স্থান ~ পরমানন্দ মিশন । সময় ~ ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ I উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই, ধীরেনবাবু, সব্যসাচী মান্না ও অন্যান্য ভক্তগণ ।

জিজ্ঞাসু :— একা একা সময় কাটানো মুস্কিল হয় মাঝে মাঝে — তাই কি করে একাকিত্ব কাটানো যায় তার পরামর্শ চাইছি?

গুরুমহারাজ :— একা একা সময় কাটানো বলতে কি বোঝাতে চাইছ? — প্রকৃতিতে কেউ কখনও একা একা থাকে নাকি? সাধারণভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে কি করে থাকবে — হয়তো এটা বোঝাতে চাইছো তুমি যেখানে থাকো সেখানে মানুষজন কম আছে, কিন্তু তাতে কি হয়েছে? গাছপালা তো রয়েছে, বিভিন্ন পশু-পাখি, পাহাড়, নদী, আকাশ, নক্ষত্র, সূর্য, চন্দ্র — সর্বোপরি পৃথিবী গ্রহটি তো রয়েছে সদাসর্বদা তোমার সাথে সাথে। নিঃসঙ্গ বলছ, কত সঙ্গ নেবে তুমি মাষ্টার! তবুও তুমি তো একটা মফস্বল শহর সিঙ্গুরে তোমার গৃহে থাকো, কতজন দুর্গম গিরি-কন্দরে বা সুউচ্চ জনমানবহীন পর্বতশিখরে অথবা গহন অরণ্যের মধ্যে সাধনভজন করে, কিন্তু সেখানেও তাদের নিঃসঙ্গ হবার জো-টি নেই।

তবে সবার তো এগুলির দিকে মনোযোগ থাকে না, তাই বেশিরভাগ মানুষ টেরই পায় না যে, তার চারদিকে কত ধরনের জীব-জন্তু বা প্রাকৃতিক বিষয়সমূহ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তো ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দু দেখে একটি বিখ্যাত কবিতাই লিখে ফেললেন। কবিরা এই রকমই তুচ্ছ-তুচ্ছ সাধারণ বিষয় থেকে অসাধারণ কিছু সৃষ্টি করতে পারেন। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা সেগুলি নিয়ে দীর্ঘক্ষণ নিজেরা শুধু মজায় কাটিয়ে দিতেই পারেন না সেগুলির মাধ্যমে অপরকেও মজা দিতে পারেন। Gardening করা যাদের অভ্যেস তারা সারাদিন গাছের সঙ্গেই কাটিয়ে দেয়, মাছ-ধরা যার অভ্যেসসে মাছ-ধরার উপকরণ নিয়ে,’চার’-এর জোগাড় নিয়ে এবং অবশেষে মাছ ধরা নিয়েই সারাদিন কাটায় ! আবার দেখা যায় যাদের বই পড়ার অভ্যেস তারা বই পড়েই সারাটা সময় কাটায়, অন্যদিকে মন দেবার সময়ই পায় না !

 কিন্তু এখন কথা হচ্ছে যে, যে কোনোভাবে জীবনের মূল্যবান সময় কাটিয়ে দেওয়াটাই কি Art of life? না তা নয়। Purpose of life-কি তা খুঁজে বের করার চেষ্টাটাই Art of life। এই অন্বেষণই বেদান্তের "চরৈবেতি"। তবে কথা হচ্ছে যে, পড়াশুনা করে সময় কাটানোর চেয়ে ধ্যান-জপ করে যাঁরা সময় কাটান তাঁরা প্রথম দলের চেয়ে অনেকটাই better। আবার গাল-গল্পের বই বা নাটক-নভেল-এর চেয়ে আধ্যাত্মিক গ্রন্থসমূহ যাঁরা পড়েন তাঁরাও better। বই পড়ে শিক্ষা গ্রহণ না করে যাঁরা সরাসরি Nature থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন তাঁরা বই পড়া বিদ্বানদের চেয়েও better — এইরকম সব ক্রম রয়েছে। Nature থেকে শিক্ষা গ্রহণটাই শ্রেষ্ঠ, কারণ এই শিক্ষা হয় জীবনমুখী। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গল্পচ্ছলে বলতেন অবধূতের কথা, যাঁর ২৪ জন গুরু ছিলেন। অবধূতের বেশিরভাগ গুরুলাভের গল্পই প্রকৃতি বা পরিবেশ থেকে নেওয়া। মৌমাছির সঞ্চয়, ব্যাধের একাগ্রতা ইত্যাদি সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনাসমূহ নিরীক্ষণ করে_ তিনি অসাধারণ সেইসব শিক্ষা গ্রহণের কথা সকলের

মঙ্গলের জন্য শিষ্যদের কাছে পরিবেশন করে গেছেন।
আমার কথাই ধরো না, ছোটবেলায় শুধু পাখির গান শুনেই আমার কত সময় না কেটে গেছে! রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার কত রাত যে কেটেছে! আর চাঁদনি রাতে আমার বেশি আনন্দ হোত! চাঁদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আমার মনকে আমি চন্দ্রালোকের সাথে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতাম। বলতাম, ‘হে আমার মন! এই মুহূর্তে যত মানুষ চাঁদ দেখছে, তাদের সবার মাঝে তুমি ছড়িয়ে পড়ো।’ এইভাবে মনকে নিয়েও তুলোধোনা করেছি। ছোটবেলায় দিদি গান গাইত, “মন নিয়ে কি মরব নাকি শেষে,”_আমার মনে হোত সবাই যেন মনকে নিয়ে খুব ব্যতিব্যস্ত ! আমি তাই ছোটবেলাতেই মনকে নিজের বশে নিয়ে আসার চেষ্টা করতাম। তারপর যখন সেইকাজে ১০০ ভাগ সফল হলাম, তখন যার মন তাকেই ফিরিয়ে দিলাম। ফলে তখন থেকেই মা জগদম্বা-ই আমার মনের মালিক,মনের নিয়ন্তা!

জিজ্ঞাসু :— তাহলে এখন আপনি যে ভাবনা-চিন্তা করেন, এগুলি কিসের ক্রিয়া?

গুরুমহারাজ :— আমার আর নিজস্ব কোন মনের ক্রিয়া নেই। আমার নিজের কোন চিন্তাই আর বাস্তবে রূপ নেয় না। ফলে আমার এই অবস্থাটাকে ‘Vacant অবস্থা’ বলতে পারো। আমি যখন একা থাকি , তখন দেখি আমার চিন্তা রয়েছে, অসংখ্য চিন্তার প্রবাহ, কিন্তু সেগুলি চলচ্চিত্রের মতো আসছে — আবার চলে যাচ্ছে। সংকল্পও নেই — বিকল্পও নেই, তাই এখন একা থাকলে মন হু-হু করে উপরে উঠে যায়, তারপর স্থির হয়ে যায়। এইবার হয়ত কেউ এলো এবং কিছু জিজ্ঞাসা করলো_ তখন যেন সেটা নিস্তরঙ্গ স্থির জলাশয়ে ঢিল ছোঁড়ার মত হোল। ফলে চিত্তে তরঙ্গ উঠল — জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে শুরু করলাম। বিশ্বাস করো — ব্যাপারটি ঠিক প্রায় এইরকমই হয়। এইজন্য অনেক সময়েই দেখবেহয়তো সিটিং-এ অনেকেই রয়েছে অথচ জিজ্ঞাসা নেইআমিও চুপচাপ! এইসময় আমাকে যে কোন বাইরের জিনিস গ্রহণ করতে হয়, হয় সিগারেট ধরাই, না হয় জল বা চা চেয়ে নিই, নাহলে পায়ের কাছে পড়ে থাকা ফুল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকি_কোন না কোন অভিনিবেশ দরকার! নাহলে নিস্তরঙ্গ চিত্তে হটাৎ কোন জিজ্ঞাসা আঘাত সৃষ্টি করে।

যাইহোক, আশ্রমে থাকলে এইসব নানারকম করে সময়টা পার করে দিতে আমার কখনোই কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু যখন রাস্তাঘাটে থাকি বা অন্যরকম পরিবেশে থাকি তখন খুবই মুস্কিল হয়। সেখানে উপস্থিত মানুষজনের তো আমার vacant অবস্থার ব্যাপারটা সম্বন্ধে কোন ধারণাই নেই। ফলে অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ থাকার পর হঠাৎ করে উপস্থিত জনেদের মধ্যে কেউ কিছু বললে বা আচমকা কেউ স্পর্শ করে দিলে সেটা নিস্তরঙ্গ অবস্থায় থাকা ব্যক্তির কাছে যে কতখানি যন্ত্রণার __তা কি করে বলে বোঝাবো! তাই ওই অনেকের মাঝে ঐ অবস্থায় যেতে চাইনা, তখন কিছু না কিছু নিয়ে সময় কাটাই। কিন্তু ঘরে যখন একান্তে থাকি তখন একেবারে নিস্তরঙ্গ অবস্থা !

 এইজন্যেই রাস্তাঘাটে যখন আমি একা ঘুরি তখন আমার খুবই অসুবিধা হয়। একবার বিদেশে একটা প্রমোদ-তরণীতে করে গ্রীস থেকে ক্রীট দ্বীপে যাচ্ছি, চারিদিকে হৈ-হুল্লোড়, Discordance, মদের আড্ডা, জুয়ার আড্ডা — ভিতরে থাকা অসহ্য হয়ে উঠছিল, ফলে উঠে এলাম ডেকে। ডেকটা ফাঁকা, তাছাড়া চারিদিকে অনন্ত জলরাশি ও দিগন্তব্যাপী সুনীল সফেন ঢেউয়ের নাচ আর আকাশ আমার মনকে শান্ত করে দিল। কিন্তু সেখানেও তো হারিয়ে যেতে পারিনা। তাই কবিতা লিখতে বসে গেলাম। এইভাবে বাইরে ঘোরাকালীন আমার বেশ কিছু লেখা হয়ে যায়। অনেকে ভাবে এত ঘোরাঘুরি করেন এর মধ্যে কি করে লেখেন? কিন্তু আমাকে এটা করতেই হয়। ব্যাপারটা বুঝলে কি? এই কারণেই একটু আগে বলছিলাম — শুধু সময় কাটানোর জন্য কিছু করে বা অহেতুক বই পড়ে তেমন খুব একটা লাভ হয় না! বই পড়ার উদ্দেশ্য যদি শিক্ষালাভ হয় তাহলে তা 'জীবিকার জন্য শিক্ষা' না 'জীবনের জন্য শিক্ষা'_ সেইটা আগে ঠিক করতে হবে। নিত্য আর অনিত্যের সংজ্ঞা জানা হয়ে গেলে তো জীবনের শিক্ষালাভ হয়েই গেল। এবার বাকি থাকে কি, না __জীবনে যোজনা অর্থাৎ practical করা ! সেইটাই করো। দ্যাখো,এটা সত্যি যে জীবন ধারণ এবংসংসার প্রতিপালনের জন্য কর্ম করতে গিয়ে সবাই ঈশ্বরমুখী হবার সময় পায় না, আবার অনেককে দেখেছি_ সময় পেলেও নিত্য-অনিত্যের সংজ্ঞা জানেনা বলে কাজের কাজটি করতে পারে না।

 কিন্তু তোমরা তো এসব জানো, আবার ঈশ্বরের ইচ্ছায় কিছুটা সময়ও পেয়েছো_ তাহলে সেটা কাজে লাগাও ! মাষ্টার! সংসারের 'সং' তো অনেক দেখলে এবার 'সার'টি কি তা দেখার চেষ্টা করো! তাহলেই সব প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে যাবে আর একাকিত্বকে burden মনে হবে না, বরং ওটাকেই দেখবে তখন বন্ধু মনে হবে।

জিজ্ঞাসু :— আপনি সেদিন বলছিলেন যেখানে দৃষ্টি চলে না সেখানে গন্ধ অনুসরণ করতে হয় — এটাও কি প্রকৃতির শিক্ষা?

গুরুমহারাজ :— নিশ্চয়ই। মরুদেশে বহু পথিক মরীচিকা দেখে জলাশয় ভেবে ছুটে ছুটে বেড়িয়ে প্রাণ হারায়। কিন্তু যদি পথিকের সঙ্গে উট থাকে তাহলে উটের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে না। কারণ উট হাঁটু গেড়ে বালিতে বসে পড়ে আর ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সাহায্য নেয়। ওদের ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের তীব্র অনুভূতি জলের গন্ধ সঠিকভাবে পেতে সাহায্য করে। এবার উট সঠিকভাবে জলাশয়ের অভিমুখে ধাবিত হয়, উট-সওয়ারি ভুল করে তাকে মারলেও সে অন্যপথে যায় না — ঠিক পথে যায়। তাই মরুভূমিতে উটই হচ্ছে একমাত্র সঙ্গী, এইজন্যই একে ‘মরুভূমির জাহাজ’ বলে। এক ধরনের নীল রঙের মাছি, আম-কাঁঠাল ভাঙলে তার গন্ধে দু’আড়াই মাইল দূর থেকে চলে আসতে পারে। সুতরাং নিম্নতর প্রাণীরা যা পারে, মানুষ উন্নত জীবন পেয়ে তা আয়ত্ত করতে পারবে না কেন? নিশ্চয়ই পারবে, যোগীরা এটা পারেন। গায়ের গন্ধ শুঁকে তাঁরা বলে দিতে পারেন — মানুষটি কি রকম? আমার গুরুদেব আমার ঘাড়ের নিচের গন্ধ শুকতেন। তবে আমি দেখেছি__ মানুষকে চিনতে তার কাছে গিয়ে গন্ধ শুঁকতে হবে তার কোন মানে নেই। দূর থেকেও এটা পাওয়া যায়। আর বলে দেওয়া যায় কোন ব্যক্তি কতটা আধ্যাত্মিক।

 গন্ধ-বিচারের কথা হচ্ছে বলেই এ নিয়ে এত কথা বলছি। দ্যাখো, তোমরাও কি খাদ্যের গন্ধ শুঁকে কোনটা ভালো খাদ্য, কোনটা বাসি বা পচা বুঝতে পারো না? এসব ব্যাপারে আমার তো কোন  অসুবিধাই হয় না ! এই তো কদিন আগে আমার ঘরে একটা টিকটিকি মরে পচে গিয়ে গন্ধ ছাড়ছিল। তপি (পবিত্রপ্রাণা) খুঁজে পাচ্ছিল না। আমি সন্ধ্যেবেলায় গন্ধ অনুসরণ করে ঠিক বের করে ফেললাম। যাইহোক, পঞ্চতন্মাত্রার মধ্যে শুধু গন্ধ কেন অন্যান্য তন্মাত্রারও Power বা শক্তিও নিজের মধ্যে  বাড়ানো সম্ভব। আর এর উপায় হচ্ছে যোগবিজ্ঞানের অনুশীলন। সাধারণত হঠযোগের দ্বারা যে কোন ইন্দ্রিয়ের শক্তি বাড়ানো যায় এবং যে কোন তন্মাত্রার অনুভূতি গ্রহণের শক্তিও বাড়ানো যায়। তাছাড়া মানব জীবনে আধ্যাত্মিক উন্নতি হবার সাথে সাথেই এগুলো আপনা আপনি বেড়ে যায়।

   দ্যাখো_সাধকের নিজের অভ্যন্তরস্থ শক্তি তো বাড়াতেই হবে__নাহলে কিছু Limited Power নিয়ে সেই unlimited-কে ধরবে কি করে? এইজন্যই বলা হয় "বোধে বোধ"। কথা হচ্ছে — যা তোমার আছে তাই তুমি পাবে। তোমার পকেটে টাকা রয়েছে, সেটা জেনেই বাজার করতে যাওয়া। টাকাটা চোখে দেখার দরকার নেই, হয়তো পকেটে হাত দিয়ে অনুভব করে নিলে, তাতেই নিশ্চিন্ত ! এইটাই ঠিক ঠিক বোধে বোধ !