জিজ্ঞাসু :– সদগুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়ার পরও দেখা যায় ভক্তদের জীবনে নানারকম বিপর্যয় নেমে আসে এর কারণ কি ?
গুরুমহারাজ :– সদগুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়া মানেই তাে তুলাের পাহাড়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া। আর ভক্ত বলছো ! সবাই কি ভক্ত ? বেশীরভাগ মানুষ জানেই না সে কি জন্য দীক্ষা নিচ্ছে। কেউ ভাবে দীক্ষা না নিলে ঠাকুরের ভােগ রান্নার অধিকার জন্মে না, কেউ ভাবে দেহশুদ্ধ হয় না, কেউ কেউ নিতে হয় তাই নেয়, কেউ আবার প্রতিবেশী বা আত্মীয়রা বলেছে_ তাই আসে দীক্ষা নিতে। আত্মানুসন্ধানের urge নিয়ে ক’জন দীক্ষা নেয় বলাে তাে ?
যাইহােক, তুলাের পাহাড়ের যে কথা বলছিলাম, তা যেন জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কাররাশি_ জমে জমে পাহাড়ের রূপ নিয়েছে। এক-একটা জীবনকে কেন্দ্র করে সংস্কার তৈরী হয় এবং সেটি জন্ম-জন্মান্তরে পাহাড়ের রূপ নেয়। তবে ওটি দেখতে পাহাড় কিন্তু পলকা, যেন তুলাের পাহাড়। একবার আগুন ধরাতে পারলেই হু হু করে জ্বলে ওঠে ! এবার কৃপার বাতাস লাগলে সেই আগুন আরও জোরে দাউ দাউ করে জ্বলবে। 'কৃপা' মানে কিন্তু 'করে পাওয়া'। তুমি গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী ঠিক ঠিক জীবনযাপন ও ধ্যান-জপ করে যাও _কৃপার বাতাস অনুভব করতে পারবে এবং দ্রুত ঐ পাহাড় ভস্মীভূত হয়ে যাবে। সে যাইহােক, ঐ যে ধিকি - ধিকি আগুন জ্বলতে থাকা _এটাকেই তােমরা ভাবছো বাহ্য ক্লেশ। কোন ব্যক্তির জীবনে ঘটে যাওয়া কোন দুর্ঘটনা দেখে তুমি ভাবছো_ ব্যক্তিটি ক্লেশ পাচ্ছে। অজ্ঞানে এমনটি মনে হচ্ছে কিন্তু জ্ঞান হলে ভাবনাটা কেমন হবে বলো দেখি ! তখন ভাববে _'আগুন যখন লেগেই গেছে আর নেভানােও যাবে না, তখন যত দ্রুত পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় ততই মঙ্গল '! আর এই জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কাররাশি দ্রুত পােড়ার জন্য কি প্রয়ােজন—না বাতাস, অনুকুল বায়ুপ্রবাহ। অধ্যাত্মদৃষ্টিতে এটিকেই বলা হচ্ছে সাধনা বা আরাধনা। গুরুপ্রদত্ত শক্তিকে নিয়মিত অভ্যাসের দ্বারা সঞ্জীবিত করা যায়, আর সেই সঞ্জীবিত শক্তিই পারে পূর্ব পূর্ব সংস্কাররাশিকে খণ্ডন করতে। আমরা সাধারণ মানুষেরা গুরুর কাছে বীজমন্ত্র লাভ করি, তিনি তাতে শক্তি সঞ্চারিত করে দেন কিন্তু আমরা কতটা তার মর্যাদা রক্ষা করি ! তুমিই বলাে না—তুমি কতটা করো ? এইভাবে এখানে যারাই বসে আছে_ প্রত্যেককে যদি পৃথক পৃথক ভাবে জিজ্ঞাসা করা হয় সবাই মাথা নিচু করবে ! এখুনি দ্যাখাে _আমার কথা শুনে সকলেই মাথা নিচু করছে ! রামপ্রসাদ মাতৃসাধক ছিলেন _তিনি এটা উপলব্ধি করে স্বীকারােক্তি দিলেন—“গুরু আমায় কৃপা করে মা, যে ধন দিলেন কানে কানে। | আমি এমন অধমমতি তাও হারালাম সাধন বিনে৷”
সুতরাং শুধু দীক্ষা নিলে কি হবে, গুরু মন্ত্রকে বলা হয় “বীজ” ! বীজ পুঁতে তাকে মাটি, জল,সার প্রয়োগ করতে হয়তবে সেই বীজ থেকে গাছ বেরোবে এবং একদিন তা মহীরুহতে পরিণত হবে। গুরুমন্ত্র নিয়েও ঠিক তেমনি সাধন-ভজন করতে হয়। তবে নিয়মমাফিক সকাল-সন্ধ্যে বসা এটা যেন ধিকি ধিকি জ্বলা, সেই জ্বলা-কে আরো শক্তিশালী করার জন্য, যেমনটি গুরু নির্দেশ করেছিলেন তা তো ঠিকমতো পালন হচ্ছে না ! এটাও একপ্রকার গুরুদ্রোহিতা নয় কি! এতে শিষ্যের অপরাধ হচ্ছে আর শুধু অপরাধই নয়_ মহা অপরাধ হচ্ছে ! তবে, এখানে যারা যুক্ত হয়েছে তাদের অপরাধ আমি নিই না। কারণ আমি কারাের উপরেই “গুরুভাব” আরােপ করি না কোন না কোন সম্বন্ধ স্থাপন করে নিই। এতে আমার উপর কোন অবিচার করলেও যে করছে তার কোন ক্ষতি হয় না। তবে দেখেছি আমার তরফে ক্ষতি না হলেও, মহামায়ার জগতে যে নিয়ম আছে—সেই নিয়ম লঙ্ঘিত হবার অপরাধে তার ভােগান্তি হয়। এতক্ষণ যে কথা হল তারপরও কথা থেকে যায়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন- ‘জাত সাপে ধরলে তিন ডাকে শেষ।’ এখানে জাত সাপ অর্থে সদগুরু বা কৌল_ যিনি ঈশ্বরকে বােধে বােধ করেছেন। মানুষ যখন মুমুক্ষ হয়, ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ জন্মায়– তখন তার মধ্যে গুরু খোঁজার জন্য ছটফটানি ভাব আসে_ ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’। এই মনের মানুষের সন্ধান তাে চট্ করে পাওয়া যায় না কয়েকজন্মও লেগে যেতে পারে। এই ভাবে ঢোঁড়া, ঢ্যামনা করতে করতে ঐ মানুষ জাত সাপের পাল্লায় পড়ে। তখন জাত সাপ তাকে দেয় ছুবলে ! এবার আর কি ? বিষে জর্জরিত হতেই হবে শুধু সময়ের অপেক্ষা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যে ‘তিন ডাকে’-র কথা বলেছিলেন ওটা যখন জাত সাপ বা বিষধর সাপ ব্যাঙকে ধরে তখনকার কথা ! জাত সাপে ব্যাঙকে ধরলে সঙ্গে সঙ্গে তাে সে সেই ব্যাঙটিকে গিলতে পারে না—কিছুটা সময় লাগে। এই অবস্থায় ব্যাঙটি চিৎকার করে। ঢোঁড়া-ঢ্যামনা ধরলে দীর্ঘক্ষণ ধরে চিৎকার করেক্যাঁ-ক্যাঁ করেই যায়! কিন্তু জাত সাপের বিষ থাকায় যখনই সে ব্যাঙটিকে কামড়ে ধরে তখনই ঐ বিষ ব্যাঙটির দেহে প্রবেশ করে। ফলে অল্পক্ষণেই ব্যাঙটির ‘ডাক’ বা চিৎকার বন্ধ হয়ে যায়। এইজন্যই বলা হয়েছে- ‘জাত সাপে ধরলে তিন ডাকে শেষ’। মানুষের ক্ষেত্রে এই উদাহরণটির প্রয়োগ হবে যে _ সদগুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিলে শিষ্যের তিনজন্মের মধ্যেই মুক্তিলাভ ঘটবে। ঐ যে একটু আগে সংস্কাররূপ পাহাড়ের কথা বলা হচ্ছিল_ ওটি ভস্মীভূত হতে তিনজন্মের বেশী সময় লাগবে না। সদগুরু হচ্ছেন উত্তম বৈদ্য। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই উদাহরণটিও দিয়েছেন যে, অধম বৈদ্য শুধু ঔষধের Prescription করে চলে যান। মধ্যম বৈদ্য রােগীর ভালাে-মন্দের খোঁজ-খবর রাখেন। আর উত্তম বৈদ্য কোন অজুহাত মানেন না—রােগীকে ঔষধ খাইয়ে তবে যান। রােগী যদি ঔষধ তেঁতাে বলে খেতে না চায় তাে উত্তম বৈদ্য রােগীর বুকে হাঁটু লাগিয়ে চেপে ধরে তার মুখ হাঁ করিয়ে ঔষধ মুখে ঢেলে দেন। সদগুরুও এইরূপ উত্তম বৈদ্যের ভূমিকা পালন করেন। শুরু প্রদত্ত সাধন-ভজন শিষ্যের তেতাে লাগে অর্থাৎ বিষয়-বাসনায় মত্ত থেকে-ব্যস্ত থেকে ঐ কাজটি করে ওঠার আর সময় হয় না। কিন্তু শিষ্য জানে না যে, সে লম্বা দড়িতে বেঁধে দেওয়া গরুর মতাে। গরুটি কিন্তু খোঁটায় বাঁধা আছে, সে সেটা ভুলে গিয়ে লম্বা দড়ির সৌজন্যে বেশ খানিকটা জায়গা ঘুরে ঘুরে ঘাস খেতে পারছে—স্বাধীনভাবে ঘােরাফেরা করতে পারছে এই আনন্দেই মত্ত হয়ে রয়েছে ! কিন্তু যেহেতু গরুটি খোঁটায় বাঁধা তাই তার কিছু Limitation আছেই, যদি মালিক মনে করে তাকে খোঁটার গােড়ায় নিয়ে আসবে_ তাহলে দেবে দড়ি ধরে টান ! সহজ-সরলভাবে আসতে না চাইলে টেনে-হেঁচড়ে গোঁজের গােঁড়ায় তাকে আনবেনই তিনি। সেইসময় যদি ঐরকম কোন ব্যক্তির হেঁচড়ানাে দেখে _ তার চারপাশের জনগণ অজ্ঞানতাবশতঃ “আহা-উহু” করতেই পারে। জেনে রাখবে_ সদগুরুর শিষ্যের অবস্থা এইরূপই হয়। মহাশক্তিধর সদগুরু কি “তুষ কুটতে” শরীর নেন নাকি ? ধান থেকে চাল বের করে তবে ছাড়বেন ! গুরুমন্ত্র নিয়েও—গুরুর নির্দেশ পালন না করলে গুরু মারবেন এমন এক হ্যাঁচকা টান যে, শিষ্য একেবারে গোঁজের গোড়ায় ! এখানে “গোঁজ” বা “খোঁটা” হচ্ছে আত্মতত্ত্ব বা উৎস। এই উৎসে সবাইকেই ফিরতে হবে, তবে কেউ স্বচ্ছন্দ গতিতে আসে আবার কেউ আসে বক্ৰগতিতে। তবে কেউ যদি উৎসের কথা একেবারে ভুলে গিয়ে জাগতিক রূপ-রসাদিতে মত্ত হয়ে যায়, ভুলে যায় _তখনই পড়ে টান ! মানবজীবনে যে কোন দুঃখ বা ক্লেশভােগ এইরকমই হ্যাঁচকা টান, যা ঐ ব্যক্তির হুঁশ ফেরাতে সাহায্য করে। সদগুরু বিবেককে উসকে দেন যে “মত্ত হয়ে যেও না, তােমার আসল ঘরের সন্ধান করাে”। তবু যে ব্যক্তি চলার পথে একেবারে ঘুমিয়ে যায়_ তার জন্যই গুরুর এই হ্যাঁচকা টান।
এবার বলাে তােমরা কি হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে আসবে_ না সহজভাবে ? তোমরা সহজ পথে, সবকিছু দেখতে দেখতে, enjoy করতে করতে, সবকিছু বুঝে খোঁটার দিকে আসবে এটাই তোমাদের কাছে আমার প্রত্যাশা ! আমি চাই তোমরা সহজ পথে, সহজ ভাবেই এসো। জীবনযাপনে সদাচারী-বিবেকপরায়ণ হও। গুরুবাক্যে নিঃসংশয় হও। নিষ্ঠা সহকারে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করো—তাহলেই হবে। বাকীটুকু তাে দেওয়াই আছে ! এগুলি পালন করে দেখাে–দ্রুত তােমার জীবনের পট পরিবর্তন হবে_ ‘এই জনমে ঘটবে কত জন্ম-জন্মান্তর’ !
“বাঁচা এবং বাড়া”–সাধারণ জীবের উদ্দেশ্য হোলেও__ মানুষের ক্ষেত্রে তা এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না ! যে Security বা নিরাপত্তার তাগিদে জীব বিবর্তিত হয়ে চলেছে এবং চূড়ান্ত অবস্থা অর্থাৎ হােমাে স্যাপিয়েন বা মানুষশরীর লাভ করেছে—তা কি এই শরীর পেলেই সম্পূর্ণতা পায় ? না, তা পায় না ! মানুষ কোথায় Secured ? মজবুত বাড়ী, গেট, তালাচাবি, আইন-আদালত, প্রশাসন- পুলিশ, মিলিটারী কত কিই না সমাজে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র নিরাপত্তার তাগিদে। কিন্তু এসমস্ত থাকা সত্ত্বেও কি মানুষ নিরাপদ ? এছাড়া রয়েছে রােগ-ব্যাধি, তার হাত থেকে বাঁচার জন্য হসপিটাল, নার্সিংহােম, ডাক্তার, সার্জেন, অপারেশন থিয়েটার, ইন্টেনসিভ কেয়ার—আরও কত কি! মানুষ স্বাস্থ্য-পরিষেবা ভালােভাবে পাবার জন্য বেশি করে শহরমুখী হচ্ছে—তা সত্ত্বেও মৃত্যুকে জয় করা গিয়েছে কি ! মানুষের গড়-আয়ু পূর্বের থেকে বেড়েছে ঠিকই কিন্তু মৃত্যুকে জয় করা যায়নি।
দ্যাখাে, সমাজে যতপ্রকার ভয়ের কারণ রয়েছে সেগুলির কোনটিকেই নির্মূল করা যায়নি আর যাবেও কোনদিন। কারণ যে কোন System-রই দুটো Pole বা মেরু থাকে। একটাকে Strong করলে Automatically অপর মেরুও Strong হয়ে যায়। এইভাবেই সৃষ্টির ব্যালান্স (balance) রক্ষিত হয়। একমাত্র মহাপ্রকৃতির ইচ্ছাতেই কোন ব্যাপার বা কোন নিয়ম সম্পূর্ণভাবে Withdraw হতে পারে—সেটা অন্য Principle । কিন্তু সাধারণভাবে কোন System-কে আইন করে বা প্রশাসন দিয়ে সহজে নির্মূল করা যায় না। পুরাণে এই ব্যাপারগুলিকে রূপকাকারে দেবাসুরের সংগ্রাম হিসাবে বর্ণনা করা রয়েছে। পজিটিভ শক্তি বা দেবতা যতবার দানব বা নেগেটিভ শক্তিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে, আবার তারা মৃতসঞ্জীবনীর স্পর্শে নববলে বলীয়ান হয়েছে। রক্তবীজের কল্পনাও এই একই ঘটনার রূপক। তাই ভয়ের উৎসে যেতে হবে—সকল ভয়ের উৎস মৃত্যুভয়। সাধারণ জীব এই মহাভয় থেকেই নিরাপদ হতে চাইছে কিন্তু পারছে না। Insecurity তাকে তাড়া করে করে বেড়াচ্ছে। Material Science-এর উন্নতি শুধু ভােগবাদের জন্য একথা বলা ঠিক হবে না, আরও বেশী Secured হবার প্রচেষ্টায় এই উন্নতি। কিন্তু যত বাহ্যিক উন্নতি, তত ধ্বংসের দ্রুকুটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কেউ পরমাণু বােমার নাম শােনেনি কিন্তু আজ প্রতিটি শক্তিধর দেশের হাতে একাধিক পরমাণু বােমা, হাইড্রোজেন বােমা যা পৃথিবীকে ২০/২৫ বার ধ্বংস করে দিতে পারে। তাহলে সমাজ উন্নত হয়েও মৃত্যুভয় নিরাপত্তাহীনতা বেড়েই চলেছে। এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় গুরুপদে আশ্রয় করে মৃত্যুঞ্জয় হয়ে ওঠা। মৃত্যুকে জয় করেছে যে, সেই মৃত্যুঞ্জয়, সেই একমাত্র অভয়, সেই নিরাপদ বা Secured।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।