স্থান ~ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন । সময় ~ ১৯৯৭ সাল । উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ নগেন, সব্যসাচী, স্বামী স্বরূপানন্দ ও অন্যান্য ভক্তবৃন্দ ।
জিজ্ঞাসু :— শ্রাদ্ধবিধি পালন কি কুসংস্কার ?
গুরুমহারাজ :—- সংস্কার কথাটির সাধারণ অর্থ যা পরিশোধিত-পরিমার্জিত হয়ে সমাজে এসেছে এবং সমাজ দীর্ঘদিন ধরে সেটাকে মেনে আসছে ও সেটা বর্তমানে প্রায় অলিখিত ‘নিয়মে’ পরিণত হয়েছে। ‘সংস্কার’ কথাটি সামাজিক ক্ষেত্রে বা ব্যাপক অর্থে এবং ব্যক্তিগতভাবেও ব্যবহৃত হতে পারে। একই সমাজের কোন ব্যক্তি বা পরিবার হয়তাে কিছু কিছু ব্যাপার বা বিধি নিষেধ মানে _অন্যরা তা মানে না। কোন সমাজ হয়তাে কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করে, অপর সমাজ তা করে না—এইরূপ হয়ে থাকে। তবে,সবসময় মনে রাখবে বিচারবিহীন বিকৃত সংস্কারই কুসংস্কার।
এবার দেখতে হবে এই যে বিভিন্ন ধরনের“সংস্কার” যেগুলি বহুদিন আগে কোন সময় একটি বিশেষ সমাজে গৃহীত হয়েছিল এবং এখনো(হয়তো ১০০/১৫০ বছর কিম্বা আরো বেশি সময় ধরে) সেগুলি ঐ সমাজে প্রচলিত রয়েছে! এখন একটা জিজ্ঞাসা এখানে রয়ে যাচ্ছে__এর পিছনে রহস্য কি ছিল ? কেন সেটি তৎকালীন সমাজ গ্রহণ করেছিল ? স্থান-কাল-পাত্রের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেটি পালনের কি এখন প্রয়ােজন রয়েছে না সেটিরও সংস্কার প্রয়ােজন?
দ্যাখো, যুক্তিনিষ্ঠতা, বিজ্ঞানমনস্কতা বা যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার মানসিকতা থেকেই পরবর্তী সংস্কার জন্ম নেয়, 'সংস্কৃত মানুষ'_ নতুন সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তােলে। —এটাই সমাজের বিবর্তন। যে সমাজ এটা পারে না, সে সমাজ ক্রমশ পিছিয়ে পড়ে, গোঁড়ামি ও সংস্কারান্ধ হয়ে ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে একদিন হারিয়ে যায়। সবসময় জানবে গতিশীলতাই জীবন—স্থিতিশীলতা মৃত্যুর নামান্তর।
তুমি শ্রাদ্ধবিধি বলতে নিশ্চয় বাঙালী হিন্দু শ্রাদ্ধবিধির কথা বলছো ! কারণ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে হিন্দুদের শ্রাদ্ধবিধি আবার ভিন্ন ভিন্ন ! সামাজিক আইন মানার জন্য হিন্দুদের রয়েছে স্মৃতিশাস্ত্র, বেদ-পুরাণাদি ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদি। যেহেতু এক এক স্থানে এক-একজন পন্ডিতের স্মৃতিশাস্ত্র চলে আসছে, তাই হিন্দু হলেও বিশাল ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে সামাজিক রীতিনীতির প্রচুর পার্থক্য রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই দেশটি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম দিকে ছিল অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ আদি ষােড়শ মহাজনপদ, তারপর আরো শত শত ছােট ছােট রাজ্যে বিভক্ত হয়েছিল এই দেশ ! ভগবান বুদ্ধের সময় থেকে বা তারও কিছুআগে থেকে বৃহত্তর ভারতবর্ষ বা ষােড়শ মহাজনপদের বাইরের দেশ থেকেও বিভিন্ন জনজাতি ভারতে ঢুকতে শুরু করেছিল। এরা এদেশে আসতো_হয় লুটপাঠ করতে অথবা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে ! ফলে ভারতবর্ষের ন্যায় বিশাল দেশে এত প্রতিকূলতার মধ্যে অখণ্ড সংস্কৃতি বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। যেখানে চীন বিশাল দেশ হলেও ওরা কয়েকশ বছর ধরে দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলে 'চীনের প্রাচীর’ গড়ে তােলায় বহিঃশত্রুর আক্রমণ বা বহিঃসংস্কৃতি প্রবেশ করার সুযােগ খুব একটা সেখানে ছিল না। আর জলপথে ইউরােপীয়রা যখন চীনে প্রবেশ করল_সেটা মাত্র কয়েকশ' বছর আগে এবং তা-ও বেশীদিন স্থায়ীও হয়নি। ফলে ওখানে এক ভাষা, একই ধরণের সংস্কৃতি অনেকটাই লক্ষ্য করা যায়।
যাইহােক, কোন বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যুর পর নানান শাস্ত্রবিধি পালনের মধ্যে তৎকালীন সমাজে বিধি-বিধানের কিছু মহান দিক ফুটে ওঠে। অবশ্য এই অনুষ্ঠানের আধ্যাত্মিক দিকও রয়েছে ! বঙ্গদেশে তখন কোন মানুষ মারা যাবার আগে তাকে তুলসীতলায় শােয়ান হােত বা গঙ্গাতীরে তুলসীগাছ রােপণ করে তার নীচে শুইয়ে রাখার বিধি ছিল। দ্যাখাে, তৎকালে অক্সিজেন-সিলিণ্ডার ছিল না--একমাত্র তুলসীগাছ একটি বড় বট বা অশত্থ গাছের সমপরিমাণ অক্সিজেন নির্গত করতে সক্ষম। তাই মুমূর্ষ ব্যক্তি যখন "খাবি খেত” বা অক্সিজেনের অভাববােধ করত তখন তুলসীতলায় বা গঙ্গাতীরে প্রচুর শুদ্ধ বাতাসযুক্ত স্থানে রাখায় _ অনেকসময় ঐ ব্যক্তি ভালাে হয়ে ঘরে ফিরে আসতো, আর মারা গেলেও অপেক্ষাকৃত কম কষ্ট পেয়ে মরতো।
কোন মানুষ মারা গেলে হিন্দু সনাতন রীতিতে রয়েছে মুখাগ্নির বিধান ! গ্রামের প্রান্তে কোন বিশেষ গাছের তলায় মুখাগ্নির প্রথা ছিল। এরও সামাজিক তথা বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে __কোন বয়স্ক মানুষ মারা গেলে হরিনাম-সংকীর্তন সহকারে ‘হরিধ্বনি' দিতে দিতে তার শবদেহকে গ্রামের মাঝখান দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলে স্বভাবতই গ্রামের আপামর মানুষ বাইরে আসবে এবং অনেকেই সেই যাত্রায় অংশ গ্রহণ করবে। এবার মৃতদেহের প্রিয়জনকে দিয়ে মুখাগ্নি করানাে হয়। শরীরের মধ্যে ঠোট এবং তালু বা টাকরা অর্থাৎ আলজিভের স্থানটি হচ্ছে প্রচণ্ড sensitive স্থান ! তাই মৃতদেহের ঐসব স্থানে তিনবার জ্বলন্ত আগুন স্পর্শ করিয়ে গ্রামবাসীর সামনে নিশ্চিত হওয়া যেত, যে ব্যক্তিটি সত্যিই মৃত কি না! তখন তাে সব গ্রামে ডাক্তার বা বদ্যি ছিল না, তাই Death-certificate-এর বিকল্প ছিল এটাই। গ্রামের মােড়লমশাই বা বিদগ্ধ জনেদের সামনে করা হােত এই অগ্নিপরীক্ষা।
মৃতদেহের দাহপ্রথাও খুব Scientific পদ্ধতি। এতে পরিবেশ দূষণ সব থেকে কম হয়। কম্যুনিষ্ট দেশগুলিতে মুসলিম-খ্রীষ্টান সহ সবধর্মমতের মৃতদেহকেই এইভাবে দাহ করা হয়। চীনেও ইলেকট্রিক চুল্লীতেই সমস্ত মানুষের মৃতদেহ দাহ করা হয়। যাইহােক, এখানে ফিরে আসি_মৃতদেহ দাহকার্য সম্পন্ন হোলে_মৃতব্যক্তির পুত্ররা এরপর দু’খন্ড সামান্য বস্ত্র বা 'কাচা' কাপড় পরে প্রথম তিনদিন সারাদিন উপবাস করে রাত্রে ফল খায় ও শ্রাদ্ধাদি কর্ম পর্যন্ত তা ১০ দিন, ১৫ দিন বা ১ মাস যাই হােক না কেন দিনে একবার হবিষ্যান্ন গ্রহণ কোরে ব্রহ্মচারীর ন্যায় কৃচ্ছসাধনে দিনাতিপাত করে। আরও দেখবে বড় ভাই-এর গলায় একটি চাবি ঝােলানাে থাকে। অনেকের হাতে লােহার দণ্ড থাকে। কারণ তখনকার দিনে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ী খবর দিতে বিপদসঙ্কুল হাঁটা পথে যেতে হত, তাই অর্ধাহারে অনাহারে ঐ দুর্বল ব্যক্তির আক্রান্ত হবার ভয়ে আত্মরক্ষার্থে লৌহদন্ডটি গ্রহণ করার রীতি ছিল।
এবার অন্যান্য পালনগুলির তাৎপর্য বলছি। সংসারে বৃদ্ধ পিতা-মাতা মারা যাবার পরই সাধারণত ভাই-ভাই ঠাঁই ঠাঁই হােত, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে পৃথগন্ন হােত। ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি এমনকি খুনােখুনিও হােত বিষয়-সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে। এইটি যাতে না হয় তারজন্যই পিতা-মাতার মৃত্যুর পর উপবাস বা অর্ধাহারের সঙ্গে ব্রহ্মচারীর ন্যায় জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন প্রাচীন ভারতীয় শাশ্ত্রকারেরা!পিতার সিন্দুকের চাবি বড়ভাই গলায় ঝুলিয়ে রাখতো_ যাতে অন্যভাই বা আত্মীয়রা_ ‘সিন্দুকের মাল হাওয়া হয়ে যেতে পারে’এরকম কোন সন্দেহ করতে না পারে ! এবার এই যে ১০দিন বা ১৫দিন সময় নেওয়া হয়, এর কারণ_ এই সময়ের মধ্যে মামা, মেশাে, শ্বশুর ইত্যাদি বয়স্ক বা প্রধান প্রধান আত্মিয়-স্বজনেরা যাতে খবর পেয়ে আসতে পারে। এদের আগমন শুধু শোকপ্রকাশ বা ভোজ খাওয়াই নয় _এনাদের মধ্যস্থতায় বা পরামর্শক্রমেই শ্রাদ্ধকৰ্ম কিরূপ হবে বা শ্রাদ্ধপরবর্তী সময়ে সংসারের চেহারা কিরকম হবে —তার রূপরেখা তৈরী করা ! আর সর্বোপরি বাবার বাক্স বা সিন্দুক খুলে টাকা ভাগ করা থেকে শুরু করে,পুত্রদের মধ্যে যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সুষ্ঠুভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা করাটা ছিল তাদের প্রধান কাজ।
তাই আজকের দৃষ্টিতে শ্রাদ্ধকর্মের কিছু ক্রিয়া কুসংস্কার মনে হলেও এবং অনেকে তা পালন না করলেও _একসময় এগুলির যথেষ্ট মূল্য ছিল–যেটাকে শ্রদ্ধা করতে হবে। কুসংস্কারমুক্ত হওয়ার অর্থ পুরাতনকে অশ্রদ্ধা করতে শেখা নয়। এখানেই অনেক আধুনিকরা ভুল করে বসে, ভাবে পুরাতনকে অশ্রদ্ধা করাই বুঝি সংস্কারমুক্তি বা আধুনিকতাএই ভাবনা আহাম্মকি ছাড়া আর কিছুই নয়।। —প্রকৃত সংস্কারমুক্ত তিনিই, যিনি বিচারের দ্বারা পুরাতনকে অতিক্রম করে এসেছেন–সেখানে অশ্রদ্ধার কোন স্থান নাই–শুধু বিচার ও সত্যের প্রতিষ্ঠা রয়েছে, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নতুনকে গ্রহণের প্রচেষ্টা রয়েছে।
এবার সাত্ত্বিক প্রকৃতির মানুষদের ১০ দিন, রাজসিকদের ১৫দিন এবং তামসিকদের যে একমাস পালন-বিধি তাও মানুষের স্বভাব বা প্রকৃতি অনুযায়ী নির্ধারিতকরা হয়েছিল। কারণ সাত্ত্বিক স্বভাববিশিষ্ট মানুষরা ১০দিন অশৌচ পালনেই বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে বিরােধের চিন্তাসকল ভুলে শান্ত হয়ে যাবে। রাজসিক ব্যক্তিদের ঐ সব ভুলতে আর একটু বেশী সময় লাগবে আর তামসিক প্রকৃতির লােকেদের জন্য আরও বেশী সময় লাগবে _কারণ তাদের লােভ-হিংসাদি প্রশমন হতে দেরি হবে। মুসলমান বা খ্রীষ্টানরাও বেশ কয়েক সপ্তাহ (৪২-দিন!)পরে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ন্যায় কিছু অনুষ্ঠান করে থাকে।
তবে এই যে ১০দিনে, ১৫দিনে, ১মাসে বা ৪২-দিনে অথবা বাৎসরিক হিসাবে মৃতব্যক্তির উদ্দেশ্যে কিছু ক্রিয়া করা হয়, এইসব ক্রিয়াচরণ বা পালনবিধির আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাও রয়েছে ! কারণ শরীর ছাড়ার পর মৃতব্যক্তি সূক্ষ্মশরীরে গভীর সুষুপ্তির মধ্যে থাকে। বিশেষ বিশেষ দিনগুলিতে তার ঐ ঘন প্রসুপ্তি কাটার সম্ভাবনা থাকে এবং যদি তা কাটে তাহলে তারা পরিবার-পরিজনের প্রতি মােহবশত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ক্রন্দনরত বা বিভিন্ন শ্রদ্ধাযুক্ত-অনুষ্ঠান পালনরত পুত্রদের বা প্রিয়জনদের দেখে বুঝতে পারে যে, তার মৃত্যু হয়েছে ! এতে তার চেতনার অবস্থান্তর ঘটে—এবং সে আবার ঘন সুষুপ্তিতে চলে যায়--নতুন শরীর গ্রহনের আশায় ! এটাই রহস্য ! তবে এখন শ্রাদ্ধকর্মে বা মন্ত্র উচ্চারণে বেশীরভাগই কোন কাজ হয় না। প্রকৃতির নিয়মেই জীবের সুষুপ্তি কাটে। অনেক সময় মহাপুরুষগণের কৃপায় অনেকের অবস্থান্তর ঘটে।
এই যে নগেন এখানে বসে রয়েছে_ ওর বাবার মৃত্যুর পর সমস্ত নিয়মকানুন পালন করে,ও পিতার শ্রাদ্ধাদিও করেছিল। আমি তখন বনগ্রামের বাইরে ছিলাম। দু’তিন মাস পরে আশ্রমে ফিরে একদিন গভীর রাত্রে(সুক্ষশরীরে) বনগ্রামের রাস্তা বরাবর ঘুরছি_হটাৎ দেখি নগেনের বাবা(সুক্ষশরীর বা প্রেতশরীর) লাঠি হাতে হাঁটতে হাঁটতে মাঠের দিক থেকে ওদের বাড়ীর দিকে যাচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়েই লাঠিতে ভর দিয়ে কষ্ট করে এসে প্রণাম করল। আমি বুঝতে পারলাম যে, নগেন যতই শ্রাদ্ধকৰ্ম করুক ওর বাবার মুক্তি ঘটে নি_ চেতনায় সেই আগের অবস্থাতেই রয়ে গেছে। আমি বললাম, 'বাবা কেমন আছাে ?' ওর বাবা বলল_ 'আর বাবা শরীরটা খুব খারাপ হয়ে গেছে—বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা ! শরীর নিয়ে সুখ নেই, রাত্রে যন্ত্রণায় ভাল ঘুম হয় না, তাই একটু পায়চারি করছি !' তখন তার সঙ্গে চেতনায় সংযােগ স্থাপন করে বীজমন্ত্রটা স্মরণকরিয়ে দিয়ে বললাম, “এটা জপ কর"। তারপর দেখলাম সেই অবয়বটা মিলিয়ে যেতে থাকল_নগেনের বাবার মুক্তি ঘটে গেল। হ্যাঁরে নগেন ! তুই আর তোর পুরোহিত মিলে মন্ত্র উচ্চারণ করে কি শ্রাদ্ধই করলি_ কাজের কাজটা আমাকেই করতে হোল। তবে তাের বাবার এবার যে জন্ম হবে–সেটা ভালােই হবে।
আমি দেখেছি_বনগ্রামের উপর মা জগদম্বা খুবই প্রসন্ন তাই এখানকার মানুষের তাড়াতাড়ি মুক্তি ঘটে। তাছাড়া এই গ্রামের মানুষ-জন বিশেষত মহিলারা আমাকে খুব ভক্তি করে। আশ্রম থেকে গ্রাম ঢুকতেই যে ঘোষবাড়ি রয়েছে_ঐ বাড়ির মা-টি খুবই ভক্তিমতী। আমি যখন সন্ধ্যাবেলায় গ্রামে(মুখার্জী বাড়িতে) যাই, প্রতিসন্ধ্যায় উনি তখন ঠিক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকেন _আর দূর থেকে জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রণাম করেন। ওনার স্বামী বা ছেলেদেরকে অগ্রাহ্য করে হয়তো উনি আশ্রমে আমার কাছে আসতে পারেন না_কিন্তু অন্তরে ভক্তি ঠিকই বজায় রেখেছেন! ওনার শরীরের কিছু বিশেষ লক্ষণ রয়েছে ,দেখবি_ শরীরের তুলনায় ওনার ছােট ছােট হাত, এটা লক্ষ্মীশ্রীর লক্ষণ ! গ্রামের প্রান্তে যে 'হুই' বাড়ি রয়েছে, ঐ বাড়ির দিদিমাও খুব ভক্তিমতী ছিলেন। তবে নগেন!_ তােদের গ্রামের পুরুষগুলাের ভক্তি মায়েদের থেকে অপেক্ষাকৃত কম ! তুলনায় সামন্তীর ক্ষুদিরাম,মদন মাজি, বটুখুড়াে_এরা সব কি ভাল মানুষই না ছিল ! ওদের কথা মনে আসতেই কত পুরানাে কথা মনে আসছে। আশ্রম গড়ে ওঠার পিছনে কত মানুষের কত অবদান! বনগ্রামের বাড়ীর মায়েরা আশ্রমের লােকেদের জন্য মুড়ি ভেজে দিতো। মুখার্জীবাড়ী ও নবুমাষ্টারের বাড়ী এবং আরো অন্যান্য বাড়িতে বাইরে থেকে ভক্তরা এসে থাকতো, খেতাে। তখন আশ্রমে চা খাবার ব্যবস্থা ছিল না, তাই বাইরের ভক্তরা চা খাবার জন্য গ্রামের বিভিন্ন বাড়ীতে যেতাে।
একটু আগে তুমি কুসংস্কারের কথা বলছিলে না __তা দ্যাখাে, এই মানুষগুলি ছিল কুসংস্কারমুক্ত। কোথা থেকে কত ধরণের মানুষ এসেছে, সকলকে আপন ভাবা বা আপন করে নেওয়াতেই তারা আনন্দ পেতাে! বটুখুড়াে, মদন মাজি এরা তখন কতটুকুই বা আমাকে চিনত—কতটুকুই বা আশ্রমের ভবিষ্যৎ রূপরেখার সঙ্গে পরিচিত ছিল, কিন্তু কতভাবে যে আমার কাজে সহযােগিতা করেছে ভাবা যায় না ! এটাই আধ্যাত্মিকতা। ঠিক ঠিক আধ্যাত্মিক মানুষ ভড়ং করে না _সেখানে পােশাক, মালা-চন্দন, তিলকের কোন প্রয়ােজন হয় না। যেখানে মানুষের সেবা হবে, কল্যাণ হবে—সেখানেই তারা লেগে যায়। তাদের কি জাত, কি ইষ্ট, কি ধর্ম, কি বর্ণ—এসব দেখে না ! এ যুগটা স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ অনুসরণ করার যুগ। মানব-কল্যাণমূলক যেখানে যে কোন কাজ হচ্ছে—জানবে সেটা যুগধর্ম, যুগপ্রয়ােজন অনুযায়ী জগদম্বার ইচ্ছাতেই হচ্ছে ! সেখানে যারা কাজ করছে, তাদের সাথে হাত লাগাও, সহযােগিতা করো ! মা জগদম্বার কাজ কোন মিশন বা আশ্রমেই যে সীমাবদ্ধ _তা কিন্তু নয়। যেখানে _যে প্রত্যন্ত প্রদেশে_ জনকল্যাণমূলক বা সেবামূলক কাজ হয়ে চলেছে সেটা মা জগদম্বারই কাজ ! বিরােধ কোর না—বাধা দিও না, বিনা দ্বিধায় সাধ্যমত তাতে অংশগ্রহণ করো_ এটাই আধ্যাত্মিকতা !
স্বামী বিবেকানন্দ একবার তাঁর গুরুভাইদের কাছে আক্ষেপ করে বলে-ছিলেন—"একটা কর্মক্লান্ত কৃষকের মুখে একটা বিড়ি ধরিয়ে দিতে পারাটাও যে আধ্যাত্মিকতা_ সেটা যদি তোরা বুঝতিস"! মানুষের প্রতি স্বামীজীর কি গভীর প্রেম ! তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে যায় ! এইজন্য স্বামীজীই আমাদের আদর্শ। তিনি বলেছিলেন—ভারতবর্ষের আদর্শ হােক ‘সর্বত্যাগী শঙ্কর।' আর আমি বলছি আধুনিক ভারতের যুবক-যুবতীর আদর্শ হােক স্বামী বিবেকানন্দ, আর তাতেই জাতির ও দেশের মঙ্গল হবে।