স্থান ~ শ্রীরামপুর, অসীম ব্যানার্জীর বাড়ি । সময় ~ ০৫/০১/১৯৯০ উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ সব্যসাচী মান্না, প্রশান্ত ভট্টাচার্য, কানাই মুখার্জি, দুর্গাচরণ মুখার্জি, লিম্, একনাথ ইত্যাদি ।

গুরুমহারাজ নিচের ঘরে সিটিং-এর জায়গায় গিয়ে বসলেন। একটু প্রণাম, কুশল বিনিময় এসব চলতে চলতেই তৃষাণ মহারাজ (বর্তমান স্বামী পরমেশ্বরানন্দ) ন’কাকাকে (শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে, গুরু মহারাজকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” এই দ্যাখো, ন’কাকা এসে পড়েছে !” গুরুমহারাজ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন যে, ন’কাকা দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে। সাথে সাথে গুরুমহারাজ মজা করে, আনন্দ করে বলে উঠলেন, ” আরে খুড়োমশাই ! তুমি ওখানে কেন ? এখানে এসো। এখানে এসে বসো। আজকের সিটিং-টা তুমিই চালিয়ে দাও ! আজ আমি শ্রোতা হই–তুমি বক্তা হও।” ন’কাকা হাত জোড় করে হাসতে লাগলেন। তৃষাণ মহারাজ ততক্ষণে আর একটা আসন জোগাড় করে নিয়ে এসে গুরুমহারাজের পাশে জায়গা করে দিলেন এবং ন’কাকা সেখানে বসলেন। এইবার গুরুমহারাজ ন’কাকাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” এইভাবে নিজেকে ঢেকে রেখে আমাকে দিয়ে আর কত কাজ করাবে খুড়োমশাই ! এবার মাঝে মাঝে সামনে এসো !”– এসব হাসি মজার মধ্যেই অসীমের ছোটমামা জিজ্ঞাসা করে বসলো –

জিজ্ঞাসু :– “কর্মণ্যকর্ম যঃ পশ্যেদকর্মণি চ কর্ম যঃ ৷

                স বুদ্ধিমান্‌ মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্মকর্মকৃৎ ।৷" – এটি গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের অষ্টাদশতম শ্লোক। বারবার এই শ্লোকটা পড়ি। বঙ্গার্থও পড়ি কিন্তু মানেটা ঠিকমতো আজও বুঝতে পারলাম না। যদি আপনি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলেন ?

গুরুমহারাজ :— এই রে! এইজন্যই খুড়ােকে এখানে বসতে বলেছিলাম। পণ্ডিত ব্যক্তিদের আমি প্রচণ্ড ভয় পাই। (সবাই হেসে উঠল)। হ্যাঁ, সত্যি! পণ্ডিত দেখলেই আমার ভয় হয়–এই বুঝি কথার ভুল ধরলো, ব্যাকরণের ভুল ধরলো ! তারপর আমার তাে লেখাপড়া জানা বিদ্যা নেই–খুড়ােমশাই আগেকার B. A. পাশআর আমার প্রাইমারী পর্যন্ত বিদ্যা, শাস্ত্রও পড়া নেই ! দুম্ করে সংস্কৃতে কোন শাস্ত্র থেকে কি উদ্ধৃতি তুলে ধরবে হয়তাে তার মানেই আমি করতে পারবো না বা বুঝতেই পারবো না__ এইসব নানা কারণে পণ্ডিতদের দেখলেই আমার ভয় লাগে! এই সভাতেও অনেক পণ্ডিতেরা এসেছেন, আমার ভয় হচ্ছে–কি জানি কখন কি ভুলভাল বলে ফেলি !

জিজ্ঞাসু (ঐ ব্যক্তি) :– না-না ভুল বলবেন কেন ? আপনি বলুন দয়া করে ! আপনার কথা অনেকের মুখে শুনেছি—আপনি সবই জানেন, সর্বজ্ঞ ! এই “কর্মে অকর্ম”–ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলুন ?

গুরুমহারাজা :– এই দ্যাখাে ! আবার এসব কি বলতে শুরু করলো। না-না আমি বিজ্ঞ-সর্বজ্ঞ — ওসব নই, তবে গীতার এই শ্লোকটার মর্মার্থ আমি যা জানি তা আপনাকে বলছি শুনুন। গীতার ৪র্থ অধ্যায়ে শ্লোকটি আছে অর্থাৎ যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জ্ঞানযােগ বলছেন। দেখুন, এই শ্লোকের মর্মার্থ বুঝতে গেলে আগে ‘অকর্ম’ কি তা ভালােভাবে বুঝতে হবে। ‘অকর্ম’ মানে inactive নয় passive হয়ে কর্ম করা অর্থাৎ যে কর্ম আসক্তিহীন হয়ে করা হয়। সাধারণভাবে মানুষ তাে কোন কর্ম করার আগে থেকেই ফলের কথা চিন্তা করে বসে—তাই অকর্মের ব্যাপারটা ঠিক ঠিক বুঝতে পারে না। এই শ্লোকে বুদ্ধিমান মানুষ বলতে জ্ঞানীদের কথা বলা হয়েছে। জ্ঞানীরাই অকর্ম করতে পারেন—অর্থাৎ যিনি কর্ম করে যাচ্ছেন কিন্তু কর্মে কোন আসক্তি নেই। তবে অনাসক্ত হয়ে যে কর্ম করা হচ্ছে তারও একটা ফল রয়েছে, সেই কর্মের সুফল কিন্তু ঐ ব্যক্তি অর্থাৎ কেউ একা ভােগ করছে না_ সমাজের অনেকে বা অনেক ক্ষেত্রে সমগ্র মানব সমাজ ভােগ করছে ! সেইজন্য এটা শুধু work নয়, dynamic work ! এখানে উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যেমন স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সমগ্র জীবনে যে কাজগুলি করে গেলেন–নিজের জন্য কিছু করলেন কি ? তাঁর মা, ভাইয়েরা, বােনেরা কত কষ্ট করেছে–তাও উনি নিজের কর্তব্যকর্মে অবিচল ছিলেন। কোনদিন কি তিনি ফলের আশা নিয়ে কর্ম করেছেন—করেননি ! তার মাত্র ঐ কয়েক বৎসরের কর্মের ফল পেল ভারতবর্ষ, পেল সমগ্র বিশ্ব ! শুধু রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা দিয়ে যদি কেউ স্বামীজীর কর্মকে বিচার করে, তাহলে তা হবে মুর্খতা ! এই ধরণের মহামানবদের কাজের সীমা দেশ-কাল-পাত্রের গণ্ডী ছাড়িয়ে সমগ্র দিকচক্রবালকে পরিব্যাপ্ত করে ফেলে ! তারমধ্যে যারা থাকেন বা বাস করেন—সকলেই এই ধরণের মহামানবদের দ্বারা কৃতকর্মের সুফল লাভ করে, কোন না কোন ভাবে উপকৃত হয়। আর এই প্রবাহ চলতে থাকে বহুদিন-বহুকাল। উনি যেটা কয়েক বছরে করে গেলেন সেটা কোন মানুষের করতে হয়তাে ১০০ জন্ম লেগে যাবে। আপনাকে কি ব্যাপারটা বােঝাতে পারলাম ?

আচ্ছা আমি আরও সহজ করে বলার চেষ্টা করছি_ যে কোন মানুষ যখন, ‘আমি’-‘আমার’ –এই বােধ নিয়ে কাজ করে তখন জানবেন সেই কর্ম অজ্ঞানতাপ্রসূত কর্ম, ঐ ব্যক্তি অজ্ঞানী ! অনিত্যকে নিয়ে থাকতেই সে মজা পাচ্ছে, ওতেই মজে আছে। আবার যখন কেউ কোন কর্ম ‘তুমি’, ‘তােমার’ –এই বােধ নিয়ে করছে অর্থাৎ ব্যক্তি অহং-এর ভূমিকা নগণ্য জ্ঞান করে সবকিছুই ‘ঈশ্বরের ইচ্ছায় হচ্ছে’ এই বােধে কাজ করে সেটাই জ্ঞানকর্ম ! আর যিনি এইভাব বজায় রেখে কর্ম করেন তিনিই ‘জ্ঞানী’। আবার যখন ‘আমিই তুমি’, ‘তুমিই আমি’ —এই বােধে বা এই স্থিতিতে কেউ থাকেন_ তিনি বিজ্ঞানী। এই অবস্থায় তিনি কোন স্থূল কাজ করুন বা নাই করুন __সতত তিনি dynamic। তার স্থূল কর্ম না থাকলেও তিনি মনােজগতে এমন dynamic কাজ করে চলেছেন, দেখা যাবে যে জগতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন উপযুক্ত মানুষের চিন্তাজগতে হয়তাে বিরাট বিরাট পরিবর্তন এসে গেল এবং সমাজ তাদের দ্বারা উপকৃত হােল ! এগুলাে সূক্ষ্ম রহস্য—সবার পক্ষে ধরা মুস্কিল ! এই ধরণের কোন কোন মহাত্মারা সমাজ থেকে অনেক দূরে থাকেন, হয়তাে কোন গিরি-গুহা বা অরণ্যে রয়েছেন, তবুও তাঁর দ্বারা মানবকল্যাণ হচ্ছে বা জগৎকল্যাণ হয়ে চলেছে– এই কথাগুলো কিন্তু ‘একশ ভাগ সত্য’– জেনে রাখবেন।

কারণ তিনি স্থূলে কোন কাজ না করলেও মানবের মনােজগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছেন, এইভাবেই আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ক্রিয় মনে হলেও তাঁর বা তাঁদের দ্বারা dynamic কর্ম হয়ে চলেছে।

এইবার এই ধরণের ব্যক্তির যে কাজ_ তার ফল কি ঐ ব্যক্তিকে ভােগ করতে হবে ? না তা হবে না ! কারণ ঐ ব্যক্তির তাে নিজের জন্য কোন কর্মই নেই ! নিজের জন্য অর্থাৎ আত্মসুখের জন্য কোন কর্ম তাঁর দ্বারা হয়নি। তিনি যা করছেন তা তাে মানুষের বা সমাজের কল্যাণের নিমিত্ত এবং যেহেতু সমাজ থেকে দূরে থেকে এই কাজ করছেন–তাই মানুষ এঁদের কথা জানতেই পারছে না। ফলে তাঁদের যে একটু প্রশংসা করবে বা স্তুতি করবে– সেটাও করতে পারছেন না। তাহলে তাঁদের কিসের কর্মবন্ধন বলুন ! নিরাসক্ত হয়ে কাজ করলে কর্মবন্ধন হয় না। আবার যে সব মহাপুরুষ সমাজে থেকে এই ধরণের কাজ বা অনাসক্ত থেকে কর্ম করেন তাঁরা আরও শক্তিশালী ! স্বামী বিবেকানন্দের মতাে যাঁরা মানুষের সমাজে এসে, মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থেকে তাদের উন্নতির জন্য কাজ করেছেন তাঁরা তাে নমস্যদেরও নমস্য। ভগবান বুদ্ধ, যীশু এঁরা সকলে এইজন্যই সর্বকালে সর্বজনের নমস্য। এঁরা সবাই মানুষের মাঝে গিয়ে মানুষের জন্য কাজ করেছেন। মানুষ তাঁদের অত্যাচার করেছে, অবহেলা-অবজ্ঞা করেছে __তাও তাঁরা মানুষের ভালাের কথাই ভেবেছেন, মানুষের ভালাে আমৃত্যু চেয়ে গেছেন।

যাইহোক, আমি তো অনেক কথাই বললাম_আপনি কি ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন ?

জিজ্ঞাসু :– হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব ভালােভাবে বুঝতে পেরেছি! সত্যিই দীর্ঘদিন ধরে আমার মনে জমে থাকা জিজ্ঞাসার উত্তর পেয়ে নিজেকে খুবই হালকা লাগছে। কিন্তু দয়া করে যদি আর একটা ব্যাপারে আলােকপাত করেন তাহলে খুবই কৃতার্থ হই ?

গুরুমহারাজ :– হ্যাঁ, বলুন ! কি আপনার জিজ্ঞাসা ?

জিজ্ঞাসু :— “প্রারব্ধ কর্ম” সম্বন্ধে যদি একটু বলেন। এটি কিভাবেই বা আসে আর কি করলেই বা প্রারব্ধ কাটে ?

গুরমহারাজ :– আপনি বােধহয়, নিয়মিত গীতাপাঠ করেন—তাই আপনার বেশীর ভাগ জিজ্ঞাসাই গীতার অংশ থেকে আসছে। প্রারব্ধ কর্ম মানে প্রা-লব্ধ ! যা আপনি পূর্ব থেকেই লাভ করেছেন। গীতায় সঞ্চিত কর্ম, প্রারব্ধ কর্ম, ক্রিয়মাণ কর্ম_ এই তিন প্রকার কর্মের কথা বলা হয়েছে। প্রতিটি মানুষের জীবনেই কর্ম রয়েছে, জন্ম-জন্মান্তর ধরে মানুষের এই যে কর্মপ্রবাহ, তার ফলগুলিই সঞ্চিত কর্ম হিসাবে জমা থাকছে। সেই সঞ্চিত কর্মের মধ্যে যেগুলি মেটানাের বাসনা প্রবল সেইগুলি মেটানাের জন্যেই মানব আবার নতুন শরীর প্রাপ্ত হয়। জাতকের পিতা-মাতা, পরিবেশ, জন্ম এগুলি সবই প্রারব্ধবশর্ত হয়। এছাড়াও ঐ জাতকের জীবনে ঘটা বিভিন্ন ভােগ-ভােগান্তি সবকিছুই প্রারব্ধ কর্মবশতই হয়।

আর এই যে জীবন আপনি পেয়েছেন, এই জীবনে ঘটে যাওয়া কর্মসমূহ‌ই হোল ক্রিয়মাণ কর্ম। এই কর্মের ফলগুলি জমে আবার ঐ সঞ্চিত কর্মের ভাণ্ডার বাড়াবে অথবা নিস্কাম কর্মের দ্বারা ভান্ডার কমাবে। ‘কমাবে’ বললাম এইজন্য যে, নিষ্কাম কর্মের দ্বারা কর্মক্ষয় হয়। যদি কোন ব্যক্তি নিষ্কাম কর্ম করে যান তাহলে তার সঞ্চিত কর্মের ভাণ্ডার কমতে থাকে । আর এই মান কমতে কমতে Zero হয়ে গেলেই _ব্যক্তির সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায় ! এটাই তথাকথিত মুক্তি অর্থাৎ মহামায়ার জগৎ থেকে বেরিয়ে এবার যােগমায়ার রাজত্বে প্রবেশ করা।