স্থান ~ পরমানন্দ মিশন ৷ সময় ~ ১৯৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দ । উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ আশ্রমস্থ ও বহিরাগত ভক্তবৃন্দ ।
জিজ্ঞাসু :— শৈবসম্প্রদায় বৈদিক, তাহলে শিবকে অনার্য দেবতা বলা হয়েছে কেন ? বেদ যেহেতু আর্যদের সৃষ্টি—তাই জিজ্ঞাসা করছি ?
গুরুমহারাজ :– হ্যাঁ, বৈদিক পঞ্চশাখা হচ্ছে সৌর, শাক্ত, শৈব, গাণপত্য ও বৈষ্ণব। পশ্চিমবাংলায় এদের প্রায় সবাইকে এখনও পাবে। ব্রাহ্মণমাত্রেই “গায়ত্রী”-র মাধ্যমে সূর্য-উপাসনা করে থাকে, তাছাড়া প্রভাতে সূর্যপ্রণাম যে কেউ করতে পারে—অনেকে করেও। বাঙালীরা সকলকেই আপন করে নিতে ভালােবাসে, সেই অর্থে গণপতি গণেশকেও সর্বসিদ্ধিদাতা হিসাবে প্রায় সকলেই পূজা করে। তাছাড়া সমস্ত পূজাতেই সর্ব প্রথমে গণেশাদি পঞ্চদেবতার পূজা করার রীতি রয়েছে। তবে “গণপতি বাপ্পা—মােরিয়া” মহারাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশী পূজিত হন। গণেশ চতুর্থী (ভাদ্র মাসে) -তে পশ্চিমভারতে ১০দিন ব্যাপী ধুমধাম সহকারে গণপতি বাপ্পার পূজা হয় যা এখানকার দুর্গাপূজার জাঁকজমককেও ছাপিয়ে যাবে। এখন তাে T.V-তে কিছু কিছু দেখতে পাও—তাই আমার কথা বুঝতে পারবে। আর শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব তাে রয়েছেই।
যাইহােক, তোমার জিজ্ঞাসায় ফিরে আসি। এই যে “আর্য-অনার্য” –sentiment, এটা বিদেশীদের দেওয়া। ইংরেজরা যেহেতু বাইরে থেকে এসে এদেশ শাসন করেছিল, তাই ঐ ধরণের একটা গল্প বলা ওদের খুবপ্রয়ােজন ছিল যে “আর্য-ভারতের বাইরে থেকে এসে এদেশে সভ্যতার বিস্তার করেছিল। ফলে ওরা অর্থাৎ ইংরেজরা নতুন কিছু করেনি বা অন্যায় কিছু করেনি—এটাই ভারতের পরম্পরা।” কিন্তু ইতিহাস বা আধুনিক কালের গবেষণা তাে এই তত্ত্বকে স্বীকার করে না। পৃথিবীতে লিখিত ইতিহাস প্রথম যা পাওয়া গেছে তা হ’ল মেগাস্থিনিসের “ইণ্ডিকা”—তাও মূলগ্রন্থ পাওয়া যায়নি, পরবর্তীকালের বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের বই-এর “কোটেশন” থেকে একটা সঙ্কলন করা হয়েছে। কিন্তু মেগাস্থিনিস তাে মাত্র ২২০০-২৩০০ বছর আগেকার লােক, তারপরের স্বীকৃত ঐতিহাসিকরা আরও নবীন। এদিকে ঋগ্বেদের যে পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে–যা লণ্ডন মিউজিয়ামে রয়েছে তার বয়স দেখা গেছে ১০ হাজার বছরেরও বেশী। তাহলে কোন ঐতিহাসিক আর্য-অনার্য তত্ত্বের সৃষ্টি করল আর কে তার সাক্ষ্য ছিল ? —এগুলাে ব্রিটিশ শাসকদের মস্তিষ্কপ্রসূত পরিকল্পিত চক্রান্ত ছিল যা তারা তৎকালীন কিছু তাঁবেদার শিক্ষিত ভারতীয়দের মুখ দিয়ে স্বীকার করিয়ে চালিয়ে দিয়েছিল। আর যা আজও চলছে। এটাই লজ্জার কথা। স্বামী বিবেকানন্দ ১০০ বছরেরও বেশী আগে ইংল্যাণ্ড, আমেরিকায় উচ্চকণ্ঠে এই তত্ত্বের বিরােধিতা করে স্বমত প্রতিষ্ঠা করে এলেন, আর আমরা এতটাই মেরুদণ্ডহীন, ভারতীয় সমাজনেতারা এতটাই রাজনীতিসর্বস্ব চিন্তার দ্বারা সীমাবদ্ধ যে, এতদিনে ভারতবাসীর কাছে অন্তত ছােট ছােট ছাত্র-ছাত্রীর কাছে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে সঠিক তথ্যটা পরিবেশন করা গেল না।
রামায়ণ মহাভারতকে ইতিহাস বলেনি বিদেশীরা, তাই ভারতীয়রাও এগুলিকে কল্পকাহিনী গল্পকাহিনী বলেই মনে করে আসছে। কিন্তু ভারতের প্রাচীন ইতিহাস ওখানে যথেষ্ট লিপিবদ্ধ রয়েছে। বহু পণ্ডিত অনেক কিছু তথ্যসূত্র আবিষ্কারও করেছেন, ভালাে করে research করলে আরও অনেক অনাবিষ্কৃত সত্য উদঘাটিত হবে আগামী দিনে।
তুমি হয়তাে এখানে কম আসা-যাওয়া করাে তাই আগে শোনোনি, কিন্তু আমরা “আর্য”-এই শব্দটি নিয়ে বা প্রাচীন ভারত নিয়ে প্রায়ই আলােচনা করে থাকি। প্রাচীন ভারতে তিনটি সংস্কৃতি প্রধান ছিল। উত্তরভারত বা হিমালয়কে কেন্দ্র করে আর্য-সংস্কৃতি, দক্ষিণভারতে দ্রাবিড়ীয় সংস্কৃতি, আর মধ্যভারতে বিন্ধ্যাচলকে কেন্দ্র করে কোল সংস্কৃতি। তিনটি সংস্কৃতিই উন্নত ছিল। বহু পূর্বে মহাযােগী সদাশিব বা ‘শিব” বা “মহাদেব” যিনি কৈলাসে (তিব্বত) সাধন ভজন করেছিলেন, যাঁর শরীরও ওখানকারই ছিল, তিনি তাঁর সাধনালব্ধ জ্ঞান সমগ্র উত্তরভারত, মধ্যভারত ও দক্ষিণভারতে প্রচার করেন। বেদ বা তন্ত্র সবই ঐ মহাজ্ঞানী, মহাযােগী শিবেরই প্রভাবে সৃষ্ট, তবে যে কোন কারণে দক্ষিণভারতে তন্ত্রের প্রসার বা উৎকর্ষতা বেশী হয়েছিল আর হিমালয়কে কেন্দ্র করে ঋষিদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল বেদ-বেদান্ত। এই হিসাবে বলা হয় ইনি দেবাদিদেব, ইনি সকলের দেবতা। বেদে রুদ্রের উল্লেখ রয়েছে, অনেকে বলেন এই বৈদিক রুদ্রই তন্ত্রের আরাধ্য বা শৈবদের উপাস্য শিব। এইভাবে তন্ত্রের সাথে বেদের যােগসূত্র স্থাপিত হয়েছে বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। কিন্তু বাস্তবে যেটা আগে বলা হ’ল ওটাই হয়েছিল—শিব-ই সবকিছুর স্রষ্টা। পৃথিবীতে যাবতীয় জ্ঞান বা বিদ্যা সব শিব প্রবর্তন করেছিলেন। শুধ বেদ বা তন্ত্র নয়, ভক্তিশাস্ত্র, যােগ, কৃষিবিদ্যা, ধনুর্বিদ্যা, (শস্ত্রবিদ্যা), চিকিৎসাবিদ্যা, (শল্য ও শলাকা), এছাড়া স্বমূত্র (শিবাম্বু ) চিকিৎসা ইত্যাদিও শিবের দান। শিবের মহিমা বলে শেষ করা যাবে না_তাই শিবভক্ত পুষ্পদন্ত বলেছিলেন–
‘অসিতগিরিসমং স্যাৎ কজ্জলং সিন্ধুপাত্রে।
সুরতরুরশাখা লেখনী পত্রমূর্বী।
লিখতি যদি গৃহীত্বা সারদা সর্বকালং
তদপি তব গুণানামীশ পারং ন যাতি।৷
নীল পর্বতসমূহকে কালির বড়ি করে যদি সাগরের সব জলে গুলে কালি করা হয়, আর পৃথিবীর সমস্ত গাছপালা কেটে যদি কলম বানানাে হয় আর স্বয়ং মা সরস্বতী যদি চিরকাল ধরে তােমার গুণের কথা লেখেনতবুও তােমার গুণের ইয়ত্তা হতে পারে না।
শিবকে অনার্য-ই বলো আর আর্য-ই বলো_ শিবের তাতে কি যায় আসে, আর শিবভক্তদেরই বা কি যায় আসে ! যে পঞ্চশাখা (বৈদিক) -র কথা বলা হল এর একটা শৈব, আর একটা শাক্ত যার ভৈরব শিব। এবার শিবের কপালে তেজ (অগ্নি বা সূর্যরূপ), চূড়ায় চন্দ্র (সূর্যের আলােয় আলােকিত)। গণপতিকে শিবপুত্র হিসাবে বর্ণনা করেছে পুরাণাদি শাস্ত্র। আবার শিবকেই বলা হচ্ছে পরম বৈষ্ণব। অদ্বৈত আচার্যকে বলা হচ্ছে শিবাবতার। সুতরাং শাস্ত্র থেকেও দেখা যায় শিব সকলের মধ্যে মধ্যমণি হয়ে রয়েছে। আবার ভারতবর্ষের তীর্থস্থানগুলি দেখাে–সুদূর কাশ্মীরের তুষারতীর্থ অমরনাথ, উত্তরের মহাপ্রস্থানের পথে দুর্গম কেদারনাথ, পশ্চিমের পূণ্যসলিলা গঙ্গাতীরে পূণ্যতীর্থ কাশী বিশ্বনাথ, সুদূর দক্ষিণে রামেশ্বরম্ আর মধ্যভারতে নর্মদাতীরে তাে শিবলিঙ্গের ভিড় লেগে রয়েছে যা ‘তপােভূমি নর্মদা’ বইটিতে উল্লেখ রয়েছে। পূর্বভারতে তারকেশ্বর, তাছাড়াও এই ধরণের নামের বহু শিবলিঙ্গ এখানে পাওয়া যায়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে আর সব “-শ্বর” অর্থাৎ তারকেশ্বর, বিল্বেশ্বর ইত্যাদি লিঙ্গের একই গল্প শুনবে–এক গােয়ালার গরু হারিয়ে যায়, সেই গােয়ালা গরু খুঁজতে গিয়ে দেখে যে, জঙ্গলের মধ্যে একটা শিলাখণ্ডের মাথায় গরুর বাঁট থেকে আপনি ঝরে পড়ছে দুধের ধারা। পরে শিলাটি আবিষ্কৃত হয় অমুক শিবলিঙ্গ বলে। এই গল্পটি চিরন্তন হয়ে গেছে।
এছাড়াও আরবে মহাকাল মন্দির বা মক্কেশ্বর শিবমন্দির ছিল। আফগানিস্থানেও ছিল, কারণ গান্ধারী (গান্ধারের রাজকন্যা) শিবভক্ত ছিলেন, শিবপূজা না করে জলগ্রহণ করতেন না। রামায়ণে উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে যে, সীতাদেবী রামেশ্বরমে শিবপূজা করেছিলেন। পরবর্তীতে সারদা মা একবার যখন রামেশ্বরম যান তখন শিবপূজা সেরে স্বগতােক্তি করেছিলেন “যেমন রেখে গিয়েছিলাম ঠিক তেমনটাই রয়েছে।” উপস্থিত ভক্তগণ নিশ্চয় করেছিলেন যে, মা তার পূর্ব পর্ব শরীরের কথা স্মরণ করেই ওকথা বলেছিলেন, অর্থাৎ তিনি যখন সীতারূপে রামের সাথে লীলা করেছিলেন তখন রামেশ্বরমে যে লিঙ্গ পুজা করেছিলেন–কয়েক হাজার বছর পরেও লিঙ্গটি সেইরকমই আছে। এই যে ইতিহাস—এগুলি কোন ঐতিহাসিক লেখেনি বলে কি সত্য নয় ! ‘মহাজনাে যেন গতঃ স পন্থাঃ’–এটাই ভারতবর্ষ–এটাই ভারতবর্ষের ইতিহাস।
সুতরাং শিবকে ঐভাবে আর্য-অনার্য হিসাবে ভাগ করা বিদেশীদের চিন্তাধারা, ভারতীয় ঋষিদের চিন্তায় নয় বা এটার কোন সত্যতাও নেই। শিব মানে মঙ্গল, যা কিছু মঙ্গলকর, তাই শিবের অবদান, এটাই সত্য জানবে। বেশ কয়েক হাজার বছর আগে মৎস্যেন্দ্রনাথ – গােরক্ষনাথ পরম্পরায় বিভিন্ন নাথযােগীরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন—এঁদের অনেকেই সিদ্ধও হয়েছিলেন। শিবের নাম অনুসারে এই ‘নাথ’ যােগীদেরও নাম ছিল, যেমন শিবের নাম-পরেশনাথ, তারকনাথ, ভূতনাথ, বিশ্বনাথ তেমনি আবার গােরক্ষনাথ, মীননাথ, পার্শ্বনাথ বা পরেশনাথ ইত্যাদি। ‘নাথ’ পরম্পরার আদিগুরু ‘গোরক্ষনাথ’-কেও শিবের অবতার বলা হয়। মহাযােগী সদাশিব (শিব) যেমন কোন একসময় আসমুদ্র হিমাচল ঘুরে বেড়িয়েছিলেন এবং তৎকালীন মানুষকে নানান শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন, তেমনি কোন এক সময় গােরক্ষনাথও সমস্ত ভারতবর্ষ হেঁটে হেঁটে ঘুরে শিবধর্ম প্রচার করেছিলেন। এখনও গ্রামে-গঞ্জে “গােরক্ষতলা” বা “গরতলা” প্রচুর রয়েছে।—হয়তাে কোনসময় তিনি ঐ সমস্ত স্থানে ঘােরার সময় বিশ্রাম নিয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ, আচার্য শঙ্কর, তৈলঙ্গস্বামী, বামদেব এনাদেরকেও শিবাবতার বলা হয়। এঁদের মধ্যে স্বামীজী ও আচার্য শঙ্করও গােটা ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করেছিলেন। শিবযােগী পরম্পরায় পরিব্রাজন একটা অঙ্গ। এইভাবে বিভিন্ন ঘটনা বা সত্য ঘটনার উপস্থাপনা করে আমি এটাই বােঝাতে চাইলাম যে, ‘শিব’ প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় সংস্কৃতির অস্থি মজ্জায় এমনভাবে মিশে.আছে যে, কোন বিদেশী দুর্বল মত দিয়ে ভারতীয়দের। মন থেকে শিবভাবনা মােছা সম্ভব হবে না। স্বামী বিবেকানন্দও সমগ্র বিশ্ব ঘুরে এসে বলেছিলেন, “গােটা পৃথিবী ঘুরে এটাই দেখলাম বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন ভাবে শিব আর শিবানীই পূজিত হয়ে চলেছেন।