স্থান ~ আজিমগঞ্জ কনসাস স্পিরিচুয়াল সেন্টার । সময় ~ ১৯৯০-৯১ (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) ৷ উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ পঙ্কজবাবু, সেনগুপ্তবাবু, মানিক ব্রহ্ম, দিল্লীর ডঃ সুধীর ও অন্যান্যরা ৷
জিজ্ঞাসু :– ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জীবদ্দশায় কলকাতার এলিট সমাজ যদি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে গ্রহণ করতে পারতাে—তাহলে পরবর্তীকালে নরেনাদি ব্রহ্মচারীদেরও অতটা কষ্ট হােত না ?
গুরুমহারাজ :— হ্যাঁ, ঠিক ! বলােতাে–ছেলেগুলির কি কষ্টটাই না সইতে হোল ? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে চলে আসা সংসারত্যাগী ব্রহ্মচারীগুলির বেশীর ভাগই ছিল বড় ঘরের ছেলে—লাটু ছাড়া খুব একটা গরীবঘরের ছেলে প্রায় কেউই ছিল না। কিন্তু কাশীপুরে Shift হয়ে চলে আসার পর বিশেষত ঠাকুরের শরীর ছাড়ার পর বেচারাদের কি রকম কষ্টটাই না পােহাতে হ’ল ! ভিক্ষা করেও দু’বেলা পেট ভরে খাবার মতাে অন্ন জোটাতে পারতাে না। দিনান্তে মানকচুর পাতায় খুদঘাঁটা নুন দিয়ে খেতো আর রাত জেগে সারারাত ধ্যান-জপ করতাে! কি সুতীব্র বৈরাগ্য তখন ওঁদের ! এই না হলে ওঁরা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য! সেই সময় ঐরূপ young ছেলে একসাথে থাকে, কোন কাজ করে না অথচ বাড়ী বাড়ী ভিক্ষা করতে যায়—এই ব্যাপারটাই তৎকালীন স্থানীয় মানুষ ভালােভাবে নেয়নি। অনেক পরে তখনকার স্থানীয়রা যারা সেই সময় যুবক বা যুবতী ছিল _তারা যখন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা হয়েছে, বেলুড়মঠ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, স্বামীজীর জগৎজোড়া নাম হয়েছে,স্বামীজীর শরীর চলে গেছে,মঠের সাধুরাও বৃদ্ধ হয়েছে—তখন ঐ ব্যক্তিগণ অনেকে লেখার মাধ্যমে, বক্তব্যের মাধ্যমে ঠাকুরের ব্রহ্মচারী ভক্তদেরকে ভিক্ষা দেয়নি বলে আপশােষ করেছে !
তবে মজার কথা কি জানাে—পরবর্তীতে যখন বেলুড়মঠ প্রতিষ্ঠা হােল, স্বামীজীর বিশাল নাম-ডাক হোল, তখন থেকে কিন্তু কলকাতার বাবুসমাজ বেলুড়ে আসা-যাওয়া শুরু করেছিল—কারণ নিজের নামটা একটা বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়াতে পারলে প্রতিপত্তি বাড়ে_শুধুমাত্র এই জন্য ! যাইহােক, ওরা তখন মঠে এসে বলতাে—নরেন্দ্রনাথ তাে আমাদের Society-র ছেলে, তাই অমনটি হয়েছে—এত নাম করেছে ! এইসব কথা বলে ওরা যেন বেশ খানিকটা গর্ব অনুভব করতাে। কিন্তু স্বামীজীর কড়া নির্দেশ ছিল বেলুড়মঠ সবার জন্য—শুধু বাবুসমাজ প্রাধান্য পাবে এমন যেন না হয় ! নটী বিনােদিনী আসতো ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তবে নারীবেশে আটকানাে হােত বলে অনেক সময় পুরুষের ছদ্মবেশে ঢুকে পড়তো ঠাকুরের ঘরে ! এই নিয়ে ঠাকুর অনেক মজাও করতেন !
সে যাইহােক পরবর্তীকালে বেলুড়মঠ প্রতিষ্ঠিত হবার পর বিনােদিনীর সাথে এবং আলাদাভাবেও অনেক এই ধরণের নারীরা মঠে আসতো। ঠাকুরের জন্মােৎসবের সময় পতিতাপল্লীর মেয়েরাও আসতো। ঐ যে মথুরবাবু একবার ঠাকুরকে পরীক্ষা করার ছলে এক পতিতালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই সময় যারা ওখানে ছিল তারা ঠাকুরকে ‘বাবা’ বােলতাে। তাই তারাও নিজেদের অন্তরের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে মঠে আসতাে। এদের আসা-যাওয়ায় বাবু সমাজের ‘prestige puncture’ হবার জোগাড় ! এই সমস্ত মহিলারা এলে বাবুসমাজের বাড়ীর মহিলারা সেখানে আসে কি করে! বন্ধ করে দেওয়া হােল অভিজাত ঘরের মহিলাদের যাতায়াত। অভিযােগ পৌঁছাল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) ও শশী মহারাজের (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) কাছে__ মঠে পতিতাদের এবং ছােট জাতের লােকের আসা-যাওয়া বন্ধ করতে হবে ! রাখাল মহারাজ নরম মনের মানুষ—সে আর কি করে , বাবুসমাজের দাবী মেনে নিয়ে ঠিক হােল উৎসব হবে দু’দিনে। প্রথমদিন বাবুসমাজের নারী-পুরুষেরা আসবে, আর দ্বিতীয়দিন আপামর জনগণ—সেদিন সবার প্রবেশাধিকার ! ভাবাে একবার—সমাজের কি দারুণ চাপ ছিল তখন! গিরীশ ঘােষ সেইসময় এই সিদ্ধান্তের প্রবল বিরােধিতা করেছিল–কিন্তু টেকেনি।
স্বামী বিবেকানন্দ তখন বিদেশে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ হলেও নরেন্দ্রনাথকে না জানিয়ে কোন কাজ করার সাহস বা ইচ্ছা ওদের কারাে ছিল না, তাই পত্র মারফৎ জানানাে হ’ল নরেন্দ্রনাথকে। নরেন্দ্রনাথ কোন উত্তর দিল না। আবার একটা চিঠি অর্থাৎ দ্বিতীয় চিঠি পাঠানাে হ’ল মঠের তরফ থেকে—ঐ ধরণের দু’দিনের উৎসবের কথা জানিয়ে। সে চিঠিরও উত্তর এল না। দেওয়া হােল তৃতীয় চিঠি। সেই চিঠির যে উত্তর এল তা যুগবিবর্তনের দলিল! সেই চিঠির সারমর্ম এই যে–মঠকর্তৃপক্ষ (রাখাল মহারাজ ও অন্যান্য শিষ্যরা) ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে যেমন বুঝেছে তারা যেন তাদের সেই “বােঝা” নিয়ে চলে, আর নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যা বুঝেছে সেইটা হৃদয়ে নিয়ে তিনি একাই চলবেন। বেলুড়মঠ যেন আর নরেন্দ্রনাথকে তাদের সাথে থাকার আশা না করে। “ঠাকুর কি ছিলেন তা তিনি একাই মানুষকে বােঝাবেন—এরজন্য তাঁর কোন মঠ বা মঠের কর্মপদ্ধতির প্রয়ােজন নেই। তিনি লিখেছিলেন “তােরা এতদিন ঠাকুরের সাথে থাকলি, সঙ্গ করলি আর বুঝলি না—তিনি কাদের জন্য এসেছিলেন ? ভদ্রলােকদের চেয়ে ‘তােদের বলা ঐ ছােটলােকেরা’_ লাখগুণে ভালাে ! মঠে ভদ্রলােকের দল যত না আসে—ততই মঙ্গল, আর তােরা কিনা তাদের সুবিধা দেবার জন্য ঠাকুরের জন্মােৎসব দু’দিনে পালন করবি ?”
এই চিঠি পেয়েই তাে মঠে মহা শােরগােল পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মত বদলিয়ে উৎসব একদিনেই করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হােল। এইসব দেখে গিরীশ মহাখুশী, বলল-“এই না হলে নরেন ! এইজন্যই ঠাকুর নরেনের জন্য এত ব্যাকুল হােত। ঐ ঠাকুরকে ঠিক ঠিক চিনেছে!”
জিজ্ঞাসু :— দেখুন, বর্তমান সমাজে বিশেষত এই পশ্চিমবঙ্গে “ছােটলােক’’ sentiment-টা আর নেই বললেই চলে। এটা কি বর্তমান রাজনৈতিক দলের বা এই দলের যে স্রষ্টা—তার অবদান ?
গুরুমহারাজ :— না-না। কোন ব্যক্তির বা রাজনৈতিক দলের অবদানে মহাপ্রাকৃতিক নিয়মের অদল-বদল হয় না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই বিরাট সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় বৈচিত্র্যে একটি ক্ষুদ্র ব্যক্তি বা কোন সংঘ অথবা দলের কি ভূমিকাই বা থাকতে পারেবাবা ! অবতার পুরষদের কথা আলাদা—তারা মহা-বিশ্বপ্রকৃতির নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে সেগুলির disharmony-কে ঠিক করে দিতে শরীর ধারণ করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ প্রকৃতির অধীন, নিজের অন্তঃপ্রকৃতিকেই বশ করতে পারেনি, কি করে বিশ্বপ্রকৃতি বা মহাবিশ্ব-প্রকৃতির নিয়মকে অদল-বদল ঘটাবে ? দ্যাখাে, মহাকালের নিয়মে বা মহাপ্রাকৃতিক নিয়মে যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে সবকিছুরই পরিবর্তন হয়। এখানে কোন ব্যক্তি বা organisation উপলক্ষ মাত্র। খেয়াল করে দেখবেএখানে কোন সামাজিক পরিবর্তন যখন ঘটে, সেই সাথে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তেও একই ধরণের পরিবর্তন ঘটে থাকে ! সুতরাং কোথাও কোন পরিবর্তন কোন বিশেষ ব্যক্তি বা দলের দ্বারা ঘটেছে এটা ঠিক নয়। পরিবর্তনটা হােতই শুধু কোন ব্যক্তি বা organisation-এর কিছু ভূমিকা ছিল মাত্র। তবে জানবে কোন স্থানে নানান সামাজিক-ব্যাধি মুক্ত (জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, বর্ণবৈষম্য) হচ্ছে সমাজ মানেই সেই সমাজের প্রতি ঈশ্বরের কৃপা রয়েছে ! কোন মহাপুরুষের শুদ্ধ সঙ্কল্প কাজ করছে বলেই এটি সংঘটিত হচ্ছে। এই যে কথাটা বললামএটি বুঝতে গেলে বিবেকযুক্ত বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে হবে—স্বচ্ছ দৃষ্টি ছাড়া এসব কথার মর্মার্থ বােঝা যায় না। সেইজন্য আমি তােমাদের বলছি তােমরা নিজেদের জীবনের পরিবর্তন নিয়ে ভাবাে–সেইটাকে নিয়ে সময় ব্যয় করাে_কোথাও হয়তো massive কোন পরিবর্তন ঘটছে সেখানে মাথা ঘামাতে গিয়ে কোন ইয়ত্তা করতে পারবে না, ওটা ঈশ্বরের ইচ্ছায় হচ্ছে। এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের নিরিখে একটি ব্যক্তি তাে বিন্দুও নয়—তাহলে সে কি করে মহাজাগতিক বা মহাপ্রকৃতির নিয়মের নিয়ন্তা হতে পারে ?
তবে এখুনি যেটা বলছিলামকোথাও যদি এমন কোন বিরাট কাজ কোন ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে, তাহলে জানবে তা মহামায়ার ইচ্ছায় হয়েছে আর ঐ ব্যক্তি ✓রী মায়ের নির্ধারিত ব্যক্তি ! ইউরােপের নবজাগরণের সময় মহামায়ার ইচ্ছায় একঝাঁক great-man সেখানে শরীর গ্রহণ করেছিল। কই পরে তাে আর ঐরকমটা হোল না ! রাশিয়ায় আর একটা লেলিন তাে পরবর্তীতে জন্মালাে না ? একটা নাম উদাহরণ হিসাবে বললাম—এইরকম সবদেশেই বা সব সমাজেই দু-চার জন great-man-এর নাম বলা যায়–যার মতন আর একজন কিন্তু সেই সমাজে পরে আর জন্মায়নি। দেখা যায় হঠাৎ হঠাৎ কোন কোন স্থানে মহাপ্রকৃতির ইচ্ছায় এই ধরণের একজন বা একঝাঁক ব্যক্তি শরীর গ্রহণ কোরে _সেই সমাজের জন্য কিছু হিতকর কাজ করে চলে যান। কোন Institution দিয়ে বা কোন Constitution দিয়ে এই ধরণের মানুষ তৈরী করা যায় না। একটু বিবেকচালিত বুদ্ধি দিয়ে শুদ্ধভাবে চিন্তা করলেই ধরতে পারবে যে মহামায়ার ইচ্ছা ব্যতিরেকে এই ধরণের ঘটনা ঘটা অসম্ভব ! ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে যে ভাবে শিল্পে, সাহিত্যে, রাজনীতিতে, সমাজ জাগরণের ক্ষেত্রে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রতিভাবান—মহান মানুষদের দেখা গেল ,পরবর্তীকালে ঐ ধরণের দু’চারজনকেও তাে দেখা গেল না! তােমাদের মনে এগুলাে সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা সৃষ্টি হয় না ? মায়ের জগৎ—মা জানেন তাঁর এই লীলাজগতে কখন, কোথায়, কিসের প্রয়ােজন। কাল প্রসন্ন হোলেই সেখানে উপযুক্ত ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটবে আর সেই স্থানের সামাজিক পরিবর্তন ঘটে যাবে, হয় মহামায়ার ইচ্ছায় নির্ধারিত ব্যক্তির দ্বারা অথবা কোন শক্তিশালী মানুষের দ্বারা এটা হয়।
সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে দেখে কোন ব্যক্তির ভূমিকা বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে মায়ের জগতের লীলা মা মহামায়াই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তাই তুমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না। অন্তর্মুখী হয়ে নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতির চেষ্টা করাে। জাগতিক রহস্যগুলি তােমার কাছে আপনা আপনিই খুলে যাবে। যা ঘটে গেছে সেই রহস্য তাে অবগত হবেই– আগামীতে কি ঘটতে চলেছে তাও তুমি জানতে পারবে। আর অন্তর্মুখী হয়ে আত্মশক্তি জাগ্রত করলে—তখন তােমার দ্বারাই নানাবিধ জগৎ-কল্যাণ ঘটতে থাকবে। তুমিও মহামায়ার লীলার একজন অংশীদার হতে পারবে।