স্থান ~ পরমানন্দ মিশন (বনগ্রাম) । উপস্থিত ব্যক্তি ~ বহিরাগত ও মিশনস্থ ভক্তবৃন্দ ।
জিজ্ঞাসা :— এত বড় উৎসব হল আশ্রমে, এত মানুষ আপনাকে সারাদিন ধরে প্রণাম করে গেল — আপনাকে দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে, তবুও হাসিমুখে আমাদের অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে — এতে অসুবিধা হয় না?
গুরুমহারাজ :— কিসের অসুবিধা…(অমুক) বাবু! আমার তো পৃথিবীতে আসা এইজন্যই। তবে তুমি যে কথাটা বলছিলে সেটা ঠিকই সহস্র সহস্র মানুষের স্পর্শের ব্যাপারটা এগুলোর বেশিরভাগই তো Negative-ধর্মী touch , আর আমার শরীরে সবসময়েই থাকে Positive Field ! ফলে হটাৎ করে touch করলে আমার শরীরে একটা ধাক্কা লাগে ! বেশিরভাগ মানুষ কিভাবে জীবন যাপন করেসে তো দেখতেই পাচ্ছো ! ভালো ভালো জামাকাপড় পরে, যেন উপরটাই চকচকে ভিতরে কামনা-বাসনা গিজগিজ করছে ! এক এক জনের স্পর্শমাত্রই শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। তবে যেহেতু আমি মা জগদম্বার কোলে বসে আছি_তাই এসব দৈহিক জ্বালা-যন্ত্রনা সহ্য করতে হোলেও মানসিকভাবে আমার এমনিতে খুব একটা অসুবিধা হয় না ! আর শরীরের যে বিধ্বস্ত অবস্থাটা দেখছো — এটা তো হবেই, কারণ শরীর তো জড়পদার্থে তৈরি —এইজন্যেই বলা হয় ‘পাঞ্চভৌতিক শরীর’। কিন্তু দেখেছি Energy-র অভাব হয় না হু হু করে Supply আসে, শরীর আবার Re-charged হয়ে যায়।
তবে, এবার উৎসবের দিনে কত লোক হয়েছিল বলো! আমার মনে হয় এই দু-তিন দিনে আমি দুই থেকে আড়াই কুইণ্টাল প্রসাদ মানুষকে দিয়েছি (গুরুমহারাজকে কেউ প্রণাম করলেইউনি তাকে কোন না কোন প্রসাদ দিতেন শুকনো মিষ্টি, সন্দেশ, চকোলেট ইত্যাদি)। দানাদার(কড়কড়ে চিনি মাখানো একটা শুকনো মিষ্টি) বেশি দিলে আমার ডানহাতের তিনটে আঙুলের ডগাগুলো ক্ষয়ে যায়, অনেক সময় রক্ত পড়ে। আবার কোনসময় ভক্তরা চানাচুর, ঝুরিভাজা নিয়ে আসে, ওগুলি এতো ঝাল থাকে যে, হাতে করে সবাইকে ভাগ করে দিতে থাকলে দেখি কিছুক্ষণ পরে হাত জ্বালা করছে। তখন ভাবি আমার হাতের তালুরই এই অবস্থা তাহলে এগুলি পেটে গেলে কি অবস্থা হয়! তবে সবার হাতের তালুর চামড়া মোটা আমার মতো অতটা Sensitive নয়, সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে আমার হাতের তালুর ছিদ্রগুলি অন্যের থেকে অপেক্ষাকৃত বড়। আসলে হাত দিয়েই তো বেশি energy pass হয় — সেইজন্যই বোধ হয় প্রাকৃতিকভাবেই এটা হয়েছে।
যাইহোক…(অমুক) বাবু_ তুমি অত্যাচারের কথা বলছিলে তো — তা মানুষের কাছে এ আর নতুন কথা কি! পূর্ব পূর্ব বহু মহাপুরুষগণকে তো মানুষ মেরেই ফেলেছে — এসব জেনেই তো আসা ! আর জেনেশুনে এই অত্যাচার যেমন সহ্য করতে হয় তেমনি উচ্চ উচ্চ লোকের(ভূঃলোক,ভবলোক ইত্যাদি) অনেক অভিনন্দনও পাওয়া যায়। গতকাল থেকেই দেখছি বিভিন্ন স্তরের মহাত্মাদের অভিনন্দন বার্তা আসছে আমার কাছে, আর শুধু পৃথিবীগ্রহের উন্নত স্তর থেকেই নয় গ্রহান্তরের বিভিন্ন স্তর থেকেও বার্তা পাচ্ছি ! তবে আমাকে যে কেবল অভিনন্দন গ্রহণই করতে হচ্ছে তা নয়, ওদেরকেও ধন্যবাদজ্ঞাপক বার্তা পাঠাতে হচ্ছে !
(একজন ভক্ত গুরুজীকে কিছু একটা বললেন) কি বলছো— হ্যাঁ-হ্যাঁ এগুলি অবশ্যই সুক্ষাতিসুক্ষ জগতের অনুভূতি। দ্যাখো_ মনের বিভিন্ন স্তর রয়েছে, যে ব্যক্তি যে স্তরে রয়েছে, সে সেই স্তরের অনুভূতিসকল ধরতে পারে বা কোন চিন্তাকে ধরতে পারে। বৈজ্ঞানিক, সামাজিক বা যে কোন বিষয়ের উপর নতুন সূত্র যখন আবিষ্কার হয় — সেই আবিষ্কারকের চিন্তাতরঙ্গ এই তরঙ্গটি স্পর্শ করতে পারছে বলেই তো হচ্ছে। এটাই যে কোন আবিষ্কারের রহস্য। যে কোন সূত্র এই মহাপ্রকৃতিতে একটা নির্দিষ্ট vibration-এর কাছাকাছি রয়েছে। যে মুহূর্তে তা ঐ vibration-কে স্পর্শ করলো — অমনি রহস্য উন্মোচিত হয়ে গেলো। বিজ্ঞানী চেঁচিয়ে বলে উঠল — 'ইউরেকা, ইউরেকা'। এমন কোন ব্যক্তি যদি থাকেন, যিনি চিন্তার সর্বোচ্চ স্তরেও বিচরণ করতে পারেন — তখন তাঁর কাছে আর কোন রহস্যই অজ্ঞাত থাকে না — তিনি সবার মনের খবর রাখতে পারেন, সকল জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে পারেন ! মনে জিজ্ঞাসার উদয় হওয়ামাত্রই তা ধরে নিয়ে তিনি আলোচনা করতে শুরু করে দেন।
দ্যাখো_পৃথিবীর সমগ্র মানবসমাজের __তা সে দেশি বা বিদেশি, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, প্রফেসর বা বিজ্ঞানী ইত্যাদি যাই হোক না কেন__বুদ্ধির জগতের খুব একটা তেমন ফারাক হয় না। মানুষমাত্রেরই বুদ্ধির একটা certain limit রয়েছে, সেইটার বেশি এই পৃথিবীগ্রহের কোন মানুষ যেতে পারে না ! কিন্তু যিনি সেই limit অপেক্ষাও শত সহস্র যোজন দূরের স্তর অতিক্রম করেছেন __তাঁর পক্ষে মহাবিশ্বের যে কোন রহস্যেরইজ্ঞান থাকে__ফলে পৃথিবীগ্রহের যে কোন মানুষের কোন জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়া কি এমন কাজ!
ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির চেতনার level -ও ভিন্ন। এই জন্যই তো স্থান-কাল-পাত্র ভেদে একই জিজ্ঞাসার উত্তর আলাদা হয়ে যায়। ব্যক্তি পাল্টালে, স্থান বা কাল পাল্টালেআমাকেও বক্তব্য পাল্টাতে হয় ! কারণ আমি জানি মানুষের কল্যাণ করাই আমার উদ্দেশ্য। যে যেমন ব্যক্তি, তার মতো হয়ে_ তার মনের মতো কথা বললে তবেই সে বুঝতে পারে বা উত্তরটা মেনে নেয়। আর তাতেই ঐ ব্যক্তির মঙ্গল হয়।
এখানে যারা আসা যাওয়া করে, তাদের মধ্যে কদাচিৎ দু-চারজন ব্যক্তিকে দেখেছি_ যারা বিদ্যার অহংকারে বা রাজনৈতিক পদের অহংকারে দাম্ভিক প্রকৃতির হয়ে ওঠে! ঐরূপ ব্যক্তিরা বনগ্রামে হয়তো একবারই এসেছে বেশিক্ষণ না কাটিয়ে চলেও গেছে। তার নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে বনগ্রাম মিশন সম্বন্ধে বা স্বামী পরমানন্দের সম্বন্ধে নানান বাজে কথা রটিয়েছে — “এই তো বনগাঁয়ে গিয়েছিলাম, নিজের চোখে দেখে এলাম ! সব বুজরকি…ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু মা জগদম্বার এমন লীলা জানো — তারা কিন্তু আমাকে ভুলতে পারে না, তার পরিচিত লোকজন আশ্রমে এলে বা আশ্রম থেকে ফিরলে তারা খোঁজ নেয় —”লোকটা(স্বামী পরমানন্দ) এখন কেমন আছেরে? সেই আশ্রমটা এখনও চলে তো?”
কিন্তু জানোএতেও ওদের মঙ্গল হবে। এবার এই শরীরটা দিয়ে ✓রী মা শুধু সবার মঙ্গল করিয়ে নেবেন। তাই ‘আমার এই শরীরের সন্ন্যাস মুক্তি বা মোক্ষের জন্য নয়, আমার সন্ন্যাস মানুষকে ভালোবাসার জন্য’।
দ্যাখো, এই মুহূর্তে আমার এখানে তোমার চিন্তার অভিঘাত আসছে — তুমি ভাবছো এই ধরনের মননশক্তি তোমারও নেই কেন? একটু আগেই তো বলছিলাম__ সাধন-ভজনের দ্বারা চেতনাকে উন্নত করতে না পারলে এই সূক্ষ্ম জগতে প্রবেশাধিকার কি করে হবে! মানুষের মন বিভিন্ন বিষয়ে আসক্ত, যেন আঠায় জড়িয়ে গেছে — কি করে সে সব থেকে মুক্ত হবে বল তো! আর আসক্তিহীন বিষয়শূন্য না হলে কি মন শুদ্ধ হয়? আর শুদ্ধ মন না হলে ঈশ্বরের মহিমা কি করে গোচরীভূত হবে? তাছাড়া রয়েছে মানুষের অহং বা ব্যক্তি-অহং, এই অহং থেকেই আসক্তি জন্ম নেয়। তবে আসক্তি কি যায় না — যায় বইকি? ঈশ্বরের প্রতি বা গুরুর প্রতি একান্ত সমর্পণে বা প্রেমে গলিত অহং হওয়া যায়। তখন ব্যক্তির জ্ঞান হয় যে, আমি নই সবই তিনি বা তুমি। সুতরাং সেখানে অহংকার করা বা বিষয়াসক্ত হয়ে ক্লেশভোগ করা তো ভ্রান্ততা বা মূর্খতা! অহং-মম বা “আমি-আমার” ভাবনা থেকে উন্নীত হয়ে মানুষ যখন “তুমি-তোমার” — এই বোধে আসবে তখন তাকে বলা হয় জ্ঞানী। তবে জ্ঞানী হওয়া তো মুখের কথা নয়, ‘অহং-মুক্ত হব’ — বললেই কি হওয়া যায়! সকলেই তো জানে — “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”, কিন্তু “শালার আমি” — আর যেতে চায় না। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই কথাগুলি খুবই বলতেন। ব্যক্তি-অহং ব্যাপারটা বোঝাচ্ছি শোন — ধর সন্ধ্যার প্রাক্কালে দু-একটা জোনাকি এখানে-ওখানে পিট্ পিট্ করছে — তখন তারা ভাবছে, “পৃথিবীকে আমি আলো দিচ্ছি”। এরপর ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বলে উঠল, তার আলো আর একটু উজ্জ্বল হল, এবার প্রদীপ ভাবল “পৃথিবীকে আমিই আলোকিত করছি”, তারপর সন্ধ্যার পর “তারায় লেখা আকাশ”, ফলে তারারা ভাবতে শুরু করল “পৃথিবীকে আমরাই আলো দেখাচ্ছি”। এরপর ‘গগনেতে উঠিলেন চাঁদা’ — অর্থাৎ চন্দ্রের উদয় হল। চাঁদের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় চারিদিক প্লাবিত হল, চন্দ্র ভাবল, “সারা পৃথিবীকে একা আমিই পারি আলো দিতে, আমার মত কই আর কাউকে দেখছি না।” তারপর রাত্রির যবনিকাপাত হয়ে যেই পূর্বদিগন্তে নবীন সূর্যের উদয় হোল, তখন জোনাকি, প্রদীপ, তারা, চন্দ্র সবাই ম্লান। কারুর আর কোন অস্তিত্বই থাকল না, এইভাবেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তার ব্যক্তি অহং তাকে সদাসর্বদা সমষ্টি থেকে পৃথক করে রেখেছে। প্রতিটি ব্যক্তিই যে সে ব্রহ্মেরই প্রকাশ তা ভুলে গিয়ে ব্যক্তি-অহং-এর আবরণে আবৃত হয়ে নিজেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করে রেখেছে, নিজের স্বরূপকে জানতে পারছে না, নিজেকে নিজে আর আস্বাদন করতে পারছে না, আর এই জ্বালাই তাকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে জন্ম থেকে জন্মান্তরের মধ্যে দিয়ে, এই যে তোমরা এখানে বসে আছ তা সকলেই তো বুঝতে পারছ এই শরীরধারণ করে সুখভোগ কতটা আর ভোগান্তি কতটা! তাই চেতনার উন্নয়ন ঘটিয়ে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জগতে প্রকাশের সুযোগ লাভ তো করতেই হবে। আর তারজন্যই মনকে শুদ্ধ-পবিত্র করে গড়ে তুলতে হবে। তাই বিষয়শূন্য ও আসক্তিশূন্য হও তোমরা, তাহলেই দেখবে মনের ঊর্ধ্বগতি হবে। আর উন্নত মনের অধিকারী হলেই তখন দুঃখহীন, ক্লেশহীন জীবনযাপন করতে পারবে। তখনই অনির্বচনীয় আনন্দের আস্বাদন হতে শুরু করবে, যা তোমার একান্ত কাম্য বা তোমার অভীষ্ট।