** *কথা প্রসঙ্গে* **

                      – _শ্রীধর_ব্যানার্জী।।

       শ্রী গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ কথা প্রসঙ্গে।।___১৯৯১/১ম

      ১৯৮৮ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বর্ধমান জেলার কুড়মুন গ্রামে সদানন্দ সামন্তের বাড়িতে শুভাগমন করেছেন । অপরাহ্নে তাঁর নিকট সমাগত ভক্তগণ তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী সাগ্রহে শ্রবণ করছেন ।

ভক্তবৃন্দের মধ্যে জনৈক শিক্ষক গুরুজীকে জিজ্ঞাসা করলেন – ” সদ্গুরু কি ? কখনই বা গুরু লাভ হয় ?”

গুরুজী উত্তর দিলেন –—

~~~~~~~~~~~~~~~

        “যিনি সকলকে  অজ্ঞান-অন্ধকার থেকে জ্ঞানালোকের দিকে নিয়ে যান, যার সংস্পর্শে এলে চিত্তে বিকার উৎপন্ন হয় না – বরং ভগবৎভাবের উদয় হয়, তিনিই সদ্গুরু ।

আর গুরুলাভের ব্যাপারটা কি জানো – ধরো, মায়ের কোলে শিশু শুয়ে আছে, শিশু যখন খেলা করছে মায়ের কোনো দৃকপাত নেই – কিন্তু ছেলে যখনই কেঁদে উঠলো মায়ের মনোযোগ সেইদিকে ৷ মা বুঝলেন ছেলের খিদে পেয়েছে । তখন মায়ের ডান হাত উঠে এল ; শিশুর মাথাটা তুলে ধরে সযত্নে স্তনের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে দিলেন – যেখানে আছে দুগ্ধরূপী অমৃতরস ৷ শিশু তখন কিন্তু নিজের চেষ্টায় সেই দুগ্ধ পান করতে লাগল ৷ রহস্যটা হচ্ছে – মা জগদম্বার কোলেই তো আছে সবাই, এবার যে অন্য রসে মত্ত না থেকে পরমানন্দ-রস পান করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, তখনই মায়ের দক্ষিণ হস্তরূপ গুরুর সঙ্গলাভ হয়! তিনিই সদগুরু,যিনি কৃপা করে ভক্তের সঙ্গে ভগবানের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন ।

জিজ্ঞাসু(শিক্ষক) :—

    মানবজীবনে গুরুকরণের প্রয়োজনীয়তা কি ?

গুরুজী :—- ভগবদ্ লাভ-ই মানব জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য । আর গুরুকরণ ব্যতীত যা একান্তই অসম্ভব ৷ দ্যাখো বাবা, সবরকম কাজের জন্যই তো গুরুর দরকার – যেমন ধরো, গান শেখার জন্য গুরুর দরকার, এরূপ নাচ শেখার জন্য, বিদ্যালাভের জন্য, বাজনা শেখার জন্য – এমনকি পকেটমারা শেখার জন্যও গুরুর দরকার হয় । অতএব বুঝতেই পারছো – আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে বা উন্নীত হতে সদ্গুরুকরণের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী ।

 জিজ্ঞাসু (ঐ একই ব্যক্তি):— আচ্ছা, কুলগুরু কি সদ্গুরু নন ?

গুরুজী :—-  প্রকৃতপক্ষে কুলগুরুই সদগুরু, কারন ‘কুল’ কথাটি ‘কৌল’ থেকে এসেছে ৷ যিনি অকুলে কুল পেয়েছেন বা ঈশ্বরত্বে উপনীত হয়েছেন – তিনিই কুলগুরু । সাধারণ মানুষ ‘কুল’ কথাটি বংশ এইরূপ ভেবে নিয়ে বংশপরম্পরায় গুরু নির্বাচন করে বসেন । কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তে ভুল হবার সম্ভাবনা ৷ কারণ সদ্গুরু নিজে সত্য উপলব্ধির পরই শিষ্য পরম্পরায় তাঁর উপলব্ধ সত্যের ব্যাখ্যা করেন বা তাঁদেরকেও সেই সত্যে উপনীত হতে সাহায্য করেন । কিন্তু সাধারণভাবে বংশপরম্পরায় নির্বাচিত গুরুর সেই সত্যের বোধ থাকে না – তাই যে ব্যক্তি অমৃত পান করেনি সে অমৃতের স্বাদ অপরকে কিভাবে বোঝাবে ? তবে এটা ঠিক যে, গুরুবাক্যে অটল বিশ্বাস ও ঐকান্তিক নিষ্ঠা থাকলে (গুরুর ভগবৎ লাভ না হলেও) শিষ্যের ভগবৎ লাভ সম্ভব হয় ৷ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন – “যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ী যায়, তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায় ৷”

অনেকেই “গুরুবাদ” নিয়ে বিতর্ক করেন – জেনে রাখা ভালো, কথাটা কিন্তু “গুরুবাদ” নয় – “গুরুপরম্পরা” । ‘গুরু’ একটি নির্দিষ্ট ‘পদ’ (Post) বিশেষ । সদ্গুরু তাঁর অর্জিত বা উপলব্ধ জ্ঞান তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরীকে দিয়ে যান, ফলে তিনিই পরবর্তী ‘গুরু’ হিসাবে পরিগণিত হন । (যেমন দ্রোণাচার্য তাঁর অস্ত্রবিদ্যার নির্যাস তাঁর পুত্রকে না দিয়ে, উপযুক্ত শিষ্য অর্জুনকে দিলেন) এইভাবেই প্রাচীন আর্য মনীষীদের প্রজ্ঞা আজও প্রবাহিত হয়ে চলেছে গুরু পরম্পরার মধ্য দিয়ে – বংশপরম্পরায় নয় ৷ এটাকে সার্বিকভাবে বোঝো – বিতর্কে জড়িয়ে পড়ো না ।

যেমন গুরুপরম্পরার শ্লোকে রয়েছে__

      “ওঁ নারায়ণম্ পদ্মভবম্ বশিষ্টং শক্তিং চ তৎপুত্র পরাশরং চ ।

      ব্যাসং শুকং গৌরপদং মহান্তং গোবিন্দ-যোগীন্দ্রম্থাস্যশিষ্যম্ ।৷

   শ্রীশঙ্করাচার্যমথাস্য পদ্মপাদং চ হস্তামলকং চ শিষ্যম্ ৷

   তং তোটকং বার্তিককারমন্যানস্মদ্ গুরুন্‌ সন্ততমানতোহস্মি ।৷”

জিজ্ঞাসু(শিক্ষক):– এবার দীক্ষার তাৎপর্য সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন তো ভালো হয় ।

 গুরুজী :—‘দীক্ষা’ কথাটির অর্থ ‘দীয়তে’ অর্থাৎ ‘দান করা’ ও ‘ক্ষীয়তে’ অর্থাৎ ‘ক্ষয় হওয়া’ থেকে এসেছে । অর্থাৎ গুরুদেব তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি শিষ্যের মধ্যে সঞ্চারিত করেন, (অবশ্য সেই আধারের গ্রহণ করার ক্ষমতা অনুযায়ী) আর সেই শক্তিকে বা বীজকে নিয়মিত অভ্যাস ও পরিচর্যার দ্বারা প্রাণবন্ত ও উজ্জীবিত করা যায় । ফলে শিষ্যের সমস্ত অজ্ঞানতার ক্ষয় হয়, জ্ঞানের আলোকে – প্রেমের আলোকে জীবন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এবং তখনই জীবনের উদ্দেশ্য সফল হয় ।

*।      *।         *।         *।      *।

 [এরপর রমেশবাবু, জনৈক যুবক এবং এক বৃদ্ধ গুরুজীকে জিজ্ঞাসাদি করতে লাগলেন ।]

জিজ্ঞাসু(রমেশবাবু) :— আচ্ছা গুরুজী! স্ত্রীবিয়োগের পর যদি স্বামী দীক্ষা নেয় তাহলে কি মৃতা স্ত্রীরও কাজ হয় ?

গুরুজী:—  স্ত্রী বিয়োগের পর স্বামী বা স্বামী বিয়োগের পর স্ত্রী_ যদি সদ্গুরুর কাছে দীক্ষা নেয়, তবে উভয় ক্ষেত্রেই মৃতা স্ত্রী বা মৃত স্বামীরও কাজ হবে ৷ কারণ বিবাহ কখনই আকস্মিক ঘটনা নয়, পূর্বাপূর্ব জীবনের চাওয়া-পাওয়ার ফলস্বরূপই এই জন্মের বিবাহ সংঘটিত হয় ।

জিজ্ঞাসু(এক যুবক) :– “প্লানচেট” কি ? এ সম্বন্ধে একটু বলুন ?

  গুরুজী :– ‘Planchet’ না বলে ওটাকে ‘Plan-cheat’ বল্! কারণ, যারা ওসব করে – তাদের বেশীরভাগই Plan করে লোককে cheat করে ! কি যে সব হচ্ছে আজকাল ! স্বামী অভেদানন্দের “মরণের পারে” বইটা পড়েই তোদের মতো যুবকেরা অনেকেই এইরকম জিজ্ঞাসা করে । যাইহোক, ব্যাপারটা বলছি শোন্__ Planchet-এ একজন ‘মিডিয়াম’ থাকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ত্রিকোনাকার একটি যন্ত্রও ব্যবহার করা হয়! এইবার অন্ধকার ঘরে কোন বিশেষ Spirit-কে(যে কোন একজন মৃত ব্যক্তি।যাঁর ফোটোও সেখানে রাখা যেতে পারে।) গভীরভাবে চিন্তা করতে করতেই ওই Spirit-টি মিডিয়াম-কে মাধ্যম করে আসে এবং কিছু বলে বা লিখে দেয় ৷ তবে ভূতকে নিয়ে গবেষণা ভূতেরাই করে – আমি বলি ভগবানকে নিয়ে গবেষণা করো,  ওতে লাভ কি ?

জিজ্ঞাসু(বৃদ্ধ) :– তাহলে কি ভুত-প্রেত নাই এবং শ্রাদ্ধকর্মেরও কোন প্রয়োজন নাই ?

গুরুজী :– শাস্ত্রে আছে দেবযান, পিতৃযান ও ধূমযানের কথা ! মৃত্যুর পর যারা ধূমযানে গমন করে সাধারণতঃ তারাই প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয় – এরূপ লেখা আছে । তবে ব্যাপারটা হচ্ছে, মৃত্যুকালীন অবস্থায় যারা সজ্ঞানে মরে তারাই দেবযান, যারা মৃত্যুর ঠিক পূর্বে জ্ঞান হারায় (‘কোমা’ অবস্থা) পিতৃযান, এবং যারা – তাদের যে মৃত্যু হয়েছে তা জানতেই পারে না – (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আকস্মিক মৃত্যু বা Accidental death) তারাই ধূমযান গতি প্রাপ্ত হয় ।

শ্রাদ্ধশান্তি ইত্যাদি ক্রিয়া প্রকৃতপক্ষে ওই সমস্ত প্রেতযোনি প্রাপ্ত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যেই করা হয়, যাতে পুত্র-কন্যার শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে বা আন্তরিক শোক প্রকাশের ফলে মৃত প্রেত – তার যে মৃত্যু হয়েছে তা বুঝতে পারে । তবে সবাই যে শ্রাদ্ধ-ক্রিয়া করে থাকে তাতে মৃত পিতা বা মাতার কোন কাজই হয় না – কারণ মৃতদের অধিকাংশই প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয় না – কিছুদিন সূক্ষ্মশরীরে অবস্থান করে এইমাত্র । তবে সেই সময়কালীন পুত্র-কন্যারা যদি শোকাবনত চিত্তে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ক্রিয়া (শ্রাদ্ধ) করে তবে মৃত পিতা-মাতা একপ্রকার Vibration অনুভব করে থাকে এবং পুত্র বা কন্যার ঐরূপ আচরণ দেখে তাঁরা প্রীত হন ও আশীর্বাদ করেন । ফলে পুত্র বা কন্যারই মঙ্গল হয়, মাতা বা পিতার নয় ৷

বর্তমানে দেখা যাচ্ছে শ্রাদ্ধকর্মে “শ্রদ্ধা”রই অভাব । তাই প্রেতযোনি প্রাপ্ত হলেও পুত্র-কন্যারা শ্রাদ্ধাদি করেও তাঁদের কোন উপকার করতে পারে না ৷ কারণ শ্রাদ্ধকর্ম বর্তমানে শ্রদ্ধাবিহীন একটা নিয়মরক্ষায় পর্যবসিত হয়েছে । এসব প্রেতযোনি প্রাপ্ত Spirit-রা দীর্ঘকাল একটা বিশেষ অবস্থাতেই ঘুরে বেড়ায়, Evolution হয় না । কখনও যদি এরা কোন উন্নত মহাপুরুষের দৃষ্টিপথে এসে যান তখন তিনি এদের মুক্তি দিয়ে দেন অর্থাৎ পুনরায় জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ফিরিয়ে দেন ।