জিজ্ঞাসু:— ‘ভাববাদ’ এবং ‘বস্তুবাদ’ নিয়ে সমাজে এখনো যে ভীষণ দ্বন্দ্ব রয়েছে_তার কি কোনোদিন অবসান হবে না ? সে সম্বন্ধে আপনি যদি আমাদেরকে কিছু বলেন!!

গুরু মহারাজ:— ‘বস্তুবাদী’ যাদের বলছো তারাও কি ‘ভাব’ বর্জিত ? সকলকেই তো ভাবতে হয়_ ভাবনা বর্জিত কে আছে ? ভাবনা থেকেই ‘ভাব’ কথাটি এসেছে।

দ্যাখো, ‘বস্তুবাদ’– ‘ভাববাদ’ এসব কথা রাজনৈতিক ধান্দাবাজদের কথার কচকচানি ! এইসবের কোনো সারবত্তা নাই । কোনো বিবেকবান, বৈরাগ্যবান লোকের কথা এগুলি নয় ! এক শ্রেণীর বিকৃত মানসিকতার মানুষ এগুলো বলে থাকে। এই কথার প্রতিবাদে কিছু কথা বলাই যায়! এরা যাদেরকে ভাববাদী বলছে তাদের মধ্যে তো ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন মহাত্মা মহাপুরুষরাও রয়েছে_ তাই না ! যাঁরা নিজেদের সমগ্র জীবন ধরে যে আদর্শ পালন করে এসেছেন বা তাঁরা সমাজকে যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন__তা হোলো ত্যাগ-সংযম-বৈরাগ্য-ভালোবাসা__ তাইতো !
এবার দ্যাখো, ‘সংযম’ ছাড়া কোনো কার্যে success আসে না, আর ‘ত্যাগ’ ও ‘বৈরাগ্য’ ছাড়া কি সেই কার্যে সম্পূর্ণরূপে dedication সম্ভব হয় ? মায়া-মোহ-সংসারের পিছুটান__এইসব থাকলে কোনোদিনই কোনো কাজে দীর্ঘ সময় ধরে লেগে থাকা সম্ভব হয় না- কর্মে ছেদ পড়ে, ফলে সেই কর্মে কৃতকার্যতা আসে না। সুতরাং আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে তো বটেই _যে কোনো ক্ষেত্রেই এই নিয়ম খাটে। কর্মজগতে সম্পূর্ণভাবে successful হোতে গেলে সত্য-ত্যাগ-প্রেম‌ ও শান্তির পথেই হাঁটতে হবে।
আর যাদের ‘বস্তুবাদী’ বলা হোচ্ছে, তাদের যারা নেতৃত্ব স্থানীয়, তাদের দিকে যদি তাকিয়ে দ্যাখো__ দেখবে প্রথম জীবনে অবশ্যই তাদের মধ্যে তীব্র ত্যাগ-বৈরাগ্য ইত্যাদির অনুশীলন ছিল ! আর ছিল বলৈই তারা এক একটা মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে বা কোনো মতবাদকে কার্যকরী করতে সামর্থ্য হয়েছে !
এই একটা জায়গাটাতেই তথাকথিত ভাববাদী এবং বস্তুবাদী উভয় দলের নেতৃত্ব স্থানীয়দের অনেকটা মিল রয়েছে ! কিন্তু যাদেরকে ‘ভাববাদী’ বলা হোচ্ছে তাদের নেতৃত্ব স্থানীয়রা অর্থাৎ কোনো ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক মতবাদের প্রতিষ্ঠাতারা সারা জীবন ত্যাগ-বৈরাগ্য-সংযমে অবিচল থেকেছেন ! কিন্তু বস্তুবাদীদের নেতৃত্ব স্থানীয়রা সেই জায়গায় স্থির থাকতে পারেনি ! তারা ক্ষমতা-ঐশ্বর্য-ইন্দ্রিয়ভোগ ইত্যাদি নানাবিধ ভোগের যখন‌ই সুযোগ পেয়েছে__তখন‌ই তারা আদর্শচ্যুত হয়েছে। এইভাবে মানুষের বা সমাজের ভালো করতে গিয়ে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজের ক্ষতি করেছে। প্রকৃতপক্ষে ভালো করা আর হয়ে ওঠেনি।।
সর্বত্যাগীরাই পারেন উচ্চ-নিচ, ধনী-নির্ধন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে এবং বর্ণভেদ নির্বিশেষে সকলকে সমানভাবে দেখতে ! যার জীবনে ত্যাগ নাই, সংযম নাই__ সে শুধু মুখেই লেকচার দিতে পারে, কাজে কতটুকু করতে পারে ! আর এইসব মানুষেরা যখনই কপালগুণে সমাজের নেতৃত্ব পায়__ তখন তারা স্বজন-পোষণ করে এবং বিভিন্ন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে ।
দ্যাখো, যে কোনো মানুষের জীবনে যদি সাধনা নাও থাকে_ শুধুমাত্র যদি তার জীবনে সংযম থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে। আর যদি কেউ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়, তাহলে সেই শরীরে immunity power সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি থাকে ।
একটা জিনিষ খেয়াল করেছো কি__সাধু-সন্ত-যোগী-সন্ন্যাসীরা বেশিরভাগ বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে অল্পাহারে বা অনাহারে পড়ে থাকে কিন্তু তাদের শরীর নীরোগ থাকে। যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় বা মহামারীতে সাধু-সন্তরা যেভাবে সমাজের মানুষের সেবা করে থাকে, সরকারি কর্মচারীরা বা অন্য কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার লোকেরা তেমনটা করতে পারে না। আর পারবেও না কোনোদিন।
সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যেদিন সংযমী হয়ে উঠবে সেই দিনই সমাজের স্বাস্থ্য সুস্থ ও সুন্দর হয়ে উঠবে । এখন সমাজের বেশিরভাগ মানুষই অসংযমী- উচ্ছৃংখল ! যুবক-যুবতীদের জীবনে সংযম নাই, এমনকি দম্পতিদের জীবনেও সংযম নাই। মেয়েরা অসঙ্গত জীবন যাপনের জন্য অত্যধিক হারে কন্ট্রাসেপটিভ পিল খাচ্ছে‌। আর এর ফলেই মেয়েদের uterus বা breast-এ টিউমার হোচ্ছে, ক্যান্সারের মতো রোগ বাড়ছে । পুরুষদের vasectomy বা মেয়েদের tubectomy-ও unnatural ! ফলে এগুলো করার ফলে তাদের শরীরে নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হোচ্ছে ।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বহু বছর পূর্বে পৃথিবীর সমগ্র মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করে একটা বার্তা দিয়েছিলেন_ ‘একটা দুটো ছেলে মেয়ে হয়ে গেলে, স্বামী-স্ত্রী ভাই বোনের ন্যায় থাকতে হয়!’ যুগপুরুষের কথা না মেনে আজকের সমাজের এরকম একটা বাজে অবস্থা হয়ে গেছে। যেখানে 20টি ইঁদুরের স্থান রয়েছে, সেখানে যদি 400 টাকা ইঁদুর ভরে দাও__ তাহলে কি হবে !!
সমগ্র বিশ্বে, বিশেষতঃ ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় এখন জনসংখ্যাই সবচাইতে জ্বলন্ত সমস্যা। মানুষের আহার জোগাতে জোগাতেই একটা দেশের সরকার শেষ হয়ে যাচ্ছে! তারপর স্বাস্থ্য-শিক্ষা-সুরক্ষা_ এগুলির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা হবে কি করে ? অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য‌ই মানুষ দুর্নীতিপরায়ণ হোচ্ছে । যে যখন ক্ষমতা বা সুযোগ পাচ্ছে __সে অপরের উপর শোষণ-নির্যাতন-অপশাসন ইত্যাদির দ্বারা নিজে অর্থবান বা ক্ষমতাবান হতে চাইছে । এইভাবেই বর্তমানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে।
এবার কথা হোচ্ছে__এসবের থেকে মনুষ্যসমাজ রেহাই পাবে কি করে ? এখান থেকে পরিত্রাণ পেতে হোলে একমাত্র ভারতীয় প্রাচীন মুনি-ঋষিদের শিক্ষা গ্রহণ করে _ তার্ জীবনে আচরণ করতে হবে। মানুষকে আবার ত্যাগ-সংযম-বৈরাগ্যের দিকে ঝুঁকতে হবে, তবেই এই জ্বলন্ত সমস্যা থেকে ভারতীয় সমাজ মুক্ত হোতে পারবে।