স্থান ~ পরমানন্দ মিশন । সময় ~ ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ । উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ নগেন, জয়দীপ, স্বামী স্বরূপানন্দ সহ অন্যান্য আশ্রমিক ও বহিরাগত ভক্তবৃন্দ ।

জিজ্ঞাসু :– মহাপুরুষকে কি দেখে চেনা যায় ?

গুরুমহারাজ :– মানুষ কি মহাপুরুষকে চিনতে পারে—মহাপুরুষগণই মানুষকে চেনেন বা জানেন। আমাকে এইরূপ জিজ্ঞাসা অনেকেই করে—”মহাপুরুষ কি করে চিনব “? প্রকৃতপক্ষে তােমার যদি তৃতীয় চক্ষুর উন্মীলন হয় তবেই তুমি মহাপুরুষ চিনবে বা আরাে অনেক কিছুই জানতে পারবে। অন্যথায় এই দর্শনেন্দ্রিয়রূপ চর্মচক্ষু দিয়ে আর কি চিনবে বাবা ! এই চক্ষুদুটোর capacity কতটা—কিছুটা দূরের বস্তুই দেখা যায় না, আর দেখা গেলেও ভালােভাবে বােঝা যায় না। আর মন, বুদ্ধি ইত্যাদি অতীন্দ্রিয়রা কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে recognise করতে সাহায্য করে, কিন্তু তাের এই মন-বুদ্ধিরই বা কতটা ক্ষমতা ? সাধনার দ্বারা মন-বুদ্ধিকে শুদ্ধি করলে, তখন অনেক কিছু বােঝা যায়। তাই সাধারণত মহাপুরুষগণ কৃপা করে নিজেদেরকে চেনা দেন তবেই সাধারণ মানুষ তাঁদের চিনতে পারে, কিছু সেবাদি করতে পারে আর এটাও মহাপুরুষদেরই কৃপা ! তাঁরা নিজেদের কাজ নিজেরাই করতে পারেন, নিজেদের অন্ন-জল নিজেরাই গ্রহণ করতে পারেন! কিন্তু হয়তাে কাউকে কাউকে দিয়ে এগুলাে করিয়ে নেন তার মঙ্গলের জন্য। যে বা যারা এই সুযােগ পায় তারা ধন্য। কারণ তারা জানতেই পারল না কত অল্প কাজের বিনিময়ে জন্ম-জন্মান্তরের কত সাধনার ফল ফলে গেল !

সে যাইহােক, যা বলছিলাম—মহাপুরুষ চিনতে হলে হয় মহাপুরুষের কৃপা পেতে হবে অথবা সাধনার দ্বারা জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন ঘটাতে হবে অর্থাৎ তােমাকেই মহাপুরুষ হতে হবে। একজন মহাপুরুষই আর একজন মহাপুরুষকে চিনতে পারেন—সাধারণে কি করে চিনবে ? মহাপ্রভুর সমসাময়িক ব্যক্তিদের ক’জন তাকে চিনেছিল ? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছোটবেলায় ‘গদাই’ নামে পরিচিত ছিলেন। কামারপুকুর গ্রামে দু-চারজন ছাড়া বাকিরা কি ওনার কৃপা পেয়েছিলেন ? না ওনাকে চিনেছিলেন ? দক্ষিণেশ্বরে আসার পর নাম হ’ল খ্যাপাঠাকুর’, রাণীর কর্মচারীরা কি হেনস্তাই না করতাে। পুরােহিত পদে উন্নীত হবার পরও ঠাকুরবাড়ি থেকে রানির কাছে বারবার নালিশ গিয়েছে এই খ্যাপা পুরােহিতকে বরখাস্ত করার জন্য। শ্রীরামকৃষ্ণের তখন একটা অন্যরকম ভাবাবস্থা ছিল—একদিন ঠাকুর কালীমন্দির চত্বরেই ভাবস্থ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। আর এখন যারা কালীঘাটের পুরােহিত সেই হালদার পরিবারের একজন রাসমণির কালীমন্দিরে চাকরি করতাে, সে ছুটে গিয়ে পায়ে করে ঠাকুরের বুড়াে আঙুলটা চেপে ধরে মাটিতে ঘষতে লাগল আর জিজ্ঞাসা করতে লাগল—“এই খ্যাপা বল না কোন গুণে (তুকতাকে) জমিদারবাবুকে (মথুরবাবুকে) বশ্ করেছিস ?” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আঙুল ফেটে রক্তারক্তি হবার জোগাড় ! ভাবস্থ অবস্থা তাে অজ্ঞান অবস্থা নয়_ পূর্ণজ্ঞানাবস্থা ! কিন্তু সেই অবস্থায় কোন ইন্দ্রিয় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না, তাই ঠাকুর সেই মুহূর্তে কোন প্রতিবাদ করতে পারলেন না। তবে ভাব কেটে গেলে তার চরম যন্ত্রণা হয়েছিল, ইচ্ছা করলে তিনি মথুরবাবুকে পুরো ঘটনাটা বলতেও পারতেন, হয়তাে বললে হালদার মশাই-এর চাকরি যেতাে বা অন্য কোন শাস্তি হােত। কিন্তু ভগবান তাে কারও দোষ ধরেন না, তিনি সর্বংসহা তাই ঠাকুর নিশ্চুপ থাকলেন। তাহলে বলাে তাে রাসমণির কালীমন্দিরের কর্মচারীরা তাে তখন সবসময় ঠাকুরের কাছে কাছেই থাকতাে, কিন্তু তারাই বা চিনলাে কই ? চেনা কি অত সহজ ? আবার বামদেবকে দ্যাখাে, সিদ্ধ হবার পরও কতক্ষেত্রে কতরকম ভাবে হেনস্থা, কতবার অপমানিত ও অত্যাচারিত হলেন ! সমকালীন মানুষেরা যদি ওনার স্বরূপ চিনতে পারতোতাহলে কি এরূপ ব্যবহার করতো ?

একবার কাশীতে সেবাইতদের হাতে মার খেলেন, এমনকি তারাপীঠেও পাণ্ডারা তাঁকে এমন কঠিনভাবে মেরেছিল যে, সাধারণ মানুষ হলে হয়তো মরেই যেতাে। সেদিন পাণ্ডারা কিন্তু উনি মারা গিয়েছেন মনে করেই নদীর ধারে ফেলে দিয়ে এসেছিল। ঘটনাটা কি হয়েছিল বলছি – কোন একটা বিশেষ তিথি উপলক্ষ্যে পূজারিরা মা তারার জন্য ভালাে ভালাে রান্না করে ভােগের ব্যবস্থা করেছিলেন। নাটোরের মহারানির under-এ ছিল তারাপীঠ, তাই তিথিবিশেষে ভােগের আয়ােজন ভালােই হােত। বহুবিধ রন্ধনসহ সমস্ত ভােগের জোগাড় সম্পূর্ণ করে সেবাইতরা সেগুলি দেবী-মূর্তির সামনে সাজিয়ে রেখেছে, শুধু নিবেদনটাই বাকি ! এদিকে বামদেব শ্মশানে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন, তাকে কেউ বলত সিদ্ধ, কেউ বলত পাগল। সেদিন তিনি শ্মশানের জঙ্গলে নদীর পাশে বসে বসে পায়খানা করছিলেন, হঠাৎ দেখেন যে, মা তারা তাকে ডাকছেন, “মন্দিরে ভালাে ভালাে খাবার রয়েছে খাবি আয় !” মায়ের আহ্বান! জলশৌচ না করেই পিছনে একতাল ‘গু’ নিয়েই বামদেব ছুটলেন মন্দিরে। গিয়ে দেখেন সত্যিই ভালাে ভালাে খাবার থরে থরে সাজানাে রয়েছে। আর তাঁকে পায় কে ? পূজারি পাণ্ডারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই লাফিয়ে গিয়ে খাবারগুলাের মাঝখানে বসে পড়লেন আর দু’হাতে এটা ওটা নিয়ে গােগ্রাসে গিলতে লাগলেন। একবার এটায় হাত দিচ্ছেন—একবার ওটায় হাত দিচ্ছেন। কিছু মুখে দিচ্ছেন, কিছু আবার মুখ থেকে পড়ে যাচ্ছে—সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য ! পূজারিরা ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়েছিল কিন্তু সম্বিৎ ফিরতেই একেবারে সকলে হাঁ-হাঁ করে উঠল। কেউ কেউ টেনে-হিঁচড়ে ওঁনাকে বাইরে এনে আছড়ে ফেললাে, তারপর রান্না করার বড় বড় লােহার হাতা-খুন্তি দিয়ে সেকি মার ! একেবারে আষ্টে পৃষ্টে মার ! পাণ্ডাদের রাগ হবে নাই বা কেন ? অত বড় আয়ােজন সব নষ্ট হয়ে গেল আর সর্বোপরি পিছনে ‘গু’ নিয়ে বামদেব একেবারে ঠাকুরঘরে ঢুকে পড়েছেন, ভােগ এঁটো করেছেন—এসব কথা রানির কানে উঠলে হয়তাে পুজারীদের‌ই চাকরি যাবে—হয়তাে তাদের মাথাও যেতে পারে ! এইসব বিবেচনা করে তাদের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল বেচারা বামদেবের উপর ! মারতে মারতে হঠাৎ ওদের খেয়াল হোল যে, ‘ব্যাটা বােধহয় মরে গেছে’, তখন ওরা ওনাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে দ্বারকা নদীর ধারে ফেলে দিয়ে এলো। এরপর সব ভােগ বাইরে ফেলে দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে, পণ্ডিতদের ডেকে প্রায়শ্চিত্ত করে, পঞ্চগব্য দিয়ে প্রতিমাকে শুদ্ধ করে পুনরায় ভােগ-রাগের ব্যবস্থা করলো ওরা। এদিকে গভীর রাত্রে মহারানি স্বপ্নে দেখছেন ✓রী মা তারা অভিযােগ করছেন যে, তিনি অভুক্ত রয়েছেন কারণ তাঁর ছেলেকে পূজারিরা মেরেছে, তাঁর উপর অবিচার হয়েছে, তাঁরও খাওয়া হয়নি ফলে দেবীরও খাওয়া হয়নি_ এর বিচার না হওয়া পর্যন্ত তিনি আর ‘ভােগ’ গ্রহণ করবেন না। স্বপ্ন দেখে নাটোরের মহারানি তাে কেঁদে আকুল ! পরদিন প্রত্যুষেই তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন তারাপীঠের উদ্দেশ্যে ! তখনকার দিনে নাটোর থেকে আসতে দু-তিন দিন সময় লেগেই যেতো। ফলে রানিমা একটু দেরিতেই পৌঁছেছিলেন । ঘটনার পরে পরেই রানিকে আসতে দেখে পূজারিরাও অবাক, ভাবলো বামা-র অনাচারের খবর যাহােক করে রানির কানে গেছে, সুতরাং তার শাস্তি নিশ্চিত ! তারা সকলে রানির কাছে এসে, বামা-র অনাচারের বিরুদ্ধে কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেকোন পণ্ডিতের বিধান নিয়েছেকাকে দিয়ে পঞ্চগব্য করিয়েছে তার সব ফিরিস্তি আর তথ্য দিতে শুরু করলো। কিন্তু রানির চোখ অন্যত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, কান অন্য কথা শুনতে চাইছে কোথায় সেই তারামায়ের খ্যাপা ছেলে ! রানি খুঁজতে বেরুলেন তারামায়ের প্রিয় সন্তানকে। বামদেবের শরীর এই কদিন ধরে নদীর পাড়ে সেখানেই পড়ে ছিল যেখানে পাণ্ডারা ফেলে রেখেছিল ! শরীরটি ভেসেও যায়নি আবার উনি নিজেও উঠে আসতে পারেন নি। রানি লােকজনের সাহায্যে বামদেবের শরীরটা তুলে আনলেন, তারপর সেবা-শুশ্রষা শুরু করলেন। একটু সুস্থ হলে রানি তাঁর পা দুটো ধরে কাঁদতে লাগলেন—বললেন, “বাবা, তুমি ঐভাবে মন্দিরে নােংরা অবস্থায় গেলেই বা কেন ?” বামদেব বললেন, “আর কখনও যাবাে না, ও আমার মা নয়, ও সর্বনাশী ! ও নিজেই আমাকে ডাকলো ! আমি তাে ‘বাহ্যে’ করছিলাম—খেতেও চাইনি, ও-ই আমাকে বললো, মন্দিরে আয়অনেক খাবারের আয়োজন হয়েছে, তােতে আর আমাতে খাবো ! আমিও ছুটতে ছুটতে গেলুম, ওঁর সাথেই খেলুম আর তারপর ঐ সর্বনাশীই আমাকে মার খাওয়ালো। ওর মন্দিরে আর আমি যাবো না। ওর মন্দিরে বাজ ফেলাবো!” রানি সব শুনে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন, বললেন– “ওকথা বলাে না বাবা, তুমি মন্দিরে না গেলে বা প্রসাদ না খেলে যে, দেবীও খাবেন না—উনিও যে কদিন থেকে তােমার সাথেই না খেয়ে রয়েছেন ! পূজারিরা আপনাকে চিনতে না পেরে মেরেছে আর কখনও মারবে না !” খ্যাপাবাবার বালকভাব_ তাই রানির সব কথা শুনে উনি হাসতে হাসতে উঠে পড়লেন, বললেন, “ও ! তাহলে শালা পাণ্ডারা আমাকে মেরেছে, তারামা আমাকে মারে নি_ দূর শালা ! আমার মায়ের উপর আমি মিছে মিছে রাগ করলাম ! চলো-চলো, আমার মা উপবাসী আছে_ তাহলে আজকে এখুনি গিয়ে একসঙ্গেই খাই !” রানি তারাপীঠে পৌঁছেই সমস্ত রকম ভােগের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, এবার মা-ছেলেকে একসঙ্গে সেইসব ভােগ নিবেদন করা হােল। ✓রী মা-কে নিবেদনের আগেই বামদেব “গপ্ গপ্”করে খেতে আরম্ভ করে দিলেন। ইষ্টদেবী আর সাক্ষাৎ সচল দেবতার ভােগ গ্রহণ সচক্ষে দেখে রানিও ধন্য হলেন।

এরপর থেকেই রানিমার হুকুমে আগে বামদেবের ভোগ এবং পরে ✓রী তারা মায়ের ভোগের নিয়ম চালু করা হয়েছিলযা আজ‌ও চলে আসছে! এই ঘটনার পর থেকেই বামদেবের প্রতি পাণ্ডাদের অত্যাচার কমে গিয়েছিল। কারণ রানি রূষ্ট হয়ে প্রধান পুরোহিত এবং দারোয়ানদেরকে দূর করে দিয়েছিলেন। তবে বামদেবও এরপর থেকে মন্দির-চত্বরে বড় একটা আসতেন নাবাইরে বাইরেই বেশি সময় কাটাতেন। তবে মন্দিরে বাজ কিন্তু পড়েছিল এবং মন্দিরের কিছুটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত‌ও হয়েছিল।

যাইহােক, এসব ঘটনা তাে ঘটেছে—এগুলাের লিখিত প্রামান্য ইতিহাসও রয়েছে, অস্বীকার করতে পারবে না। তাহলে বলো–কি করে মহাপুরষকে চিনবে ? মহাপুরুষ যদি কৃপা করে তােমার কাছে ধরা না দেন তাহলে তােমার কি সাধ্য যে তুমি তাঁকে ধরবে ? মানুষ তাে যুগে যুগে, কালে কালে মহাপুরুষদের মেরে ফেলেছে, অত্যাচার করেছে এটাও কি ইতিহাস নয় ! হ্যাঁ, অবশ্য এটাও ঠিক যে, কিছু মানুষ মহাপুরুষদের চারপাশে থেকে তাঁর মহিমা প্রকাশে সাহায্য করেনতবে এদের বেশীর ভাগই মহাপুরুষদের পার্ষদ বা পূর্ব নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি যাঁরা সংকল্প করে শরীরধারণ করেন ঈশ্বরের কাজের সহযােগিতা করার জন্য। বাকি যে সমস্ত লােকেরা মহাপুরুষদের চারপাশে থাকে তারা কৃপাপ্রাপ্ত। সুতরাং বুঝতে পারলে তো যে, সাধারণ মানুষ কখনই মহাপুরুষকে চিনতে বা বুঝতে পারে না। আরে বাবা ! সাধারণ মানুষ তার চারপাশের মানুষদেরই চিনতে গিয়ে অনেক সময় ভুল করে বা ঠকে যায় তাে মহাপুরুষকে কি করে চিনবে !