স্থান ~ পরমানন্দ মিশন । উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ ইতালির আলেক্স, ইলারিও, রুজেরো, জার্মানির ফ্রেডরিকা (শান্তি) সহ অশ্রমিক ও বহিরাগত ভক্তগণ ।

জিজ্ঞাসু :– Theosophical Society -র west-এ খুব রমরমা, বিভিন্ন দেশে প্রচুর branch রয়েছে। ওগুলাে কি আধ্যাত্মিক সংস্থা ?

গুরুমহারাজ :– ভারতবর্ষে Theosophical Society-র প্রবর্তন করেন অ্যানিবেসান্ত। তখন অ্যানিবেসান্ত ছাড়াও মাদাম বাটলিভস্ক নামে একজন মহিলাও এই society-র কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। তবে ইউরােপের বিভিন্ন দেশে এই society-র জনপ্রিয়তা লাভের পিছনে যিনি দায়ী তার নাম জে.কৃষ্ণমূর্তি। ইনি একজন দক্ষিণ ভারতীয় ব্যক্তি। খুব ছােট বয়সেই ইনি অ্যানিবেসান্তের সান্নিধ্যলাভ করেন। বেসান্ত-ই ওনাকে higher education করান ও বিদেশে পাঠান। পরবর্তীকালে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে কৃষ্ণমূর্তি একজন বিখ্যাত পণ্ডিতে পরিণত হন। ইউরােপে থাকাকালীন বা ভারতবর্ষেও ওনার পাণ্ডিত্যে তৎকালীন মানুষেরা মুগ্ধ হােত। ওনার বিভিন্ন ভাষায় লেখা অনেক গ্রন্থ রয়েছে, যেগুলি পড়লে ওনার অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। অবশ্য গুণীজনেরা সেগুলির এখনও যথেষ্ট কদর করেন। সমসাময়িক সাধু-সন্তরা তার জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনে বা লেখা পড়ে ধারণা করতেন ইনি বৌদ্ধসন্ন্যাসী নাগার্জুনের উত্তর-শরীর। যাইহােক, এই শরীরেও কৃষ্ণমূর্তি সন্ন্যাসীর ন্যায়ই জীবনযাপন করতেন।

Theosophical Society-র অনুগামীদের উপাসনার মধ্যে spirit নিয়ে গবেষনা খুব রয়েছে। বিভিন্ন Planchet ক্রিয়া বা নানারকম আচার অনুষ্ঠান। তবে শােনা যায় শেষ বয়সে অর্থাৎ মৃত্যুর আগে নাকি কৃষ্ণমূর্তি নিজেই তাঁদের নিজেদের ধর্ম আচরণের বিরােধিতা করেছিলেন বা ওদের নিজেদের দর্শনকে অস্বীকার করেছিলেন।

এবার কথা হচ্ছে এই সংস্থা কতটা আধ্যাত্মিক বা Spiritual ? তােমরা ইউরােপীয়রা(যে ছেলেটি জিজ্ঞাসা করেছিল,সে একজন ইউরোপীয়) বেশীরভাগই spirit বলতে ভূত-প্রেত (ghost) ইত্যাদিকে বােঝ। Spiritual-এর Spi-টা বাদ পড়ে গেলে যেমন কথাটা ritual হয়ে যায়, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে ! Theosophical Society-র লোকেরা Planchet ইত্যাদি ভূত-প্রেতাদির ক্রিয়া খুব করে। তুমি কি কখনও ওদের কোন শাখায় গিয়েছ নাকি ? ওঃ_ যাওনি ! গেলে দেখবে ওখানে বিভিন্ন রকম মন্ত্র উচ্চারণ আর নানারকম আচার-অনুষ্ঠান ক্রিয়াদি চলছে অথবা কোন মাধ্যম বা medium-কে কেন্দ্র করে Planchet ক্রিয়া হচ্ছে ! ওরা বলে __ spirit- দের আবার সাতটি স্তর রয়েছে। Planchet-এ নিম্ন স্তরের Spirit-রা তাড়াতাড়ি সাড়া দেয়, ঊর্ধ্বস্তরের Spirit-রা আসেই না অথবা আসলেও অনেক দেরিতে আসে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা কি হয় জানো__ ওদের medium-গুলােই তাে চেতনায় উন্নত নয়_ দুর্বল প্রকৃতির, তাই soul-গুলো একটু উচ্চ চেতনার হোলে আর যােগাযােগ করতে পারে না ! যদিও এই planchet ব্যাপারটাকেই আমার cheating বলে মনে হয়, তবুও এর মধ্যে যেটুকু সত্যি রয়েছে, সেই কথাগুলােই তোমাদের কাছে বললাম।

এবার ওদের সাথে ঘটে যাওয়া আমার নিজের জীবনের একটা অভিজ্ঞতা থেকে বলছি শােন। কোলকাতার টালিগঞ্জে ওদের( Theosophical Society-র )একটা শাখা রয়েছে– তখন ওখানকার head ছিলেন একজন ভদ্রমহিলা ! ওখানকার ভক্তরা আমাকে ‘ওনার কথা’ বলতে গিয়ে বলেছিলেন_ তাঁর “ভর” বা ‘আবেশ’ হয় এবং উনি spirit-দের সাথে যােগাযােগ করতে পারেন এবং সেই অবস্থায়সকলের সমস্ত সমস্যার উত্তর দিতে পারতেন বা ভবিষ্যৎ বলে দিতেন। আমার কয়েকজন বন্ধু ওখানে খুব যেতো, তারাই আমাকে এইসব কথা জানালো এবং আমাকে একবার ওখানে যাবার জন্য খুবই অনুরােধ করলো। আমি চিন্তা করে দেখলাম ‘ভারতীয় পরম্পরার মূল দিকটিকে ছেড়ে আমার এই বন্ধুরা গৌণ কিছু আচার-অনুষ্ঠানে আকৃষ্ট হচ্ছে কিন্তু এটা তাে ঠিক নয় __তাহলে ওদের জন্য কিছু করা দরকার’ ! এই মনে করে আমি ওদেরকে বললাম “ঠিক আছে যাব ওখানে”।

কোন এক সময় আমার ছােট বোনের চিকিৎসার জন্য ওকে নিয়ে কোলকাতার টালিগঞ্জে গিয়েছিলাম । বোনকে সঙ্গে নিয়েই আমার কয়েকজন বন্ধুদের সাথে সেদিন Theosophical Society-র টালিগঞ্জ শাখায় একেবারে ভিতরে আমরা ঢুকে গেলাম। ওখানে গিয়ে শুনলাম-Head-এর সঙ্গে দেখা করার একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে – সেই সময়ে ওখানকার যিনি কর্ত্রী (এক মহিলা), তার আবেশ বা “ভর” হয়। নির্দিষ্ট সময়ে আমি বােনকে বাইরে বসিয়ে রেখে বন্ধুদের সাথে ভিতরে গেলাম। দেখলাম একজন মহিলা এলােচুলে মাথা নীচু করে বসে আছেন, খুব ধূপটুপ জ্বলছে, গন্ধে চারিদিক একেবারে ‘ম’ ‘ম’ করছে, ম্লান আলাে–আলাে-আঁধারি বলা চলে। আমাদের মতাে অনেকে নানান সমস্যা নিয়ে এসেছে—তারাও বসে রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছেন মহিলাটি। দেখলাম অনেক কর্মীও রয়েছে যারা ভিড় maintain করছে বা শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করছে। আমাদের নাম ডাকা হােল (কারণ নাম ঠিকানা আগেই লিখে দিতে হয়)। আমি এগিয়ে গেলাম ওনার একদম সামনে, আমার বােনের ফটো দেখালাম, তারপর দুঃখ দুঃখ ভাব নিয়ে বললাম আমার বােন হারিয়ে গেছে, ও কোথায় আছে—কেমন আছে যদি একটু বলে দেন, আমার কথাগুলাে শুনে মহিলাটি অনেকক্ষণ চুপ করে কি যেন ভেবে নিলো বা হয়তো সবকিছু দেখে নিলো, তারপর উত্তর দিলেন, “তাের বােন অনেক দূরে রয়েছে, বদমাস লােকের পাল্লায় পড়ে গেছে, ফিরে পেতে দেরি হবে”–ইত্যাদি অনেক কথা। আমি চট্ করে উঠে গিয়ে বাইরে থেকে বােনকে হাত ধরে ভিতরে নিয়ে এসে বললাম–”এই দেখুন আমার বােন_ও হারায়নি ! আপনি অযথা কেন বাজে বকছেন আর মানুষজনকে বিভ্রান্ত করছেন।” তারপর আমরা চলে এলাম। আমার বন্ধুরাও ওদের চালাকির ব্যাপারটা ধরতে পারলো। আসলে মানুষ বিপদাপন্ন হলে সাময়িকভাবে বাস্তববােধ হারিয়ে যায়—সেইসময় যে যা বলে সে তাই করে। এইরকমভাবেই সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ধান্দাবাজ ব্যক্তির দ্বারা বা কোন সংস্থার দ্বারা প্রতারিত হয় বা তার কিছু অর্থদণ্ড হয়। সুতরাং তােমরা বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে চলার চেষ্টা করবে, অযথা বিচলিত হয়ে উল্টোপাল্টা কিছু করবে না।

দ্যাখো,পূর্ব পূর্ব জীবনের কর্মরাজি দিয়ে তৈরী হয় মানুষের কর্মফল। এর মধ্যে প্রারব্ধকর্ম হেতু এই বর্তমান জীবন। এই জীবনের ভালো ভালো কর্মদ্বারাই পূর্বের জমানাে কর্মফল ক্ষয় হয় আবার মন্দ কাজের জন্য নতুন নতুন কর্মফল জমা হয় ! এই দুটির কোনটি হবে তা নির্ভর করছে “ক্রিয়মাণ কর্ম” বা বর্তমান কর্মে-র উপর। পূর্ব পূর্ব জন্মের কর্মফলে যদি কিছু ভােগ-ভােগান্তি থাকে তা তাে ভুগতেই হবে, কে রক্ষা করবে ? তবে সারদা মা বলেছিলেন—যদি ঈশ্বরের শরণাগত হয়ে কেউ থাকে_ তাহলে পা-টা কেটে বাদ দেবার বদলে হয়তাে ‘ছুঁচ’ ফুটল। এই কথাগুলোর মর্মটা ধরতে হবে। তোমরা ঈশ্বরকে ধরে থাকো—ritual নয় spiritual হও ! প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা বা spirituality কি সেটা উপলব্ধি করো, তাহলে আর তােমাদের এইসব অলিগলিতে হাঁটতে হবে না ! দেখবে তােমার সামনে প্রশস্ত রাজপথ—যা তােমাকে নিয়ে যাবে রাজবাড়ীতে। প্রারব্ধবশত ভােগান্তির একটা ঘটনা বলছি শােন—যেটা আমার গুরুদেব রামানন্দ অবধূতের জীবনে ঘটেছিল।

গুরুদেব রামানন্দজী ১৬২ বছর বয়সে শরীর ত্যাগ করেছিলেন কিন্তু এই ঘটনাটি তাঁর শরীর ছাড়ার অনেক আগের ঘটনা। উনি ছ’মাস থাকতেন গঙ্গোত্রীতে, আর ছ’মাস উত্তরকাশীতে। উত্তরকাশীতে থাকাকালে অনেক মানুষ এই মহাত্মাকে দর্শন করতে আসতো। বেশীরভাগ পুন্যার্থী মানুষ সাধুবাবাদের টাকা-পয়সা দিয়ে প্রণাম করে থাকে। ফলে ওখানে ছ’মাসে অনেক টাকা প্রণামি পড়তো। উনি সেবকদের বলতেন ওই টাকাগুলাে কুড়িয়ে নিয়ে কুঠিয়ার সামনে একটা পাথরের গর্তের মধ্যে পাথর চাপা দিয়ে রেখে দিতে। ছ’মাস পর যখন আবার উনি গঙ্গোত্রী চলে যেতেন, তার আগে উনি ঐ টাকায় একটা সাধু-ভাণ্ডারা দিয়ে দিতেন। ওনার নিজের টাকা-পয়সার কোন প্রয়ােজন ছিল না কারণ উনি বস্ত্র পরতেন না, ওনার আহার‌ও ছিল খুবই অল্প এবং থাকতেন পাথরের নির্মিত গুহায় অথবা ছােট কুঠিয়ায় ! সাধুর জীবন তো বিলাসবর্জিত জীবনতাই বেশি টাকাপয়সার এমন আর কি দরকার!

দুষ্কৃতি ব্যক্তি সবজায়গাতেই থাকে, এখানেও ছিল। তারাও লক্ষ্য রেখেছিল যে, সাধুবাবার গুহায় ছ’মাসের প্রণামি বেশ কয়েক হাজার টাকা হয়ে গেছে। ওরা একরাত্রে ঐ টাকাটা হাতাবার উদ্দেশ্যে কুঠিয়ায়এসে হাজির ! সাধুবাবার চোখে তাে ঘুম নাই—সারারাত্রি যোগে-যাগে বিনিদ্র-রজনী যাপন করেন। চোরেরা দেখল যে, সাধুবাবা বসে বসে সব দেখছেন। তারা ভাবল সাধুবাবা যদি তাদের চিনিয়ে দেয় বা পুলিশকে জানিয়ে দেয়_ তাহলে তাে খুব‌ই মুশকিল হবে। তার চেয়ে বুড়াে সাধুকে মেরে ফেলাই ভালাে ! এই ভেবে তারা ছুরি মেরে মেরে ওঁনাকে রক্তাক্ত করে দিয়েছিলতারপর উনি মারা গিয়েছেন ভেবে ঘরের মধ্যে একটা সিন্দুকে ওনার দেহটাকে ভরে তালা দিয়ে চোরেরা পালিয়ে যায়। পরদিন সকালে রক্ত দেখে সেবকেরা চেঁচামেচি করে এবং লােকজন এসে রামানন্দজীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায় ! এরপর পুলিশ-টুলিশ আসেবিভিন্ন স্থানীয় আশ্রমের মোহান্ত-মহারাজেরাও ভিড় জমায় ইত্যাদি নানা কাণ্ড হয়েছিল। পুলিশ হাসপাতালে গিয়ে ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিল—ওঁনার কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযােগ আছে কিনা—উনি উত্তর দিয়েছিলেন “না, যাদের প্রয়ােজন ছিল তারা সব নিয়ে গেছে।” ফলে কোন কেস-কামারি হয় নি!

ঘটনা ঘটার অনেক পরে আমি যখন ওখানে গিয়েছিলাম, উনি নিজেই ঘটনাটি আমার কাছে বর্ণনা করেছিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “গুরুদেব! আপনি তো ব্রহ্মজ্ঞানী তাহলে আপনার মতো মানুষের এরূপ হোল কেন ?” উনি উত্তর দিয়েছিলেন‘প্রারব্ধ’। আমি বললাম—”আপনার নির্বিকল্প সমাধি হয়ে গেছে, আপনার আবার প্রারব্ধ কি ?” উনি বললেন, “কুলালচক্র দেখেছ—কুমােরের চাক্‌ ! ওটা কুমােরেরা একটা লাঠি দিয়ে কয়েকপাক জোরে জোরে ঘুরিয়ে দেয়, তারপর কিন্তু ওটা আপনা আপনিই ঘুরতে থাকে। কত হাঁড়ি, বাসন, গ্লাস তৈরী হয়—তবু ওর ঘূর্ণন যেন শেষই হতে চায় না। মানুষের প্রারব্ধ-কর্মফলও তেমনি। আমার নতুন করে কর্মফল আর সৃষ্টি হচ্ছে না ঠিকই কিন্তু পূর্বের যে সঞ্চিত কর্মফল জমা ছিল, সেটার কিছু ভােগ বাকী ছিল—সেগুলি এভাবে শােধ হয়ে যাচ্ছে !