স্থান ~ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন । সময় ~ ১৯৯১ সাল । উপস্থিত ভক্তগণ ~ স্বামী স্বরূপানন্দ, পঙ্কজবাবু, গঙ্গাবাবু ইত্যাদি ।
জিজ্ঞাসু :— স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের প্রতি আকর্ষণজনিত কারণে মানুষের জীবনের অধিকাংশ সময় সাংসারিক কাজেই ব্যয়িত হয়—ঈশ্বরের জন্য বা ভগবানের জন্য সময় দেওয়া প্রায় হয়েই ওঠে না। তাহলে আমাদের মতাে সংসারীর কি করা কর্তব্য ?
গুরুমহারাজ :– দ্যাখাে, যখন মানুষ মায়ের গর্ভ থেকে প্রথম জন্ম নিয়েছিল, তখন তো সে স্ত্রী-পুত্ৰাদিকে সঙ্গে করে আনেনি_ আবার যখন মারা যাবে, তখনও সঙ্গে করে নিয়ে যাবে না। এই জগৎ-সংসারে জন্মগ্রহণ করে মানবের জীবনকালে আর পাঁচটা বস্তুর ন্যায় বিভিন্ন ব্যক্তির সাথেও তার সংযােগ স্থাপন হয়। তাদের মধ্যে অনেকের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, অনেকের সাথে গড়ে না। তবে কোন সম্পর্কই তাে চিরন্তন নয়। আচার্য শঙ্কর বলেছেন, “কে মাতা, কে পিতা, কে স্ত্রী, কেই বা পুত্র–সকলই মায়ার বন্ধন, একমাত্র ‘মা ভবানী’ই জীবের মুক্তির কারণ।”
তাছাড়া 'আমার স্ত্রী’ বা ‘আমার পুত্র' যাদেরকে বলছো, কে জানে__ কে কার স্ত্রী বা কে কার পুত্র ? তােমার এই জন্ম বা জীবনকাল তাে পূর্ব পূর্ব অনেকগুলি জন্মের ফলমাত্র। ফলে এই জন্মে যাকে তােমার স্ত্রী ভাবছো বা পুত্ৰাদি ভাবছো এবং তাদের মনােরঞ্জনের জন্য প্রাণাতিপাত করছো—আগের আগের জন্মে তারা কার স্ত্রী বা কার পুত্র ছিল তা কি তুমি জানাে ? এখানেই বসে আছে এমন অনেককেই আমি জানি যারা এজন্মে যে স্ত্রী লাভ করেছে, পূর্ব জন্মে সে অন্যের স্ত্রী ছিল বা অনেক স্ত্রী-শরীর এখানে বসে রয়েছে_ যাদের পূর্ব পূর্ব জন্মে অন্য স্বামী ছিল ! এবার আমি যদি সত্যি বলে দিই _তাহলে কি গণ্ডগােল লাগবে ভাবাে একবার ! মহামায়ার মায়ায় সবাই পুর্ব পূর্ব জন্মের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে, তাই বর্তমানে যেটা দেখছে বা ঘটছে সেটাকেই সঠিক বােধ করছে।
জানো__অনেকসময় পূর্ব জন্মের মহাশত্রু__ পুত্র, কন্যা, ভ্রাতা বা স্ত্রী ইত্যাদি হিসাবে জন্মগ্রহণ কোরে প্রতিশােধ নেয় ! এর ফলে তুমি তোমার প্রিয়জন হিসাবে তাকে ফেলতেও পারবে না,আবার তার সমস্ত অত্যাচারও সহ্য করে যেতে হবে_ এই হল মহামায়ার মায়া ! তাই বলা হয়েছে “মম মায়া দুরত্যয়া"।
ঠিক ঠিক জ্ঞান হলে দেখা যাবে _তুমি আছ আর ঈশ্বর আছেন। তাহলে গুরুর ভূমিকা কি নেই ? হ্যাঁ আছে–গুরু থাকেন শুরুতে। ভক্ত আর ভগবানের সংযােগ ঘটান তিনি, ঘটক বা Middleman বলতে পারাে। এরপর 'চরৈবেতি' ‘চরৈবেতি’ করতে করতে শেষে পৌঁছে দ্যাখা যায় গুরুও নাই _ তুমিও নাই, শুধু ঈশ্বরই আছেন ! সেই অবস্থায় তুমি-আমি ভেদ থাকে না, তুমিই আমি- আমিই তুমি—এই বােধ থাকে। এটা বিজ্ঞান অবস্থা। অজ্ঞানী, জ্ঞানী আর বিজ্ঞানী–জীবের তিনটি ভাগ রয়েছে। "আমি-আমার" ভাবটা অজ্ঞান অবস্থা। "আমি-তােমার"ভাব হোল জ্ঞান অবস্থা। আর তুমি-ই আমি বা আমিই তুমি—বিজ্ঞান অবস্থা।
অজ্ঞানীরা “আমি-আমার” অবস্থা থেকে ভাবে আমার স্ত্রী, আমার পুত্র, আমার বিষয়, আমার সম্প্রদায়, আমার সমাজ ! বিভিন্ন এষণার পিছনে ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে মানুষ—পুত্রৈষণা, বিত্তৈষণা, লােকৈষণা, ভােগৈষণা ইত্যাদি। কিন্তু কিছুতেই শান্তি মিলছে না কেবল এখান থেকে ওখানে ছুটে ছুটে বেড়ানােই সার হচ্ছে।
শাস্ত্র বলছে–‘ন জাতু কামঃ কামানামুপভােগেন শাম্যতি।’ –কাম্যবস্তুর উপভােগে কামনার শান্তি হয় না। ঋষিরা এটাই বুঝতে পারলেন যে, এভাবে ছুটে বেড়ালে শান্তি পাওয়া যাবে না। উপভােগে শান্তি নেই, অপরাপর বস্তুতে শান্তির স্থায়িত্ব নেই । তাই তাঁরা সিদ্ধান্ত করলেন যে, বাইরের কোন বস্তুতেই যখন শান্তি নেই তখন নিজের মধ্যেই শান্তির অন্বেষণ শুরু করা যাক্। বৈষ্ণব ভক্তিতত্ত্বে এটিকেই বলা হয়েছে_ ‘অভিসার’। নিজের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পাবার ব্যাকুল প্রয়াস ! এইভাবেই এপথ-ওপথ করতে করতে সঠিক পথের সন্ধান পেল মানব, উত্তরণের পথ। এতদিন যেন হেথায়-হােথায় ছুটে বেড়ানাে “কোথায় পাবো তারে” ? সাধক প্রথমটায় বিভ্রান্ত হয়_ ব্যাপারটা ঠিকমতো বুঝতে পারে না। যেমন কস্তুরী মৃগ তার নিজের মধ্যেই যে কস্তুরীর সুগন্ধ বেরুচ্ছে—তা বুঝতে না পেরে চারিদিকে ছুটে ছুটে বেড়ায়, তেমনি অমৃতের পুত্র বা পূর্ণ থেকে উদ্ভূত মানব, অপূর্ণতার জ্বালা বুকে নিয়ে এগিয়ে চলে পূর্ণত্বের দিকে ! অবশেষে সে সন্ধান পায়তার নিজের মধ্যেই রয়েছে পূর্ণত্বে উপনীত হবার চাবিকাঠি ! সমাধির গভীরতায় পূর্ণত্বের বোধ হয়ঋষিকন্ঠে উচ্চারিত হয় বেদমন্ত্র__
“ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।”
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
ঋষিদের পরম বােধজাত এই “জ্ঞান”। এই বােধ চিরন্তন সত্য জানবে, অর্থাৎ “জ্ঞান” বা “বােধে বোধ” হয়ে গেলেই মানবের আর আত্মবিস্মৃতি থাকে না_ তখন শুধুই পূর্ণতার বােধ।
তাহলে বােঝা গেল যে, অজ্ঞানতাবশতই মানুষ “আমি-আমার” জগতে থাকে। শাস্ত্র বলছে ‘অহং-মম’ _ এই চেতনায় থাকলেই শত-সহস্র বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে মানুষ। নানান কর্ম-বিপাকে পড়ে নাকানি-চোপানি খেতে হয়। জীবকে কর্ম করতেই হয় আর তারজন্যই কর্মফলও সৃষ্টি হয় সুকর্মের সুফল,কুকর্মের কুফল! এই ফলের ভোগ বা ভোগান্তি পরবর্তী জন্মগুলিতে ভুগতে হয়। এই জন্যই দেখা যায় যে, মানবের জীবনে কখনাে একটু সুখের মুখ তারপরই আবার দুঃখভােগ বা ভােগান্তি ! নিরবচ্ছিন্ন শান্তি বা সুখের অবস্থাকখনই তৈরি হয় না। কিন্তু মানবের মধ্যেই নিহিত আছে পূর্ণত্বের সম্ভাবনা, তার অন্তঃকরণে স্বভাবের মধ্যেই আছে নিরবচ্ছিন্ন শান্তির সংস্কার। তাই আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক জ্বালার সাথে সাথে মাঝে-মধ্যেই আধ্যাত্মিক জ্বালাও তাকে পীড়া দেয়। এইভাবে ত্ৰিতাপক্লিষ্ট মানব স্ব-স্বরূপে স্বয়ং পূর্ণ হয়েও অপূর্ণতাজনিত বিভিন্ন জ্বালা বহন করে নিয়ে চলেছে জন্ম থেকে জন্মান্তরে। এই অপূর্ণতা থেকে একমাত্র তখনই মুক্তি ঘটবে, যখন সে কর্ম-বন্ধন থেকে মুক্তির আশায় একান্তভাবে ব্যাকুল হবে !
ব্যাকুলতার রহস্যটিও বলছি শােন। আন্তরিক ব্যাকুলতার এত জোর যে, এটি Universal Principle-কেও স্পর্শ করতে পারে ! আর এই আন্তরিক ব্যাকুলতা থেকেই মানবের কাছে আসেন গুরু ! তারপর এইগুরু-ওইগুরু করতে করতে অবশেষে সদ্গুরুর সন্ধান পায় মানব। এই সদগুরুই শিষ্যের সঠিক মার্গ নির্বাচন করে তার পূর্ণত্বের দিকে যাত্রার পথ সুগম করে দেন। ভক্তিশাশ্ত্রে রাধাকৃষ্ণের মিলন বা ভক্ত-ভগবানের মিলন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যখন ভক্ত-ভগবানের মিলন হয় বা ভক্ত ভগবানে লীন হয় তখনই হয় পূর্ণত্বের আস্বাদন !এটাই লীলাবিলাস ! এই লীলা হয়ে চলেছে যুগ হতে যুগান্তরে। যিনি বা যাঁরা এটাকে ধরতে পারেন তিনি বা তাঁরাই প্রকৃত জ্ঞানী বা প্রেমী ! আর যারা এই তত্ত্ব বুঝতেই পারে না তারা_ ধনী, গুণী বা পণ্ডিত যাই হােক না কেন_ তারা চরম অজ্ঞানী। তাহলে ব্যাপারটা কি বুঝতে পারলে মুক্তির উপায় কি—উপায় ব্যাকুলতা, উপায় সদগুরুশরণ। “অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন-শলাকায়া।/ চক্ষুরুন্মীলিতং যেন, তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ ॥”
জিজ্ঞাসু :– আপনি মাঝে মাঝে আপনার পূর্ব পূর্ব শরীরের কথা বলেন—আপনি কি কখনও নারীশরীর ধারণ করেছিলেন ?
গুরুমহারাজ :— হ্যাঁআমার নারী শরীরও ছিল। এখন যে শরীরটা তোমরা দেখছোএটা আমার ৬০,৪১৮ তম শরীর। এরপরও জগদম্বার ইচ্ছায় আমায় কতবার আসতে হবে তিনিই জানেন(একবার বলেছিলেন মোট ৬৪০০০-বার ওনাকে আসতে হবে)। মনুষ্যশরীরে আমি দু’বার নারীশরীরে এসেছিলাম। দু’বারই ব্রহ্মচারিণী শরীর ছিল। বিশেষ কাজের জন্য ঐ দু’বার শরীর নিতে হয়েছিল !
তবে মনুষ্য শরীরে উল্লেখযােগ্যের মধ্যে আমি একবার একটা পুরুষ শরীর নিয়েছিলাম, যার অনেকগুলি স্ত্রী ছিল। তবে আমি যখন যে শরীর-ই নিয়েছি, সবসময়েই আমার পূর্ণজ্ঞান বিরাজমান ছিল। তাই আজও কোন ঘটনাই বিস্মৃত হইনি। স্মৃতি ধরে একটু টান মারলেই পূর্বাপর সব ঘটনা স্মৃতিপটে এসে যায়। আবার দেখেছি, শুধু অতীতই নয়__আগামী কয়েকহাজার বছরের ঘটনাবলীও ইচ্ছামাত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে ! তাই আগামীতে কোথায় কি ঘটবে তাও আমার সবই জানা আছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন–“গ্রীনরুম বা সাজঘর দেখে যাত্রা শুনতে বসা” __অর্থাৎ যাত্রাপালার আগে গ্রীনরুমে ঢুকে কে কি সেজেছে, তা দেখে নিলে_যাত্রা শুনতে বসে কোন্ Roll কে করবে তা আগেভাগেই বলা যায়। তবে Roll দেখার যে enjoyment সেটা আলাদা ব্যাপার !