স্থান ~ পরমানন্দ মিশন ৷ সময় ~ ১৯৯২ সাল । উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ পরমানন্দ মিশনস্থ সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারী ও বহিরাগত ভক্তবৃন্দ।
জিজ্ঞাসা :– আপনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়েছিলেন শুনেছি, ওখানেও অনেক মানুষ আপনার sitting-এ আসত। ওদের জিজ্ঞাসা বা আপনার আলোচনা কি এখানকার মতই ছিল? আপনার আলোচনা কি ওরা ঠিক বুঝতে পারত?
গুরুমহারাজ :– কি বলি বল তো তোমাদের ! একটা কথা বলতে পারি — তোমরা যেমন এখানে বোকার মত প্রশ্ন কর সেরকমটা ওরা কখনও ওখানে করেনি! বোঝাবুঝি বলতে যদি ভাষার সমস্যা বোঝাও — তাহলে বলতে হয় যে, সহজ-সরল ইংরাজী আমি বলতে পারি, আর তার দ্বারা আমার বক্তব্য প্রকাশ করতে কোন অসুবিধা হয় না এবং আমার বক্তব্য_ ইউরোপিয়ানদেরও বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি।
এবার যদি বল যে, আমার বক্তব্য অর্থাৎ ভারতীয় দর্শন বা আর্য-ঋষিদের শিক্ষাসমূহ ওরা ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছে কিনা — তাহলে বলব এগুলো ওরা তোমাদের থেকে ভালোভাবে বুঝতে পারে। কারণ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, Material Science যত উন্নত হবে, অধ্যাত্মবিজ্ঞান মানুষ তত ভালোভাবে বুঝতে পারবে। ইউরোপের বেশীরভাগ দেশ তো Material Science-এ ভীষণ উন্নত। কতটা উন্নত তা তুমি এখানে বসে ভাবতে পারবে না, বলা যায় উন্নতির চরম সীমায় পৌঁছেছে। সুতরাং ভারতীয় দর্শন ও পুরাণাদি শাস্ত্রের গল্পসমূহ যখনই আমি বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করছিলাম তখন ওদের বিভিন্ন University-র পণ্ডিতমহল অবাক তো হচ্ছিলই_ যৎপরোনাস্তি কৌতুহলীও হচ্ছিল। তাছাড়া তোমরা তো জানো যে, আমি আধ্যাত্মিকতা বলতে বোঝাই 'Art of Life এবং 'Art of Living' — জীবনের কলা এবং বাঁচার কলা। মানুষ যখন রয়েছে তখন জীবন বা Life তো সবদেশেই রয়েছে আর সে বাঁচতে চায় — এবং ভালোভাবে বাঁচতে চায়। তাছাড়া ইউরোপীয়ানরা রজঃপ্রধান জাতি, ওরা ভোগ, ঐশ্বর্য্য, বিলাস-ব্যসন ভালোবাসে। সুতরাং যখনই ওরা "জীবনের কলা", "বাঁচার কলা"_ কথাগুলি শুনল, তখনই আমার কাছে ভিড় জমাতে শুরু করল। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম — ওরা এখানকার অনেকের মত আলসে-কুঁড়ে বা তমঃপ্রধান নয়। ওরা যখন যেটা শিখেছে, তখন থেকেই সেটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। কেউ হয়তো প্রাণায়ামের উপকারিতা শুনল, সেই দিন থেকেই অভ্যাস শুরু করে দিল। Auto-urine therapy বা স্বমূত্র চিকিৎসার কথা শোনার পর থেকেই বহুজন আমিষ ছেড়ে দিয়ে স্বমূত্র পান করতে শুরু করে দিল। ইউরােপের দেশগুলিতে এইরকম বহু ঘটনা ঘটেছে।
জিজ্ঞাসু :– পৌরাণিক ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলছিলেন, সে সম্বন্ধে যদি দু-একটা বলেন?
গুরুমহারাজ :– যেমন ধরো_ পুরাণে রয়েছে যে, ব্রহ্মার পুত্র কশ্যপের ৮ টি স্ত্রী ছিল। তার এক এক স্ত্রীর সন্তানেরা পৃথক পৃথক প্রকৃতি বিশিষ্ট! পুরানে বর্নিত ব্রহ্মাকে বলা হয়েছে সৃষ্টিকর্তাকশ্যপ অর্থাৎ উন্নত জীব সৃষ্টির পর পৃথিবীতে স্থলচর প্রানীদেরকে ৮ টি Species বা প্রজাতিতে ভাগ করেছিলেন পুরানকার।এদের মধ্যে যেমন পশুপাখি ছিল, তেমনি অনুন্নত মানব থেকে উন্নত মানবের শ্রেণীবিভাগেরও বর্ণনা করা হয়েছে। ওখানে বলা হয়েছে_ কশ্যপের স্ত্রীদের মধ্যে কদ্রু, বিনতা, স্বসা, দিতি, অদিতি ইত্যাদি রয়েছে। এদের মধ্যে বিনতার সন্তানেরা পক্ষীশ্রেনীর,কদ্রুর সন্তানেরা সরীসৃপ শ্রেনীর ছিল — এসব থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, সরীসৃপ প্রজাতি-পক্ষী প্রজাতি ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া ওখানে দেখানো হয়েছেবিনতার পুত্র কদ্রুর সন্তানদের dominate করছে অর্থাৎ এখানে বিবর্তনে বিভিন্ন প্রজাতির ক্রমোন্নতির দিকটা তুলে ধরা হয়েছে। আবার আদি মানব থেকে সভ্য মানুষের বিবর্তন বোঝাতে স্বসার পুত্রগণকে রাক্ষস, দিতির পুত্রদের দানব এবং অদিতির পুত্রদের দেবতা বলা হয়েছে। এভাবে মানুষের মধ্যেই যে, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃপ্রধান ব্যক্তিরা রয়েছে এবং স্বভাব বা প্রকৃতি অনুযায়ীই যেতাদের আচার-আচরণের পরিবর্তন হয়_তা বোঝানো হয়েছে। দানবেরা স্বার্থপর, ক্রূর, অলস ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ অর্থাৎ তমঃপ্রধান-মানবের এইগুলিই চরিত্র-লক্ষণ। রাক্ষসেরা বলশালী, পররাজ্য লুণ্ঠনকারী, ভোগ-ঐশ্বর্যলোলুপ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা-পরায়ণ — যেগুলি রজঃপ্রধান ব্যক্তিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আর দেবতারা ক্ষমাশীল, দানপরায়ণ, নির্লোভ, পরার্থপর, শ্রদ্ধাশীল, পুজ্য ও ধীরতা-সম্পন্ন। এঁরা সমাজের সত্ত্ব-প্রধান ব্যক্তি।
এইভাবে আমরা পুরাণাদি শাস্ত্রে দশাবতারের (মৎস,কূর্ম,বরাহ, নৃসিংহ, পরশুরাম,বলরাম,রাম,বামন,বুদ্ধ ও কল্কি)বর্ণনায় জীবের অভিব্যক্তির পূর্ণাঙ্গরূপ পাই। জলজ প্রাণী থেকে বিবর্তনে উন্নততর প্রজাতির প্রাণীতে পরিণত হবার ক্রমটি এই কাহিনীর মাধ্যমে বর্ননা করা হয়েছে।
পুরাণে সমুদ্রমন্থনের মে কাহিনী রয়েছে, তাতে মানুষের সাধনজগতের অন্তর্লীন রহস্যের কথা বলা হয়েছে। যোগবিজ্ঞানকে(আসন, প্রাণায়াম ইত্যাদির দ্বারা প্রাণ এবং আপাত বায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে সমানকে সুষুম্নায় চালনা করা) কাজে লাগিয়ে,মূলাধারে অবস্থিত সর্পরূপীনী কুলকুন্ডলিনীর মেরুদন্ড বরাবর বিভিন্ন চক্র বা গ্রন্থির ভেদের কথাই নানা ঘটনার মাধ্যমে উপস্থাপনা করা হয়েছে।
ইউরোপের বেশ কয়েকটি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আমার সাথে regular যোগাযোগ রাখতেন এবং ওঁরা আমাকে অনেক University-তে বক্তব্য রাখার জন্য নিয়েও গিয়েছিলেন ! ওই দেশের মানুষের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, ওরা কিন্তু কখনই বিনা পয়সায় আমার বক্তব্য শোনেনি। প্রায়ই দেখতাম আলোচনা সেরে সেমিনার থেকে চলে আসার সময় ওরা একটা মোটামুটি অঙ্কের চেক আমাদের হাতে ধরিয়ে দিতো। প্রথম প্রথম আমি এই ব্যাপারটায় খুবই আপত্তি করেছিলাম কারণ আমার ভারতীয় সংস্কার, পয়সার বিনিময়ে অধ্যাত্ম-আলোচনায় অভ্যস্ত তো নই আমরা ! কিন্তু ওখানকার কর্মকর্তারাই বোঝালেন যে, এসব দেশে থাকতে একটা মানুষের প্রচুর খরচ, তার উপরে যাতায়াতেরও খরচ যথেষ্ট। যদি কোন মানুষ রোজগার না করে তাহলে বৎসরাধিক কাল থাকা বা যথেচ্ছ ঘুরে বেড়ানো অসম্ভব। পরে আমি দেখেছিলাম ওদের বক্তব্যই ঠিক ছিল। প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে জীবননির্বাহ করার এত খরচ যে ভাবা যায় না! বাড়িতে যতগুলি বয়স্ক member — সকলকেই কিছু না কিছু রোজগার করতে হয়, নাহলে ওরা ওখানকার standard বা status maintain করে বাঁচতে পারবে না।
যাইহোক, একটু আগে তুমি জিজ্ঞাসা করছিলে_ ওখানকার(ইউরােপের) মানুষ ভারতীয় পৌরাণিক ব্যাখ্যা বুঝতে পারতো কিনা — তাই তো! তা তোমাকেই জিজ্ঞাসা করছি, এই যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাগুলো এতক্ষন ধরে বলা হোল তা তুমিই বা কতটা বুঝলে _ পরে না হয় এখানকার অন্য ক’জন শ্রোতা বুঝলো তার হিসাব নেওয়া যাবে! আগে নিজের বিচার করো_তারপর নাহয় অন্যের খোঁজ নেবে !
এখানে(ভারতবর্ষে) তো ধর্মালোচনা বলতে শুধু পাঠ হচ্ছে অথবা কথকতা হচ্ছে ! শাশ্ত্রসমূহেরঅন্তর্নিহিত অর্থ আর পরিস্ফুট করা হচ্ছে কই? এ থেকেই বোঝা যায় যে, এখানকার মানুষ এখনও ততটা চেতনায় উন্নত নয়। আর পরমানন্দ “বেনা” বনে মুক্তো ছড়াতে চায় না, যেখানে যেটা প্রয়োজন সেখানে সেটাই বলে এবং যতটা দরকার ততটাই বলে ! যেখানে যেমন, সেখানে তেমন, যখন যেমন, তখন তেমন, যার যেমন, তার তেমন !
জিজ্ঞাসু :– কিন্তু আমরা তো দেখি এক-একরকম পরিবেশে বা মাটিতে এক-একরকম ফসল হয় — তার quality-ও আলাদা হয়, তাহলে মানুষের মানসিকতাও তো এক-এক দেশে ভিন্ন ভিন্ন রকম হওয়া উচিত ?
গুরুমহারাজ :– তোর জিজ্ঞাসার ধরন দেখে মনে হচ্ছে তুই যেন অনেক ভেবেচিন্তে একটা বিজ্ঞের মত জিজ্ঞাসা করলি ! কিন্তু কথাটা কি হচ্ছে জানিস — মানুষকে তোরা ভিন্ন পাঁচটা জিনিস বা বস্তুর সাথে তুলনা করিস ! কেউ করে পশুর সাথে, কেউ যন্ত্রের সাথে, তুই করলি ফসলের সাথে_ কিন্তু এই বিচারধারাটা ঠিক নয়। মানুষ পৃথিবীগ্রহের শ্রেষ্ঠ জীব। বহু বিবর্তন, পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানুষ এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। মানুষ কি কম রে! মানুষই ঈশ্বর হতে পারে ! আবার স্বয়ং ঈশ্বর মানুষ শরীরে লীলা করেন — এটা যেদিন বুঝতে পারবি, সেদিন আর এইরকম অজ্ঞের মত বিজ্ঞতা দেখাবার প্রয়াস করবি না।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে আমি দেখেছি যে কোন দেশের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অবস্থা, পরিবেশ, জলবায়ু, মৃত্তিকা, ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদির পরিবর্তনের ফলে মানুষের রঙের, আকার-আকৃতির, ব্যবহারের ও পোশাক-পরিচ্ছদের পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু মানসিকতার বিচারে সবদেশের মানুষের মধ্যেই ত্রিগুনের প্রভাব অর্থাৎ সত্ত্বপ্রধান, রজঃপ্রধান এবং তমঃপ্রধান ব্যক্তিরা কিন্তু রয়ে গেছে ! তবে এদের সংখ্যা কোথাও কোনটা বেশী, কোনটা কম যেমন ইউরােপে রজঃপ্রধান লোকের সংখ্যা বেশি।
তবে,যে দেশেরই মানুষ হোক না কেন, প্রত্যেকেরই Need of life হচ্ছে — অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, Necessity of life — স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সুরক্ষা এবং Purpose of life — ঈশ্বরলাভ। অর্থাৎ চেতনার উন্নতির সাথে সাথে আধ্যাত্মিক পথের সন্ধান এবং আধ্যাত্মিক পথ-প্রদর্শকের সন্ধান সবাই চায় ! আর এই চাওয়াটা জীবনের অগ্রগতির ক্রমের মধ্যেই পড়ে।
দ্যাখো, আমি জীবনকে ভালবাসি_ মানুষকে ভালোবাসি ! তাই যে যেটা চায়, যেটা পেলে সে আনন্দে থাকতে পারে, তার মঙ্গল হয়আমি তাকে সেই পথটাই দেখিয়ে দিই। আমি শুঁটকে সাধু নই, সানাইয়ের পোঁ ধরে আমি থাকতে চাই না। আমি নিত্যমুক্ত — স্বাধীন ! কোন নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে আমি থাকতে চাই না ! লক্ষ্য করে দেখবি এখানে — যুবক বা কিশোর বয়সী ছেলেরা আমার সাথে বন্ধুর মত মেশে, আবার তাদেরই বাবা-মায়েরা আমার সাথে শ্রদ্ধাজনিত কারণে দূরত্ব রেখে মেশে ! আমার কাছে আসে এমন অনেক ছেলে-মেয়েদের আমি বিবাহ করতে বলি, আবার অনেককে দেখে তাদেরকে বলি “ঘর-সংসার তোদের জন্য নয়” ! এর কারণ_ আমি জানি ছেলেটি বা মেয়েটি__ বিবাহ করলেও সেই বিয়ে টিকবে না, মাঝে থেকে ওরা ছাড়াও আরো অনেক কষ্ট পাবে।
আমার এখানে আসা কত ভক্তকে আমি বিভিন্ন স্থানে অন্য কোন পরম্পরায় গুরুকরণের জন্য পাঠিয়েছি — দেখেছি তাদের সংস্কারে সেই সব পরম্পরার ধারা রয়েছে। ফলে সেই পরম্পরায় দীক্ষা নিলেই তাদের মঙ্গল হবেতাই পাঠাই! মানুষের মঙ্গল করাই তো আমার উদ্দেশ্যফলেৎএই ধরনের নানা কাজ আমাকে করতে হয়যার সঙ্গে আশ্রম পরিচালনার কাজের কোন সম্পর্ক নাই।
গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা খুবই গোঁড়া হয় কিন্তু নবদ্দীপ অঞ্চল থেকে অনেক বৈষ্ণব সাধু এখানে আসে, একান্তে আমার সাথে দেখা করেই আবার চলে যায়। তাদের সাথে আমার খুবই প্রেমের সম্পর্ক! কিন্তু ওদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে এতো restriction যে বনগ্রাম আশ্রমের অন্ন গ্রহন করতে চায় না ! আবার অনেক নামকরা মিশনের সাধুরা লুকিয়ে লুকিয়ে এখানে আসে। তারা বলে যে, তাদের পরমানন্দ মিশনে আসার ব্যপারটা যদি ওদের মিশশন-কর্তৃপক্ষ জানতে পারে _তাহলে হয়ত তাদের মিশনে থাকাই মুস্কিল হবে। তারা লুকিয়ে ‘চরৈবেতি’ পত্রিকা পড়ে, আমার লেখা বই গুলো পড়ে। এতো বিপদ উপেক্ষা করেও তারা এখানকার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে !
তাহলে বুঝতে পারছিস তো__ মানুষ যতই ভিন্ন ভিন্ন রকমের হোক না কেন__ তুই যদি একবার তাদের মনের মত হয়ে উঠতে পারিস _তাহলে তুই সবার কাছে না হোলেও অনেকের কাছে acceptable (গ্রহণযোগ্য) হয়ে যাবি ! কিন্তু এই Art তো সবার জানা নেই, সাধারণ মানুষ তার পরিবারের লোকেরই মনের মতন হয়ে উঠতে পারে না তো__ সকলের মনের মতো কি করে হবে ! সত্যি কথা বলতে মানুষ তার নিজের মনের মতোও হয়না ! তাহলে প্রশ্ন — কিভাবে তা হওয়া যায়? — মনকে বশে আনলেই মন অন্তত তোমার মতো হবে, আর ধীরে ধীরে তাকে সম্পূর্ণ বশে এনে _এবার তাকে যত ছড়াতে পারবে ততই তুমি অনেকের মনের মতো হতে পারবে ! তখন অনেকের ভাবনা_তখন তোমার ভাবনাই অনেকের ভাবনাকে স্পর্শ করবে, আবার অনেকের অনেক ভাবনা তোমার ভাবনায় মিশে যাবে! ঋষিরা এই অবস্থায় পৌঁছে তবেই বলেছিলেন, "বসুধৈব কুটুম্বকম্।"
তূমি ফসলের কথা যা বলছিলে ওটা জৈব বিবর্তনের অধীন। ডারউইন বলেছিল Natural selection ! প্রাকৃতিকভাবেই বিভিন্ন মহাদেশের ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু বা মৃত্তিকায় বিভিন্ন উদ্ভিদ বা প্রানীরা জন্মে। আবার অনেক গাছ বা প্রানীরা কৃত্রিমভাবে অথবা migrate কোরে_ এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে বা এক দেশ থেকে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েয় ! যেসব গাছ বা ফসল ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন-ভিন্ন জলবায়ুতে জন্মাতে পারে — এরাই survival of the fittest ! অর্থাৎ অন্যান্য গাছ কোন বিপর্যয়ে কোন এক স্থানে নষ্ট হয়ে গেলেও এরা survive করবেই ! আবার দেখা যায়_ বহু প্রাচীনকাল থেকে কিছু প্রজাতির গাছপালা বা কিছু শ্রেণীর প্রাণীরা কোথাও যায় নি_তাদের শরীরেরও বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়নি! ২০০০-৫০০০ বছর ধরে আজও একইরকম থেকে গেছে। তোমাদের হাতের কাছে রয়েছে আরশোলা, এরা বহু বছর ধরে প্রায় একই রকম থেকে গেছে !
প্রাকৃতিকভাবে migrate করাটা মানবজাতির পক্ষে বিশেষ মারাত্মক কিছু নয় বরং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তার সুফল পায় মানুষ। কিন্তু মানুষ যখন কোন উদ্ভিদ বা প্রানীর কৃত্রিমভাবে প্রজনন ঘটাচ্ছে বা জোর করে এদের migrate করাচ্ছে এবং তার উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে তার gene-এর পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে high-productive হয়ে উঠতে বাধ্য করছে — তখনই হচ্ছে খারাপ ! এতে হয়ত ফসল পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তার quality বা খাদ্যগুণের তারতম্য ঘটে যাচ্ছে। ভারতে তো কৃষিবিজ্ঞান বা ভূমিবিজ্ঞান এতটা উন্নতিই হয়নি যে, কর্তৃপক্ষ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার করে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল তা বলে দেবে অথবা চাষীকে সেইমত চাষ করতে বাধ্য করাবে। ইউরোপ বা আমেরিকা এসব ব্যাপারে খুবই সচেতন ! ভারতবর্ষ বা এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা ওদের দেশে প্রচুর গবেষণার সুযোগ পাচ্ছে, ফলে ওই সমস্ত দেশের গবেষণা উন্নত হচ্ছে। আর এদেশে তেমন পরিকাঠামোও নেই, সরকারী নজরও নেই _ তাহলে দেশটার উন্নতি হবে কি করে ?
সব ফসল সব মাটিতে হয় না। আবার হোলেও মাটির পার্থক্যে ফসলের গুনগত পার্থক্য অর্থাৎ taste বা size-এর পার্থক্য ঘটে। যেমন কমলালেবু পাহাড়ি এলাকায় হয়। গ্রামবাংলায় সেটাই আকারে প্রায় কমলারমতো হলেও প্রচণ্ড টক হয়। গাছের গোড়ায় প্রচুর চুন (ক্যালসিয়াম কার্বনেট)ব্যবহার করলে টকজাতীয় যে কোন ফলকে মিষ্টি করা যায়। পুরুলিয়ার মাটিতে Horticulture বা বাগিচা-ফসল ভাল হবে। ওখানে ধান-গম চাষ করতে যাওয়া বোকামি ! বর্ধমান ধানচাষের উপযুক্ত ভূমি, বর্তমানে প্রচুর আলুও হচ্ছে। কিন্তু চব্বিশ-পরগণায় — বিশেষত লবণযুক্ত মাটিতে ধানচাষ না করে জোয়ার, ভুট্টা ইত্যাদি চাষ করলে লাভজনক হবে। যাইহোক ,কৃষিবিজ্ঞানীরা এসব নিয়ে ভাবুক — আমরা এখানে হরিগুণগান করতে এসেছি এখন তাই করি !