স্থান ~ পরমানন্দ মিশন, বনগ্রাম । সময় ~ ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ ৷ উপস্থিত ব্যক্তি ~ আশ্রমস্থ ও বহিরাগত ভক্তগণ ৷

জিজ্ঞাসু :– আপনি একবার বলেছিলেন_ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোন নক্ষত্রলোকেও প্রাণের বা প্রাণীর অস্তিত্ব আছে। কিন্তু এই সৌরমণ্ডলে তো কোথাও প্রাণী নেই?

গুরুমহারাজ :— না তা নেই। সূর্য থেকে বুধ, শুক্র, পৃথিবী এবং তারপর মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি ইত্যাদি পরপর গ্রহগুলি অবস্থান করছে বা এরা বিভিন্ন কক্ষপথে সূর্যকে আবর্তন করছে। দ্যাখো_ সূর্য থেকে প্রতিনিয়তই তো তাপ বা আলো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, এবার যে গ্রহ সূর্যের যত কাছে আছে, সে তাপ তত বেশি পাচ্ছে।ফলে সেখানে এত উত্তাপ যে, সেগুলি যেন এখনো জ্বলছে ! আবার যে গ্রহগুলি সূর্য থেকে যত বেশি দূরে আছে সে ততটা কম তাপ পাচ্ছে(ইউরেনাস, নেপচুন ইত্যাদি) শেষের দিকের গ্রহগুলি তো প্রচন্ড ঠান্ডায় জমে কৃষ্টাল অবস্থায় রয়েছে !

 দেখা গেছে পৃথিবী গ্রহটি সূর্য থেকে যে দূরত্বে রয়েছে _সেটাই প্রাণধারণের এক্কেবারে ideal দূরত্ব। কারণ সূর্য থেকে আগত রশ্মি ও তাপ খুব বেশিও নয়-খুব কম‌ও নয় ! এই আলো এবং তাপ পৃথিবীর একেবারে আদিম অবস্থায় নানারকম রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে সাহায্য করেছে, ফলে সৃষ্টি হয়েছে জীবন ধারনের প্রধান উপাদান অক্সিজেন-সৃষ্টি হয়েছে উপযোগী আরও অনেক যৌগিক পদার্থ ! তাছাড়া এর ফলে এক সময় পৃথিবীতে দীর্ঘকাল ব্যাপী বৃষ্টিপাত হোতে সাহায্য করেছে ! আবার দ্যাখো_বায়ুমণ্ডল সৃষ্টি হবার পর,এর বিভিন্ন স্তর কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত তাপ বা সূর্যালোক পৃথিবীতে প্রাণ ধারণের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে__ আর এইসব ব্যাপারগুলো ঠিকঠাক হয়েছে বলেই এই সৌরমণ্ডলের সমস্ত গ্রহের মধ্যে একমাত্র পৃথিবীগ্রহেই জীবের সৃষ্টি হয়েছে এবং তাদের বিবর্তন‌ও হয়েছে __ যার চূড়ান্ত রূপ হোল আজকের মানুষ।

   এবার একটা মজার কথা বলি শোন, অনেক সময় দেখবে মহাকাশ-বিজ্ঞানীরা দাবি করছে যে __কোনসময় চাঁদে বরফ ছিল, মঙ্গলে বা শুক্রে জল ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ব্যাপারগুলো কি! একটু আগে যে বলছিলাম সূর্য থেকে পৃথিবীর যে দূরত্ব (১৫ কোটি মাইলের মত) এটাই হল সৃষ্টির বা প্রাণ ধারণের ideal দূরত্ব। বিজ্ঞানীরা বলছেন এই মহাবিশ্ব এখনও expansion বা প্রসারিত হয়ে চলেছে অর্থাৎ প্রত্যেকটি গ্রহ বা নক্ষত্র পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। আবার একসময় আসবে তখন contraction বা সংকোচন হবে অর্থাৎ প্রতিটি মহাজাগতিক বস্তু পরস্পর পরস্পরের কাছে চলে আসবে।

যাইহোক, এখন যেহেতু প্রসারণের সময় চলছে— তাহলে এই পৃথিবী সূর্য থেকে ধীরে ধীরে আরও দূরে সরে যাচ্ছে এবং এমন একটা সময় আসবে যখন শুক্রের কক্ষপথ বাড়তে বাড়তে পৃথিবীর বর্তমান অবস্থায় আসবে। এটা দেখা গেছে যে, সেটা হতে হতে হয়ত কয়েক কোটি বছর লাগবে, তারপর আর কিন্তু প্রসারিত হবে না তখন হবে সংকোচন। এই সঙ্কোচনের সময় আবার পৃথিবী তার পূর্বের স্থানে কোন সময় আসবে। কিন্তু আরও সংকোচন হলে পৃথিবী সূর্যের আরও কাছে চলে যাবে কিন্তু মঙ্গল সেই স্থানটি দখল করবে।

  সুতরাং এটা বোঝা গেল যে, এই process-গুলোর এত ধীর প্রক্রিয়া এবং এত দীর্ঘকাল এর স্থায়িত্ব যে, যখন যে গ্রহ সঠিক স্থানে এসে পৌঁছায় তখন সেখানেই জল সৃষ্টি হয়, বায়ুমণ্ডল সৃষ্টি হয় এবং প্রাণের সঞ্চার শুরু হয়। কয়েক কোটি বছরের বিবর্তনে আবার সেই গ্রহটি হয় সূর্যের কাছে চলে আসে বা দূরে সরে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এই সৌরমণ্ডলে মঙ্গল, পৃথিবী ও শুক্র এই তিনটি গ্রহের মধ্যে প্রাণের বিবর্তনের খেলা হয়ে থাকে।

এইজন্যেই বলা হয়_ ঈশ্বরের লীলার অন্ত হয় না, শুধু স্থান ও কালভেদে __পাত্রভেদ হয়। পৃথিবীগ্রহেরলীলার কাজ শেষ হলেই বা শেষ হবার আগেই অন্যত্র লীলা শুরু হয়ে যায়। আবার একত্রে একসঙ্গে বিভিন্ন গ্রহান্তরেও লীলাও চলে ! কথায় আছে না — ঈশ্বরের লীলা কে বুঝতে পারে!

জিজ্ঞাসু :– শ্রীমদ্ভগবদগীতা মহাভারতের অন্তর্গত খানিকটা অংশবিশেষ। এবার মহাভারত অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে, শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অর্জুনকে কিছু কথা বলছেন — সেখানে কিন্তু প্রত্যক্ষ কেউ ছিল না, তাই কি কথা হয়েছে কেউ শোনেনি। ধৃতরাষ্ট্র দিব্যচক্ষুপ্রাপ্ত সঞ্জয়ের দ্বারা যা শুনল, সেটা আবার ব্যাসদেব লিখল। এতো বহু ঘাটের জল, সুতরাং ব্যাপারটার originality নষ্ট হয়ে যাবারই তো কথা! অথচ বলা হয় গীতা হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ — এটি চিরন্তন, শাশ্বত। সকল মহাপুরুষগণও এই গ্রন্থকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিলেন — এই সম্বন্ধে আপনি কি বলবেন?

গুরুমহারাজ :— এককথায় তুমি জানতে চাইছো_ গীতাতে “শ্রীভগবানুবাচ” বলে যে শ্লোকগুলি রয়েছে সেগুলি ‘ভগবানের কথা’ বলে কেউ চালিয়ে দিয়েছে কিনা — এই তো! আচ্ছা বলছি শোন :

তুমি যে বললে ওখানে কেউ উপস্থিত ছিল না — এটা ঠিক নয় ! অনেকেই ছিল মহাভারতেই উল্লেখ রয়েছে যে অর্জূন ছাড়াও দূর্যোধন শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন করেছিল — কিন্তু তার উপর এর কোন effect হয়নি, দূর্যোধন শ্রীকৃষ্ণকে মায়াবী, জাদুকর ইত্যাদি বলেছিল ! দ্যাখো_ উপযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কখনও কেউ ভগবানের মহিমা বুঝতে পারে না, ভগবান শুধুমাত্র ভক্তের কাছেই ধরা দেন ! দিব্যদৃষ্টিপ্রাপ্ত সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে যে কথাগুলি বলেছিলেন তার কোনো বিকৃতি ঘটেনি — যা সত্য তাই বলেছিলেন। এর কারণ সঞ্জয় ছিলেন সত্যবাদী, ধার্মিক ও সদাচারী। তাঁর এই সমস্ত সদগুণ ছিল বলেই তো তিনি দিব্যদৃষ্টির অধিকারী হয়েছিলেন — কই আর কারও তো এই সৌভাগ্য ঘটেনি ! ব্যাসদেবও ঘটনা ঘটার সময়ই হোক আর পরবর্তীকালেই হোক সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করেই লিখেছিলেন। বিশ্বাস হোল না তো_ তাহলে রাম জন্মবার আগেই বাল্মিকী কি করে রামায়ণ লিখেছিলেন? বিভিন্ন শাস্ত্রাদিতে উল্লেখ আছে যে, ব্যাসদেব সমস্ত ঘটনা সত্য জানার পরই তা লিপিবদ্ধ করেন। এছাড়া দ্যাখো — ব্যাসদেবই সঞ্জয়-ধৃতরাষ্ট্রের কথোপকথন বা সঞ্জয়ের দিব্যদৃষ্টির ব্যাপারসমূহ মহাভারতে লিখে রেখেছিলেন বলেই তো তুমি জানতে পারছো_ তাই না? তিনি তো সরাসরি নিজেই শুনেছেন এরূপ কথাও লিখতে পারতেন — তা করলেন না কেন? এইসব ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে _ভগবানের মহিমাকে যথাযথ তুলে ধরতেই তিনি যা সত্য তাই বর্ণনা করেছেন।

  যাইহোক, এবার কথা হচ্ছে — কোন ধর্মশাস্ত্র তা ভগবান স্বয়ং লিখুন বা বলুন অথবা অন্য কেউ লোককল্যাণের জন্য লিপিবদ্ধ করুক — তাতে সাধারণ মানুষের কতটাই বা আসে যায়? ক'জন মানুষ ধর্ম-শাস্ত্রাদির মূল্য দেয়? কত সহস্র ধর্মশাস্ত্র যে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কত সহস্র ধর্মশাস্ত্র এখনও গিরি-গুহার অভ্যন্তরে সযত্নে অথবা অযত্নে রয়ে গেছে — ক'টা সাধারণ মানুষ সেই নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে বা হাহাকার করেছে? আর করলেই বা কি হতো? ধর্ম কি শাস্ত্রে আছে — ধর্ম আছে মানুষের হৃদয়ে। শাস্ত্রেই বলা হয়েছে__ "ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং" — হৃদয়গুহায় নিহিত রয়েছে ধর্মের তত্ত্বসমূহ। সেইখানে খোঁজ, তবেই ধর্মতত্ত্ব জানতে পারবে। কুরুক্ষেত্রের রনাঙ্গনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতা বলেছিলেন, — গীতাপাঠ করে তো আর তিনি কৃষ্ণ হননি __হয়েছিলেন কি? তাই হাজার বছর ধরে ধর্মশাস্ত্র পাঠ করেও কেউ ধার্মিক হতে পারে না _যতক্ষণ না তার হৃদয় নির্মল হচ্ছে ! নির্মল হৃদয়ে ভগবৎতত্ত্ব অনুভূত হয়। ধর্ম-শাস্ত্রাদিতে বর্ণিত সত্য হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। শুধু মুখস্ত করে অথবা ধর্মশাস্ত্রকে সিঁদুর, বেলপাতা দিয়ে পুজো করে কি লাভ? যার হৃদয়ের যত বেশি ময়লা দূরীভূত হয়েছে তিনিই তত বেশি ধর্মরহস্য বা সত্যকে উপলব্ধি করতে পারবেন, ধারণা করতে পারবেন এবং একমাত্র তাঁর‌ই ধর্মবোধ হবে। এটাই সিদ্ধান্ত।

তোমরা নির্মল হৃদয়ের অধিকারী হও, দেখবে এক এক করে সংশয় কেটে গিয়ে তোমাদের হৃদয়েও সত্যের আলো ফুটে উঠবে। একমাত্র তখনই তুমি বোধ করতে পারবে সত্যের স্বরূপ। অন্যথায় জিজ্ঞাসা-উত্তরের মাধ্যমে গুরুর কাছে শিক্ষলাভ করে হয়তো conception হতে পারে কিন্তু perception হবে কি? ঐটা তোমার একান্ত নিজস্ব এবং সাধনার দ্বারা ওটি তোমাকেই অর্জন করতে হবে।

তুমি বিভিন্ন মহাপুরুষের কথা তুলেছ — দ্যাখো, ভারতীয় পরম্পরার প্রতি বা বিভিন্ন মহাপুরুষগণের প্রতি যদি তোমার শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস থাকে, তাহলে যেহেতু তাঁরা সকলে শ্রীমদ্ভগবদগীতাকে শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দিয়ে গেছেন তাহলে তোমার মতামতের মূল্য রইল কোথায়? “মহাজনো যেন গতঃ সঃ পন্থা।” মহাজনের মত ও পথ অনুসরণ করাই তো বুদ্ধিমানের কাজ। আর তা না করে যদি তুমি নিজেকে তাঁদের থেকেও জ্ঞানী বা বোদ্ধা ভাবো — তাহলে তুমি একটা ‘আহাম্মক’ ছাড়া আর কিছু নও।

  নিজেদের পুরোনো সংস্কার-সংস্কৃতি নিয়ে সংশয় তো করতে পারলেই হোল — এখন তো ভারতবর্ষের নব্য শিক্ষিতদের মধ্যে এইরকমই একটা trend চলছে ! তা তোমার সংশয় বাড়ানোর জন্য আমি কিছু points দিচ্ছি শোন__ পাণিনি সংস্কার-সাধন করে বর্তমান 'সংস্কৃত' ভাষাটি সৃষ্টি করেছিলেন, যে ভাষায় বর্তমান গীতা রচিত রয়েছে। কিন্তু ভগবান বুদ্ধের সময় অর্থাৎ আজ থেকে মাত্র আড়াই হাজার বছর আগে ভারতবর্ষের ভাষা ছিল পালি। কারণ সম্রাট অশোক বিভিন্ন শিলালিপি বা স্তম্ভলিপিতে পালিভাষাই ব্যবহার করেছে। তার‌ও দু-চার হাজার বছর আগে অন্য কোন ভাষা ছিল কিনা_তার‌ও কোন প্রমান নাই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আদৌ হয়েছিল কিনা প্রমানাভাবে বর্তমান বিজ্ঞানীরা সে কথাটাও এখনো নিশ্চয় করতে পারে নি। সুতরাং মহাভারতের যুগে ভারতবর্ষের কি ভাষা ছিল সেটা সঠিকভাবে কোন্ পণ্ডিত বলতে পারবে বলে দেখি ?

 একমাত্র ভারতীয় সনাতনপন্থীরা গভীরভাবে বিশ্বাস করে যে, মহাভারতের ঘটনা সত্য! কিন্তু মহাভারতের সময়কাল নিয়ে আবার পন্ডিতদের মধ্যেও নানান সন্দেহ রয়েছে। তবে মোটামুটি ধরে নেওয়া হয়েছে খ্রীঃ পূঃ ২৫০০ থেকে ৫০০০ বছর আগেকার ঘটনা হতে পারে। খ্রীঃ পূঃ ২৫০০ বছর আগের সিন্ধুসভ্যতার সিন্ধুলিপির মর্মার্থও আবিষ্কৃত হয়নি। তাহলে গীতা প্রকৃতপক্ষে কোন ভাষায় কথিত হয়েছিল বা রচিত হয়েছিল_ সে নিয়ে সংশয় করা যেতেই পারে !

  কিন্তু সাধু-সন্তের কাজ সংশয়-সৃষ্টি না করে সিদ্ধান্ত দেওয়া।‌ সুতরাং সেই চেষ্টা করা যাক ! 'গীতা' যখনকারই হোক আর যে ভাষারই হোক — বর্তমানে যে ভাষায় রয়েছে সেটাই এই যুগের পক্ষে সঠিক। ভাষা যাইহোক — ভাব ঠিকই রয়েছে। গীতাতেই রয়েছে ভগবান বলছেন : "অসংশয় হও",  অসংশয় হোতে পারলেই কার্যসিদ্ধি ঘটবে।