সবার মধ্যে মিল খুঁজে পাবে ! এমনটা হোলে দেখবে, সবকিছুই এক অদৃশ্য মেলবন্ধনে কি সুন্দরভাবে আবদ্ধ!

আমার ক্ষেত্রে এটাই হয়! আমি সবকিছুর ভিতরে সেই ‘এক’কেই দেখি। বৈচিত্র্যের মধ্যে কি সুন্দর ঐক্যতান সদা-সর্বদা বেজে চলেছে দেখে আমি তন্ময় হয়ে যাই–আত্মস্থ হয়ে যাই ! যাইহােক তুমি ঐ যে বলাছলে, “তৃণাদপি সুনীচেন’–ওটা কার কথা জানাে ? ওটা কোন গোঁসাই মহান্তোর কথা নয়, ওটা স্বয়ং শ্রীমন্মহাপ্রভুর শ্ৰীমুখের কথা। মহাপ্রভুর নিজের লেখা বা নিজের মুখের কথা বেশী সংরক্ষণ করা যায়নি, শুধুমাত্র ‘শিক্ষাষ্টকম্’ নামে আটটি শ্লোক স্বয়ং মহাপ্রভুর নিজের বলে ধরা হয়। ঐ যে শ্লোকটি তুমি বললে—ওটি শিক্ষাষ্টকম্-এর একটি শ্লোক থেকে নেওয়া।

মহাপ্রভুর‌ই প্রথম জীবনটা যদি দ্যাখাে–তাহলে এতক্ষন ধরে যা বলা হোল তা বোঝা অনেকটা সহজ হবে! সন্ন্যাসগ্রহণের পূর্বে ‘নিমাই পণ্ডিত’ মানে হচ্ছে _নবদ্বীপের তৎকালীন তথাকথিত বিখ্যাত বিখ্যাত পণ্ডিতদের কাছে যেন একটা ‘মূর্তিমান ভয়’। পণ্ডিত পাঁজি-পুথি নিয়ে বসে আছে দেখলেই নিমাই তার সঙ্গে তর্ক শুরু করে দিতেন, আর তার চোখা চোখা যুক্তিজালে দ্রুত তাকে পরাস্ত করে ছাড়তেন! কতজনের টোল যে তিনি তুলে দিয়েছিলেন কিংবা কত পন্ডিতদের যে তিনি টিকি কেটেছিলেন তার ইয়ত্তা নেই! শেষের দিকে এমন অবস্থা হয়েছিল যে, নিমাই পণ্ডিত দলবল নিয়ে আসছেন শুনলেই পণ্ডিতের দল পুঁথিপত্তর গুটিয়ে আড়ালে লুকিয়ে পড়তাে, কারণ তারা সকলে ধরেই নিতাে যে_ নিমাই-এর সাথে তর্কে এটে ওঠা অসম্ভব ।

কিন্তু দ্যাখো, এহেন নিমাই পণ্ডিত পরবর্তীকালে, কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস নেবার পর যখন “শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য” হলেন_ তখন তিনি‌ নিজেই”তৃণাদপি সুনীচেন”! তাহলে এবার বলোতো যে, সাধারণ মানুষের চেতনা দিয়ে ওনার কথার মর্মার্থ কি করে বােঝা যাবে ? ‘প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া’-গুরুর চরণতলে বসে প্রণিপাতের দ্বারা, সেবার দ্বারা তাঁকে সন্তুষ্ট করে ‘পরিপ্রশ্ন’ অর্থাৎ শ্রদ্ধাপূর্বক জিজ্ঞাসার দ্বারা এসবের উত্তর জানতে হবে বাবা! নাহলে ঐ বিরােধ করেই মরবে_কোনকিছুর‌ই সমাধান করতে পারবে না!

মহাপ্রভুর জীবনের আর একটা ঘটনার উল্লেখ করছি শােন, তাহলে বুঝতে পারবে উনি যখন যেটা মুখে বলেছেন তখন সেটা একশভাগ জীবনে প্রয়ােগ করেছেন বা আচরণে এনেছেন, আর এমনটা যিনি করতে পারেন_ জানবে তিনিই হোলেন ষােলকলায় পূর্ণ পুরুষােত্তম!

তখনকার দিনে কাশীই ছিল হিন্দুশাস্ত্রবিশারদ পণ্ডিতদের স্থান, তাঁরাই তখন হিন্দুধর্মের অলিখিত রক্ষক ও পালক হিসাবে নিজেদের স্থান করে নিয়েছিলেন। তখনকার দিনে হিন্দুদের যা কিছু হোত, ওখানকার পণ্ডিতরাই তার বিধান নির্দিষ্ট করে দিতেন। নবদ্বীপের পণ্ডিতরা নিমাই পণ্ডিতের কাছে লাঞ্ছিত হয়ে তার প্রতিক্রিয়াশতঃ অনেকেই কাশীতে গিয়ে তৎকালীন পণ্ডিতসমাজের কাছে ওনার বিরুদ্ধে নালিশ জানান। তখন কাশীর পণ্ডিতসমাজের মণ্ডলেশ্বর ছিলেন স্বামী প্রকাশানন্দ। উনি ছিলেন যেমন মহাপণ্ডিত তেমনি বাগ্মী। সে যাইহােক, নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিতের নামে বারবার অভিযােগ পাওয়ার পর প্রকাশানন্দ ওখানকার পণ্ডিত সমাজের একটা বৈঠক ডাকলেন, তাতে ব্রাহ্মণ-সন্তান হওয়া সত্ত্বেও নিমাই পণ্ডিত আচণ্ডালে শাস্ত্রকথা শােনান, তাদেরকে নিয়ে চলেন, পণ্ডিতদের অপমান করেন, ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরােধিতা করেন, বৈদিক যাগ-যজ্ঞ, ধ্যান-জপ, পূজা-পাঠ এসব বিসর্জন দিয়ে ভক্তি আন্দোলন করেন–কেঁদে কেঁদে হরিনাম করতে বলেন–এইসব নানান অভিযোগ দায়ের করে _ বিচারসভা বসেছিল।

এদিকে ঘটনাক্রমে মহাপ্রভু ঐ সময়েই কাশীতে গিয়ে হাজির ! বড় বড় পণ্ডিতেরা যখন গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে শাস্ত্রগ্রন্থ ঘেঁটে ঘেঁটে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার অপরাধ খুঁজছেনজীর্ণ কৌপীন-কন্থা সম্বলিত মহাপ্রভু তখন ঐ সমাবেশ-মন্দিরের প্রবেশদ্বারে ধুলােয় বসে নিজের বস্ত্রের আঁচল দিয়ে পণ্ডিতদের ছেড়ে যাওয়া পাদুকাগুলি ধীরে ধীরে যত্নসহকারে মুছছেন। ভিতরে পণ্ডিতদের তুমুল বাদ-বিতণ্ডা, হৈ-হট্টগোলচলছিল ! তাই বেশীরভাগই ঐ নিয়ে ব্যস্ত ছিল, আর যারা মহাপ্রভূকে দেখেছিল তারা জীর্ণবেশ পরিহিত, মুখে একমুখ দাড়ি, বড় বড় চুল সমন্বিত যে সাধুটি পাদুকা পরিস্কার করছিল, সে কোন অন্তজশ্রেণীর লােক বা কোন অপরাধে অনুতপ্ত সাধু–ঐ কর্মের দ্বারা নিজের পাপস্খালন করছে–এরকম কিছু ভেবেছিল! তাছাড়া যে বিখ্যাত নিমাই-পণ্ডিত নবদ্বীপের পণ্ডিতদের ত্রাস, এমনকি দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত কেশব-কাশ্মীরীও যাঁর কাছে হার মেনেছেন, যিনি নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, তিনিই যে তাদের খড়ম পরিষ্কার করছেন_এটা তারা ভাবেনই বা কি করে !

পণ্ডিতেরা শাস্ত্র ঘেঁটে কিছু একটা বের করছেন আর প্রকাশানন্দ তা খণ্ডন করছেন। এইভাবে আরও আরও যুক্তি-প্রমাণের গভীরতা বা দৃঢ়তা চাইছেন প্রকাশানন্দ! কারণ প্রতিপক্ষ যে নিমাই-পণ্ডিত, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্বল যুক্তিসমূহ টিকবে না এটা তিনি ভালমতই জানতেন । কিন্তু কিছুতেই মনােমত যুক্তি দাঁড় করানাে যাচ্ছে না । হঠাৎ সেই প্রবেশদ্বার থেকে সুললিত সংস্কৃতে, মধুর কণ্ঠে মহাপ্রভু এমন একটি শ্লোক বললেন যা কোন গ্রন্থে নেই এবং যা উপস্থিত সবার সব মতের synthesis! সমবেত পণ্ডিতেরা তো এটা শুনে একেবারে অবাক! ভিখারীর বেশে, ভাঙ্গীর কাজ করছে যে__ সে এত সুন্দর, জ্ঞানগম্ভীর, সংক্ষিপ্ত অথচ সম্পূর্ণ শ্লোক মুখে মুখে রচনা করতে পারে! কে ইনি–নিশ্চয়ই কোন ছদ্মবেশী মহাত্মা !

স্বামী প্রকাশানন্দের ইঙ্গিতে কয়েকজন মহাপ্রভুকে ধরে নিয়ে গেল ওনার সামনে। কুণ্ঠায় যেন সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছেন মহাপ্রভু! সাধু এবং জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও ওরকম করে ধুলোয় বসে নিচজাতির কাজ পাদুকা পরিষ্কার করার কি কারণ জানতে চাইলে মহাপ্রভু বললেন—এখানে অনেক জ্ঞানী-গুণী, মহাপণ্ডিতের আগমন ঘটেছে, তাঁদের চরণধূলি পাওয়া, তাঁদের একটু সেবা করাতো মহাভাগ্যের কাজ! তাই তিনি ধুলােয় বসে তাঁদের চরণধূলির স্পর্শ নিচ্ছিলেন আর পাদুকা পরিষ্কার করে তিনি এ সমস্ত মহাজনেদের সামান্য একটু সেবা করছিলেন। এবার তাঁরা মহাপ্রভুকে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, তিনি বঙ্গদেশের লোক। তাই তাঁরা তাঁর কাছে বেদান্ত-সূত্রের একটা মীমাংসা জানতে চাইলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল—যেহেতু লােকটি পণ্ডিত, অতএব নিমাই পণ্ডিতের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে এখানকার অন্য পণ্ডিতদের কতটা পারদর্শিতা তা জানা দরকার বা ইনি যদি প্রকৃত পণ্ডিত হন, তাহলে একেও সঙ্গে পাওয়া যাবে–তাই এই পরীক্ষা। মহাপ্রভু উত্তরে ঐ বেদান্ত-সূত্রের উপরে কৃত ব্যাসদেব, শুকদেব, শ্রীধরাচার্য, শংকর সকলের ভাষ্য টীকাসহ একে একে বলে যেতে লাগলেন। আর সবার শেষে ঐ সূত্রটির যুগােপযােগী নিজস্ব ব্যাখ্যা সুললিত-সংস্কৃতে ঝরঝর করে বলে গেলেন। পণ্ডিতসমাজের মুখে আর কথা নেই, সকলেই হতবাক–একজন সামান্য ব্যক্তির এত জ্ঞান! কিন্তু ভুল করলেন না স্বামী প্রকাশানন্দ–উনি মহামণ্ডলেশ্বরের আসন থেকে নেমে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মহাপ্রভুকে–ভক্ত চিনতে পেরেছেন ভগবানকে, ভক্ত-ভগবানের মিলন হােল! প্রকাশানন্দ ঘোষণা করলেন এরপর থেকে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনার স্পর্ধা যেন কেউ না দেখায়!

দেখলে তাে পরম-বৈষ্ণবের আচরণ ! ভিতরে অনন্তজ্ঞানের প্রবাহ, বাইরে দীনতা, ক্ষমা, সেবা ও করুণা_ ভগবান নিজে আচরণ করে শেখালেন। একজন শক্তিমান ব্যক্তি যদি অহিংসক, ক্ষমাশীল হ’ন তবেই তিনি সংযমী, তবেই তাঁর শক্তির সার্থকতা। অন্যথায় একজন হীনবল ব্যক্তির অপরের সাথে না লড়তে পেরে ক্ষমা দেখানাে তাে দুর্বলতা বা কাপুরুষতা !

সুতরাং জানবে, কোন মহাপুরুষ বা অবতাররূপে ভগবানই যুগে যুগে লীলা করে যান । স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী বিভিন্ন মত সৃষ্টি করেন বা বিভিন্ন আচার পালনের নির্দেশ দেন—একে “যুগধর্ম” বলা হয়। যা সত্য, তা শাশ্বত—চিরন্তন! কিন্তু মানুষ দুর্বলতাহেতু সত্যের সন্ধান সহজে পায় না। তাই যুগপুরুষরা এসে যুগধর্ম প্রবর্তন করেন। সমকালীন মানুষ তাকে গ্রহণ করলে এবং জীবনে তা যােজনা করলে সুফল পায়—তারআধ্যাত্মিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়—এটাই উপনিষদের চরৈবেতি।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা অনুসরন করে বলা যায়—সুলতানী আমলের মুদ্রা বাদশাহী আমলে ছিল না, আবার দেখাে বাদশাহী আমলের মুদ্রা নবাবী আমলে চলেনি–এইভাবেই তাে চলে আসছে। পুরাতনকে আঁকড়ে থাকাটা জাড্যতা, এটা তামসিকতার লক্ষণ। যে ধর্মমত এইভাবে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছে তা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছে, তারপর একদিন পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়েছে। গতিশীলতাই জীবন যা সদা-সর্বদা এগিয়ে চলে।

চরৈবেতি-চরৈবেতি।

যাইহােক, তােমরা আর ভুল কোরােনা, হাল আমলের মুদ্রা ব্যবহার করতে শুরু করো–নিজ নিজ স্বভাব অনুযায়ী সদগুরু যে বিধান দিয়েছেন সেইটা অবলম্বন করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলাে। তাহলেই দেখবে ছােট্ট ছােট্ট পায়ে চলতে চলতে—একদিন ঠিক পৌছে গেছ পরম লক্ষ্যে। তােমাদের ভয় কি—ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তােমাদের সহায় !