স্থান ~ বনগ্রাম, পরমানন্দ মিশন ৷ উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ কতিপয় বহিরাগত ভক্তসহ কয়েকজন মহারাজ ।
জিজ্ঞাসু:— সমাজে বর্তমানে যে ঈশ্বরবাদ বা আস্তিক্যবাদ চালু রয়েছে, এর দ্বারা এক শ্রেণীর মানুষ যথা–পুরােহিত, মােল্লা, যাজক, এমনকি সাধু-মহারাজরা পর্যন্ত মানুষকে ঠকিয়ে চলছে। তারা সাধারণের মাথায়হাত বুলিয়ে বেশ তাে দেখি বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছে। আমরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং বিজ্ঞানমনস্করা এইসব বুজরুকি কেন মেনে নেব ?
গুরুমহারাজ :— দেখুন, প্রথমেই আমার আপত্তি ঐ ‘বাদ’ কথাটার সম্পর্কেআপনিবললেন না “ঈশ্বরবাদ” ঐ কথাটা mean করতে চাইছি। দেখুন_কোন বাদ বা ismই ভাল নয়, কারণ আমরা সমাজ বিবর্তনের ইতিহাস পর্যালােচনা করে দেখেছি যে, সমাজে যে কোন বাদ বা ism-ই বিবাদ ডেকে আনে। আর তার ফলে সমাজে শুরু হয় সংঘাত, সংঘর্ষ, রক্তপাত। এইভাবেই সমাজের ভাল করতে চেয়ে মতবাদসমূহ মানুষের তথা সমাজের চরম সর্বনাশ করছে। তাই আস্তিক্যবাদ, ধর্মবাদ, ঈশ্বরবাদ–এই ধরণের শব্দগুলাে আপনাদের মতাে কিছু বুদ্ধিজীবী আজকাল ব্যবহার করছেন, কোন ধর্মীয় আচার্যগণ এইসব শব্দ কখনই ব্যবহার করেননি। যে কোন মতের ‘মতবাদ’ হয়। কিন্তু ধর্ম শাশ্বত, সনাতন, এটা কোন মত নয়। ঈশ্বর সত্য—এটাও কোন মত নয়, এগুলাে বােধ। তাই কোন ‘বাদ’ দিয়ে এই সকলের বােধ হতে পারে না। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘মতুয়ার বুদ্ধি ভাল নয়’! এইভাবেই দেখবেন কোন ধর্মবিজ্ঞানী কখনই কোন ‘মত’কে বা মতবাদকে গুরুত্ব দেননি। অনেক সময় উপস্থিত ব্যক্তিগণের চেতনার Level অনুযায়ী শিক্ষা দিতে গিয়ে হয়তাে কোন সময় তারা কোন হালকা শব্দ ব্যবহার করে ফেলেছেন—সেটা পরে আবার অন্যত্র সংশোধন বা পরিষ্কারও করে দিয়েছেন। সুতরাং ঈশ্বরবাদ, ধর্মবাদ—এসব কথা ঠিক নয়।
এবার আপনার জিজ্ঞাসার উত্তরে আসি, আপনি জানতে চাইছেন- মানুষ ঈশ্বরকে মানবে কেন ? আবার বলছেন—ধর্মগুরুরা মানুষকে শােষণ করে—ইত্যাদি। এর উত্তরে আসুন আমরা সমাজবিজ্ঞান পর্যালােচনা করি। দেখুন বহু প্রাচীনকাল থেকেই আমরা সমাজে দুটো ধারা রয়েছে দেখছে পাই। একদল আস্তিক, আর অন্যদল নাস্তিক। প্রাচীন ইতিহাস থেকে এও জানা যায় যে, ঐ দুই দলের মধ্যে বহুবার মারামারি করেছে, রক্তপাত ঘটেছে কিন্তু কেউই কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। কারণ আজও এই নিয়ে বিতর্ক চলছে যেমন আপনিই এখানে করছেন এরূপ আরও অন্যত্র চলছে! কিন্তু আমি বিতর্ককারী এই দুই দলকেই আহাম্মক বলি, কারণ একদল বলে ঈশ্বর আছে আর একদল বলে ঈশ্বর নেই! একদল বলে— বিশ্বাস করি, অন্যদল বলে–বিশ্বাস করিনা। দেখা যায় এরা আবার দল বিনিময়ও করে, অর্থাৎ কিছুলােক কিছুদিন ঈশ্বর-বিশ্বাসী ছিল, কোন কারণে তারাই আবার ঈশ্বর-অবিশ্বাসী হয়ে যায় বা বিপরীতক্রমে কেউ হয়তাে ঈশ্বর-অবিশ্বাসী ছিল, কোন কারণে সেই আবার ঈশ্বর-বিশ্বাসী হয়ে যায়। ফলে এই যে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী—দুজনই অজ্ঞান কারণ এরা দোদুল্যমান, নিজেদের সঠিক ধারণা নেই তাে অপরকে কি বােঝাবে? এইসব বিতর্ক বা বুদ্ধির কচকচি ছাড়া আর কিছু নয়। স্বামী বিবেকানন্দ যখন কলেজেপড়া ছাত্র–নরেন, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে গিয়ে তিনি প্রথম জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন…… আমাকে দেখাতে পারেন ?”—ইত্যাদি। তাহলে দেখুন, এটা দেখা যাচ্ছে যে, ঈশ্বর আছে কি নেই– এই জিজ্ঞাসা যেন অধ্যাত্মজগতে প্রবেশের পথে সনাতন এক জিজ্ঞাসা! ‘জিজ্ঞাসা’ মানে জানার ইচ্ছা, জিজ্ঞাসাই মানবকে এগিয়ে নিয়ে চলে – সমস্ত বেদ ও উপনিষদসমূহ এইরূপ জিজ্ঞাসা-উত্তরের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে।
আজকেও আপনি আবার এই গুলি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করছেন__তাহলে আমারও উচিত তার উত্তর দেওয়া উচিৎ! সুতরাং উত্তর দেবার চেষ্টা করা যাক! দেখুন, ব্যক্তিগতভাবে আপনি ‘ঈশ্বর কি?' ‘ধর্ম কি?--এসব মানেন বা মানেন না অথবা জানেন কি জানেন না – এই নিয়ে সমাজের কিছু যায় আসে না, কিন্তু যখনই আপনি অধৰ্মচারী হবেন অর্থাৎ দুনীতিপরায়ণ, দুরাচারী, অনাচারী, অসৎ, অবিবেকী হবেন, তখনই সমাজের ক্ষতিসাধন হবে। এবার দেখুন, আপনাদের শিক্ষিত বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ দুনীতি ইত্যাদি রােধ করার জন্য আইন, আদালত, পুলিশ, প্রশাসন, স্থানীয়ভাবে সামাজিক অনুশাসন ইত্যাদি নানান কিছু চালু করেছে। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দার্শনিকদের মতবাদ গ্রহণ করে তাদের নিজ নিজ দেশের অনুশাসন কায়েমকরেছে। কিন্তু পৃথিৰীয় কোন দেশ থেকেই কি দুনীতি, দুরাচার, অন্যায়, অত্যাচার, হিংসা, অনৈতিকতা দূর করা গেছে ? তাহলে সিদ্ধান্ত কি করবেন – অনুশাসন দিয়ে এইগুলি দূর করা যায় না! বরং এটা দেখা গেছে, আইন যত দৃঢ় হয়েছে-- শাসন যত শক্ত হয়েছে, দুরাচারসমূহ ততোধিক মারাত্মক হয়েছে, Scientific হয়েছে ! আজকে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে ভয়ঙ্কর অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফলে এই গ্রহটারই অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে চলেছে!
তাহলে আপনি কিসের গর্ব করছেন, কোন্ শিক্ষা বা সভ্যতার, কোন বিজ্ঞনমনস্কতার ? যে শিক্ষা বা সভ্যতা, যে বিজ্ঞানমনস্কতা পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার বাড়িয়ে পৃথিবী গ্রহকে ১৪ বার (এখন আরো বেশি)ধ্বংস করতে পারে, তারজন্য যদি আপনি গর্ব করেন __তাহলে আমি আপনার বুদ্ধিকে প্রশংসা করতে পারি না । একটা শক্তিশালী দেশ অন্য দেশগুলিকে dominate করতে চাইছে, তাই আরো ভয়ানক যুদ্ধাস্ত্র তৈরি, আরো শক্তিসঞ্চয়! আর এই প্রতিযােগিত্তায় Capitalist দেশসমূহ যেমন রয়েছে, Communist দেশগুলিও রয়েছে–এটা অস্বীকার করতে পারবেন না! তাহলে নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে বিচার করলে আপনি কাউকেই ভাল বলতে পারছেন না।
এবারে তাকান পৃথিবী গ্রহের মানব বিবর্তনের দিকে, সেখানে দেখুন কাল-সমুদ্রের বুকে জনসাধারণ রূপ অসংখ্য ছােট ছোট বুদ্বুদের বা ছােট ছোট তরঙ্গের মাঝে মহামানবরূপ কয়েকটি বিশাল বিশাল তরঙ্গ রয়েছে, যারা মহাকালের বুকে এক-একটা দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যাচ্ছেন। আপনাদের মতাে শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্করা তাঁদের দিকে তাকাচ্ছেন না_ মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন! তাতে কে ঠকছে –আপনিই নন কি ? বিশাল তরঙ্গ যাঁদের বলা হোলতাঁরা হলেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান বুদ্ধ, ভগবান যীশু, ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমূখ। ঐতিহাসিক, দার্শনিক, সাহিত্যিক ইত্যাদিরা ছােট ছোট তরঙ্গ তাদের কোন মতামত বা মতবাদকে আশ্রয় করেই আপনারা এরূপ জিজ্ঞাসা করেন তা আমরা জানি। কিন্তু কি আশ্চর্যআপনারা ঐ মহামানবরূপ বিশাল এবং মহান তরঙ্গগুলিকে গ্রহণ করতে পারেন না! হয়তো ভয় পান_ কি Poor আপনাদের বিচারশক্তি। যে সব মানুষের স্বায়িত্বকাল মাত্র ১০০ বছর কি ২০০ বছর, আপনারা তাঁদের নিয়ে মাতামাতি করেনকিন্তু এঁরা হাজার হাজার বছর ধরে কালের বুকে স্বমহিমায় বিরাজমান, যাঁরা শুধু নিজেদের জীবন পাত করে শুধু মানবকল্যাণই করে গেছেনশরীরে না থেকেও আজও করে চলেছেন —তাঁদেরকে জানার চেষ্টা করবেন না ! কালজয়ী মহাপুরুষদের এড়িয়ে চলার এই যে প্রবণতা, এটা কোন ব্যক্তির, জাতির বা বলা যায় দেশের পক্ষে প্রকৃতপক্ষেই দুর্ভাগ্যের পরিচায়ক! এটা আহাম্মকি ছাড়া কিছু নয়। আর স্বামী বিবেকানন্দ বলছিলেন—আহাম্মকের ধর্ম হয় না।
দেখুন, একটা দেশ বা জাতিকে কখন সার্বিক অর্থে শিক্ষিত বা সভ্য বলা যায় জানেন?– যখন সেই দেশের মানুষ বা জাতির অধিকাংশের মধ্যে বিবেকের জাগরণ ঘটে। Academic শিক্ষা দিয়ে অথবা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের সংখ্যা দিয়ে যদি কোন দেশ বা জাতিকে সভ্য ধরা হয়__ তাহলে আমেরিকাকে নিয়ে গােটা পৃথিবীর এত দুশ্চিন্তা কেন? সেই তো সমগ্র দেশের, তথা মনুষ্য-সমাজের আদর্শ হয়ে যেতাে! কিন্তু হোল কি__হোল না! সুতরাং ওটা ঠিক নয়। আবার প্রকৃত শিক্ষা বা সভ্যতা নিরুপণ হয় সেই জাতির মধ্যে থেকে কতজন মহামানবের আবির্ভাব হয়েছে_ সেই বিচারে! ওই যে বলছিলাম কালের বুকে স্থায়ী তরঙ্গের কথা। এবার ব্যক্তিগতভাবে প্রকৃত সভ্য মানুষ সেই, যার বিবেকের জাগরণ হয়েছে। সাধারণত মানুষ অন্যায় করে সবার অলক্ষ্যে_ সবাই ঘুমােলে (যদিও দানব প্রকৃতির মানুষেরা জবরদস্তিভাবে অন্যায় করে থাকে)!
যাইহােক, দেখবে কোন সাধারণ মানুষ কোন অন্যায় করে_ সকলের অলক্ষ্যে, সে ভাবে কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না! কিন্তু অনেক সময় অন্য মানুষেরা তাদের দেখে ফেলে_ ধরা পড়ে গেলে শাশ্তিও পায়।কিন্তু যার বিবেক জাগ্রত, সেই মানুষ কোনদিনই আর কোন অন্যায় করতে পারে না। সে মানুষজনের অলক্ষ্যে যেতে পারে কিন্তু তাকে ঘিরে সদাজাগ্রত বিবেকের প্রহরা রয়েছে যে ! তার কাছ থেকে তাে সে দূরে যেতে পারবে না, ফলে দেখবেন বিবেকীরা কখনও অন্যায় কাজ করে না। দেখা গেছে মনুষ্য-সমাজে আইন-আদালত, পুলিশ প্রশাসন অবিবেকীদের জন্য, বিবেকবান মানুষের এসবের কোন প্রয়ােজন হয় না। সারাজীবনে এরা কখনই আদালত বা পুলিশের দ্বারস্থ হন না,বা ঐ মুখেই হাঁটেন না। তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারলেন , সমাজে শােষণ, দুনীতি, অনাচার, দুরাচার দূর করতে হলেউন্নত-সুসভ্য মানবসমাজ গড়ে তুলতে হলে, প্রয়ােজন বিবেক জাগরণের! আর বিবেক জাগরণের একমাত্র উপায় মহাপুরুষের সংস্পর্শলাভ—অর্থাৎ বিবেক জাগ্রত হয়ে গেছে এমন কোন মানুষের সঙ্গ-করা– জাগ্রত বিবেকীরাই সাধু, এঁরাই সৎ! এঁদের সঙ্গই _সাধুসঙ্গ বা সৎসঙ্গ! কোন মানুষ যদি কিছুদিন সৎসঙ্গ বা সাধুসঙ্গ করে, তাহলে ঐ ব্যক্তি সমাজের ভাল কিছু যদি করতে নাও পারে, অন্তত খারাপ কিছু করবে না।
তাহলে এমন একটা সমাজের কথা কল্পনা করুন_ যেখানে কেউই কোন অন্যায় করছে না, কেউ কারও দ্বারা শোষিত বা নির্যাতিত হচ্ছে না ! আর এমনটা স্মৃতি সত্যিই হওয়া সম্ভব কিন্তু সেটা কোন মতবাদ দিয়ে নয়–এটা হোতে পারে এক মাত্র Mass-এর যদি বিবেকের জাগরণ ঘটে _তবেই!
কিন্তু এটা হওয়া কি এতই সহজ! এর জন্য কোন সমাজের বেশিরভাগ সদস্যকে অবশ্যই কোন না কোন( মহাকালের বুকে মহান তরঙ্গরূপী) মহামানবের বা উচ্চকোটী মহাপুরুষের আশ্রয় গ্রহণ করে তার নির্দেশানুসারে চলতে হবে অথবা তাঁকে নিজের জীবনে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে! ভারতবর্ষের বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষ_ এখনই স্বামী বিবেকানন্দকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করুক, আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই ভারতবর্ষ পৃথিবীর আচার্যের ভূমিকায় চলে আসবে—এ ব্যাপারে আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিতে পারি! এই- জন্যই বলা হয়েছে—'মহাজনো যেন গতঃ সঃ পন্থাঃ'।
তাহলে আপনি যে বলছিলেন, সমাজে শােষণ করে সাধু মহারাজরা–সেটা কি যথার্থ ? সমাজে সবসময়ই শােষণ, পীড়ন, নির্যাতন হয়ে চলেছে। সবল সবসময়ই দুর্বলকে শোষণ করে–পীড়ন করে, এটাই চিরন্তন নিয়ম। বড় গাছ ছােট গাছকে বাঁচতে দিতে চায় না, বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে ফেলে__ জীবন বিজ্ঞানের খাদ্যশৃঙ্খল অধ্যায়টা পড়লে আপনি জানতে পারবেন_উন্নত প্রজাতির প্রাণীরা, নিম্নতর প্রাণীদের খেয়েই জীবনধারণ করে থাকে! বড় এবং শক্তিশালী পশুরা__ ছােট দুর্বল পশুদের মেরে ফেলে এবং তাদেরকে খেয়েই জীবনধারণ করে থাকে। এটা আমরা সবসময় দেখি! ঠিক তেমনি সমাজ-বিবর্তনের সবযুগেই __ধনী, শক্তিশালী মানুষ, দুর্বল মানুষদের শােষণ করেছে,শাসন করেছে,অত্যাচার করেছে। সমাজ-বিবর্তনের প্রথম দিকে দলপতি বা সর্দারেরা—পরের দিকে সামন্ত-জমিদার অথবা রাজা-বাদশারা সাধারণ মানুষের উপর শােষণ-পীড়ন চালিয়েছে। এখন ব্যবসাদাররা আর রাজনৈতিক নেতারা সাধারণ মানুষের উপর শােষণ-পীড়ন চালাচ্ছে–এই কথাগুলিও অস্বীকার করতে পারবেন না।
আবার সাধুবেশী কোন ভন্ড বা প্রতারক ক্ষমতা পেলেও এই একই ধরনের কাজ করতে পারেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যাঁরা সাধু, তাঁরা বিবেকীফলে তাঁরা কি করে কোন অন্যায় করবেন ! তাঁরা তো হাজার হাজার মানুষকে বিবেকের আলােয় উদ্ভাসিত করে যান— সেই জন্যেই তো এঁরা সদগুরু, সমাজের আচার্য, সমাজের আদর্শ! কাজেই আপনার এই ধরণের জিজ্ঞাসাও অর্থহীন কারণ আপনি “সাধু”-র অর্থ না জেনেই জিজ্ঞাসা করেছেন অথবা আপনি বুঝতে ভুল করেছেন, কেন না আর একটা শব্দ আছে ‘সাধক’ যিনি বা যাঁরা সাধন পথে চলছেন । এমন কারো কথা যদি বলেন তাহলে অবশ্য আলাদা কথা! কারণ তারা তো এখনো সিদ্ধ হয়নি তাই কোন ভুল করতেই পারে। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রেও আমি আপনাকে বলব_ তাদের সহযােগিতা করুন, সমালোচনা করছেন কেন! যাতে সবার মঙ্গল হয়_এমন কাজ করাই তো ভালো!
জিজ্ঞাসু: – তাহলে ‘ঈশ্বর কি’? ঈশ্বরলাভ কিভাবে হয়?
গুরু মহারাজ:– এর উত্তরে আমি আপনাকে বলব – দেখুন, এটা একান্ত জিজ্ঞাসা_ সার্বজনীন নয়। কারণ আমরা দেখেছি যে, দলবেঁধে চুরি-ডাকাতি হয়, সমাজসেবা হয়, রাজনীতি করা যায়, উৎসব-অনুষ্ঠানাদি করা যেতে পারে কিন্তু ঈশ্বরলাভ হয় না! মৃত্যুর পথে এবং ঈশ্বরলাভের পথে মানুষকে একা চলতে হয়। ঈশ্বরলাভের পথে যদি আপনি অগ্রসর হতে চানতাহলে আপনাকে একলা চলতে হবে। আগ্রহ এবং সৎ-সাহস থাকে তো এগিয়ে আসুন! আপনি এক পা এগােলে, ঈশ্বর আপনার দিকে একশ পা এগিয়ে আসবেন। ঈশ্বরলাভের পথ- ‘মনুষ্যত্বং- মুমুক্ষুত্বং- মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ’। মানুষকে প্রথমে ঠিক ঠিক মানুষ হয়ে উঠতে হবে, এরপর তার মধ্যে মহামায়ার ভুবনমোহিনী মায়া থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছা জাগতে হবে এবং শেষ শর্ত হিসাবে মহাপুরুষের সাক্ষাৎ-সংস্পর্শ লাভ করতে হবে। সকল জাগতিক ও পারমার্থিক জ্ঞানের লয় হয় ঈশ্বরতত্ত্বে! এই জন্যই বলা হয়“ঈশ্বর” একটি তত্ত্ব, যা সকল তত্ত্বের শেষ সােপান। ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছু ধারণা করতে পারলেন কি?
আসলে কি জানেন তাে, একটা প্রাইমারির ছাত্রকে আপনি কি করে University-র শিক্ষা বােঝাবেন ? এখানেও ঠিক তাই হয়, যিনি আধ্যাত্মিকতার রাজ্যে প্রবেশই করেন নি, তাকে কি করে ঈশ্বরতত্ত্ব বােঝানো যায় ? এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রয়াস বা প্রযত্নেরই বেশি প্রয়ােজন হয়। তবে এটুকু বলা যায় – ঈশ্বর একটা খোঁজ – যা মানুষকে পূর্ণতার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর আপনি যদি সত্যিই ঈশ্বরতত্ত্ব জানতে চান, অনুসন্ধানে নামুন! ডুব দিন জীবনসমুদ্রের গভীরে, তবে তাে হৃদি-রত্নাকরের রত্নসমূহ তুলে আনতে পারবেন! কৃতকার্য হলে ধন্য হবেন আপনি, সার্থক হবে আপনার জননীর গর্ভধারণ, গৌরবান্বিত হবে আপনার দেশ ও দেশবাসী! আপনার তুলে আনা রত্নমালিকায় বিভূষিত হয়ে ওঠার সাথে সাথে সেই রত্নের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে সমাজের শরীর!
এক-একজন মহাপুরুষ নিজেদের জীবনকে এইভাবেই মানবকল্যাণে উৎসর্গ করেছেন–জীবনের গভীরে ডুব দিয়ে। আত্মনিমগ্ন হয়ে বা সাধনায় সমাহিত হয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন যৌবনের উচ্ছ্বল দিনগুলি, আর তুলে এনেছেন গলা-পচা সমাজ শরীরকে সুস্থ করার সঞ্জীবনী সুধা! মানুষকে দিয়েছেন ‘চরৈবেতি’র মন্ত্র, জীবনের মন্ত্র, বাঁচার মন্ত্র! এইভাবে তাঁরা জীবনরহস্য, জগৎরহস্য, ঈশ্বররহস্য উদঘাটন করে সেগুলিকে সূত্রাকারে উত্তরসূরিদের উপহার দিয়ে গিয়েছেন ! সেগুলিকে যত্ন করে প্রতিপালন করুন – অবহেলা করবেন না। এইসব মহান মানবদের সারা জীবনের ত্যাগ, তিতিক্ষা, সাধনা, সংযমকে আপনারা অগ্রাহ্য করেন কি করে ? নিজেদের পিতাকে অসম্মান-অবহেলা করে অপরের পিতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করাটাই তো আহাম্মকি! আগে আপনার নিজের দেশ ও জাতির ঐতিহ্যের গভীরে প্রবেশ করুন, আপনি নিজে দেখুন সেটা পূর্ণ না শূন্য – পরে অপরের কাছে যাবেন। যেখানে বিশ্বের সমস্ত উন্নত দেশগুলো ভারতবর্ষের প্রাচীন জ্ঞানরাজির রহস্য সন্ধানে বড় বড় গবেষণাগার স্থাপন করেছে, মহা মহা পন্ডিত বা বিজ্ঞানীদের কাজে লাগিয়েছে_সেখানে আপনাদের মতো শিক্ষিতরা – বিজ্ঞানমনস্করা সেগুলিকে অবজ্ঞা এবং অবহেলা করে চলেছেন – এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য আর কিই বা হতে পারে!!