জিজ্ঞাসু:— এখন যে কথায় কথায় শোনা যায় “রাম রাজত্ব” ! এই ‘রাম রাজত্ব’ ব্যাপারটা ঠিক কি?

গুরু মহারাজ:– দ্যাখো, রাজনৈতিক নেতারা স্লোগানে কি বলে_ সেটার মধ্যে আমি কখনো যেতে চাই না ! কারণ আমি এটা জানি যে, এই সমস্ত রাজনেতাদের কোনো ব্যাপারেই ঠিক মতো ধারণা নাই ! এরা শুধু কথার জাগলারির দ্বারা সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে গদিতে টিকে থাকতে চায় । আর এরা মানুষকে দলে টানার জন্য নানা রকম স্লোগান আমদানি করে থাকে, নানান কথা বলে থাকে। যে সমস্ত মানুষের মানসিকতার সঙ্গে সেই বক্তব্যগুলি মিলে যায়_তারা সেই মত অবলম্বন করে অর্থাৎ সেই রাজনৈতিক দলে নিজেকে সামিল করে নেয়। এই ভাবেই সমাজে নানান রাজনৈতিক দল,উপদল ইত্যাদি তৈরি হয়।

প্রকৃতপক্ষে ‘রাম রাজত্ব’ কেমন ছিল__ তা এরা কি করে জানবে বলোতো ? রামায়ণ থেকে পাওয়া যায় যে, ভগবান রামচন্দ্র যৌবনপ্রাপ্ত হবার পর যখন রাজা হবার উপযুক্ত হোলেন _তখন উনি সমগ্র ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়িয়ে নিজের চোখে সবটা দেখে নিতে চেয়েছিলেন ! এই জন্যই তো তিনি বনবাসে গিয়ে ভারতের উত্তর অংশ থেকে দক্ষিণ ভাগ পর্যন্ত সমগ্র অংশ ঘুরে বেড়ালেন !

তৎকালে ভারতবর্ষে সবচাইতে উন্নত তিনটি dynasty ছিল__ আর্য, দ্রাবিড় এবং নিষাদ। আর্য বীর শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে বেরিয়ে বাকি সমস্ত উল্লেখযোগ্য জনজাতির নেতাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিলেন ‌। আর সেই বন্ধুত্ব যে সে বন্ধুত্ব নয়, এমন বন্ধুত্ব যে_ একে অপরের জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ! বালি, সুগ্রীব হনুমান এঁরা ছিলেন দ্রাবিড় জাতির মানুষ। গুহক চন্ডাল নিষাদ জাতির নেতা ছিলেন। শবরী মাতার যে কাহিনী রয়েছে–ওঁরাও ছিলেন নিষাদ জাতির সদস্য। আর রাক্ষস জাতির নেতা ছিলেন রাবন, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ, মারীচ, কালনেমী প্রমুখেরা। তৎকালে দ্রাবিড় নেতা সুগ্রীব ও হনুমান, নিষাদরাজ গুহক এবং রাক্ষস-নেতা বিভীষণের সাথে রামচন্দ্র বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে সমগ্র ভারত বর্ষকে এক প্রেমের বাঁধনে বেঁধে ফেলেছিলেন। বিভিন্ন স্থানে উনি অত্যাচারী রাজাদেরকে সরিয়ে দিয়ে ন্যায় ও বিবেকপরায়ণ একজন করে ভালো মানুষকে(সুগ্রীব, বিভীষণের ন্যায়) সিংহাসনে বসিয়েছিলেন রামচন্দ্র। রামায়ণে এমন‌ও উল্লেখ রয়েছে যে, পাতাল রাজ্যে মহিরাবনকে বধ করার পর__ মকরধ্বজ্ নামে একজনকে ভগবান রামচন্দ্র রাজা করেছিলেন। তার মানে হোচ্ছে __ভারতবর্ষের সব জায়গাতেই উনি একটা প্রেম ও মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন এবং বিবেকবান কোনো ভালো মানুষকে সিংহাসনে বসতে সাহায্য করেছিলেন।

এইভাবে বন্ধুত্ব স্থাপনের মাধ্যমে এক একটা অঞ্চলের অত্যাচারী শাসকদের সরিয়ে দিয়ে বিবেকবানদের হাতে রাজত্বের ভার দিয়ে– সেই সব রাজ্যের সাধারণ মানুষদের জীবনে স্বস্তি বা শান্তি এনে দিতে সাহায্য করেছিলেন ভগবান শ্রী রামচন্দ্র । এইভাবে তিনি তৎকালীন সমগ্র ভারতবর্ষের অর্থাৎ উত্তরে হিমালয়, পশ্চিমে বর্তমান পাকিস্তান ও আফগানিস্তান, পূর্বে বর্তমান বাংলাদেশ বার্মা, দক্ষিনে বর্তমান সিংহল বা শ্রীলঙ্কা সহ আরো অনেক দ্বীপ রাষ্ট্র (যা হয়তো এখন জলের তলায় রয়েছে)__ এই সকল রাষ্ট্রকে এক ছত্রছায়ায় নিয়ে এসেছিলেন।

এইভাবে একজন উপযুক্ত আর্য রাজার রাজত্বে পাশাপাশি সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের ফলে সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের ভিন্ন ভিন্ন কালচারের মানুষজনেদের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন হয়েছিল । নিজের দেশের সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের শাসনকর্তা এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শাসকদের মধ্যে এই যে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান এবং ফলস্বরূপ প্রজাবর্গের জীবনে আসে সমৃদ্ধি ও স্বস্তি__এটাকেই বলতে পারো “রাম রাজত্ব” ! এমনটা যদি ভারতবর্ষে বা পৃথিবীর কোথাও কখনো হয়, তাহলে জানবে অবশ্য‌ই সেখানে সাধারণ মানুষের জীবনে সুখ-স্বস্তি এবং সমৃদ্ধি নেমে আসবে ! এমন ‘রামরাজত্ব’ আসুক না ! মানুষ তো সুখ-স্বস্তি-সমৃদ্ধিতে থাকতেই চায় _কে আর অশান্তি-দুঃখ-কষ্ট বরণ করতে চায় বলো?
তৎকালীন রামরাজত্বের বিস্তার যে পশ্চিমে বর্তমান পাকিস্তান পর্যন্ত ছিল তার প্রমাণ হোলো রামপুত্র লবের রাজধানী ছিল লবপুর__ যা বর্তমানে লাহোর ! আবার উত্তরে কুশিনগর ছিল কুশের নাম অনুসারে _হয়তো ওখানে রাজা কুশের রাজধানী ছিল ৷৷