স্থান ~ পরমানন্দ মিশন, (বনগ্রাম) । সময় ~ ১৯৯২ খ্রীস্টাব্দ, জানুয়ারী । উপস্থিতি ~ আশ্রমস্থ ও বহিরাগত ভক্তগণ ৷
জিজ্ঞাসু :– ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মপত্রিকা (কোষ্ঠী) বিচারে দেখা যায় যে, তিনি একজন উন্নত মহাপুরুষ ছিলেন, তাহলে কোষ্ঠীবিচার কি বিজ্ঞানসম্মত ?
গুরুমহারাজ :– আচ্ছা, এই যে তুই ‘বিজ্ঞানসম্মত’ কথাটা বললি তুই–আগে বলতাে–বিজ্ঞান সম্বন্ধে তাের ধারণাটা কি ? বিজ্ঞানের সংজ্ঞাটাই আগে বল দেখি। —বিশেষ জ্ঞান বা বিশেষরূপে জানাটাই তাে বিজ্ঞান। আর এই বিশেষ জ্ঞান যাঁর রয়েছে বা যিনি বিশেষরূপে জানেন তিনি বিজ্ঞানী। কিন্তু এই ‘বিশেষ’-টি কি ! বেদ বলেছে ‘সঃ ব্রহ্ম নির্বিশেষঃ’ । সেই অর্থে আমরা বলি ‘আমিই তুমি’ বা ‘তুমিই আমি’ –এই বােধ যাঁর হয়েছে তিনিই বিজ্ঞানী—অর্থাৎ পূর্ণজ্ঞানী। বাকি যত কিছু জ্ঞান রয়েছে–তা হতে পারে বস্তুর জ্ঞান, বিষয়ের জ্ঞান, ব্যক্তির জ্ঞান, জাগতিক বিষয় সমূহের যে কোন জ্ঞান–এগুলি সবই আংশিক বা part ! আর যাঁর অদ্বৈতের বােধ হয়েছে, যিনি জেনেছেন ‘অহং ব্রহ্মাম্মি’, যিনি সবসময় অপরোক্ষ অনুভব করেন, যিনি জানেন_ জড় জগৎ-জীবজগৎ সবকিছুই তারই প্রকাশ—তিনিই বিজ্ঞানী।
সাধারণত তােমরা যারা Academic, তারা সবাই জানাে যে educational institution-সমূহে কয়েকটি মাত্র educational course-এর শাখাকে (২৫-৩০টি) “বিজ্ঞান” আখ্যা দিয়ে পড়াশুনা করানাে হয়—আর তােমরা বােধহয় ভাবাে—এই ক’টিই “বিজ্ঞান” বাকী যা কিছু আছে তা “অবিজ্ঞান” ! কিন্তু এটা ঠিক নয় যে ঐ ২৫-৩০টি শাখা আর তাদের কিছু উপশাখাই বিজ্ঞান ? এটা ভাবা মূর্খতা ! Physics, Chemistry, Zoology, Botany – ইত্যাদি ছাড়াও কত বিজ্ঞানের শাখা রয়েছে ! মনােবিজ্ঞান (Psychology), সমাজবিজ্ঞান (Sociology)_ এগুলি কি বিজ্ঞান নয় ? সমস্ত কিছু হিসাব করলে বিশ্বে কত বিজ্ঞানের শাখার সন্ধান পাওয়া যাবে তার কি ঠিক আছে ? আমি তো সবকিছুর মধ্যেই বিজ্ঞান দেখি ! এখানে(বনগ্রামে) আমার কাছে যারা আসে, তাদের মধ্যে যারা অল্পবয়স্ক এবং শিক্ষিত —তারা কোন আলোচনা শোনার পর বলে—“যে কথাগুলি বললেনসেগুলি কি বিজ্ঞানসম্মত” ? তার মানে সে জাহির করতে চায় যে, সে ‘বিজ্ঞান’ ব্যাপারটা জানে বা বােঝে । আমি কিন্তু বেশ বুঝতে পারি যে প্রকৃতপক্ষে তার ‘বিজ্ঞান’ সম্বন্ধে কোন ধারণাই তৈরি হয়নি।
দ্যাখাে, যে কোন বিজ্ঞানের তিনটি দিক আছে---Theory, Observation এবং Implementation, অর্থাৎ তত্ত্ব, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রয়ােগ। তুই যে জ্যোতিষবিদ্যা বা জ্যোতিষবিজ্ঞানের কথা উল্লেখ করলি _তারও তিনটি দিক রয়েছে। বহুপূর্বে এই বিদ্যাকে সামুদ্রিকবিদ্যা বলা হােত। Astronomy, Astrology—এগুলি মহাকাশবিজ্ঞানের নাম। এগুলির সাথে সামুদ্রিকবিদ্যার যােগাযােগ রয়েছে। বহু পূর্বে রাজারা এবং বড় ব্যবসায়ীরা যখন দেশে এবং বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সমুদ্রে জাহাজ ভাসাতাে—তখন মহাকাশ-বিদ্যার সাহায্য লাগতো ! যাত্রাপথের আবহাওয়া কেমন থাকবে–তা জানা খুবই জরুরি ! তাছাড়া জোয়ার-ভাটার অবস্থা, বায়ুমণ্ডলের গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি জানার জন্য সামুদ্রিক বিদ্যার প্রচলন ঘটেছিল।
যাইহােক, জ্যোতিষবিদ্যারও কিছু লিখিত সূত্রাদি রয়েছে, বিভিন্ন পন্ডিতেরা তাদের নিজ নিজ গবেষণা-সংক্রান্ত বই লিখে রেখে গেছেন—যার উপর নির্ভর করে বর্তমানে জন্যকুন্ডলী বা কোষ্ঠী প্রস্তুত করা হয় এবং হস্তরেখা বিচার করা হয় ! এই পুস্তকগুলির নির্যাস-ই জ্যোতিষবিজ্ঞানের theory ! এরপর Observation –অর্থাৎ ঠিক ঠিক Method-এ বিচারকে এগিয়ে নিয়ে চলা। আর বিচারে যে ফলটা উঠে আসছে—ব্যক্তির জীবনে সেগুলি বাস্তবে রূপায়িত হচ্ছে কিনা সেইটা দেখাটাই_জ্যোতিষের Inplementation !
যে কোন জড়বিজ্ঞান বা জীববিজ্ঞানেও এই তিনটি দিক রয়েছে এবং এই তিনভাবেই যে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণা সিদ্ধ হয়। সুতরাং ঠিক ঠিক ভাবে এই তিনটি পদ্ধতি জ্যোতিষবিজ্ঞানে কার্যকরী হলে—সঠিক Result পাওয়া সম্ভব। আর এই পদ্ধতি সঠিক কিনা জানার জন্য ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মপত্রিকা দেখতে হবে কেন–তাের নিজের ঠিক ঠিক জন্ম-সময় ধরে ঐ বিষয়ে কোন পণ্ডিত ব্যক্তিকে দিয়ে একটা জন্মপত্রিকা বা কোষ্ঠী বানিয়ে নে না! তারপর দ্যাখ্_ ঠিক ঠিক মিলছে কিনা! যদি সঠিক জন্মসময় ভুলভাল হয় তবে জন্মপত্রিকা বা কুন্ডলীর হিসাবও ভুল হয়ে যাবে। এইরকমই কোথাও হয়তাে দেখলি _তার জীবনের ঘটনাবলীর সঙ্গে কোষ্ঠীবিচার মিল হচ্ছে না—তাই বলে তুই সিদ্ধান্ত করতে পারবি না যে, পুরো ব্যাপারটাই ভুল। কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যদি theory ভুল থাকে বা বিজ্ঞানীর কর্ম-পদ্ধতির ভুল থাকে—তাহলে কি সঠিক Result পাওয়া যাবে ! –এখানেও সেরূপ হয়। সঠিক জন্মসময় দিয়ে লগ্ন, রাশি, নক্ষত্রের অবস্থান ঠিকমতাে করতে পারলে, আর ব্যক্তিটি যদি উপযুক্ত হন তবে বিচার একদম ঠিক ঠিক হতে পারে। [সেই সময় একজন বর্ধমান জেলার খাটুন্দী গ্রামের শিবকিঙ্কর শাস্ত্রী মহাশয়ের নাম উল্লেখ করলেন— যিনি তাঁর নিজের হাতে তৈরী কোষ্ঠীবিচার করে যে কারাের চাকরীর যােগ, বিবাহযােগ, এমনকি মৃত্যুযােগ অভ্রান্ত বলে দিতে পারতেন, এরূপ অনেক নিদর্শন দিলেন। গুরুমহারাজ তাঁর কথাগুলি শুনে আবার বলতে শুরু করলেন। ]
দ্যাখ্, যে কোন বিজ্ঞানের শাখার যেমন স্থূল দিক আছে, তেমনি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকও রয়েছে। কখনই ভাবিস না যে, শুধু কোষ্ঠী বিচারের দ্বারা বা হস্তরেখা বিচারের দ্বারাই মানুষের ভূত, ভবিষ্যৎ বলা যায়, অন্যভাবে বলা যায় না ! শুধু মুখমণ্ডল দেখে বা কপাল দেখেও মানুষের সম্বন্ধে অনেক কথা বলা যায়। ঐরূপ ব্যক্তি এমন এমন গােপনকথা বলে দেবে যা শুধুমাত্র তুই ছাড়া আর কারও পক্ষে জানা সম্ভবই নয়। আনন্দমূৰ্ত্তিজী বা প্রভাতরঞ্জন সরকার যখন কোন কর্মীর P.C(personal contact বা ব্যক্তিগত সংযোগ) নিতেন, তখন এই ধরণের অনেক গােপনকথা সরাসরি বলে দিতে পারতেন। কারণ ওনার তন্ত্র-সাধনার বেশ কিছু সিদ্ধি ছিল।
এবার আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা বলছি শােন। আমাদের এখানে আগে দুর্গাপুরের একজন ভক্ত আসতো —যে প্রথমজীবনে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল, ফলে ধর্ম-কর্ম, জ্যোতিষ, তন্ত্র-মন্ত্র এসব কিছুই মানতো না বা বিশ্বাস করতো না । কোনভাবে জেনে ওই ব্যক্তি এই আশ্রমে এসেছিল ! আমার সাথে পরিচয় হবার পর থেকে সে যাওয়া-আসা শুরু কোরলো এবং কিছুদিনের মধ্যেই ধর্মজগৎ সম্বন্ধে ওর অনমনীয় মনােভাবের পরিবর্তন হোল। আরো কিছুদিন পর ছেলেটি আমার কাছে দীক্ষা প্রার্থনা কোরলো এবং নির্দিষ্ট দিনে তার সম্পন্নও হয়ে গেল। কিন্তু দীক্ষা নেবার পরও ওর মন থেকে কিন্তু সংশয় যায়নি। একদিন দুর্গাপুর থেকে ওর একটা চিঠি পেলাম—তাতে লেখা ছিল যে, ঐ ব্যক্তি অমুক তারিখে আশ্রমে আসবে এবং ওর মােটর সাইকেলে আমাকে একজায়গায় নিয়ে যাবে—আবার ফিরিয়েও দিয়ে যাবে—এই ব্যাপারে আমি যেন কোন আপত্তি না করি।
ঠিক আছে ! কি আর করা যায় ! তমােভক্তির জোর খুব _তাই আমি রাজি হয়ে গেলাম ! ঘটনাটা কি ছিল—দুর্গাপুরের কাছেই কোন জায়গায় একজন নামকরা তান্ত্রিক থাকতো, সেই তান্ত্রিক কারুর চোখের দিকে তাকিয়েই অনেক কথা বলে দিতে পারতো। এইরকম একটা শক্তিশালী তান্ত্রিকের পরিচয় পেয়ে দুর্গাপুরের ঐ ভক্তটির ইচ্ছা হয়েছিল যে, ঐ তান্ত্রিককে দিয়ে আমাকে একবার Test করিয়ে নেবে যে_ ওর গুরু নির্বাচন সঠিক হয়েছে কিনা ! যাবার পথে ও আমাকে শিখিয়ে দিলো যে, তান্ত্রিক যা বলবে _আমি যেন তাই মেনে নিই এবং ও আমাকে তান্ত্রিকের কাছে ওর বন্ধু হিসাবে পরিচয় দেবে—তাও বলে দিল। আমি বললাম, “দ্যাখাে, আমি মিথ্যা বলতে পারবাে না, তার চেয়ে আমি চুপচাপ থাকবাে—তুমি যা বলার বলবে। যা Experiment করার করবে—আমি কিছুই বলবো না।”
তান্ত্রিকের আশ্রমে পৌঁছে যথারীতি ও আমাকে ‘বন্ধু’ হিসাবে পরিচয় দিলো—আমার অন্য বেশ থাকার জন্য(গুরু মহারাজ গেরুয়া কাপড় ঢেকে গেছিলেন) সন্দেহ হবারও কথা ছিল না ! তান্ত্রিক আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমার রাশি ও লগ্ন জিজ্ঞাসা কোরলো। আমি বললাম_ কুম্ভ রাশি, সিংহ লগ্ন, শতভিষা নক্ষত্র। তান্ত্রিক চোখ বুজে কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর আমার সঙ্গের ব্যক্তিটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল—“অসম্ভব ! উনি তােমার বন্ধু হতে পারেন না। ইনি হয় তােমার গুরু কিংবা গুরুস্থানীয় কেউ হবেন। তােমার মত লােকের সাথে এনার বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকতেই পারে না।” এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনার মধ্যে তাে আশ্চর্য রকমের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি ! এরকম ধরণের কোন ব্যক্তির সাথে আমার কখনাে দেখা হয়নি।” আমি তখন ওনাকে বললাম—“আপনি ঠিকই বলেছেন, আমি ওর গুরু। ওর অনুরােধেই আমি এখানে এসেছি। এবার যদি আপনি অনুমতি করেন_ তাহলে আমরা বিদায় নিই !” উনি সম্মতি জানালে আমরা ফিরে এলাম।
এই ঘটনাটা সত্যিই আমার জীবনে ঘটেছিল _ এটা আশ্রমের অনেকেই জানে এবং দুর্গাপুরের ঐ ব্যক্তিটিও এখনাে জীবিত রয়েছে বলেই এই ঘটনার উল্লেখ করলাম। ঘটনাটা উল্লেখ করলাম এইজন্য যে, আমি বলতে চাইলামঐ ধরণের ব্যক্তিরাও জগতে রয়েছে, যারা জ্যোতিষবিদ্যাটি ভালােমতােই রপ্ত করেছে ! জানো আমার যা রাশি-নক্ষত্র, তাতে জ্যোতিষবিজ্ঞান অনুযায়ী_ ‘আমি যে কোন পরিবেশেই জন্মগ্রহণ করি —বা যে কোন Fields of work-এই থাকি না কেন—আমি ধর্ম-আশ্রিত হবাে এবং সেই field-এ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবাে’। যদি আমি সমাজে থাকতাম তাহলে আমি ‘রাজা’ হতাম এবং পৌরাণিক রাজা জনকের ন্যায় “রাজর্ষি” হয়ে উঠতাম। কিন্তু আমি এখন সন্ন্যাস আশ্রমে রয়েছি “বহুজন হিতায়” কাজ করে চলেছি। কারণ আমি জেনেছি যে, একমাত্র অধ্যাত্মজ্ঞানে উন্নীত করতে পারলেই মানুষের যথার্থ হিত বা মঙ্গলসাধন করা সম্ভব হয়—আর যখন থেকে একথা জেনেছি তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই কাজই করে চলেছি।
।।ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।