স্থান ~ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন । সময় ~ ১৯৯o, সেপ্টেম্বর ৷ উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ পঙ্কজবাবু, বিপ্লব, নগেন ও আশ্রমস্থ মহারাজগণ ৷
জিজ্ঞাসু :– আমিও শুনেছিলাম_ কোন কোন যােগী একস্থানে বসে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের মানুষের সাথে যােগাযােগ করতে ও তাদের উন্নতি করতে পারেন—কিন্তু ঐসব শক্তিমান সাধকদের শক্তির উৎস কি ?
গুরুমহারাজ :— তুমি কি এই ব্যাপারটা বললেও বুঝতে পারবে? তবুও আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি! এই যে তুমি একজন মানুষ _অর্থাৎ একটা ব্যক্তি, কিন্তু তােমাকে ঘিরে একটা বিরাট পরিমণ্ডল রয়েছে। প্রথমে তােমার পরিবার, তারপরে সমাজ, তারপরে রাজ্য, রাষ্ট্র, দেশ, মহাদেশ, পৃথিবী, সৌরমণ্ডল, গ্যালাক্সি… এই করতে করতে কত বৃহৎ, কত বৃত্তের যে পরিমণ্ডল রয়েছে তার ঠিক নেই। এইভাবে আমরা সকলেই কোন না কোন পরিমণ্ডলের অন্তর্গত। কিন্তু তােমার নিজের উপরেই তোমার কোন control নেই, তাই তুমি তােমার পরিমণ্ডলের উপরেও কোন control আরােপ করতে পারছো না। দেখবেএকই পরিবেশে বেড়ে ওঠা একজনকে অনেকে মান্যগণ্য করছে, আবার কাউকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। এতে কি বােঝা যায় না যে, প্রথম ব্যক্তির power দ্বিতীয় ব্যক্তি অপেক্ষা বেশী। অধ্যাত্ম সাধনার দ্বারাই এই আভ্যন্তরীণ power বাড়ানাে যায়। এতে ঐ সাধকের পরিমণ্ডলের যেমন বিস্তৃতি বেড়ে যায়, তেমনি সাধনার গভীরতায় বিভিন্ন sphere-এর উপর control-ও বাড়তে থাকে। যেমন একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিন্দুকে কেন্দ্র করেই শুধুমাত্র Radius বাড়িয়ে বাড়িয়ে বৃহত্তর বৃত্ত, আরও বৃহত্তর বৃত্ত আঁকা যায়—যা শুধু গােটা পৃথিবীটাকেই ব্যাপ্ত করতে পারে তা নয়, সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেও পরিব্যাপ্ত করতে পারে তেমনি কোন সাধক তার দেহভাণ্ডকে কেন্দ্র করে তার পরিধি বাড়াতে বাড়াতে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পরিব্যাপ্ত হতে পারেন। এই অবস্থাটাই বিষ্ণু। যিনি সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের sustaintion ও operation-এর কর্তা।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে–
“যােগীশ্বরম বন্দে শিবম
যােগেশ্বর বন্দে হরিম।”
শিব যােগীশ্বর_ তাঁর সব আছে কিন্তু প্রকাশ নেই। আর হরির ঐশ্বর্যের প্রকাশ আছে। তাই শিবের অবতারও রয়েছে কিন্তু সাধারণত হরির অবতারগণই যুগাচার্যরূপে জীবের কল্যাণসাধন করেন ও তাদেরকে যুগােপযােগী পথের দিশা দিয়ে যান। শিববতাররা ওসব তােয়াক্কা করেন না—যাদেরকে সামনে পান তাদের সর্বনাশ করে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যান—যুগধর্ম প্রচারের বা প্রসারের দায়িত্ব নিতে যান না। হরির অবতারেরা সবসময়ই সাধারণের জন্য, সাধারণ বেশে- সাধারণের মাঝে এসে_ তাদের মতাে হয়েজগদ্ধিতায় কাজ করেন। তাই তাঁদের কৃপাময় বা করুণাময় বলা হয়। সাধারণ মানুষের কাছে হরির অবতারের সান্নিধ্যলাভ প্রকৃত অর্থেই সুদুর্লভ—কারণ ঈশ্বরের সঙ্গলাভ মুনি-ঋষিদেরও দুষ্প্রাপ্য। অথচ সেই হরি তখন করুনাময় রূপে স্থুলশরীর ধারণ করে অবতীর্ণ হন __তখন সাধারণ, অতি সাধারণ,ব্রাত্য,হীনকুল, সমাজের অপাঙক্তেয় হিসাবে গন্য জগা, মাধা, হরি, পচা সবাই সুযােগ পায় তাঁকে কাছ থেকে দেখার, স্পর্শ করার, জল বা খাদ্য খাওয়াবার, সেবা করার ! এইজন্যেই অবতারগণকে বলা হয় দয়াময় বা করুনাময়!!
কিন্তু যেহেতু তিনি ষড়ৈশ্বর্যবান, হরির অবতার– তাই তাঁর মধ্যে ঐশ্বর্যের প্রকাশ ঘটে যায়। সাধারণের মতাে হয়ে, সাধারণের মধ্যে থাকলেও কিছুকালের মধ্যেই তাঁর মধ্যে অসাধারণত্ব প্রকাশ পেয়ে যায়। আর সাথে সাথেই তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ভক্তের পরিমণ্ডল—শুরু হয়ে যায় যুগাবতারের আরব্ধ কাজ! কাজের পটভূমি তৈরি করে দিয়েই অবতার লীলা সংবরণ করেন কিন্তু তিনি যাদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন_তাঁদেরকে কেন্দ্র করে পরে আবার নানান সমাজকল্যাণমূলক কাজ হতে থাকে। এইরকমভাবেই চলছে বর্তমানের মানবসমাজ!
ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এই যে ত্রিশক্তি অথবা হরির অবতার বা শিবাবতার —এগুলি সবই তাে প্রকাশের ভিন্নতা বা কার্যকারিতার ভিন্নতা ! প্রকৃতপক্ষে শক্তি তাে শক্তিই। আর যদি বলাে শক্তি কার ?” আমি বলব “শক্তি তাঁর।” “তাঁর” বলতে কিন্তু ‘his’ বা ‘her’ নয়, এখানে “সে" বা ‘তাঁর' অর্থে “That"। 'His’ বা ‘her' হলে ব্যক্তিসত্তা আরােপিত হবে-- মূর্তি আসবে, নারী না পুরুষ এই নিয়ে বিতর্ক চলবে ! সুতরাং ওসবে ফেঁসাে না। জানবে এই মহাবিশ্ব এক মহান শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত _যার মধ্যে বিভিন্ন Principle ক্রিয়াশীল। এটাকেই প্রকাশের ভিন্নতা বলা হচ্ছে।Principle-গুলি হোল__(1) Principle of Projection–ব্রহ্মা। (2) Principle of Preservation and operation–বিষ্ণু।
(3) Principle of destruction—মহেশ্বর।
বিন্দু থেকে বিসর্গ—এটাই বিস্তার বা অবরোহ আবার বিসর্গ থেকে বিন্দু–এটাই আকুঞ্চন বা আরােহ। চিত্রাকারে ব্যাপারটা এমন হবে :–
• • (বিসর্গ)
• (বিন্দু)
• • (বিসর্গ)
ঊর্ধ্ব ত্রিমাত্রা ও অধঃ ত্রিমাত্রা। মহেশ্বরের হাতে যে ডমরু বা পিনাক রয়েছে তার চিত্র এইরূপ। মহাকাল বােঝাতে এই Symbol ব্যবহার হয়েছে। বিন্দু থেকে বিসর্গ আবার বিসর্গ থেকে বিন্দু—মহাশক্তিতরঙ্গের এই প্রবাহ বয়ে চলেছে বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির আদি থেকে। আর এর মধ্যেই কাল বা মহাকালের অবস্থান। বিসর্গ নষ্ট হয়ে বিন্দুতে মিলিত হয়ে গেলে আর কালের অস্তিত্ব থাকবে না। বিন্দুর এক এবং বিসর্গের দুই এই তিনটি ক্ষেত্রে স্বয়ং মহাশক্তিরূপিণী মহাসরস্বতী বা ব্রহ্মাণী, মহালক্ষ্মী এবং মাহেশ্বরী বিরাজ করেন। অবরােহ ও আরােহক্ৰমে যে ঊর্ধ্ব ত্রিমাত্রা ও অধঃ ত্রিমাত্রা—এতে ষটকোণ সৃষ্টি হয়, আর এই ষট্কোণ থেকেই ষট্বিকার উৎপন্ন হয়। এইভাবেই প্রাগ্-উৎপত্তি, উৎপত্তি, প্রবৃদ্ধি, রূপান্তর, ক্ষয় ও লয় হয়ে চলেছে। তন্ত্রে রয়েছে : 'ত্বং স্বাহাঃ, ত্বং স্বধা, ত্বং হি বষট্কারা।” এই যে ডমরুর ন্যায় কালচক্র, এর মধ্যে সবসময়ই সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় হয়ে চলেছে। কত গ্রহ, নক্ষত্রাদি মুহূর্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং Black whole-এরূপ নিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ঐ Black whole-ই যেন মহাকালীর জিহ্বা যা মুহূর্তে যে কোন কিছুকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আবার কোন স্থান থেকে সর্বদা সৃষ্টির বীজ বেরিয়ে আসছে। সুতরাং সৃষ্টি এবং লয় এ দুটির মধ্যাবস্থাটাই স্থিতি বা কাল। আর সবকিছু একত্রে যেন কালচক্র !
তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে,সৃষ্টি ও লয়ের মধ্যাবস্থাটাই কাল বা মহাকালরূপে বর্ণিত হয়েছে। আর সেই সময়ের মধ্যে বা মহাকালের বুকে যা কিছু হয়ে চলেছে বা ঘটে চলেছে তাই মহাকালীর নৃত্য। Static শবরূপী শিবের বুকে dynamic কালীর নৃত্য—এটাই জগৎ, এটাই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য যা প্রকৃতিতে সকলের কাছে প্রতীয়মান রয়েছে। এইভাবেই কালচক্রে অবরােহ ও আরােহ হয়ে চলেছে যা বিন্দু আর বিসর্গের খেলা। একটি অবরােহ এবং একটি আরােহকে নিয়ে হয় এক একটি কল্প। কল্প শেষ হয় _ কিন্তু মহাশক্তির খেলা শেষ হয় না ! তা চলতে থাকে কল্প থেকে কল্পান্তরে। শক্তির যে static অবস্থা তাকে ‘ব্রহ্ম’ বলা হয়েছে। আর ঐ বিন্দু থেকে বিসর্গে আসা আবার বিসর্গ থেকে বিন্দুতে ফিরে যাওয়া—এটি ব্রহ্মবিলাস, ফলে কল্প থেকে কল্পান্তরে শুধু ব্ৰহ্মবিলাসই হয়ে চলেছে। সাধারণ মানুষ এই জগতে কতকিছু দেখে,কত বৈচিত্র্য-কত হাসিকান্না-যুদ্ধবিগ্রহ-সাম্রাজ্যের উত্থানপতন_কিন্ত জ্ঞানীরা “এক” দেখেনব্রহ্মবিলাস!
এতক্ষন যে আলোচনা করা হোল সেই ব্যাপারটা কি তুমি বুঝতে পারলে ? তুমি বিভিন্ন মহাপুরুষদের যে শক্তির উৎস খুঁজছিলে— তা কি পেলে ? দ্যাখো, সাধারণ মানুষের যার যতটা sphere _সে তার মধ্যেই তার শক্তির প্রকাশ ঘটাতে চায় ! এইভাবেই সমাজের কোন শক্তিশালী ব্যক্তির দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি শক্তির প্রকাশ ঘটলে__তা দেখে বহু সাধারন মানুষ বিস্মিত হয় এবং তার অনুগত হয় বা তার পদানত হয়। আবার সাধারণ মানুষদের মধ্যে তারা একটু উন্নত মানসিকতার লােক_ তারা প্রাকৃতিক শক্তির বিশালতার কাছে মাথা নােয়ায় আবার এদের থেকেও উন্নত মানুষ যারা _তারা ঈশ্বরের শক্তির সর্বব্যাপিত্ব ও সর্বপ্রকাশক রূপের কাছে শরণাগত হয়।
এইভাবেই যার জ্ঞানের পরিধি, চেতনার পরিধি যত বেশী তার কাছে শক্তিতত্ত্ব ততটাই অধিক থেকে অধিকতররূপে প্রকাশিত। আর একটা রহস্য বলছি শােন, যে ব্যক্তি যে Level-এ রয়েছে সে তার থেকে বেশী কোন শক্তিমানকে আদর্শ করে অর্থাৎ তার মত হতে চায়। সুতরাং উন্নত মানব বা অধ্যাত্মপথের সাধকের আদর্শও হয় উন্নত এবং তার জীবনের লক্ষ্য হয়—ঈশ্বরলাভ ! ঈশ্বরলাভ অর্থে ঈশ্বরত্ব লাভ__তাই সাধনার চূড়ান্ত অবস্থায় সাধকের মধ্যে ঈশ্বরীয় শক্তির প্রকাশ দেখা যায়। ঈশ্বরের ষড়ৈশ্বর্যের শ্রী, বল, যশ ইত্যাদি সকল ঐশ্বর্যই ধীরে ধীরে তাঁর মধ্যে প্রকাশিত হতে থাকে। বাউলগানে বলেছে-“এই মানুষে সেই মানুষ আছে”। যে মানুষ “সােনার মানুষ"। মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য,ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ- এরকমই এক একজন সােনার মানুষ ছিলেন। এঁদেরকে দর্শন পাওয়াই কত জন্মের তপস্যার ফল।
একটা গান রয়েছে _"ময়লি চাদর...."! বহুদিনের ময়লা জমে থাকা চাদর ধুয়ে-কেচেও পরিস্কার করা যাচ্ছে না_তাই কোন সাধক প্রাণের আর্থিক নিয়ে এই গানটি রচনা করেছিল। সাধারণ মানুষের মন যেন সেই “ময়লি চাদর”...। মন মলিন হয়ে আছে, মনের কোণে ময়লার পুরু আস্তরণ। কিভাবে মনের এই ময়লা যেতে পারে? তা যেতে পারে একমাত্র–সদগুরু সন্নিধানে ! সদগুরু কানে কানে যে মন্ত্র দেন সেই মন্ত্রই_ মনকে ত্রাণ করে। 'মন’ কে ‘ত্রাণ’ করে যা—তাই মন্ত্র। আর ইষ্ট কি–না যা অনিষ্ট দূর করে। তাই “ইষ্টমন্ত্র” বলা হয়েছে।
কিন্তু জানোতো__ কারও মন পূর্ব থেকে মলিন ছিল না। অনিত্য বিষয় সমূহের ছাপ পড়ে পড়ে স্বচ্ছ মন মলিন হয়ে গেছে। এই মলিন মনে ঈশ্বরীয় তত্ত্ব বা অধ্যাত্ম তত্ত্বের প্রবেশই ঘটে না__ তাে বােধের কথা দূর অস্ত ! আমি অনেককেই দেখেছি__ যখন সিনেমার গল্প হচ্ছে—পলিটিক্যাল তর্ক হচ্ছে তখন তাদের খুবinterest, কিন্তু যেই অধ্যাত্ম কথা শুরু হ’ল অমনি ‘হাই’ তুলতে লাগল ! তােমরাও লক্ষ্য করবে—এটা খুবই দেখতে পাবে। তাহলে উপায় কি ? উপায় হোল_ পুনরায় নিত্যের চিন্তা করতে করতে আবার মনকে স্বচ্ছ করে তোলা। স্বচ্ছ মনে অর্থাৎ শুদ্ধ মনে ধারণা পাকা হয়। আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাে বলেই দিয়েছেন যে, শুদ্ধ মনে ব্রহ্মের মহিমা গােচরীভূত হয় ! তাই আমি তােমাদের সকলকে বলছি—সদগুরুর চরণাশ্রিত হয়ে তাঁর নির্দেশ অনুসারে, তাঁর দেওয়া জীবন পথের পাথেয় অবলম্বন করে এগিয়ে চল। চরৈবেতি—চরৈবেতি। দেখবে যতই অন্ধকার মনে হােক, ঠিক-ই পথের শেষে আলাের দিশা পাবে। জ্যোতির্লোকে প্রবেশের দ্বার খুলে যাবে।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।