স্থান ~ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন । সময় ~ ১৯৯২, ডিসেম্বর । উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ সব্যসাচী মান্না সহ সিঙ্গুর ও আশ্রমস্থ ভক্তবৃন্দ ৷
জিজ্ঞাসু :— অবতার পুরুষ বা এই ধরনের মহাপুরুষরা বাহ্যিকভাবে দেখতে বেশ সুন্দর বা সুদর্শন হন — এরূপ হওয়ার কি কোন কারণ আছে?
গুরুমহারাজ :— সুদর্শন বলতে তুমি কি বলতে চাইছ সব্য —সর্বকালীন এবং সর্বজনীন সুদর্শন বলা যায়_এমন কাউকে বা এমন কিছুকে কি তুমি জানো? স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মানুষের সৌন্দর্যবোধ পাল্টে পাল্টে যায়তা তো তোমার জানা উচিত ! একজন চীনা সুন্দরী বা কোরিয়ান সুন্দরী তোমার চোখে অর্থাৎ ভারতীয়দের চোখে সুন্দরী নাও হতে পারে। একজন নিগ্রো সুন্দর পুরুষ বা আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মানুষের কাছে একজন কৃষ্ণবর্ণের সুন্দর পুরুষ বা সুন্দরী নারী কি শ্বেতাঙ্গদের চোখে সুদর্শন অথবা সুদর্শনা বলে বিবেচিত হবে?_নিশ্চয়ই হবে না, তাই নয় কি ?
বহু প্রাচীনকালের মানুষেরা তাদের চোখে কোন সুন্দরকে (ব্যক্তি অথবা বস্তু)হয়তো কোন পাহাড়ের গায়ে, পোড়ামাটির ফলকে চিত্রায়িত করে রেখেছিল অথবা কোন স্থাপত্যে খোদাই করে রেখেছিল__ সেগুলি যদি তুমি আজকে দেখো, তাহলে কি সেগুলিকে দেখে তুমি উচ্ছাসে "আহা"-"আহা"করে উঠবে ! হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর যে প্রাচীন সভ্যতা সেটা আধুনিক মানুষদের কাছে প্রাচীনতার দিক দিয়ে সত্যিই বিস্ময়কর — কিন্তু সেই সভ্য মানুষদের কিছু শিলালিপি বা ভাস্কর্য পাওয়া গেছে এবং সেখানে এক বা একাধিক নারী-পুরুষের মূর্তিও পাওয়া গেছে ! কে বলতে পারে_যাদের মূর্তিগুলি পাওয়া গেছে,হয়তো তাঁরাই তৎকালীন মানুষের Icon ছিল-আদর্শ ছিল ! হয়তো অত্যন্ত সুদর্শন বা সুদর্শনা হিসাবেই তখনকার কোন বিখ্যাত শিল্পী তাদেরকে চিত্রায়িত বা খোদিত করে রেখেছিল ! কিন্তু এখনকার মানুষের চোখে কি তারা সেইভাবে বিচার্য হবে? এটা জেনে রাখবে যে কোন কালে বা সময়ে, যে কোন জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষই তাদের নিজের নিজের গোষ্ঠীর কোন মানুষকেই আদর্শ করতে চায়__ তাদের গোষ্ঠীর কোন নারী বা পুরুষকেই তারা সুদর্শন বা সুদর্শনা বলে মনে করে ! বুঝেছো ব্যাপারটা !
যাইহোক, এবার তোমার জিজ্ঞাসায় আসি_ অবতার পুরুষ বা মহাপুরুষরা কেন সুন্দর ? এই কথার উত্তরে বলতে হয়__' মূলত যাদের স্বভাব সুন্দর, তারাই প্রকৃত সুন্দর' ! দ্যাখো,স্ব-ভাবকে যিনি জেনেছেন, তিনিই তো স্বভাবের অধীশ্বর হতে পারেন __ ফলে ঐ ব্যক্তির অন্তঃকরণ সহজ, সরল, সুন্দর ও মাধূর্যমন্ডিত হয় ! তখন তিনি সবার কাছে প্রিয় হন, সবার গ্রহণযোগ্য হন, সবার কাছে সুন্দর হিসাবে বিবেচিত হন !
সাধারণতঃ মানুষ সুন্দরের পূজারী _তাই মহাপুরুষরা যেহেতু প্রকৃত অর্থে "সুন্দর", তাই তাঁরা সমকালের মানুষের দ্বারা তো বটেই এমনকি উত্তরকালের মানুষের দ্বারাও পূজিত হন। হয়তো সমকালীন সময়ের বেশিরভাগ মানুষ তাঁকে গ্রহণ করতে পারে না কিন্তু উত্তরকালের মানুষেরা তাঁকে অনেকাংশে গ্রহণ করে নেয়।
তবে এখানে একটা কথা আছে_মহাপুরুষগণ দেখতে সুন্দর ছিলেন বা "সুদর্শন" ছিলেন__বলতে একদম স্থূলরূপ দিয়ে বিচার করতে গেলে কিন্তু তুমি ঠকবে ! "গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু দেখতে খুবই সুন্দর ছিলেন,কারণ তিনি গৌরবর্ণ ছিলেন, দীর্ঘদেহী ছিলেন" — এই ধরনের সব বর্ণনা অর্থাৎ চামড়ার রঙ,টিকালো নাক ইত্যাদি দিয়ে মহাপুরুষের বর্ণনা করতে যেও না__এটা তাঁদের বাহ্যরূপ, যা একদমই স্থূল। তুমি তো জানো সব্য__ জগৎ বলতে প্রকৃতপক্ষে তিনটে জগতের কথা বলা হয়েছে — স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ। শুধু স্থূলজগতে যারা রয়েছে তারা শুধুমাত্র স্থূল নিয়েই সর্বদা বিচার করে- আলোচনা করে বা সমালোচনা করে ! আমি তোমাদেরকে বলবো _তোমরা যেন ওই দলে পড়ে যেও না, তাহলে কিন্তু ভুল করবে। মহাপুরুষদের ক্ষেত্রে তো বটেই, যে কোন ব্যক্তি বা বস্তুর বিচারের ক্ষেত্রেই __তার বাহ্যরূপ নয়, তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের বিচার করার চেষ্টা করবে। তাতে তোমার ব্যক্তিগত চেতনারও উৎকর্ষ হবে আবার ধারণাও ঠিক ঠিক হবে।
এই কথাগুলি আমি কেন বলছি তা ভালো করে বুঝিয়ে বলছি শোন ! মহাকাব্যের যুগে বা তারও পূর্ববর্তী সময়ে যে সমস্ত অবতারের কথা জানা যায় তাঁদের বেশীরভাগেরই রঙ তো কালো ছিল। রাম, কৃষ্ণ ব্যাসদেব এঁদের সকলের রঙ কালো ! মহাভারতের অন্যান্য character-রা যেমন দ্রৌপদী কালো ছিলেন, তাই তাকে ‘কৃষ্ণা’ বলা হোত। অর্জুন কালো ছিলেন, দুর্বাসা মুনিও সুদর্শন ছিলেন না। অষ্টাবক্রের আটটি অঙ্গই বাঁকাচোরা ছিল অথচ দ্যাখো এঁরা কি অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন ! সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাহ্যরূপ দিয়ে ভগবানের ভগবানত্ব বা মহাপুরুষের মহাপুরুষত্ব বোঝা যায় না। তাঁদের অন্তর্নিহিত রূপ দিয়েই তাঁদের পরিচয় পাওয়া যায় অর্থাৎ তাঁরা জীবনে কি করলেন, কি শেখালেন, কি আচরণ করে জগতকে দেখালেন, সেই দিয়েই তাঁদের পরিচিতি গড়ে ওঠে, বাহ্য রূপ দিয়ে যদি বিচার হোত তাহলে তো দেশ-দুনিয়ায় glamour-world-এর লোকেরা জগতের আদর্শ হয়ে যেত। ছেলে-ছোকরারা কম বয়সে এই মোহে পড়ে_তাই কিশোর বয়সে অথবা যৌবনে glamour-world-এর লোকেরাই তাদের আদর্শ হয়, অবশ্য বড় হয়ে গেলে ওটা আর টেকে না।
এবার কথা হচ্ছে, অবতারগণ যখন শরীর গ্রহণ করেন সেটা তো আর সাধারণ নিয়মে হয় না, সেখানে অন্যরকম নিয়ম কাজ করে। সেখানে কোথায় শরীরগ্রহণ হবে, কিভাবে হবে, কিরকম শরীর হবে, কি কি কাজ সম্পন্ন করতে হবে ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ই পূর্ব নির্ধারিত হয়ে থাকে। এর কারণ যদি জানতে চাও তাহলে বলতে হয় যে, তাঁরা তো নিজের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য বা কোন ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য শরীর নেন না, তাঁরা আসেন, 'বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়' — বহুজনের হিত ও সুখের জন্য এবং লোকশিক্ষা দেবার জন্য। তাঁরা যেন মানুষের কাছে আগামীর বার্তা-বহনকারী, মানুষের জীবনে আলোর দিশারী ! মৃত্যুর জগৎ, অজ্ঞানের জগৎ ও অন্ধকারের জগৎ থেকে উত্তরণের কাণ্ডারী। তাই স্থান-কাল ভেদে যেরূপ শরীরধারণ করলে যুগোপযোগী জগত কল্যাণ ঠিক ঠিক ভাবে সম্পন্ন হবে _তাঁরা ঠিক সেইরকমই শরীরধারণ করেন। এই দ্যাখো_ আজ তোমাদের ভগবানের শরীরধারণের রহস্য বলে দিলাম।
আসলে হয় কি_ ভগবানের লীলা সংবরনের পরবর্তীকালে, ভক্তেরা ভগবানের শরীরধারণ নিয়ে তাদের মতো করে নানারকম ব্যাখ্যা করেন — তার মধ্যে কিছুটা সত্য থাকলেও সম্পূর্ণ থাকে না ! কিন্তু যাই থাক বা না থাক এগুলো ভক্তসমাজে ভক্তির সঞ্চার করে — তাই গ্রহণযোগ্য হয়। উদাহরণ হিসাবে আমি বলতে পারি_ যেমন মহাপ্রভুকে বলা হোল — "রাধাভাব এবং রাধার বাহ্যিকরূপ নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের অবতরণ।" ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে বলা হোল, "নিত্যানন্দের খোলে চৈতন্যের আবির্ভাব।" এইভাবে ভক্তরা যাই ব্যাখ্যা করুক না কেন প্রকৃতপক্ষে অবতার পুরুষদের স্থূল বা বাহ্য রূপ, অন্তর্নিহিত বা আভ্যন্তরীণ রূপ_ যা কিছু সবই নিয়ন্ত্রিত হয় Universal will থেকে ! বিরাটের-ইচ্ছা বা মহতী ইচ্ছার সাথে সর্বদা তাঁদের স্থূলশরীরের ব্যক্তি-ইচ্ছা ওতপ্রোত হয়ে থাকে। কারণ ওই শরীরটি তো মহতী ইচ্ছারই ফসল ! কোন ব্যক্তিগত বা individual-এর ভূমিকা সেখানে থাকে না ! তবে হ্যাঁ_ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইচ্ছারই বিরাট রূপ ঐ মহতী ইচ্ছার প্রকাশ__ এটা বলতে পারো। এই হিসাবে কোন কোন ভক্তিশাস্ত্র ভক্তকে মহান বা শ্রেষ্ঠ বলে বর্ণনা করেছেন, কারণ ভক্তের আন্তরিক প্রার্থনা ভগবান মঞ্জুর করেন — এটাই ভক্তের শ্রেষ্ঠত্ব। এইজন্যই বলা হয়__ অদ্বৈত আচার্যের আমন্ত্রণে মহাপ্রভুর আগমন। যাইহোক, এসব আংশিক সত্য হলেও একশ'ভাগ নয়। কারণ ভগবানের অবতরণের সহস্র কারণ থাকে। সেই সব কারণগুলি একাকার হলে তবেই ভগবানের নরতনুধারণ সম্ভব হয়।
জিজ্ঞাসু :— গরম জল পান করা কি ভালো?
গুরুমহারাজ :— এসব কি জিজ্ঞাসা করছো? গরম জল ফুটন্ত হলে কেউ কি পান করতে পারে! ডাক্তারবাবুরা অনেক রোগীকে হয়তো পরামর্শ দেন যে, “জল ফুটিয়ে পান করবেন”। তাই বলে ফুটন্ত গরম জল খাবে নাকি? জল ফুটিয়ে রেখে ঠাণ্ডা করে খাবে। কিন্তু এতেও জলে দ্রবীভূত কিছু উপকারী খনিজও অপকারীদের সাথে থিতিয়ে পড়ে। ফলে গরম জল পান করা যে ১০০ ভাগ ভালো তা বলা যায় না, আর কারও হয়তো দাঁতে ব্যথা বা অন্যান্য কারণে তাকে কুসুম গরম জল বা ঈষদুষ্ণ গরম জল পান করার কথা বলা হয় — সেটা আলাদা ব্যাপার ! কারণ ঐটা বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে — সার্বজনীন নয় বা সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রেও সব সময়ের জন্য তা প্রযোজ্য নয়। তবে যখনই কোন কারণে ঈষদুষ্ণ জল পান করবে কখনই গরম জলের সাথে ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে তা পান করবে না, উষ্ণ জলকে ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা করে তারপর পান করবে।
ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করাও ভালো — এতে heart ভালো থাকে। টিউবওয়েলের টাটকা জল গরমকালে ঠাণ্ডা মনে হয় বাইরের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে বলে, আবার এই জলই শীতকালে গরম বলে মনে হয় ! ফলে বারোমাস টিউবওয়েলের জলে স্নান করা ভালো। তবে শাশ্ত্রে অবগাহন স্নান সবচাইতে উত্তম বলা হয়েছে, কারণ এই পদ্ধতিতে স্নানটা automatically খানিকটা scientific হয়ে যায়। দ্যাখো_ এই স্নানে প্রথমে পায়ের পাতা ডোবে, তারপর হাঁটু, তারপর কোমর, নাভি, বক্ষঃপ্রদেশ, এরপর মস্তিষ্ক ডুবিয়ে অবগাহন স্নান। বাড়িতে স্নানকালেও এভাবেই বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আগে জল দিয়ে ঠাণ্ডা করে তারপর মাথায় স্নান করতে হয় — তাহলে সমস্ত অঙ্গের সাম্য থাকে। আর হঠাৎ করে ঠাণ্ডা জল মাথায় ঢাললেই ধক্ করে বুকে একটা স্পন্দন সৃষ্টি হয়, এইটা হোতে হোতে কালক্রমে heart-এর রোগ সৃষ্টি করে। ওই জন্যই দেখবে মায়েরা বলেন, 'আচমকা ঠাণ্ডা জলের ছিটে গায়ে দিবি না' — এটারও ওই একই কারণ।