স্থান ~ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন । সময় ~ আগষ্ট, ১৯৯o । উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ স্বরূপানন্দ মহারাজ, নগেন ও আশ্রমস্থ ভক্তগণ ৷

জিজ্ঞাসু :– বুদ্ধি আর বিবেকযুক্ত বুদ্ধি এ- দুটোর পার্থক্যটা কি?

গুরুমহারাজ :— একটু আগে বলছিলাম – Head, Heart and Muscle অর্থাৎ শরীর, হৃদয় এবং মস্তিষ্ক এই তিনটির complete manifestation-ই পূর্ণতা। ভগবান যখন শরীরধারণ করেন তখন তাঁর মধ্যে এই তিনটিরই complete manifestation দেখা যায়। অপরপক্ষে, যারা সাধক তারা এইগুলির manifestation-এর চেষ্টা করেচলেছেন। এবার যদি কোন সাধকের মস্তিষ্কের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটে, তাহলে তিনি হবেন বিবেকপরায়ণ, তেমনি হৃদয়ের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটলে তিনি হবেন হৃদয়পরায়ণ এবং কারো শরীরের পরিপূর্ণ বিকাশের ফলে তিনি হবেন সেবাপরায়ণ।

সাধারণ মানুষ শরীর দিয়ে কি করে – আহার-নিদ্রা-মৈথুনাদি বা কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য সংসারের যাবতীয় কাজ_এইসব‌ই করে থাকে! কিন্তু কর্মযোগী কি এসব নিয়ে থাকবে? তাঁর শরীর জীবসেবায়-মানবকল্যানমূলক কাজ করতে করতেই পাত হয়ে যাওয়া উচিত। তাহলেই সেই কর্মযোগী দৃষ্টান্ত হয়ে যাবে। এরকমটা কোথাও হলে জানবে ঈশ্বর স্বয়ং তাঁকে বরণ করে নেবেন ! ইন্দ্রিয়-সেবার জন্য মরজগতে আর তাঁকে শরীর নিতে হবে না! শরীরধারণ হলেও ঈশ্বরেচ্ছায় হবে – তাঁর দ্বারা ঈশ্বরেরই কাজ হবে।

ভগবান বুদ্ধ বলেছিলেন “আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ।” – হয় আত্মসাক্ষাৎকারের চেষ্টায় একান্তভাবে ব্রতী হও অথবা জগতের হিতে প্রাণপাত করো – জগৎকল্যাণ করো। দুরকম পথেরই ফল এক, শুধু taste আলাদা। বৌদ্ধদের মতে এটাই “বোধিসত্ত্ব” এবং “বুদ্ধ” অবস্থা।

এবার জিজ্ঞাসা হতে পারে – কোন্ বুদ্ধি বিবেকচালিত হবে? – না, যে বুদ্ধি তোমাকে আত্মমোক্ষার্থের পথে চালনা করবে অথবা স্বার্থপরতা বিসর্জন দিয়ে জগৎকল্যাণে ব্রতী করবে – সেটাই বিবেকযুক্ত বুদ্ধি। একে শাস্ত্রে ধর্মবুদ্ধিও বলা হয়েছে। সাধারণ মানুষের বিবেক কোথায়? বিবেককে উপেক্ষা করেই বুদ্ধির প্রয়োগ ঘটানো হয়, বিবেক কাঁদছে। যে কোন সমাজের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো – এমনকি গোটা বিশ্বে বিবেকবান মানুষের সংখ্যা খুবই কম। তাইতো বর্তমান বিশ্বের এই দুরবস্থা! বিবেকচালিত বুদ্ধির প্রয়োগ হোক সমাজে – সদসদ্ বিচার করে সৎকে গ্রহণ করাই বিবেকের কাজ। বড় বড় দেশের বড় বড় নেতারা কি হৃদয়হীন – কি বিবেকবর্জিত বুদ্ধির প্রয়োগ করে চলেছে! গোটা বিশ্বে হানাহানি-মারামারি, হিংসার বীজ ছড়িয়ে পড়েছে। বিবেকের জাগরণ অথবা হৃদয়ে প্রেম জাগরিত না হলে মানবকল্যাণ-সমাজকল্যাণ-জগৎকল্যাণ বা জীবজগতের সেবা – কোনটাই করা সম্ভব হয় না। আর প্রেমহীন হৃদয়ে তা করতে যাওয়াটা নিতান্তই আহাম্মকির কাজ !

সমাজসেবা মূলক profession-গুলোর দিকে তাকিয়ে দ্যাখোকি করুন অবস্থা! ডাক্তারী profession-কেই দ্যাখো না_জীবসেবা বা মানুষের সেবা করার এটাতো একটা অন্যতম ভালো মাধ্যম ! পাশ করার পর ডাক্তার বা নার্সরা সার্টিফিকেট নেবার সময় নানান অঙ্গীকার করে, তাদেরকে দিয়ে নানারকম শপথবাক্য পাঠ করানো হয় – কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এসে এদের বেশিরভাগই সাধারণ duty-টুকুও করেনা। যেটুকু করে_ চাকুরীর ক্ষেত্রে উপরওয়ালার চাপে, সাংগঠনিক চাপে অথবা বাড়তি পয়সার বিনিময়ে – হতশ্রদ্ধার সঙ্গে করে। তাছাড়া রোগীদের সঙ্গে তারা যে ব্যবহার করে তাকে আর যাই বলা হোক _একে “সেবা” বলা যায় না। নিঃস্বার্থ সেবা তিনিই করতে পারেন যাঁর হৃদয়ের বিকাশ ঘটেছে অর্থাৎ যিনি হৃদয়বান।

এই যে স্বরূপানন্দ, ও যে কাজ করছে – এর দ্বারাও সেবা হচ্ছে। সৎ-গ্রন্থ পাঠ করা বা শোনার মধ্যে দিয়ে মানুষের চেতনার উত্তরণ ঘটে, ফলে ও যে ‘চরৈবেতি’ পত্রিকা প্রকাশ করে চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, এতে মানুষের কল্যাণ হচ্ছে। তাই এ কার্য সেবাকার্য হয়ে যাচ্ছে। এতে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মীই এই সেবাযজ্ঞের অংশীদার হয়ে যাচ্ছে।

তবে এটা জেনে রাখবে প্রকৃতপক্ষে যাঁর মধ্যে Head, Heart and Muscle – এই তিনটির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে তিনিই পূর্ণ -তিনিই বাউল! তাঁর সবকিছুই dynamic! বিবেক – dynamic, প্রেম – dynamic, সেবা -dynamic, অর্থাৎ তিনি যখন যে অবস্থায় বা যে অবস্থানেই থাকুন না কেন, সব সময় তাঁর দ্বারা জগৎকল্যাণ হয়ে চলে! স্বামী বিবেকানন্দের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো_ কেমন dynamic ! এক ঝটকায় গোটা পৃথিবীকে কয়েক century এগিয়ে দিয়ে গেলেন! ঈশ্বরের শক্তিই এইসব শরীরকে ঘিরে লীলা করে থাকে। আর তাঁদের যা কিছু কর্ম – সবই লোকশিক্ষার জন্য। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই স্বামীজীকে দেশে-বিদেশে নানান কাজ করতে হয়েছিল, যাতে তিনি মনুষ্য সমাজের আদর্শ হয়ে ওঠেন – পরবর্তীকালের বহু মানুষ তাঁকে অনুসরণ করে যাতে এগিয়ে যেতে পারে – যাতে তারা তাদের চেতনায় উত্তরণ ঘটাতে পারে! বর্তমানের যুবকদের স্বামী বিবেকানন্দই আদর্শ হোক – তাতেই তাদের তথা বর্তমান সমাজের বা বিশ্বের প্রকৃত কল্যাণ হবে।

জিজ্ঞাসা :— বর্তমানের যুবকরা তো ইউরোপ বা আমেরিকার প্রভাবে খানিকটা বিপথে চালিত হচ্ছে বা বলা যায় তাদেরকে চালিত করা হচ্ছে। অনেক অভিভাবক বা শিক্ষকরাও তাদেরকে অনৈতিক শিক্ষা দিচ্ছেন, কারণ তাঁরাও পাশ্চাত্য প্রভাবের শিকার — এ ব্যাপারে আপনি আমাদেরকে কিছু বলুন?

গুরুমহারাজ:— হ্যাঁ — ঠিকই বলেছ, শহরাঞ্চলগুলোতেই এই প্রভাব বেশি করে পড়েছে, পরে পরে এইগুলি মফস্বল বা গ্রামে-গঞ্জেও বিস্তার লাভ করছে। তবে জানো, এসবের পিছনে রয়েছে সুগভীর ষড়যন্ত্র! ভারতবর্ষের যে আর্যচিন্তা তার প্রভাব এত গভীর যে, এই জাতিটা হাজার হাজার বছর ধরে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, অত্যাচার, অভাব সহ্য করে আজও টিকে আছে! তার ঐতিহ্য — তার সংস্কৃতি আজও অম্লান আছে__এটা সমগ্র বিশ্বের কাছে একটা বিস্ময়! এবার বিশ্বের তাবড় তাবড় শক্তিশালী ধনী দেশগুলির ঐতিহ্য আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা কিন্তু সকলেই চায় সবাই তার মতো হোক। কিন্তু ভারতবাসীর অস্থিতে-মজ্জায় সুপ্রাচীন আর্য-ভাবধারা রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে রয়েছে। অতএব ‘বেনো জল ঢুকিয়ে সাবেক জল বের করা’ — বলে একটা কথা আছে — সেই চেষ্টা চলছে। হিপি কালচার, Disco কালচার, শিল্প-সাহিত্যে অশ্লীলতা ও যৌনতার যথেচ্ছ ব্যবহার, বিভিন্ন বিদেশী দর্শন (Philosophy) ঢোকানো, সেই সঙ্গে ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃতিগুলির খারাপ দিক নিয়ে আলোচনা — সেই সম্বন্ধে প্রচার বা বিভিন্ন সংগঠনের এগুলির বিরুদ্ধে যুক্তিস্থাপন করা, ছাত্র-সমাজের মধ্যে অনৈতিকতা ও রাজনীতি ঢোকানো, ভারতীয় ইতিহাস — ভারতীয় ঐতিহ্যকে পাঠ্যক্রমে না রেখে বিদেশীদের ইতিহাস, বিদেশী সাহিত্য বা দর্শন পড়ানো — এ সবই এই চক্রান্তের সামিল!

 আমিও শুনেছি কলকাতার ভালো ভালো স্কুলে ছাত্রদের শেখানো হয় বীর্যধারণ করা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক_মাঝে মাঝে বীর্য্যস্খালন করা ভালো_ ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ দ্যাখো_ভারতীয় ঋষিরা ব্রহ্মচর্যকেই ছাত্রদের জীবনে একান্ত আবশ্যক বলে গেছেন এবং এটাই বিজ্ঞানসম্মত। সংযম বা ব্রহ্মচর্যসাধন ছাড়া কখনও কোন কলকাতার বড় স্কুল একটা শুকদেব, একটা স্বামী বিবেকানন্দ কি দিতে পারবে? মেডিক্যাল কলেজ বা ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের হোস্টেলে যারা বাস করে তাদের কি অবস্থা! Drug addicted হচ্ছে, সমকামিতা বাড়ছে, মেরুদণ্ডহীন — হাই-পাওয়ারের চশমাপরা ছেলেরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না — এরা করবে সমাজ উদ্ধার — দেশ উদ্ধার!

ব্রহ্মচর্যই ছাত্রজীবনের বুনিয়াদ। সকল পিতামাতাকে তাদের সন্তানদের এই শিক্ষাই দিতে হবে। এর ফলেই সন্তানদের সুস্বাস্থ্য হবেএবং তাদের সৎচরিত্র গড়ে উঠবে — আর এমনটা হোলে তবেই তারও মঙ্গল এবং সমাজেরও মঙ্গলসাধিত হবে। যে সমস্ত ছাত্ররা অনৈতিকতার কবলে পড়ে গেছে, তাদের জীবন-যাপন প্রণালীর পরিবর্তন করতে হবে। আহার-বিহারে তাদের সংযত হতে হবে। বাজে সঙ্গ, বাজে আলোচনা ও চিন্তা যথাসম্ভব পরিহার করে সৎ ও জীবনমুখী আলোচনা ও সৎ গ্রন্থপাঠের সঙ্গে যোগাসন অভ্যাস করতেহবে। বিশেষ করে সময় পেলে স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী পড়বে বা অন্যান্য মহাপুরুষের রচনা বা জীবনী পড়বে। যদি কোন সৎ মহাপুরুষের সান্নিধ্য পাওয়া যায় তাহলে খুব করে তাঁর সঙ্গ করবে। যদি বল — কে সৎ ,তার চিনব কি করে? তাহলে আমি বলব যাঁর সঙ্গ করলে তোমার মধ্যে সৎ-ভাবনা, সৎ-বুদ্ধি, সৎ-চিন্তার স্ফুরণ ঘটবে — তিনিই সৎ-ব্যক্তি বলে চিহ্নিত হবেন — আর তা না হয়ে যদি বিপরীতক্রম হয়, তাহলে সেই সঙ্গ বর্জন করবে।

তবে, তোমরা চিন্তা করোনা_ মহাপুরুষদের দৃষ্টিগোচরে এসব ব্যাপার রয়েছে। তাঁরা এর প্রতিবিধানের চেষ্টাও করছেন, ফলে আগামী দিনে দেখবে ভারতবর্ষ আবার তার স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে — আর তা দাঁড়াবে যুবকদের কাঁধে ভর করেই।