জিজ্ঞাসু :— সমাজে অনেক ব্যক্তিই বিভিন্ন ভাল ভাল কাজ করে, অনেকে সৎপ্রসঙ্গ করে, ভাষণ দেয় – এতেও তো অনেকের আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় ?
গুরুমহারাজ :– ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সময়ে তাঁর কাছে নীলকন্ঠ গোঁসাই(মুখার্জী) নামেএকজন কীর্তনীয়া আসতেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে কীর্তনগান গেয়ে বেড়াতেন, আর লােকে তার গানের গায়কী-তে এবং ভাবমাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে যেতাে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর গান শুনতে খুবই ভালবাসতেন । একবার সেই কীর্তনীয়া ঠাকুরের কাছে এসেছেন, একথা-সেকথার পর ঠাকুর তার প্রশংসা করে বললেন–“তুমিও তো কত গুণী – দেশে দেশে ভগবানের নাম-গান গেয়ে বেড়াও, তাতে কত লােক পার হয়ে যায়।” কীর্তনীয়া ছিলেন মহাচতুর, তিনি তাড়াতাড়ি ঠাকুরকে প্রণাম করে বলেছিলেন—”আপনি শুধু এইটুকু দেখবেন, শেষে যেন আমি নিজে না ডুবি”। ব্যাপারটা বুঝতে পারলে ? এখানে ঐ কীর্তনীয়া জানেন কাউকে ডােবানো বা তোলা অথবা পারে নিয়ে যাওয়ার হাত ঐ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণেরই আছে—তাঁর নেই! এইটাই হচ্ছে জ্ঞান! এইটুকু বজায় থাকলেই হােল, তাহলে আর অহংকার চট্ করে বাসা বাঁধতে পারবে না।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আরও গল্প করতেন__ ছোট নৌকা নিয়ে কখনোই সাগর পাড়ি দেওয়া যায় না! কিন্তু যদি একটা বড় জাহাজের সঙ্গে অনেকগুলি ছোট ছোট নৌকা বাঁধা থাকে, তাহলে তাদের আর সমুদ্রের ঢেউয়ে বা ঝড়-তুফানে ডুবে যাবার ভয় থাকে না। কারণ বড় বড় ধাক্কা জাহাজই সামলাবে, এদের গায়ে তেমন কিছু লাগবে না। আর লাগলেও অথবা কোনটা যদি ডুবেও যায় – তুলতে তেমন কোন কষ্ট হবে না। সদ্গুরুই জীবের সেই অবলম্বন, তাঁকে ধরে থাকলে ভবসাগরের পারে যেতে ডােবার আর কোন ভয় থাকে না।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই ধরণের ছােট ছােট উদাহরণ অথবা গল্প দিয়ে বেদ-বেদান্তের গূঢ় এবং অন্তর্নিহিত শিক্ষাসমূহ সহজ করে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন__ আর এইজন্যই আধ্যাত্মিক জগতের বিভিন্ন রহস্য ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের দ্বারাই সাধারণ মানুষের বােধগম্য হয়েছে। এই সব কারণে বলা হয় বেদ বা বেদান্তের অধিকার সকলের কিন্তু সকলেরই আছে কিন্তু তা সবার পক্ষে গ্রহণযােগ্য বা বােধগম্য হয় না । ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সরল, সাধারণ ভাষায়- সাধারণের মতাে করে মানুষকে সেই সকল বুঝিয়ে গেলেন —এটাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অসাধারণতা!
একবার হয়েছে কি, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর থেকে কামারপুকুর চলেছেন। তখন উনি বর্ধমান পর্যন্ত ট্রেনে যেতেন, তারপর ওখান থেকে সেহারাবাজার হয়ে গরুর গাড়ী ভাড়া করে কামারপুকুর পৌঁছাতেন । সেবার ওনার সঙ্গে বেশ কয়েকজন যুবক ছেলে ছিল। রাস্তায় হঠাৎ ওনার চোখে পড়ল একটা বলদগরু একটা গাই গরুর পিঠে চাপছে। গাই গরুটির তখন প্রজনন সময় উপস্থিত হয়েছিল বলেই হয়তাে বলদটির এরূপ আচরণ! ঠাকুর গাড়ীর ভিতর থেকে বাকী সকল যুবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ওরে দ্যাখ্ দ্যাখ্,—কি রকম মজা দ্যাখ্, দামড়ার কি কাণ্ড দ্যাখ্।” ছেলেরা ঠাকুরের ওতটা উচ্ছ্বসিত ভাব দেখে ভাবল কি না মজা ! তারপর ঐ দৃশ্য দেখে সকলেই লজ্জায় অধােবদন হয়ে রইল। এটা দেখে ঠাকুর আবার তাদের বােঝাতে লাগলেন_ ‘বেশী বয়সে গরুকে পুরুষত্বহীন করলে তাকে ‘দামড়া’ বলে । এটার দ্বারা আর প্রজনন হবে না কিন্তু পূর্বসংস্কার ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে – প্রবৃত্তিতে বদ্ধ করে রেখেছে, নিবৃত্তমার্গ অবলম্বন করতে দিচ্ছে না। তেমনি যারা ছোটবয়স থেকেই আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করে_তাদের অসুবিধা হয় না, কিন্তু বেশি বয়সে যারা আসে তাদের রুপ-রসাদির প্রতি মোহটা থেকেই যায়!
তাহলে ব্যাপারটা একবার বােঝ, আর ঠাকুরের শিক্ষাদানের কৌশলটাও লক্ষ্য করো–সাধারণ একটা দৃশ্য, কিন্তু শিক্ষা দেবার কি নিপুণ প্রয়ােগ-কৌশল ! এরূপ তো হামেশাই দেখা যায় যে, কেউ ঘর-সংসার, বিষয়-আশয় এসব নিয়ে বহুদিন থেকে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে হয়তো ধর্মজগতে প্রবেশ করেছে! গুরুলাভ হয়ে হয়তো ‘এঁড়ে’ থেকে ‘বলদে’ রূপান্তরিত হয়েছে, কিন্তু দেখা যাবে পূর্ব সংস্কার তাকে বারবার মায়া-মোহের আবর্তে টেনে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে!
তাহলে এইসব ক্ষেত্রে উপায় কি হবে ? না _চাই প্রবল আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় সংকল্প। তাকে ভাবতে হবে মানুষ তাে গরু নয়, সে মানুষ ! তাই গুরুবাক্যে অটল বিশ্বাস, নিষ্ঠা ও ভক্তি থাকলে পূর্ব সংস্কার, অজ্ঞানতা ইত্যাদি সবকিছু দূর হয়ে যাবে! সে ঠিকই জানতে পারবে যে, তার দ্বারা আর কোন অন্যায় কাজ সাধিত হবে না কারণ গুরু তাকে ধরে রেখেছেন। তাহলেই গুরুকৃপাধন্য সেই মানবের ধীরে ধীরে উত্তরণ ঘটবে – অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানে, মৃত্যু থেকে অমৃতে – অন্ধকার থেকে আলােয় তথা মহাজ্যোতির রাজ্যে!
জিজ্ঞাসু :– গুরুজী, সমাজে এত অত্যাচার, অনাচার – এসব বন্ধ হয়ে কি করে সুস্থ মানবসমাজ গড়ে উঠবে?
গুরুমহারাজ :—মানব দেহ-মনে সুস্থ হলেই মানবসমাজ সুস্থ হবে। মনুর পুত্র মানব, মানব মনপ্রধান। মানুষের দেহ সুস্থ না থাকলে সে আকুল হয়, কিন্তু মনে যে হাজার অসুস্থতা রয়েছে – সেগুলো না সারলে দেহও সুস্থ হবে না আর মানবের মধ্যে কখনই স্থিরতা আসবে না। জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার ধরে এই অসুস্থতা বাহিত হয়ে আসছে – সহজতার মধ্যে এটাই বিকার বা বিকৃতি। আমি দেখেছি কোন কোন শিশুকেমন নৃশংসভাবে ছোট ছোট কীট বা পতঙ্গকে মারছে, গাছ থেকে পটাপট ছিঁড়ে ফুলের পাপড়িগুলো কুচি কুচি করে ফেলছে, আর এতে তারা আনন্দ পাচ্ছে। এই ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা কি হবে? পূর্বসংস্কারে রয়েছে অপরকে কষ্ট দেবার প্রবণতা, ফলে বিকৃতি বা বিকার থেকে আনন্দকে খোঁজার যে চেষ্টায় ছুটছে মানবসমাজ, তারই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় ঐ শিশুটার কাজেও! এই ভাবেই অসহজ মানুষেরা বিকৃত হয়ে অসহজ মানবসমাজ গড়ে তুলছে। সেইজন্যেই তোমরা দেখতে পাচ্ছ সমাজে অবিচার, অনাচার। শাস্ত্রে ইন্দ্রকে সহস্রচক্ষু অথবা কালীয়নাগকে সহস্রফণা বলা হয়েছে, এগুলো হচ্ছে thousands faculty of mind! কাম বা কামনা – এর একটা faculty, এমনি সহস্র বিকৃতি রয়েছে_ যা মানুষের মনে সর্বদা কিলবিল করছে। উপযুক্ত স্থান-কাল-পাত্রে স্বতঃই এগুলির প্রকাশ ঘটে যায়। এর জন্যই__ বাইরে থেকে দেখে হয়তো কারুকে সভ্য বা শিক্ষিত অথবা রুচিবান লাগছে কিন্তু এমন লোকের জীবনেও হঠাৎ হঠাৎ কোন দূর্ঘটনা ঘটতে দেখা যায় – যেটা অশ্লীল, সেইরূপ মানুষের পক্ষে যা অশোভনীয়।
সমাজের সমস্ত স্তরে এইরূপ অসহজ মানুষ থাকায় - বিকৃত বা অসুস্থ মানুষ থাকায়, সুস্থিত কোন ব্যবস্থাই গড়ে উঠছে না সমাজে। বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা বিকৃত হোলে আরও বিপর্যয় নেমে আসে সমাজজীবনে - যেমন হিটলার, স্ট্যালিন বা এখনকার চাওসেস্কু - এরা এই ধরণেরই বিকৃত মানব। দূর্ভাগ্যবশত বারবার এইরূপ মানুষের হাতে ক্ষমতা আসায় পৃথিবী বারবার অকারণে রক্তস্মাত হয়েছে। স্বেদ, অশ্রু আর রক্তের প্লাবনে ধরণী ভারাক্রান্ত হয়েছে। এখন তো সংবাদপত্রে দেখছি যে, রোমানিয়ায় এক একটা গণকবরে পাওয়া গেছে ৮/১০ হাজার মানুষের কঙ্কাল। এরূপ কত যে গণকবর রয়েছে তা কে জানে! তাহলে কি বলবে এগুলোকে? এগুলি কি মানুষের মস্তিষ্কের সুস্থতার লক্ষণ! এই ভাবেই বিকৃত মানব সদা সর্বদা তার বিকৃতি চরিতার্থ করতে চাইছে। উপযুক্ত পরিস্থিতিতে বা পরিবেশে যখন সেগুলি কার্যে রূপ নিচ্ছে, আমরা তা দেখে শিউরে উঠছি, বলছি - কি ভয়ংকর! কিন্তু এটাতো শেষ নয়, এইরকম কত শত বিকৃতি যে জমে রয়েছে মানুষের মনোজগতে তার হিসাব কে রাখে! সেগুলির প্রকাশ ঘটতে থাকলে মানবসমাজে আরও কত বীভৎসতা যে নেমে আসতে পারে তা কি কখনও চিন্তা করেছো?
তাহলে এই অসহজতা, এই বিকৃতির হাত থেকে কি কখনও মুক্তি পাবে না মানবসমাজ, মানব কি কখনও সহজ ও সুস্থ হতে পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে। বিকৃতিমুক্ত সহজ মানবের দুটো আদর্শ তোমাদের সামনে রয়েছে - এক, মদন-ভস্মকারী শিব, অন্যটি মদনমোহন শ্রীকৃষ্ণ। একটি প্রতীক দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, তীব্র বৈরাগ্য ও যোগ সাধনার দ্বারা মদনভস্ম করে নীলকণ্ঠ হতে হয় এবং অন্য রূপ দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে আনন্দের আস্বাদন গ্রহণ করে মদনমোহন হতে হয় অর্থাৎ কালীয়দহের মধ্যেই কালীয়নাগকে বশ করে তার মাথায় নৃত্য করতে হয়।
যে সব মানুষের মধ্যে এই দুটি রূপের যে কোন একটি বিদ্যমান, তাঁরাই বাউল- তাঁরাই সহজ। মানবসমাজে কদাচিৎ এঁদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কখনও কখনও মানুষের প্রতি করুণাবশত মানুষকে কৃপা করতে, মানুষের বেশে এঁরা সমাজে নেমে আসেন - অসুস্থ মানবসমাজকে সুস্থ করেন। পরবর্তীকালে মানুষেরা এঁদেরকেই ঈশ্বরের জীবন্ত বিগ্রহ বা ভগবান বলে মনে রাখে, পূজা করে। ঈশ্বরকে করূণাময় বলার তাৎপর্য এটাই। ভগবান বুদ্ধ বা যীশু বা শ্রীচৈতন্য অথবা শ্রীরামকৃষ্ণ - এঁরাই ঈশ্বরের জীবন্ত বিগ্রহ-স্বরূপ - সচ্চিদানন্দঘন বিগ্রহ। এঁরা সকলেই করূণাময়, করুণা করে সেই অসীম অনন্ত সসীমে লীলা করে গেলেন - অমূর্ত ঈশ্বরতত্ত্ব মূর্তমানরূপে ধরা দিলেন ধরণীর ধূলিকে ধন্য করার জন্য - এটাই রহস্য বাবা। আর এইটা জানার জন্য, বোধে বোধ করার জন্যই সাধনা। অসুস্থ সমাজকে ঈশ্বরই পারেন সুস্থ করতে। আইন, নিয়ম, শাসন, রাজনীতি দিয়ে সমাজকে সুস্থ করা কখনই সম্ভব নয়। দ্যাখোনা - বর্তমান বিশ্বেআইন-কানুন করে সমাজ নিয়ে কত পরীক্ষা নিরীক্ষাই তো চলছে, কোথাও কি সুস্থ বা সুস্থিত মানবসমাজ গড়েতোলা সম্ভব হয়েছে? - হয়নি। তবু অসহজ মানব সহজতাকে উপেক্ষা করে কৃত্তিমতা বা বিকৃতিকেই বেশি করে আশ্রয় করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন কারাপ্রাচীর গড়ে উঠছে, নতুন নতুন আইনের অনুশাসন আনা হচ্ছে, গিলেটিন থেকে পরমাণু বোমা পর্যন্ত প্রয়োগ করা হচ্ছে পৃথিবীতে শান্তি, সাম্য বা সুস্থিতি আনার জন্য। কিন্তু অস্থিরতা ও রোগমুক্ত সমাজ কি বিশ্বে কোথাও গড়ে উঠেছে? আর গড়ে তোলা যাবেও না কোনদিন।
এর একমাত্র remedy হচ্ছে - "মহাজন যেন গতঃ স পন্থাঃ"। মহাজন, মহাপুরুষগণের নির্দেশিত পথই পথ। তাই তোমরা সমাজকে সুস্থ করতে চেয়োনা - নিজেরা সুস্থ হও। মানব অন্তর্মুখী হয়েই ভগবৎমুখী হতে পারে। আর ভগবৎমুখী হলেই মানব সুস্থ হয়। এইভাবে সমাজের এক একটা unit যখন সুস্থ বা সহজ হবে তখনই ধীরে ধীরে মানবসমাজ সুস্থ ও সরল হয়ে উঠবে। বিশ্বকবি বলেছিলেন, "কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস।" তিনি ঠিকই বলেছিলেন, যুগে যুগে মহাপুরুষগণও এটাই বলে গিয়েছেন - individual বা এক একটা unit আগে অধ্যাত্মজ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক, তাহলে সেই জ্বলন্ত প্রদীপই পারবে সহস্র প্রাণের প্রদীপকে জ্বালিয়ে দিতে।