স্থান ~ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন ।

জিজ্ঞাসু:– “স্বামী পরমানন্দ’ এই নামটি বড় একটা পাওয়া যায় না। এই নামটি কি আপনার নিজেরই নেওয়া ?

গুরুমহারাজ :– সাধু সমাজের খবর তুই আর কতটুকু রাখিস ? ভারতবর্ষে ‘পরমানন্দ’ নামের অনেক সন্ন্যাসী রয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দের এক শিষ্য ছিলেন, যার নাম

ছিল স্বামী পরমানন্দ । আমি যখন ঋষিকেশে সন্ন্যাস নিতে যাই তখন ঐ অঞ্চলে দুজন স্বামী পরমানন্দ নামের সন্ন্যাসী ছিলেন। ঐ অঞ্চলে ওনারা ‘ছােট পরমানন্দ’ এবং ‘বড় পরমানন্দ’ নামে পরিচিত ছিলেন। একজনের শরীর এত বিশাল ছিল যে_ তার হাত, বগল বা পায়ের ভাজগুলােয় চর্মরােগ হয়ে গিয়েছিল, কারণ ঐ অঞ্চলগুলি, এতো চর্বিযুক্ত ও মাংসল ছিল যে একটুও হাওয়া বাতাস পেতোনা। সবসময় চাপাচাপি করে থাকার জন্য‌ই এই অবস্থা! আর ওনার পেট-টা এত ঝুলে গিয়েছিল যে, তিনি যদি পরনে কিছু নাও পরতেন তাতেও নিম্নাঙ্গ দেখা যেতো না,তাই কোন অসুবিধাও হােতনা। আর অন্য যে একজনের কথা বলা হোলঐ পরমানন্দের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ ছিল। তবে আর এক পরমানন্দের সাথে আমার খুব প্রেমের সম্বন্ধ ছিল তিনি সিঙ্গুরের কাছে বলরামবাটিতে থাকতেন! অবশ্য তিনি মাঝে মাঝে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেও বেড়াতেন। ফলে বাংলার বাইরেও ওনার সঙ্গে আমার দেখা হোত।

    তবে, আজকে তােমাদের বহুকাল আগের একজন পরমানন্দ-র গল্প বলছি শােন। ইনি পৌরাণিক যুগের লােক ছিলেন। ভগবান বুদ্ধের আগমনের আগে ভারতবর্ষের সন্ন্যাসী পরম্পরা তেমনভাবে চালু ছিল না। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস এই চতুরাশ্রম অনুযায়ীই আধ্যাত্মিক মানুষেরা জীবন-যাপন করতেন। এদের মধ্যে অনেকেই অবশ্য গার্হস্থ্যজীবনে যেতেন না_গুরুর আশ্রমেই থেকে যেতেন। যাইহােক, আমরা যে পরমানন্দের কথা বলছি ইনি গার্হস্থ্যজীবন শেষ করে বানপ্রস্থ জীবন অবলম্বন করে _এক বনের ধারে আশ্রম তৈরী করেছিলেন। এবার ওনার কথায় আসার আগে গল্পের পটভূমিকাটা সেরে নিই।

একবার সপ্তঋষি প্রতিদিনের মতো মানস সরােবরে স্নান করতে গেছেন, গিয়ে দেখলেন যে_ এক পরমাসুন্দরী তরুণী অনাবৃত হয়ে পরম আনন্দে সেখানে স্নান করছেন! সাধারণত কোন সাধারণ রমণী সেই মনােহর সরােবরে স্নান করতে পারে না, তাই কোন অপ্সরী বা দেবকন্যাই হয়তো হবেন_ এই নিয়েই তাঁরাআলোচনা করতে লাগলেন। সেই রমণী কিন্তু প্রকৃতপক্ষেই একজন অপ্সরী ছিলেন। তার নাম ছিল চিত্রাঙ্গদা, তিনি শিবের অনুচরী ছিলেন। শিবকে প্রসন্ন করে তিনি স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের যে কোন স্থানে ভ্রমণের অধিকার পেয়েছিলেন। সেদিন মর্তে ভ্রমণকালে মানস সরােবরের সুন্দর শােভা দেখে তাঁর সেখানে স্নান করার প্রবৃত্তি জন্মে এবং তিনি স্নান করতে নামেন। কিন্তু স্নান করা হয়ে গেলে পাড়ে উঠতে গিয়ে তাঁর হঠাৎ নজরে পড়ে ৭ জন ঋষিকে, যাঁরা অবাক হয়ে তাকেই দেখছিলেন ! এটা দেখে চিত্রাঙ্গদা খুবই ক্রুদ্ধ হলেন_ যেহেতু এই ৭ জন পুরুষ অনাবৃত স্ত্রী-অঙ্গ কৌতুকভরে দেখেছেন, যা শুধু মানুষেরই ন্যায় আচরণ [কারণ মনুষ্যেতর বা ঊর্ধ্বমানসচেতনার প্রাণীরা অনাবৃত স্ত্রী অঙ্গ দেখে আনন্দ পায়না, তাই তাদের এ ব্যাপারে কোন আকর্ষণও থাকে না] তাই তিনি অভিশাপ দিলেন যে, এঁরা যেই হোন না কেন, তাঁদের আবার মানুষ হয়ে জন্মাতে হবে ।

  ঋষিরা তাে আর সত্যি সত্যিই ওসব দেখেননি – তাঁরা অবাক হয়েছিলেন এই ভেবে যে, এখানে একাকিনী রমণী এল কি করে, তাছাড়া ইনি কে ? কিন্তু শিব-অনুচরীর অভিশাপ মিথ্যা হবার নয় _আবার এঁরাও ঋষি, সমস্ত সিদ্ধি এদের করায়ত্ত, সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে এঁরা! এঁদেরকে অভিশাপ দিলে তা ফিরে__ যে দিয়েছে তারই উপর বর্তাবে। এই ঘটনাটি আচমকাই ঘটে গেছিল কিন্তু ঘটনাটা ছিল মারাত্মক এবং তা নিয়ে স্বর্গে দেবসমাজে তুমুল সরগােল পড়ে গেল! ঋষিরা যদি ক্রুদ্ধ হন তাহলেও সর্বনাশ, আবার চিত্রাঙ্গদা শিব-অনুচরী _তাঁর অভিশাপ‌ও বলবেই! এবার এই অভিশাপে ঋষিদের যদি মনুষ্যজন্ম হয়, তাহলে কে তাঁদের ভার নেবে ? অবশেষে শিবকে মধ্যস্থতা করে একটা সিদ্ধান্ত হল যে, ঋষিরা মর্তে শরীর নেবে এবং তাঁদের ভার নেবার জন্য দেবগুরু বৃহস্পতি "পরমানন্দ" নাম নিয়ে ব্রাহ্মণ পরিবারে আগেই শরীর ধারণ করবে। এদিকে যাঁদেরকে নিয়ে এতো কান্ড, তাঁরা যখন সব জানতে পারলেন তখন তাঁরা শুধু শর্ত রেখেছিলেন যে চিত্রাঙ্গদাকেও মর্তে জন্মাতে হবে এবং তাঁদের যখন সেখানে আবার দেখা হবে, তাঁদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে__ তখন সকলেই অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে।  ঋষিরা অবশ্য চিত্রাঙ্গদাকে সেভাবে কোন অভিশাপ দেননি, তবু তাকে মর্তে জন্মগ্রহণ করতেই হবে_তাই সেদিন দেবসভায় এক বিশেষ ঘটনা ঘটানো হ’ল । নৃত্যসভার আয়ােজন করে ডাক পড়ল চিত্রাঙ্গদার। সেই আসরে স্বয়ং শিবও উপস্থিত। নৃত্যকলায় পটিয়সী চিত্রাঙ্গদা অসাধারণ নৈপুণ্যে নৃত্য পরিবেশন করতে শুরু করেছেন, হঠাৎ সেখানে দেবরাজপুত্র জয়ন্ত এসে হাজির। অপরূপ রূপলাবণ্যসম্পন্ন জয়ন্তকে দেখেই নৃত্যরত চিত্রাঙ্গদা তার প্রতি আকৃষ্ট হলেন। দেবতাদের নির্দেশে মদনদেব এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছিল। জয়ন্তও চিত্রাঙ্গদার ইঙ্গিতকে স্বীকার করলেন ইঙ্গিতেই। শিব এসব দেখে রেগে আগুন! তিনি দুজনকেই অভিশাপ দিলেন ‘তােমরা মনুষ্যোচিত আচরণ করেছ, যাও _মর্তে গিয়ে এক জন্ম মানুষের ন্যায় আচরণ করে এস।' ব্যস্ এইভাবেই সমস্ত ঘটনা ঘটে গেল ! দেব গুরু বৃহস্পতি_ পরমানন্দ নাম নিয়ে মর্তে শরীর নিয়ে আচার্য্য হয়ে গেলেন। ৭ জন ঋষি মর্তে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে শরীর নিয়ে _কৈশােরেই পিতা-মাতাকে হারিয়ে অনাথ হয়ে গেল । এদের বুদ্ধি থাকলে মুস্কিল হোত ,কারণ _এদের সকলেরই তাে অষ্টসিদ্ধি বর্তমান, তাই সাধারণ শরীর হোলে জগতের অনেক নিয়ম বেনিয়ম হয়ে যেতে পারে। যাইহােক, এদিকে চিত্রাঙ্গদা জন্মাল এক নটীর ঘরে _আর জয়ন্ত রাজপুত্ররূপে,হিমালয় সংলগ্ন একটি রাজ্যে!

কালের নিয়মে ৭ জন জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ভাই পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে একদিন পরমানন্দের কুটীরে এসে হাজির! তাদের এখানেই ঠাঁই ও পাকা হয়ে গেল। পরমানন্দ তাে সবই জানেন কিন্তু মুস্কিল হ’ল ব্রাহ্মণীকে নিয়ে! ব্রাহ্মণী দিন দিন এই ৭ জনের নির্বুদ্ধিতায় অতিষ্ঠ হয়ে চেঁচামেচি করতেন, তাছাড়া এরা খেতেও পারতাে খুব আর কিছুদিনের মধ্যে সবার চেহারা বিশাল হয়ে গেল আর গায়ের জোরও হ’ল তেমনি ! আচার্য পরমানন্দের শত চেষ্টাতেও তাদের বুদ্ধিবৃত্তির বিশেষ কোন পরিবর্তন হলনা, শিশুর মতাে সরল আর অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন হয়েই রইল। কিন্তু মজাটা হোল এই যে, এই ছেলেগুলি আসার পর থেকেই আশ্রমেররােজগার বাড়ল—ওদের মতাে খাইয়েদের অন্নসংস্থান করার পরও গৃহিণীর হাতে কিছু পয়সা জমতে লাগল। কি কারণে এসব হচ্ছে তা ব্রাহ্মণ সবই বুঝলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণী বুঝতে চাইতেন না। এরপর যে ঘটনাগুলি ঘটল তাতে করে ব্রাহ্মণীর পক্ষে আর কষ্টসহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ল।

 একদিনকার ঘটনা বলছি! পরমানন্দের আশ্রমে গাভীটি মারা গেছে । তিনিও বৃদ্ধ হয়েছেন। তখন ছেলেগুলিও বড় হয়েছে এবং তারা এখন অনেক কথাই বুঝতে পারে । এই ভেবে তিনি ওদেরকে ডেকে ভাল করে বুঝিয়ে বলে দিলেন যে, হাটে গিয়ে একটা ভাল গাভী কিনে আনতে। তিনি আরও বলে দিলেন ভাল গাভী যদি ওরা বুঝতে না পারে তাহলে পাঁচজনে যেটাকে ভাল বলবে বা বেশী দুধের গাভী বলবে __সেইটা যেন কিনে আনে! এই বলে তিনি দড়ি ও কিছু মুদ্রা ছেলেদের দিয়ে হাটে পাঠিয়ে দিলেন। ব্রাহ্মণীর এতে খুবই আপত্তি ছিল কিন্তু ব্রাহ্মণ একপ্রকারে জোর করেই পাঠিয়ে দিল তাদের। এদিকে ঐ সাতজন ছেলেরা পশুর হাটে যাবার পথে এক জায়গায় দেখল অনেক মানুষের জটলা__ সেখানে গ্রামের একটি দুগ্ধবতী গাভী মারা গেছে, সকলে মিলে সেটাকে ভাগাড়ে ফেলতে এসেছে। মালিক হা-হুতাশ করছে আর বলছে আমার ভাল গাভীটা মারা গেল, সে অনেক দুধ দিতো--ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও পাঁচজনে বলাবলি করছে—হ্যাঁ,হ্যাঁ গাভীটা ভাল ছিল, অনেক দুধ দিতো। ছেলেরা একথা শুনেই ভাবল গুরুদেব বলে দিয়েছে পাঁচজনে যে গাভীকে ভাল বলবে সেটাই কিনতে, অতএব এই গাভীটিকেই কিনতে হবে! ওরা লােকগুলিকে অবাক করে দিয়ে গুরুদেব যা টাকা দিয়েছিলেন তা ওদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁশে বেঁধে মৃত গাভীটিকে কাঁধে করে নিয়ে এসে গুরুদেবের আশ্রমে ধড়াস করে ফেলে দিল। মরা-গরু দেখে আর টাকাটার শ্রাদ্ধ হয়েছে জেনে ব্রাহ্মণী হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ব্রাহ্মণ নানাভাবে বােঝানোর চেষ্টা করেও কিছুতেই বােঝাতে পারছিলেন না। অবশেষে রফা হ’ল যতদিন না টাকা শােধ হয় ছেলেগুলির খাওয়া বন্ধ! ছেলেদেরকে ব্রাহ্মণী জোর করে ঘরে পুরে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিল। এদিকে অত ভারী গাভীকে কাঁধে করে অতটা রাস্তা বয়ে এনেছে, ফলে ওরা সকলে ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে ছিল। ওরা ঘরে বসে বাচ্ছা ছেলের মতাে সুর করে কাঁদতে লাগল “ওমা খেতে দাও”, “ওমা দরজা খােল" । দরজা খােলেনা দেখে সবাই মিলে দরজায় ধাক্কা মারতে লাগল। এদিকে হয়েছে কি ওদের মধ্যে তাে সিদ্ধি রয়েছে—ওদের জন্য টাকা নষ্ট হয়েছে _এটা ওরা বুঝতে পেরে অন্তরে কষ্ট পাচ্ছিল _আর তাতেই টাকার একটা ব্যবস্থাও হয়ে গেল! কিভাবে হোল সেটা বলছি__পরমানন্দ যে আশ্রমটায় থাকতেন ওটা কোন সময়, কোন রাজা তার রাজগুরুর সাধন-ভজনের জন্য নির্মাণ করেছিলেন। নির্মাণ সম্পন্ন হলে রাজা গুরুকে জানিয়ে চুপিসারে একটি কলসে কিছু স্বর্ণমুদ্রা দরজার মাথায় দেওয়ালের মধ্যে রেখে_বাইরে থেকে গেঁথে দেওয়া করিয়েছিলেন। যদি কখনও প্রয়ােজন হয় তাহলে যেন গুরুদেব তা কাজে লাগাতে পারেন_এটাই তাঁর ইচ্ছা ছিল। কালক্রমে গুরুদেব শরীর ছেড়েছেন_বাকিরা হয়তো এইসব মুদ্রার কথা জানতোই না, আর যদিও কেউ জানতো _সে সঠিক অবস্থানের কথা ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু যণ্ডামার্কা সাতজনের ধাক্কাধাক্কিতে দরজার চৌকাঠ প্রবলভাবে নড়তে নড়তে ঐ গাঁথনীর মুখ খুলে ঝনঝন করে স্বর্ণমুদ্রা পড়তে লাগল ! ঐ কাণ্ড দেখে তাে ব্রাহ্মণীর চক্ষু চরকগাছ। পরমানন্দ ব্রাহ্মণীকে বললেন “দেখলে তাে আমি বরাবরই বলি ওদেরকে বােকোনা ওরা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করবে !” টাকা দেখে ব্রাহ্মণী চুপ করলেও বলে রাখলেন_ এরপর যদি কোন অন্যায় ওরা করে তাহলে হয় উনি থাকবেন নয় ওরা থাকবে।

     কিছুদিন আর কোন ঘটনা ঘটল না। গুরুদেবের কন্যা বিবাহােপযুক্ত হয়েছিল, ফলে পাত্রপক্ষের কিছু লােকজন সেদিন আসার কথা ছিল। সকালেই গুরুদেব তাই ছেলেদের ডেকে বললেন, “আজ কিছু অতিথি আসবেন, তাই বাড়ীঘর-উঠান সমস্তকিছু পরিচ্ছন্ন করে রাখবে—আর তােমরাও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে।" এই বলে গুরুদেব স্নানের উদ্দেশে বেরিয়ে গেলেন। গুরুমাও কোন কাজে আশ্রমের বাইরে গিয়েছিলেন। ছেলেরা মহা-উৎসাহে আশ্রম প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করছিল। ঝাঁটা-বালতি নিয়ে আশ্রমের সবকিছুই ঝাড়া-মােছা-ধােওয়ার কাজ ভালই চলছিল। এমন সময়েই ঘটল বিপত্তি !

পাত্রপক্ষের লােকেরা তাে সেই সময়েই এসে হাজির । আর যায় কোথায়—সাতজন ছেলেরা তখন ওদেরও ধরে ধােলাই করতে শুরু করে দিল। অতিথিরা পরিত্রাহি করে চেঁচাচ্ছে আর ছাড়া পাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু মােষের মত শক্তিশালী ছেলেদের সঙ্গে পারবে কেন ? তারা মনের মতো ধােলাই করে ছেড়ে দেওয়া মাত্রই পাত্রপক্ষের দল দে দৌড়!

খানিকপরই গুরুদেব ফিরে এলেন, ফিরে এলেন গুরুমাও। প্রতিবেশীদের মুখে সব কথা শুনে গুরুদেব খুবই দুঃখিত হলেন—গুরুমাও প্রচণ্ড কান্নাকাটি করতে লাগলেন। রাগের চোটে তিনি জিদ ধরে বসে রইলেন যে, যতক্ষণ না ঐ সাতজন ছেলে আশ্রম থেকে চলে যায় ততক্ষণ তিনি আর ঘরে ঢুকবেন না। পরমানন্দ অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গুরুমাকে নিয়ে গেলেন। ফলে এ যাত্রায়ও ছেলেরা রক্ষা পেল। কিন্তু এই ঘটনা তাদের মনে গভীর রেখাপাত করল। তারা ভাবতে লাগল তাদের বােকামির জন্য গুরুদেব – গুরুমা কত কষ্ট পান, অথচ গুরুদেব তাদের কত ভালবাসেন, তাদের জন্য গুরুমার কাছে বা অন্যদের কাছে কত ছােট হন, তবুও তিনি তাদেরকে তাড়িয়ে দেন না বা মারধর করেন না। এসবকিছুর বিনিময়ে তারা যখন কিছু করতেই পারে না তখন আর বেঁচে থেকে লাভ কি ! তারা স্থির করল যে, তাদের মরে যাওয়ায় ভাল। কিন্তু কিভাবে মরতে হয় তা তাদের জানা নেই, তাহলে উপায় ! তখন তারা স্থির করল কিভাবে মরা যায় সেটা যতদিন না জানা যাচ্ছে ততদিন চুপচাপ থাকাই উচিত ।

এইভাবে দিন কাটতে লাগল। একদিন গুরুমা ঠাকুরের প্রসাদের জন্য এবং অতিথি অভ্যাগতদের দেবার জন্য‌_ নিজের হাতে কিছু নাড়ু তৈরী করছিলেন! তিনি দেখলেন ছেলেরা লােলুপ দৃষ্টিতে সেই দিকেই চেয়ে রয়েছে, গুরুমা বুঝলেন _এই নাড়ু তৈরী করে যেখানেই রাখা হােক না কেন, ওরা নিমেষের মধ্যে তা খেয়ে নেবে। তাই তিনি ওগুলি বানাতে-বানাতেই ওদেরকে বললেন, “দ্যাখাে, এই বিষ-নাড়ু তৈরি করছি, যেদিন তােমরা আবার কোন বােকামি করবে, এইগুলাে তােমাদের খাওয়াবাে। আর জানােতো, বিষনাড়ু খেলেই তােমরা মরে যাবে। এইগুলাে ঘরে রাখছি, দেখাে, যেন এমনি এমনি খেয়াে না, তাহলে আর বাঁচবে না।”

ছেলেরা তাে হাতে চাঁদ পেল – এ-ওর দিকে একবার চোখাচোখি করে নিয়েই দে ছুট! গুরুমা ভাবলেন যা বাঁচা গেল—আপদগুলাে ভয় পেয়ে পালিয়েছে। কিন্তু বাইরে গিয়ে ওদের কি স্ফুর্তি! সবাই মিলে হৈ হৈ করছে, হাসছে, লাফ মারছে যাক্ তাহলে এবার মরার বিদ্যাটা জানা গেল ! ওদের মধ্যে যে বড়, সে সবাইকে ডেকে বলল- “শােন ভাই, গুরুমার নাড়ু খেলেই তাে আমরা মরব, কাজেই আমাদের আর কোন ঝামেলা নাই, আমাদের জন্য আর গুরুদেবকেও কষ্ট পেতে হবেনা, তাহলে চলো আজ রাত্রেই সবাই মিলে সব নাড়ুকটা চুরি করে খেয়ে নিই, আর সবাই মিলে মরে যাই।” পরামর্শ সবার বেশ মনােমত হোল । ফলে সেই রাত্রেই রান্নাঘরের দরজা খুলে নাড়ুর কৌটো চুরি করে ওর সাতজনে আশ্রম ছেড়ে গভীর জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। ওরা আশ্রম থেকে অনেকদূরে গিয়ে মরতে চাইল, কারণ ওরা মারা গেছে শুনলে গুরুদেব দুঃখ পাবেন। ওরা জানতাে এই পৃথিবীতে একমাত্র তিনিই ওদের ভালবাসেন। সেই কথা ভেবে জঙ্গলে ঢুকে একটা ঝরনার ধারে গাছতলায় বসে ওরা নাড়ুর কৌটো খুলল । তারপর সকলে মিলে ভাগ করে সেই নাড়ু খেয়ে–জল খেয়ে গাছতলায় শুয়ে পড়ল। রাত্রিকাল, ক্লান্ত শরীর, ফলে ঘুম আসতে দেরি হ’লনা। পরদিন ভােরে পাখির ডাকে ওদের ঘুম ভাঙল। রাত্রে জঙ্গল কেমন তা তারা দেখেনি, এখন দিনের আলোয় অপরিচিত জায়গা_ আর অন্ধকার-ঘন জঙ্গল দেখে ওরা ভাল মরে গিয়ে যমরাজার জঙ্গলে এসে হাজির হয়েছে! তাহলে জঙ্গল পার হয়ে যমরাজার সঙ্গে দেখা করতে হয়,–এই ভেবে ওরা জঙ্গল দাপিয়ে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে ওরা পরবর্তী রাজ্যের প্রান্তে এসে উপস্থিত হ’ল। সেখানকার নগরপাল ঐরকম সাতজন কালান্তক চেহারার মানুষকে জঙ্গল থেকে বীরদর্পে আসতে দেখে ভাবল এরা ডাকাত। ফলেতাদেরকে বেঁধে কারাগারে বন্দী করল এবং রাজাকে খবর দিল ।

এদিকে হয়েছে কি সেই রাজ্যের রাজাই তাে শাপগ্রস্ত দেবরাজপুত্র জয়ন্ত আর তার রাণীটিই হচ্ছে সে রাজ্যের বিখ্যাত নৃত্যগীত – পটিয়সী চিত্রাঙ্গদা। যার নাচগানে মুগ্ধ হয়ে সে রাজ্যের রাজা তাকে বিবাহ করেছিল। যাইহােক, এরা সাতজন বদ্ধ গারদে থাকতে পারছিল না। ফলে গারদের লােহার শিকল ভেঙে ওরা সেই রাত্রেই বাইরে চলে আসে বাইরে বেড়াতে বেড়াতে ওদের চোখে পড়ে একটা শিবমন্দির । মন্দিরের দরজা খুলে শিবলিঙ্গ দেখে ওদের আনন্দ আর ধরে না। কেউবা শিবকে জড়িয়ে ধরতে লাগল, কেউবা ডাল-পাতা-ফুল দিয়ে পুজো করতে লাগল, কেউবা জুড়ে দিল তাণ্ডবনৃত্য। এইসব করতেই ভাের হয়ে গেল ৷ এমন সময় রাজা ও রাণী মন্দিরে এসে উপস্থিত প্রাতঃপ্রণাম সারার জন্য। তাঁরা এসে ষন্ডামার্কা সাতজন লােকের ঐ উন্মাদ নৃত্য আর উল্লাস দেখে ভাবলেন হয়তাে এরা শিব-অনুচর নন্দী-ভৃঙ্গীর দল। ফলে তারা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ওদের অদ্ভুত কাণ্ড-কারখানা দেখতে লাগলেন। তারপর একটু সকাল হতেই রাজা-রাণী সামনে বেড়িয়ে এসে মন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়াতেই সাতজন ঋষির সঙ্গে ওদের চোখাচোখি হয়ে গেল। ব্যস্, সঙ্গে-সঙ্গেই ঋষিদের পূর্বকথা স্মরণ হয়ে গেল এবং শিবের বর অনুযায়ী ওদের শাপমুক্তি ঘটল। ফলে ওঁরা রাজা-রাণীকে আজীবন সুখে-সমৃদ্ধিতে রাজত্ব করার আশীর্বাদ দিয়ে ফিরে গেলেন হিমালয়ে। জয়ন্ত আর চিত্রাঙ্গদার যেহেতু কামনা-বাসনা ছিল তাই তারা সংসার-জীবনের মধ্যেই রয়ে গেলেন।

তাহলে, এই গল্প থেকে দেখা গেল ভাবনা-ইচ্ছা-ক্রিয়া, এই তিনটির মধ্যে ভাবনা যদি ইচ্ছায় রূপ নেয় তাহলে তা ক্রিয়াশীল হবেই। ইচ্ছাময়ী সকলের ইচ্ছাই পূর্ণ করেন। সেইজন্যই মহাপুরুষগণ চিত্তের বৃত্তি কমিয়ে আনার কথা বলেছেন। জীবের চিত্তহ্রদে নানারকম ঢেউ উঠছে, নানান এষণা, কামনা-বাসনা ইত্যাদি। এগুলো যেন চিত্তহ্রদে একটা একটা ঢিল ছুড়ে ছুড়ে তরঙ্গ সৃষ্টি করা হচ্ছে, ফলে কখনই এই হ্রদ শান্ত হচ্ছে না, আর জীবও নানান অশান্তির জ্বালায় জ্বলে মরছে, জন্ম-মৃত্যুর বিবর্তনে ঘুরছে। তারপর নিজেই ছুটে বেড়াচ্ছে শান্তির সন্ধানে। এ এক আহাম্মকি! এটাকেই অজ্ঞানতা বলা হয়েছে। জীবকে শান্তি পেতে গেলে চিত্ত-হ্রদকে শান্ত করতে হবে। কামনা-বাসনারূপ ঢিল ছােড়া বন্ধ করতে হবে। তাহলেই মানুষ শান্তির সন্ধান পাবে।

জিজ্ঞাসু:– শীতকালটা খুবই কষ্টের–এটা যত তাড়াতাড়ি চলে যায় ততই ভাল–তাই নয় কি গুরু মহারাজ ?

গুরু মহারাজ :– সে কি রে ! শীতকাল তাের ভাল লাগেনা ! অনেকের আবার শীতকালটা ই পছন্দের! এটা ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে_ জানিস! সাধারণতঃ দেখা যায়যার যে ঋতুতে জন্ম, তার সেই সময়ে শরীর-মন ভাল থাকে। দ্যাখ্ ভারতবর্ষে তো ন’মাস গরম আর দুই থেকে আড়াই মাস শীত। এটা তাে ভালোই! আমার তাে শীতকাল ভাল লাগে –অন্য সময় অপেক্ষা এই সময়ে আমি অধিক স্বচ্ছন্দ বােধ করি! গরমকালে ঘেমে শরীরের নাকাল অবস্থা, তারপর মশার উপদ্রব ! ও: সে এক অশান্তি, আর বনগাঁয়ের ছােট ছােট মশার তীব্র জ্বলুনি!

তবে তুই একদিকে ঠিকই বলেছিস, আমাদের দেশেতো গরীবের সংখ্যা অনেক—রাস্তাঘাটে, প্ল্যাটফর্মে বহু মানুষ বাস করে, তাদের সবার আশ্রয়ই নেই তো আবার শীতবস্ত্র কোথা থেকে পাবে ! সত্যিই তাদের খুবই কষ্ট হয় শীতকালে। কিন্তু যাদের বাড়ীঘর রয়েছে, উপযুক্ত শীতবস্ত্র রয়েছে, তাদের কাছে শীতকাল তো আরামদায়ক! এই সময় প্রচুর শাক-সবজি, vegetables-এর এত Variety তুই অন্য কোন Season-এ পাবিনা। তাছাড়া, এই সময় রাত বড়, ফলে খাদ্য হজম হতে সময় পায়, শরীরের বিশ্রামও বেশী হয়। শীতে জীবাণু সংক্রমণ কম তাই যে কোন জিনিসের পচন কম হয়, ফলে পাকস্থলী বা অন্ত্রে বেশীক্ষণ খাদ্য পরিপাক হতে সময় পায়। সুতরাং পয়সাওয়ালা লােকের কাছে শীত আরামদায়ক ঋতু! এই সময় নানারকম পার্বণেরব্যবস্থা এই জন্যই! গ্রামাঞ্চলে শীতকালে গৃহস্থের গােলাভর্তি ধান ওঠে—আর এই সময় মানুষের একটু কাজকর্মও কম থাকে, ফলে লােকে আয়েস করে একটু খাওয়াদাওয়া করে, পিকনিক, বনভােজন ইত্যাদি করার সুযোগ পায়।

 তবে এই সময় শরীর শ্রীহীন হয়ে যায়! শীতকে এই জন্যই দেখবি ‘বুড়াে শীত বলা হয়। যুবক-যুবতীও দেখবি শীতকালে কেমন যেন গুটিসুটি মেরে থাকে, আর শিশু এবং বৃদ্ধদের তাে কথাই নেই! এই সময়ে গােটা শরীর বস্ত্রে ঢাকা থাকে- ফলে শরীরে রোদ লাগে কম,ভাল করে স্নান করা হয়ে ওঠে না। এই জন্যই শীতকালে নানারকম চর্মরােগ হয়। আর মুখ-চোখ কালাে হয়ে যায় খানিকটা ময়লার জন্য, আর খানিকটা ঠাণ্ডায়। শরীরে রােদ লাগলে যেমন চামড়ার রঙের পরিবর্তন হয়, তেমনি অতিরিক্ত ঠাণ্ডাতেও শরীর কালো বা বিবর্ণ হয়। "বুড়োশীত"_ বলার অন্য অর্থও আছে! এই সময় প্রকৃতিও যেন উজ্জ্বলতা, চঞ্চলতা, গতিশীলতা হারিয়ে বসে। গাছ-পালায় নতুন কলি গজায় না, বাতাসের বেগ কমে যায়, নদী-নালাও যেন কেমন ধীরগতিতে প্রবহমান হতে থাকে। এই সময় ভালাে করে সূর্যও সবদিন ওঠে না। পাখিরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে গান করে না, বহু প্রাণীরা শীতের ভয়ে ঘুমে চলে যায়। এই ভাবে দেখা যায় প্রকৃতি যেন খানিকটা শ্লথ হয়ে যায়। তবে কিন্তু Season flower এই সময় অজস্র ফুল দিয়ে প্রকৃতির শােভা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করে।    

 যাইহােক, এরপর শীত কেটে যেই বসন্ত আসে _অমনি প্রকৃতি নতুন সাজে সেজে ওঠে! পুরােনাে পাতা ঝরে আবার নতুন কলি গজায়। পত্রে, পুষ্পে, পল্লবে নতুন সাজে সেজে ওঠে প্রকৃতি! মানুষের জীবনেও আসে পরিবর্তন। প্রকৃতপক্ষে শ্রীপঞ্চমীর (সরস্বতী পূজা) পর শীতের প্রকোপ একেবারেই কমে যায়। তাই দেখবি শ্রীপঞ্চমীর দিন নিম-হলুদ মাখতে হয়। অর্থাৎ এই দিন থেকে নিয়মিত নিম-হলুদ মেখে ভালভাবে স্নান করে শরীরের শ্রী ফিরিয়ে আনতে হয়। বসন্তকালে মানুষের শরীরে ও মনে এমনিতেই পরিবর্তন হয়—শরীরের লাবণ্য ফিরে আসে। এইজন্য কবিরা বসন্তকালের ফাল্গুনমাসকে মধুমাস বলেন। মানুষের মন এই সময় Romantic হয়ে যায়। কারণ প্রাকৃতিক নিয়মে বসন্তকাল মানুষের প্রজননকাল। খেয়াল করে দেখবি_বেশিরভাগ মহাপুরুষের গর্ভে আগমনকাল এই সময়। শীতকালে মানুষের উচিত নিয়মিত পিপুল খাওয়া আর বসন্তকালে মধুপান করা, এতে শরীরও ভালো থাকে আবার রোগব্যাধির হাত থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।