স্থান:—বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন। সময়:–১৯৯১সাল।

উপস্থিত ব্যক্তিগণ:– সিঙ্গুরের ভক্তগণ, পঙ্কজবাবু,রমেশবাবু,স্বরূপানন্দ এবং অন্যান্যরা।।

     জিজ্ঞাসু:----- নেহেরু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন চীনারা ভারত বর্ষ আক্রমণ কোরলো এবং ভারতবর্ষের বেশ কিছুটা জায়গা দখল করে নিল কিন্তু ভারতীয় সৈন্যরা কিছুই করতে পারলো না ! এটা কি নেহেরুর দুর্বলতা ছিল?

   গুরু মহারাজ:----দূর পাগল ! নেহেরু তো ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপ্রধান হবার যোগ্য লোক‌ই ছিল না ! নেহেরুর অদূরদর্শিতার জন্যই তো এমনটা হয়েছিল__নাহলে অকারণে চীনারা ভারতের সঙ্গে ঝামেলা করতে যাবে কেন ? এর পিছনে একটা বিরাট কারণ ছিল যেটা অনেকেই জানে না ! তাই মনে করে, চীনারা বোধহয় জোর করে ভারত আক্রমণ করেছিল ! অকারণে চীনারা কোনোদিন ভারত আক্রমণ করবে না _এটা বলাই যায় ! কারণ চীনের সঙ্গে ভারতের বহুকাল থেকে একটা সম্পর্ক রয়েছে এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও অনেক মিল রয়েছে ! অবশ্য বর্তমানে চীনের কমিউনিস্ট সরকার ওখানকার পুরোনো সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে ফেলছে, ফলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে তাদের প্রাচীনকালের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বা মিলের ব্যাপারটা বজায় নাও থাকতে পারে ! কিন্তু যখনকার কথা তুমি বলছো, তখন যে কারণে চিনারা ভারতবর্ষের মধ্যে ঢুকেছিল বা ভারত অধিকৃত কিছুটা জায়গা দখল করে নিয়েছিল __তার কারণটা বলছি শোনো !

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বা বলা যায় ভারতের স্বাধীনতা লাভ (১৯৪৭)-এর পর নেহেরু এবং চার্চিলের মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছিল যে, হিমালয়ের উপরে একটা আমেরিকান ঘাঁটি করার অনুমতি ভারতকে দিতে হবে ! তৎকালীন চীনা প্রধানমন্ত্রী ছিল চৌ এন লাই ! গোপন সূত্রে তিনি এই খবরটা জানতে পারেন এবং খবর পাওয়ার পরে তৎক্ষণাৎ সৈন্য অভিযান করে তিব্বত অধিগ্রহণ করে নেয় এবং তিব্বতকে কেন্দ্র করে ভারতীয় সীমান্তে নিজেদের সৈন্য ঢুকিয়ে ওই অঞ্চলে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে চার্চিলের প্ল্যানটা ভেস্তে দিয়েছিল। চীনারা যদি তিব্বতে ঘাঁটি না গাড়তো, তাহলে আমেরিকার ঘাঁটি হোত হিমালয়ের চূড়ায় এবং সেটা শুধু ভারতবর্ষের জন্যই নয়, গোটা বিশ্বের জন্য খুবই ক্ষতিকর হোত ! কারণ ওরা যে নজরদারি ঘাঁটি করার অনুমতি নেহেরুর মাথায় টুপি পরিয়ে আদায় করে নিয়েছিল, তা একবার সাকসেসফুল করতে পারলে গোটা বিশ্বকে ওরা ওখান থেকেই কন্ট্রোল করতো !

  এটাই ছিল চীনাদের ভারত আক্রমণের প্রকৃত ইতিহাস ! আমাকে যদি ওই লড়াইয়ের ফল ভালো না খারাপ জিজ্ঞাসা করো __তাহলে আমি বলব, সেই লড়াইয়ে ভারত হেরেছিল ঠিকই কিন্তু আখেরে গোটা পৃথিবীর লাভ‌ই হয়েছিল, ক্ষতি কিছু হয়নি ! তাছাড়া যে সময় ভারত চীনের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল অর্থাৎ 1962 সালে __তখন ভারতবর্ষ সবে স্বাধীনতা লাভ করেছে _তখন কোথায় আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, কোথায় কি ? আর নেহেরুর দুর্বল বিদেশনীতি এবং স্বদেশ নীতির মাশুল গুনতে হচ্ছিলো তখন ভারতবর্ষকে ! ফলে ভারতীয় সৈন্যদের প্রয়োজনীয় যুদ্ধ সরঞ্জাম তখন ছিল না । চীনাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে ভারতীয়দের বেওনেট লাগানো রাইফেল পারবে কেন ? তাছাড়া চীনা সৈন্যরা কৌশল করে সাদা পতাকা উড়িয়ে "ইন্দি-চিনি বাই(ভাই)_ বাই" করতে করতে ভারতীয় সৈন্যদের নিজেদের কব্জায় এনে ফেলেছিল ! এই ভাবেই চীনা সৈন্যরা ভারতের মূল ভূখণ্ডের কিছুটা জায়গা দখল করতে সমর্থ হয়েছিল !

  পরবর্তীকালে ভারতের সৈন্যবাহিনীর প্রধানেরা নেহেরুকে নানা রকম পরামর্শ দিয়েছিল কিন্তু নেহেরু বলেছিল _ওই সমস্ত অঞ্চলে যেহেতু কোনো ফসল হয় না _"ব্যারেন ল্যান্ড", সুতরাং ওগুলো গিয়েছে যাক্__ ওই নিয়ে আমাদের

মাথা না ঘামালেও চলবে ! এই ভাবেই ভারতের খানিকটা জায়গা চীনারা অধিগ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছিল।

জিজ্ঞাসু:---আচ্ছা গুরু মহারাজ ! আমার মনে হয় বিদেশীরা বারবার ভারতবর্ষকে আক্রমণ করেছে বা লুটপাট করে এখানকার ধন-সম্পদ হরণ করে নিয়ে গেছে, এইসব কারনেই বর্তমান ভারতের এতটা খারাপ অবস্থা _তাই নয় কি?

  গুরু মহারাজ:----খারাপ অবস্থা বলতে তুমি কি বলতে চাইছো ? বারবার বিদেশীরা আক্রমণ করে এখানকার ধন-সম্পদ, এখানকার সাংস্কৃতিক সম্পদ হরণ করে নিয়ে গেছে ঠিক‌ই কিন্তু এই দেশের যে প্রাকৃতিক সম্পদ সেটা তো কেউ কেড়ে নেয়নি ! এখনো ভারতবর্ষের যা প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, কৃষি ব্যবস্থা উন্নত করে যদি উৎপন্ন ফসলের সমবন্টন ব্যবস্থা চালু করা যায় __তাহলেই দেশের মানুষের অনেকটাই উন্নতি ঘটবে। কৃষিজ ও খনিজ সম্পদ যা এই দেশে আছে, তাতেই এই বিশাল জনসংখ্যা বিশিষ্ট ভারতবর্ষের মানুষ অন্যান্য অনেক দেশ অপেক্ষা উন্নত বা একটা standard অবস্থায় থাকতে পারবে ! এখানে তো শুধু সম্পদের monopoly হয়  এবং এই জন্যই ভারতকে বিদেশীদের কাছে ঋণ নিতে হয় ! অন্যথায় ভারতবর্ষকে বিশ্বব্যাংক বা অন্যান্য কোনো সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না তো !

  হ্যাঁ, এটা সত্যি যে ভারতবর্ষকে বিদেশীরা লুণ্ঠন করেছে, অনেকেই টন টন সোনা,রূপা,মনিমুক্তা-হীরে-জহরৎ নিয়ে গেছে ! কিন্তু মজার ব্যাপারটা কি যেন সেই সোনাই চোরাপথে হু হু করে এখন ভারতবর্ষে ঢুকছে ! ভারতবর্ষে কি কম সোনা এখনো রয়েছে ! এইতো কদিন আগে কয়েক টন সোনা চন্দ্রশেখর সরকার বিক্রি করলো এবং তাতেই দেশে "গেল"- "গেল" রব উঠেছিল ! কিন্তু এখনো ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকে সঞ্চিত সোনার পরিমাণ কিছু কম নয় ! এবার যদি ব্যক্তিগত ব্যাংকের লকারগুলো 'সিজ্' করে দেওয়া হয়, তো কয়েকশো টন বা কয়েক হাজার টন সোনা পাওয়া যাবে ! ভারতের সাধারণ মানুষ হাতে দুটো পয়সা পেলেই সোনা কিনতে চায় __ এটা ভারতবর্ষের মানুষের মানসিকতা ! যেমন ইউরোপিয়ানরা টাকা পেলেই স্ফুর্তি করে, 'ডিসকো থেকে' যায়, ক্লাবে যায়, আউটিং করে, বিদেশ ভ্রমণ করে __বেশিরভাগ ভারতীয়রা কিন্তু সেটা করে না ! ভারতীয়দের টাকা থাকলে, তারা সম্পদ আহরণ করে !

   এসব ছাড়াও আর একটা ব্যাপার আছে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন _"তোতাপুরি কিমিয়া বিদ্যা জানে" ! কথাটা হচ্ছে এই যে নাগা সন্ন্যাসী সম্প্রদায় বা এই ধরনের কিছু অন্যান্য সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা রয়েছে, যারা যে কোনো ধাতু থেকে সোনা তৈরি করতে পারে !  আমি উত্তরকাশীতে দেখেছিলাম লিঙ্গায়েত সাধুরা পারদ জমিয়ে শিবলিঙ্গ তৈরি করেছে এবং ওরা সেটাকেই পুজো করে !

  প্রকৃতিতে পারদ সাধারণত তরল অবস্থায় পাওয়া যায় ! পারদ কোথায় পাওয়া যায় জানো তো__ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভ্রের খনিতে !  তরল অবস্থাতেই অভ্রের ফাঁকে ফাঁকে পারদ থাকে, তাছাড়া রুপোর খনিতেও পারদ পাওয়া যায়। এবার কথা হচ্ছে যে, যে কোনো উপায়ে পারদ জমাতে পারলে, এখান থেকে সোনা তৈরি করা খুবই সহজ ! বিজ্ঞানের লোকেরা বা বিজ্ঞানীরা এটা জানে বা এই কথাটা বুঝতে পারবে ! কারন সোনার পরমাণুর গঠনের সঙ্গে পারদের পরমাণুর গঠনের খুবই সাদৃশ্য রয়েছে !

 যাই হোক, যে কোনো ভাবেই হোক না কেন__ ভারতে তেমন উল্লেখযোগ্য স্বর্ণখনি না থাকা সত্বেও প্রাচীনকাল থেকেই এদেশের সোনা ছিল প্রচুর ! ইংরেজরা এ দেশ অধিগ্রহণ করার পর দেশের কোনে কোনে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে__ সোনার খনি পাওয়া যায় কিনা ! ওরা হতাশ হয়েছে, উল্লেখযোগ্য সোনার খনি পায়নি ! অথচ আশ্চর্যের বিষয় কি বিশাল পরিমাণ সোনা প্রাচীন ভারতে ছিল ! এক নাদির শাহ-ই কতবার ভারত আক্রমণ করে কত  সোনা যে নিয়ে গেছে __তার ইয়ত্তা নাই !

 সে যাই হোক, পুরোনো কথায় কাজ নাই, আমি বলতে চাইছি বর্তমানের অবস্থার কথা ! এখনো এসব সম্পদ ভারতে যথেষ্ট আছে !  ভারতবর্ষের কৃষি ক্ষেত্রে কতটুকুই বা আর উন্নতি হয়েছে, তাতেই ভারত খাদ্যসঙ্কট থেকে বেড়িয়ে এসেছে তো বটেই __এখন বিদেশে খাদ্য রপ্তানি করছে ! অন্য দেশের সঙ্গে এ ব্যাপারে প্রতিযোগিতায় নেমেছে ভারত ! এবার রাজনৈতিকভাবে যদি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি এবং সম্পদের সমবন্টন নীতি এই দেশে চালু হয়( সমবন্টন নীতি বলতে __কৃষিজ এবং খনিজ সম্পদের সারভাগ সরাসরি সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া!), তাহলে মুষ্টিমেয়ের হাত থেকে সম্পদ সমাজের সকল মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে ! আর এইটা করতে পারলে ভারত আর অনুন্নত দেশ থাকবে না, অতি শীঘ্রই উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি পাবে।


 জিজ্ঞাসু:--- বেদান্তে বলা হয়েছে "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা"! কিন্তু তাহলে তো ঈশ্বর‌ও মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে, তাই নয় কি?

     গুরু মহারাজ:----"জগৎ মিথ্যা" অর্থে তুমি কি বুঝেছো ? এখানে "মিথ্যা" অর্থে অসত্য নয়_নশ্বর !  তাই নশ্বর যা কিছু তাকেই 'মায়া' বা 'মিথ্যা' বলা হয়েছে। দ্যাখো, এই জগৎটা ব্রহ্মের-ই প্রকাশ ! ভিন্নতা যা কিছু__ সেগুলি ব্রহ্মের প্রকাশিত কলার ভিন্নতা মাত্র ! ফলে, ব্রহ্ম সত্য, আর সেই ব্রহ্মের প্রকাশিত কলাগুলি অসত্য _কি করে হয় ? পূর্ণ

থেকে পূর্ণই আসে ! সত্য থেকে সত্যই আসে অসত্য কখনো আসে না ! অপূর্ণ থেকে পূর্ণত্বের দিকে যাওয়ার পথে সদা সর্বদা যিনি ঈক্ষণ করে চলেছেন _তিনিই ঈশ্বর ! তাই ঈশ্বর‌ও সত্য !

   যে বিরাট কালের(সময়ের) মধ্যে এই লীলা সমূহ ঘটে চলেছে, তাকেই বলা হচ্ছে মহাকাল ! তাহলে এটা বলা যায় যে, মহাকালের বুকে একটা প্রচন্ড dynamic শক্তির প্রকাশ ঘটেছে এবং তার ক্রিয়া হয়ে চলেছে ! মহাকালের বুকে ক্রীড়ারত এই শক্তিকেই বলা হয় মহাকালী ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন _ "ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ" অর্থাৎ উভয়ই সত্য !  যেমন অগ্নি আর তার দায়িকা শক্তি । অগ্নিকে বাদ দিলে তার দাহিকা শক্তির কোনো অস্তিত্বই নাই, আবার দাহিকা শক্তিকে বাদ দিয়ে অগ্নি-রূপ কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না !

   ব্যাপারটা বুঝতে পারলে কি ? নিত্য‌ও সত্য, লীলাও সত্য ! আর জগৎসংসারে এই যে, যা কিছু ঘটতে দেখছো__ সে সব ঈশ্বরের‌ই লীলা ! সাধকের এই ধারণা পাকা হয়ে গেলে আর "আমি-আমার" _এই অজ্ঞানতা থাকেনা !  তিনি তখন "তুমি-তোমার" বোধে জ্ঞানের চরম-ভূমিতে উন্নীত হন ! এরপর তিনি আরো সামনের দিকে এগিয়ে চলেন এবং অন্তিমে আসে "আমিই তুমি, তুমিই আমি"- বোধ ! এটাকেই শাশ্ত্র বলেছে _"বিজ্ঞান অবস্থা" !

  তাহলে ক্রমটা বুঝতে পারলে কি? "অজ্ঞান" থেকে "জ্ঞান" অবস্থায় এবং "জ্ঞান" থেকে "বিজ্ঞান"অবস্থায় পৌঁছে অধ্যাত্মবিজ্ঞানী হয়ে ওঠা __এটাই অধ্যাত্ম জগতের ক্রম !