স্থান ~ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন । সময় ~ ১৩/৮/৯২– ১৬/৮/৯২ উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ স্বামী স্বরূপানন্দ মহারাজ, সব্যসাচী মান্না, নগেন ও অন্যান্য ভক্তগণ।
জিজ্ঞাসু :— আপনি যে সেবা ও সাধনার কথা বলেন—এক্ষেত্রে মাদার টেরিজা তাে এর একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ ?
গুরুমহারাজ :– নিশ্চয়ই! মা টেরিজার ওখানে(কোলকাতায়) আমি অনেকদিন বিভিন্ন সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম , এমনকি কুষ্ঠরােগীদের সেবাও করেছি। ফলে ওনাদের কাজের ধারা আমি জানি। আধ্যাত্মিক বিচারে ওনার যেটুকু ত্রুটি তা হোল, উনি Baptise না করে কাউকে ওখানে allow করতে চান না। আগে সে খ্রীষ্টান হলে, তারপর তাকে খ্রীষ্টজ্ঞানে সেবা করা হয় । আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এটাও একটা sentiment, যা একপ্রকার বন্ধন। মা টেরিজা প্রথম বিশ্বের কাছ থেকে যে সমস্ত সুযােগ-সুবিধা বা বিভিন্ন সম্মান ও পুরস্কার পান, এর পিছনেও এই sentiment-ই কাজ করছে। তবু যে কোন শর্তেই হােক বা যে কোন ভাবেই হােক, ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবার’ যে আদর্শ—সেটা কিন্তু ওনার আশ্রমে বাস্তবায়িত হয়।
যে ঘটনায় মা টেরিজা জগদম্বার প্রসন্নতা অর্জন করেছিলেন এবং শক্তিলাভ করেছিলেন_সেটা বলছি! কালীঘাটের মায়ের মন্দিরের অদূরে কিছু পতিতাপল্লী রয়েছে। ওখানকার বয়স্কা মহিলাদের জীবন বড়ই কষ্টের। যতদিন এদের যৌবন থাকে, ততদিন বেশ স্ফূর্তিতেই কাটে কিন্তু যেই শরীরে বার্ধক্য নেমে আসে অমনি সমাজে আর তাদের কোন কদর থাকে না। ফলে রােজগার বন্ধ হয়ে যায়, তাছাড়া নানান যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে যায় তারা। আর এর ফলস্বরূপ বস্তি থেকে অন্যান্যরা এদেরকে তাড়িয়েও দেয়। এরা তখন মায়ের মন্দিরের আশেপাশে ভিক্ষা করে আর রোগক্লিষ্ট দেহে যন্ত্রণাভােগ করতে করতে অবশেষে রাস্তাঘাটেই মরে পড়ে থাকে।
যাইহােক, মা টেরিজা তখন প্রথম কলকাতায় সেবামূলক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কাজে এসেছিলেন এবং কলকাতার বস্তিবাসী এবং প্রবাসীদের দু্ঃখ-দূর্দশা নিজের চোখে দেখেছিলেন।এসব দেখে উনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তিনি এখানেই থেকে যাবেন এবং স্বাধীনভাবে নিঃস্বার্থ মানবসেবার কাজ করবেন! তিনি একদিন কালীঘাট মন্দিরের ওখানটায় ঘুরছেন, হঠাৎ দেখলেন মন্দিরের পাণ্ডারা কয়েকটি অসহায়, গলিত-অঙ্গ বিশিষ্ট অতিবৃদ্ধা রমণীদেরকে নিষ্ঠুরভাবে মন্দির-প্রাঙ্গণ থেকে বের করে দিচ্ছে। একে গলিত-দেহ, শারীরিক ক্ষমতার অভাব—তাও দু’মুঠো অন্ন জোটানাের জন্য বৃদ্ধাদের এই আকুল প্রয়াস, এই পরিস্থিতিতে আবার তাদের উপর অত্যাচার—এই দৃশ্য দেখে মা টেরিজার অন্তঃকরণ দ্রবীভূত হয়ে গেল। উনি তাড়াতাড়ি তাদেরকে এক জায়গায় বসিয়ে পেটভরে খাবার ব্যবস্থা করে দিলেন এবং তাদের ক্ষতস্থানগুলির সেবা-শুশ্রুষা করতে শুরু করলেন! স্থানীয় জনগণ এক বিদেশিনীর এই ধরণের অদ্ভুত আচরণ দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন—বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন তার পাশে এসে দাঁড়ায়—এইভাবেই ধীরে ধীরে মা টেরিজা ওখানেই ওনার নিজের সংস্থা ‘নির্মল হৃদয়’-এর শুভ সূচনা করেন। সে যাইহোক, যে মুহূর্তে মা টেরিজা ঐ মহিলাদের প্রতি করুণাপরবশ হয়ে নিজেকে ভুলে তাদের সেবার কাজে ব্রতী হলেন—সেই মুহুর্তে মা মহাকালীর(কালীঘাটের কালী) মন্দির থেকে শক্তির ধারা তার উপর বর্ষিত হতে লাগল। মা টেরিজা হয়তো এই রহস্য কোনদিনই জানতে পারেন নি_কিন্তু তাতে কি! উপযুক্ত ক্ষেত্র পেলে সবসময়েই এই ধরনের শক্তি transmission হয়!
মা টেরিজার ছােটখাটো শরীর, দেখে মনেই হবে না যে তিনি অত পরিশ্রম করতে পারেন। কিন্তু কি অসাধারণ পরিশ্রমী, চিন্তা করতে পারবে না—একা হাতে সব সামলাচ্ছেন ! এখন তাে উনি International Figure, ফলে কর্মপরিধিও অনেক বেড়েছে, আর বেড়েছে বয়স তবু দেখবে ওনার হাঁটা চলা কত সপ্রতিভ!(গুরু মহারাজ যখন কথাগুলি বলেছিলেন_তখনও মা টেরিজা শরীরে ছিলেন)!
এখন তােমরা বলতে পারো_ মায়ের মন্দির থেকেই বা ওনার শক্তিলাভ হোল কেন ? যে কোন মন্দির, গীর্জা, মসজিদ বা কোন উপাসনালয় বা কোন তীর্থস্থান এগুলােতে বহু সাধক, বহু মানুষ বহুকাল থেকে শুভ চিন্তা করে বা সাধন-ভজন করে থাকে! তাছাড়া বিভিন্ন মহাপুরুষগণ ঐ সমস্ত স্থানে মান এবং সেখানকার আধ্যাত্মিক শক্তির ভাণ্ডার বাড়িয়ে তােলেন। ফলে এক-একটা ঐ রকম স্থান যেন bank ৷এইজন্যেই দেখবে _যে কোন মন্দির বা গীর্জা বা যে কোন উপাসনালয়ে গিয়ে একাকী কিছুক্ষণ বসে থাকলে অশান্ত মনও কেমন শান্ত হয়ে যায় !
জিজ্ঞাসু :– আপনি ইউরােপের প্রায় ১৬টি দেশ ঘুরে এলেন, ওখানে কি আপনি ভারতীয় উপনিষদের শিক্ষাই দিয়ে এলেন?
গুরুমহারাজ :—“উপনিষদ’ বলতে তুই কি বুঝিস? ঋষিবাক্যই তাে উপনিষদ। যে সমস্ত ঋষিরা ব্ৰহ্মকে জেনেছিলেন—এই বিশ্ব-বিরাটের রহস্য অবগত হয়েছিলেন—তাঁরা তাদের উত্তরসূরিদের কল্যাণ কামনায় বা জগৎকল্যাণকল্পে যে বাণীসমূহ মন্ত্রের আকারে বা উপদেশের আকারে শুনিয়ে গেছেন__সেগুলো দীর্ঘকাল ধরে পরম্পরাগতভাবে শ্রুতি হিসাবে ছিল, পরে লিপিবদ্ধ হয়েছে। ফলে সমাজ পেয়েছে বেদ-উপনিষদ বা বিভিন্ন শাস্ত্রসমূহ। বেদের সারভাগ বেদান্ত বা উপনিষদ এটাকেই বলা হয় বেদের জ্ঞানকাণ্ড।
এবার কথা হচ্ছে স্থান, কাল, পাত্রভেদে এই জগৎসংসারটাই রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে আর কোন বক্তব্য বা কোন কিছুর প্রকাশের ভঙ্গি পালটাবে না? সত্য সবসময় সত্য কিন্তু তার প্রকাশের ভঙ্গিমার পার্থক্য থাকবে বই কি ! সেই যম আর নচিকেতা অথবা উদ্দালক আর শ্বেতকেতুকে টেনে না আনলে উপনিষদ বলা যাবে না—এটা কি ঠিক ? ভালো করে চিন্তা করে দ্যাখ্_আমার কথাগুলো, তাহলে ঠিকই বুঝতে পারবি! স্বামী বিবেকানন্দ সমাজকে কি দিলেন ? তিনি তো আধুনিক কালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঋষিই ছিলেন ! তাহলে তিনি যা বলে গেলেন অথবা তােরা যে তাঁর 'রচনা' পাচ্ছিস এগুলো তাহলে কি ? এগুলােও বেদ বা উপনিষদই নয়কি? হ্যাঁ, বলতে পারিস্ 'আধুনিক উপনিষদ'।
তাছাড়া “ওদেশে”, “Europe”-এইসব শব্দ ব্যবহার করে কি বােঝাতে চাইছিস—’উপনিষদ’ তােদের একার সম্পত্তি ? উপনিষদে চিরন্তন সত্য-কে ধরা আছে! সত্য সবার জন্য। যে পরমতত্ত্ব উপলব্ধি করেছে, বােধে বােধ করেছে সত্য তারইজ্ঞান তারই ! তাতে সে যে কোন স্থানের মানুষ হােক না কেন, এতে কিছুই যায় আসে না। তাের হয়তাে ভারতীয় হিসাবে এই sentiment-টা আসছে কারণ ভারতের আর্যঋষিরা প্রথম এই সত্যকে জেনে, মানুষকে জানিয়ে ছিলেন_ সেই জন্য। কিন্তু এটা একটা আহাম্মকি,ফালতু sentiment ! ঋষিরা কখনও এধরণের একদেশদর্শিতায় ভােগেন নি, তাঁরা সম্বােধন করেছিলেন, ‘শৃন্বন্ত বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’—এই বলে। সুতরাং সবসময় জানবি– ‘বেদ কার? না_ যে জানে তার’। তাছাড়া তােদের ভারতবর্ষে বেদ বা উপনিষদ সৃষ্টি হয়েছিল বলে কি তােরা সবাই এক-একটা ঋষি হয়ে গেছিস নাকি ? বরং তােরা যে ঋষির বংশধর, তার ধারা থেকে বিচ্যুত হতে হতে আজ কোথায় এসে পৌঁছেছিস– তা নিজেই বিচার করে দ্যাখ্ !
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এগুলােকেই বলতেন, ‘মতুয়ার বুদ্ধি'—অর্থাৎ কোন মতকে সত্য ধরে নিয়ে সেটাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা, কিন্তু বেদান্ত কোন মত নয়—এটা সার্বজনীন! সব ‘মত' বা সব ‘পথ'ই এতে সিদ্ধ হয় । আমি কাউকে মতুয়া হতে শেখাই না, আমি তো তোদের বারবার বলি – প্রথমে তােরা ঠিকমতো বাঁচতে শেখ,—'How to Survive'। এই আশ্রম যেন একটা Survival camp-এখানে সব সময় Art of life এবং Art of living-এরই শিক্ষা দেওয়া হয়। অামি Europe-এও এই একই কথা বলেছি। আমি মানুষকে ভালােবাসি---তাই যে যেখানে আছে সবাই ভাল থাক, শান্তিতে থাক_ এটাই তো আমি চাইব। আমার কাছে তো ভারতীয়, ইউরােপীয় বলে কিছু নাই_ সকল মানুষ ভালাে থাকুক, ভালাে হয়ে উঠুক—এটাই আমার কাম্য । ফলে তাদের মঙ্গলের জন্য, ভালোর জন্য_ যা বলা দরকার তাই বলেছি, আর সেই একই কথা এখানেওতােদেরকেও বলি! নতুন কথা আর কি বলবো_'সকলের কল্যান হোক'-- এই কথাই বলি!!
দ্যাখ্, এই জীবজগৎ, জড়—সবকিছুই সেই ব্রহ্মেরই প্রকাশ । মানুষে তার বেশী প্রকাশ। আবার কোন কোন মানুষে তার আরও বেশী প্রকাশ! এবার যে সমস্ত মানুষ আমার কাছে আসে, তাদের মানসিকতা অনুযায়ী তারা আমাকে নানান জিজ্ঞাসা করে এবং আমি তাদের মনােমতো উত্তর দিই। আমি সকলকেই বলি—তােমরা যে যে অবস্থায় আছাে, সেই অবস্থা থেকেই এগিয়ে চলাে পরম লক্ষ্যের দিকে! তােমাদের সকলের মধ্যেই অনন্ত সম্ভাবনা রয়েছে_ তোমরা জড়ত্বের আদিমতা কাটিয়ে উঠে পূর্ণত্বের দিকে, এগিয়ে চলাে।
তবে এটাও দেখেছি যে_ শুধু মুখে বললেও সবসময় কাজ হয় না, practical-ও কিছু করাতে হয়! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন তিন প্রকার বৈদ্যের কথাযারা শুধু প্রেসক্রিপশন করেন তারা অধম বৈদ্য, যারা প্রেসক্রিপশনও করেন আবার ঔষধ খেয়েছে কিনা খোঁজ-খবরও নেনতারা মধ্যম বৈদ্য, আর যাঁরা রােগীদের বাড়ী বাড়ী ঔষধ নিয়ে গিয়ে প্রয়ােজনে বুকে হাঁটু দিয়ে ধরে জোর করে ঔষধ খাওয়ান এবং রােগীকে নিশ্চিত আরােগ্য করে তােলেন—এঁরাই উত্তম বৈদ্য । কল্প থেকে কল্পান্তরে মায়ের এইরকমই সব লীলা হয়ে চলেছে, আগামীতে আরও কত লীলা সংঘটিত হবে—তা মা জগদম্বা ছাড়া আর কেই বা বলতে পারে!