জিজ্ঞাসু—বর্তমান সমাজে এত নৈতিক অধঃপতন, বিশেষত যুবসমাজের — মানুষ যে মহাপাতক করছে, এতে কি করে আগামী দিনের পৃথিবী সুন্দর হবে, দিন দিন তো অধোগতিই হচ্ছে ?

গুরুমহারাজ—তাই কি কখনও হয় ? সামগ্রিকভাবে সমাজের তথা পৃথিবীর যদি অধোগতিই হয় তাহলে আমি বলব সেখানে মানুষের কোন দোষ নেই—দোষ যদি কারও থাকে তাহলে মহাপুরুষদের দোষ। সমাজের অধোগতি দূর করার জন্য, প্রকৃতির balance রাখার জন্যই তো মহাপুরুষগণের জন্মগ্রহণ ! তাঁদের বারবার জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও যদি পৃথিবীগ্রহের অধোগতি হয় তাহলে দায় বলুন, দোষ বলুন সে সব তাঁদের অর্থাৎ পৃথিবীতে অবতীর্ণ মহাপুরুষদের— সাধারণ মানুষের তো নয় ! মনুষ্যসমাজে মহাপুরুষগণের শরীর ধারণ ব্যাপারটাও একটা নির্দিষ্ট নিয়মে হয়—কোন সময়ে তাঁরা অনেকে ঘনঘন আসেন, কখনও অনেকদিন পরপর। যখন ঘনঘন আসতে হয়, তার মানে পৃথিবীতে তখন খুবই দুরবস্থা, দুর্যোধন, কংস, রাবণের সংখ্যা বেড়ে গেছে। আর যখন সমাজ সুস্থিত থাকে তখন তাঁদের কম আসার প্রয়োজন হয়—এটাই নিয়ম। এবার কথা হচ্ছে মহাপুরুষগণ নিয়মিত শরীর নিচ্ছেন অথচ পৃথিবীগ্রহের বা মানব- সমাজের অধঃপতন হচ্ছে, এতে individual-এর দোষ কোথায় ? তাহলে সেটা মহাপুরুষদের বা Universal principle-এর দোষ, system-এ গণ্ডগোল রয়েছে অর্থাৎ মহাপুরুষগণ ঠিকঠিক কাজ করতে পারেননি।

কিন্তু এমনটা হয় না। ঈশ্বরের ভুল হয় না। আপনার দেখার ভুল হচ্ছে বা বিচারপদ্ধতির ভুল হচ্ছে । পৃথিবীগ্রহ বা মানবসমাজের কখনই অধোগতি হয়নি—ঊর্ধ্বগতিই হচ্ছে। বিবর্তনবাদ পড়েছেন কি ? বিবর্তন-উদ্‌বর্তন এগুলি সবই অগ্রগতি অধোগতি নয়। আর আপনি যে শব্দটা ব্যবহার করলেন ‘মহাপাতক’, এটার অর্থ কি জানেন ! পিতৃহত্যা, মাতৃহত্যা, গুরুপত্নী- হরণ বা গুরুদ্রোহিতা এই ধরণের সাংঘাতিক অপকর্মকে বলা হয় ‘মহাপাতক’। সাধারণ অন্যায় কাজগুলিকে ‘পাতক’ বলে –তা থেকে সৃষ্ট কর্মফল ভোগ-ভোগান্তির মাধ্যমে অপসারিত হয়। কিন্তু ‘মহাপাতক’-এর ফল মারাত্মক—কল্পকাল ভোগেও তা যায় না । সেইজন্য যখনই মহাপুরুষগণ জন্মগ্রহণ করেন, তখন তাঁরা এইরূপ মহাপাতকদের উদ্ধার করেন। বিভিন্ন নিম্নযোনিপ্রাপ্ত বা দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় এরা থাকে, মহাপুরুষগণ এদেরকে কাছে কাছে রাখেন, হয়তো তাদের বিভিন্নভাবে সেবার সুযোগ দেন, তারা মহাপুরুষের সেবা, সান্নিধ্য ও স্পর্শ লাভ করার সুযোগ পায়। আর এর ফলে তাড়াতাড়ি তারা কর্মফল মুক্ত হয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারে। মহাপুরুষগণের জন্মগ্রহণ মানে কি শুধু দুটো আশ্রম প্রতিষ্ঠা না পাঁচটা building তৈরী করা! তাঁদের অন্তর্জগতের কাজের পরিধি কত, কে তার হিসাব রাখে !

জিজ্ঞাসু—ক্রোধকে রিপু বলা হয় অথচ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন “ফোস্‌” করতে—তাহলে এটা কি ক্রোধ প্রকাশ হ’ল না ?

গুরুমহারাজ—তুই কি জিজ্ঞাসার জন্য জিজ্ঞাসা করছিস, না জানার জন্য জিজ্ঞাসা করছিস ? ঠাকুরের ‘ফোঁস্’ করার কথা বললি যখন তখন তো নিশ্চয়ই গল্পটাও জানিস। উনি গল্পের মাধ্যমে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ক্রোধ না করে প্রয়োজনে কিভাবে ‘ফোঁস’ করতে হয়। তুই একটা মাথামোটা, তাই বুঝতে পারিস নি। ‘ফোস্ করা’ স্নায়ুবিকার নয়, এটা জেনেশুনে অভিনয় করা। ক্রোধে মানুষের স্নায়ুদৌর্বল্য ঘটে, ক্রোধে বুদ্ধিনাশ হলে সর্বনাশ ঘটে। এইকথাগুলি “গীতা”-য় লেখা আছে, শ্রীভগবান স্বয়ং কথাগুলি বলেছেন। এছাড়া শারীরবিজ্ঞানীরা দেখেছে যে, ক্রোধীব্যক্তি অর্থাৎ যার ক্ষণে ক্ষণে কথায় কার্যে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার শরীরের বিভিন্ন ‘এণ্ডোক্রিন’ গ্রন্থির অস্বাভাবিক ক্ষরণ ঘটে ফলে হার্টের রোগ, diabetes, চোখের রোগ এবং অবশ্যই স্নায়বিক রোগ হয়। শরীরে একবার ক্রোধের সঞ্চার হলে মস্তিষ্ক কোষগুলি বা স্নায়ুসমূহ এমন উত্তেজিত হয় যে, ক্রোধ শান্ত হলেও মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলিতে আরও ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত irregular vibration থাকে। তাহলে বুঝলি কেন ক্রোধকে রিপু বা শত্রু বলা হয়েছে !

এবার কথা হচ্ছে যে, ক্রোধকে জয় করা যায় কি করে। একমাত্র প্রেমের দ্বারাই ক্রোধকে জয় করা যায়। অন্য কোনভাবে চেষ্টা করলে ক্রোধ suppressed হয়, পরে আবার এটার বিকার ঘটে, অন্য রূপ নেয়। যেমন ভয়ে ক্রোধ সাময়িক suppressed হতে পারে, কিন্তু পরে আবার তার অন্য বিকৃত রূপ দেখা দিতে পারে। আবার এর উল্টোটাও দেখা যায়, ক্রোধে অন্ধ মানুষ সাময়িকভাবে ভয়কেও জয় করতে পারে এবং হয়তো তার পক্ষে যা সম্ভব নয় এমন একটা অঘটনই ঘটিয়ে ফেলল। তবে কাম-ক্রোধ ইত্যাদি রিপুর কথা যাই বলা হোক সাধনপথে অগ্রগতির প্রধান বাধা অহং। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অহংসর্বস্ব অবস্থাকে বলতেন ‘কাঁচা আমি’, বলতেন “আমি ম’লে ঘুচিবে জঞ্জাল”। অরণ্যে হনু বা বানর ধরার গল্প তোমাদের বলেছি। কুঁজোর মত দেখতে শক্ত পাত্রকে মাটিতে গর্ত করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, শুধু তার মুখটা বাইরে থাকে। এবার কিছু ছোলা ভাজা তার ভিতরে রেখে দেওয়া হয়, আর কিছু ছোলা বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এবার লোকজন অনেকটা দূরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। হনু বা বানর যেই ছোলার লোভে গাছ থেকে নেমে কুঁজোর মধ্যে হাত ঢোকায়, তখন খালি হাত সুরুৎ করে ঢুকে যায়। কিন্তু যেই ভিতরের ছোলা মুঠি করে ধরে বের করতে যায়, তখন আর হাত বেরোয় না। হনুটি ভাবে গর্ত বুঝি তার হাত ধরে টানছে। সে মুঠি খোলে না কিন্তু পরিত্রাহি চিৎকার করে ছাড়া পাবার জন্য। তখন বানর ধরা লোকেরা এসে ভালো করে বেঁধে যেই মাথায় আলতো করে একটা ডাণ্ডা মারে তখন সে মুঠি ছেড়ে দেয় আর বানরের হাতও বেরিয়ে আসে। সেইরূপ সংসার অরণ্যে মোহগর্তে ভোগবাসনা- রূপ ছোলা রয়েছে। জীবসকল বিশেষত মানুষ ‘আমি দেহ’ এই অভিমানবশত যেই মোহে পড়ে ভোগবাসনা মেটাতে যায়, অমনি সংসার আবর্তে আটকে পড়ে পরিত্রাহি চিৎকার করে, ভাবে বা বলে সংসার তাকে ধরে রেখেছে, তাই সে বেরোতে পারছে না। তাকে বোঝানো দুষ্কর যে, সংসার তাকে ধরে রাখেনি, ভোগ-বাসনা রূপ ছোলা মুঠিতে ধরতে গিয়েই সে আটকে পড়েছে। ভোগবাসনা চরিতার্থ করার প্রবৃত্তি নষ্ট হলেই সে মুক্ত। কিন্তু অহংবোধ বা দেহবোধ থেকেই ভোগ-বাসনা চরিতার্থের প্রবৃত্তি জন্মায় — ফলে দেহ অভিমান না গেলে এটিও যাবার নয়। তাহলে কি দেখা গেল, না— অহং থেকে আসে অভিমান যা তমোগুণের প্রকাশ। আর প্রেম বা প্রণয় থেকে হয় ‘মান’ যা সাত্ত্বিক। রাধা অভিমান দ্বারা কৃষ্ণকে লাভ করতে পারেনি, ‘মান’-এর দ্বারা লাভ করল। তাই প্রেমই পরম পুরুষার্থ, প্রেমের দ্বারাই সাধনপথের সমস্ত বাধা যেমন বহির্জাগতিক বাধা, রিপু আদি বাধা—এ সবকিছুকে অতিক্রম করা যায়।

আমি আমার জীবনেও নানা experiment করেছি, তাতে যা দেখেছি, যা বোধ করেছি তাই তোমাদের বলছি–তোমাদের সকলের সমস্ত সাধনার উদ্দেশ্য হোক ‘প্রেমলাভ’। প্রেম অপ্রাকৃত, এই অপ্রাকৃত প্রেম লাভ হলে জীব শিব হয়, মানব মাধব হয়, । মানবের কর্ম হোক ধ্যান, ধ্যানে ভর করুক জ্ঞান, জ্ঞানের সিংহাসনে বিরাজ করুক প্রেম। এটাই ধর্মবিজ্ঞান।

আর যে বলছিলাম “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল”–এটার অর্থ অহং নাশ। অপার্থিব প্রেমেই একমাত্র অহংনাশ হয়। ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের বসন চুরির যে আখ্যান রয়েছে, তার তাৎপর্য এটাই। নির্বসনা অর্থাৎ নির্বাসনা। নির্বাসনা হলেই, সংসার-অরণ্যের মোহগর্তে আটকে যাওয়া মুঠি খুলে যাবে। আর সাধক তখন মুক্তির স্বাদ কি তা জানতে পারবে। অহং নাশ হলেই জীব শিব হয় এর অর্থ মানুষের মল-বিক্ষেপ আবরণরূপ চিত্তের মল অপসারিত হয়। এই অবস্থায় সাধকের তনু “ভাগবতী তনু” হয়ে যায়, সেই শরীরধারীকে ‘ভগবান’ বলে অভিহিত করা হয়। ভাগবতী তনু অর্থাৎ ভগবৎ লীলাবিলাসের উপযোগী তনু। যখন লড়াই করতে হবে তখন ক্ষত্রিয় শরীর, যখন প্রেম দিতে হবে তখন প্রেমে দ্রবীভূত শরীর, কর্ম করতে হলে কর্মীর শরীর—এই রকমভাবে শরীরের গঠন হয়ে যায়। কিন্তু শরীর যেরূপই হোক হাজার জনের মাঝে থাকলেও তাঁকে আলাদা করে চেনা যায়। তাই সেই তনু ভাগবতী তনু, আর সেই তনুর অধিকারী ভগবান।

জিজ্ঞাসু— আপনার কাছে আমরা যেমন সুন্দর সুন্দর কথাগুলো শুনি, তেমনি যতবার মহাপুরুষগণ শরীর নেন, ততবারই মানুষ সুন্দর সুন্দর কথা শোনে, লিখেও রাখে ফলে পরবর্তীতেও বহু মানুষ পড়ে তা জানতে পারে, শিখতে পারে। তবু পৃথিবীতে এত হানাহানি, মারামারি, পরমাণু বোমা সঞ্চয়—যেন ধ্বংসের বাতাবরণসৃষ্টি হয়েছে। তাহলে এই সুন্দর পৃথিবী কি ধ্বংসই হতে বসেছে ?

গুরুমহারাজ—আপনি বললেন সুন্দর পৃথিবী বা পৃথিবী গ্রহটি সুন্দর। জানেন, যার ঠিক ঠিক সুন্দরের বোধ হয়েছে, সে বুঝতে পারে যে, যার মধ্যে সামগ্রিক harmony বা ঐক্যতান রয়েছে, তাই সুন্দর। তাই সুন্দর কখনও আংশিক হয় না—সমগ্ৰটাই বা সবকিছু মিলেই সুন্দর। ধারণা হল কি ? সেই অর্থে শুধু সৃষ্টি সুন্দর বা এই যে জগৎ দেখা যাচ্ছে এটি সুন্দর এমন নয়, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় সবকিছুর মধ্যে যে harmony রয়েছে, ঐক্যতান রয়েছে, সেইটা যখন আপনার বোধ হবে তখন-ই হবে ঠিক ঠিক সুন্দরের ধারণা। যে কোন মানুষই এই সুন্দরের বে।ব করতে পারে কিন্তু তারজন্য তার নিজের জীবনকে আগে harmonise করার প্রয়োজন। যার নিজের জীবনের প্রতিটি ছন্দ harmonise, সে এই মহাবিশ্ব প্রকৃতির harmony বা মা জগদম্বার সুন্দর রূপটির বোধ করতে পারবে।

সেই অর্থে পৃথিবীর কোন একটি অংশের রূপ বা ব্যক্তির রূপ বা কোন ঘটনা বা বিষয়কে ‘সুন্দর’ এই আখ্যা দেওয়া চলে না। “সত্যম—শিবম—সুন্দরম’, এই যে সুন্দরের কথা বলা হয়েছে সেটা আংশিক নয় সামগ্রিক। অর্থাৎ আরও ভালো করে বলতে গেলে বলতে হয় যা আপেক্ষিক তা সুন্দর নয়, যা চিরন্তন তাই-ই সুন্দর। একটা কথা রয়েছে, “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য”। কিন্তু পৃথিবী গ্রহে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের দৃষ্টি কোথায়—সবাই বিরোধ দেখছে তো ! ফলে স্থূলে আপনিও হানাহানি, মারামারি, রক্তপাত হিসাবে সেটাকেই প্রকটিত দেখতে পাচ্ছেন। জ্ঞানীরা জানেন এই হানাহানি, রক্তপাতের কারণটি কি ! কখনও দেখছেন কোন মহাপুরুষ হানাহানি, মারামারি বন্ধ করার জন্যই শরীর ধারণ করেছে বা এই নিয়ে গলা ফাটিয়েছে ? এটা তারা করেননি কারণ তারা এসবকিছুর মূল কারণটি কি তা জানেন। ভগবান বুদ্ধ ২৫০০ বছর আগে বলেছিলেন পৃথিবীর কসাইখানাগুলি বন্ধ হলেই যুদ্ধ বন্ধ হবে। কে শুনেছে তাঁর কথা ? আমি কি অস্ত্র হাতে লড়াই করতে পারতাম না অথবা রাজনীতির নেতা হতে পারতাম না ? আমি দেখলাম সমাজের unit হচ্ছে মানুষ। এই মানুষ যদি পরিবর্তিত হয়, সমাজ পরিবর্তিত হয়ে যাবে। তাই আমার এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বনগ্রাম নামক এক অখ্যাত গ্রাম থেকে কর্মকাণ্ড শুরু। দুটো-একটি লোক নিয়ে শুরু হয়ে অসংখ্য মানুষের কাছে এই বার্তাই পৌঁছে দিতে হবে যে, individual-কে harmonise হতে হবে তাহলেই সমাজ harmonise হবে। আর তখন প্রকৃতিরযে harmony রয়েছে তারও সন্ধান পাওয়া যাবে। তখনই বোঝা যাবে ঠিক ঠিক বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ব্যাপারটা কি ? আর হানাহানি- মারামারির কথা যেটা বলছিলেন, তাতে এখনই এই পৃথিবী গ্রহ ধ্বংস হবার কোন সম্ভাবনা নেই। পৃথিবী ধ্বংস হবার ব্যাপারটা কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা আবিষ্কারের উপর নির্ভর করে না, এর একটি Universal principle রয়েছে। এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অংশ হল এই পৃথিবী, পৃথিবীর সাথে এই সৌরমণ্ডল এবং সৌরমণ্ডলের সাথে পরবর্তী নক্ষত্রমণ্ডল—এইভাবে প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের মহাজাগতিক আকর্ষণ বা যোগাযোগ রয়েছে। সুতরাং পৃথিবী ধ্বংস হওয়া মানেই হচ্ছে সেই Universal principle-কে নাড়া দেওয়া। অন্যান্য নক্ষত্রমণ্ডলীতে যে উন্নত চিন্তার জীব রয়েছে, তারাও এগুলি লক্ষ্য রাখে, ফলে এখানকার কোন দেশ বা কোন বিজ্ঞানী ইচ্ছা করলেই পৃথিবীর মারাত্মক ক্ষতি কিছু করতে পারবে না।

জিজ্ঞাসু — যতরকমের যোগ রয়েছে, তারমধ্যে জ্ঞানযোগই কি শ্রেষ্ঠ ?

গুরুমহারাজ—যতরকমের বলতে কি বোঝাতে চাইছ মুষ্টিযোগও যোগ জান তো ? রাজযোগ, সাধারণত জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ এই চারটিকে প্রধান ধরা হয়। এখানে ‘যোগ’ অর্থে মিলন। আত্মা-পরমাত্মা বা ভক্ত-ভগবানের মিলনই হ’ল যোগ। আর তার জন্য যে সাধন বা ভজন—এটাই যোগাভ্যাস। দ্যাখো, পূর্ণতাপ্রাপ্ত হওয়া বা আনন্দলাভ-ই তো জীবের উদ্দেশ্য। তাই যে কোন মানব তার নিজ নিজ স্বভাব বা প্রকৃতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে সেই অনুযায়ী যে কোন একটা ‘যোগমার্গ’ অবলম্বন করে এগিয়ে চলে পূর্ণত্বের দিকে। ধ্যানীর ধ্যানে আনন্দ, জ্ঞানীর জ্ঞান-বিচারে বা জ্ঞানলাভে আনন্দ, প্রেমীর প্রেমলাভে আনন্দ হয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় জ্ঞানযোগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এক জায়গায় বলেছেন—জ্ঞানীভক্তই আমার সবচাইতে প্রিয়, আমার মন হয়—আপনি ওখান থেকেই জিজ্ঞাসাটা করছেন। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে জ্ঞানযোগ তো সবার জন্য নয়। প্রতিটি ব্যক্তিরই পৃথক পৃথক স্বভাব বা প্রকৃতি রয়েছে। স্ব-ভাব অর্থাৎ নিজ নিজ ভাব রয়েছে। এইটি সূক্ষ্ম অবস্থা, এরও উৎসে কারণ অবস্থা রয়েছে। যে ব্যক্তিটি দেখা যাচ্ছে তিনি ঐ কারণ ও সূক্ষ্ম অবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাই যে কোন মন্ত্র বা যে কোন যোগ বা সাধনা যা কারণ বা সূক্ষ্ম অবস্থার অনুকূল নয়—তা ঐ ব্যক্তির ইষ্ট না হয়ে অনিষ্ট হয়ে যাবে। এইজন্যই সদগুরু উপযুক্ত আধারে উপযুক্ত সাধনপদ্ধতি বা মন্ত্র দেন। অধিকারী ভেদে কেউ কর্মযোগী, কেউ জ্ঞানযোগী কেউ ভক্তিযোগী ইত্যাদি হয়—সবাই ইচ্ছা করলেই অন্যরকম হতে পারে না। আর হবেই বা কেন, স্ব-স্বভাব অবলম্বন করেই তো আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্ভব হয়, অন্যের অনুকরণ করতে গিয়ে বা জোর করে অন্য ভাব অবলম্বন করতে গিয়ে নিজের অনিষ্ট ডেকে এনে লাভ কি ?

জ্ঞানীর জ্ঞানবিচার কেমন জানো তো। জগতের সবকিছুই কল্পনামাত্র। এরা যোগী অর্থাৎ রাজযোগীদের বলে ‘মর্কট’, ভক্তের ভক্তিকে বলে ‘রোগ’। উপনিষদে রয়েছে—“পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচাতে, পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে”—অর্থাৎ “উহা পূর্ণ, ইহাও পূর্ণ, পূর্ণ থেকে পূর্ণ-ই পাওয়া যায়, পূর্ণের পূর্ণত্ব গ্রহণ করলে পূর্ণই অবশিষ্ট থাকে।” জ্ঞানযোগী একথা জানেন বা তাঁর ধারণা রয়েছে যে, তিনি পূর্ণ, তবু যেহেতু তাঁর এই পূর্ণের বোধ নেই, পূর্ণত্বলাভ হয়নি, তাই সাধনা। এই অতৃপ্তিই সাধনার কারণ। পূর্ণের-ই পূর্ণত্ব লাভের বাসনা আবার যখন পূর্ণত্ব লাভ হয়ে যাচ্ছে তখন বোধ হচ্ছে সবই কল্পনা। এ যেন ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’ গল্পে– “কত রঙ্গ দেখালি শেষে তো তুই সেই পদি !” গল্পে রয়েছে পদির বর্মিবাক্সে নানান রঙ, নানান সাজপোশাক, সে সব রঙ-চঙ মেখে, জমকালো সাজ-পোশাক পরে তার নানান কসরৎ। অবশেষে রঙচঙ সাজপোশাক খুলে যখন সে সাধারণ পোশাকে সকলের সামনে এসে দাঁড়াল, তখন সবাই অবাক হয়ে বলে উঠল— “ওমা, এ যে আমাদের পদি।’ পদি সেই পদি-ই ছিল মাঝখানে কিছু রঙ্গ-তামাসা হয়ে গেল। সাধকের বোধ যখন হয় তখনও ব্যাপারটি কিছুটা এরকমই হয়।

জিজ্ঞাসু- গুরুর পা ধোয়া জল খাবার একটা রেওয়াজ রয়েছে, এতে কি উপকার কিছু হয় ? বরং পা-ধোয়া জলে নোংরা, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া থেকে তো শিষ্যের শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনাই প্রবল ?

গুরুমহারাজ—দ্যাখ্ রীতি-রেওয়াজ এগুলো বহুদিন থেকে চলে আসা ব্যাপার। প্রতিটি মানুষ তার নিজ নিজ স্বভাব বা প্রকৃতি অনুযায়ী চলে। তুই যে ভাবে বিচার করছিস, সব মানুষ কি তোর মতোই তা করে ? করে না–করবেও না। তুই যদি আজ থেকে এই ব্যাপারে আন্দোলন শুরু করিস–মিছিল বের করিস, তাহলে কিছুমানুষ তোর কথা শুনলেও সবাই শুনবে না বা মানবে না। স্বপক্ষ, বিপক্ষ, নিরপেক্ষ তিন ধরণের মানুষ রয়েছে। যখনই তুই কোন প্রতিবাদ- আন্দোলন ইত্যাদি করবি, দেখবি কিছু মানুষ তোর দলে ঢুকে গেছে, কিছু মানুষ তোর বিরোধ করছে, আর কিছু মানুষ silent রয়েছে। আমি এসব ব্যাপার জানি, মানুষের স্বভাব সম্বন্ধেও আমার ধারণা রয়েছে। আমি জানি মানুষের চেতনার বিকাশ না ঘটলে স্বভাব বদলায় না, তাই আমি সার্বিকভাবে প্রতিবাদ করিনা। তবে কখনই আমি আমার কাছে যারা আসে তাদের এ ব্যাপারে উৎসাহিতও করি না। আবার অতি উৎসাহীকে নিরস্তও করি না।

তবে তুই hygienic point of view থেকে যে কথা বলছিলি অর্থাৎ গুরুর পা ধোয়া জল খেলে শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনা, সেটার উত্তরে আমি বলব – যা তো hospital-গুলোর খবর নিয়ে দ্যাখতো আজ পর্যন্ত কতহাজার রোগী গুরুর পা-ধোয়া জল খেয়ে কলেরা বা ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ? কিন্তু খবর নিয়ে দ্যাখ রাস্তার ধারে তেলেভাজার দোকানের বাসি খাবার খেয়ে, বিষাক্ত মদ খেয়ে বহু লোক hospital-এ ভর্তি হয়, মারাও যায়। তোর মত young ছেলেরা কোথায় এই সবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবি, তা নয় কি নিয়ে প্রতিবাদ করতে এলি ? তোর মতো স্বাস্থ্যসচেতন ছেলে, বাসি- পচা খাবারের বিরুদ্ধে, খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের বিরুদ্ধে প্রচার চালাবি, পথে নামবি তা নয় এখানে নিরীহ সাধুর আশ্রমে এসে বুলি আওড়াচ্ছিস্? তোকে চোখে আঙুল দিয়ে, পরিসংখ্যান দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম, এবার সত্যি সত্যি কিছু কর্ তো দেখি ?

এবার যা বলছি সেটা মনোযোগ দিয়ে শোন—যদি নিষ্ঠা- ভক্তি-শ্রদ্ধা সহকারে কোন ব্যক্তি তার গুরুর বা বাবা-মায়ের পা- ধোয়া জল পান করে, তাতে কি তার ক্ষতি হতে পারে বরং তার মঙ্গল-ই হয়। বিশেষত সদগুরু বা প্রকৃত আধ্যাত্মিক গুরু কিভাবে শিষ্যকে শক্তি সঞ্চার করেন—তা তোর ওই মোটামাথা দিয়ে আর ঐটুকু hygienic sense দিয়ে কি করে বুঝবি বলতো ?

আগ্রার রাধাস্বামী পরম্পরা রয়েছে, সেখানে গুরুদেবের স্নান- জল শিষ্যরা সংগ্রহ করে রাখে, বিপদে-আপদে তা পান করে। তাদের বিশ্বাস এতে রোগ-আরোগ্য হয়। এমনিতেও বিভিন্ন দেব-দেবীর স্নান-জলের বিধি রয়েছে, এক্ষেত্রে দেবতার মূর্তি না হয়ে কোন ব্যক্তির স্নান-জল—এই যা তফাৎ। দেওঘরের অনুকুলচন্দ্র ঐ একই ঐ পরম্পরার গুরুদেব। তিনি এখন শরীরে নেই, কিন্তু ওনার পরম্পরা রয়েছে, ওরাও বড় বড় গামলায় বসে স্নান করে। কারণ ওদের শিষ্যসংখ্যা বেশী ফলে স্নান-জলের demand-ও বেশী। তবে এ ব্যাপারে সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে দলাই-লামা। তিব্বতীদের বিশ্বাস দলাই-লামার ‘গু’ নাকি মহৌষধি। তাই দলাই লামার ‘গু’ শুকিয়ে পুরিয়া করে রাখা হয়, তার শিষ্য-ভক্তদের জন্য। এটা বিভিন্ন দেশে বিক্রিও হয় বেশ চড়া দামে।

আশাকরি ব্যাপারটা তোকে বোঝাতে পারলাম । যা না, একবার ঐগুলির প্রতিবাদ করে দ্যাখতো; গায়ের চামড়া আর হাড় আলাদা আলাদা হয়ে যাবে, বুঝলি ? তাই যা বলছি মন দিয়ে শোন —মানুষ তার নিজ নিজ সংস্কার, প্রচলিত বিশ্বাস সর্বোপরি তার নিজ প্রকৃতি বা স্বভাব অনুযায়ী কর্ম করে বা সেইরকম ধর্ম আচরণকে ভালোবাসে। অর্থাৎ তার জীবনের সবকিছুকেই সে নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী নির্বাচন করে নেয় বা সাজিয়ে নেয়। তুই হয়তো জানিস না, আমি অনেককে জানি যারা হিন্দু হয়েও মুসলমান রীতি-নীতি পছন্দ করে, তাদের খাদ্য-খাবার খায়, তাদের সঙ্গে বেশী মেলামেশা করে। আবার অনেক মুসলিম রয়েছে যারা হিন্দুর রীতি-নীতি বা সংস্কৃতিকে ভালোবাসে, ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দের ফটো রাখে, হিন্দুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। এগুলো কি বলবি ? এগুলিকেই বলা হয় নিজ-নিজ সংস্কার বা প্রকৃতি। এই ব্যাপারগুলো না বুঝে যদি তুই বিরোধ বা প্রতিবাদ করিস, তাহলে সংঘর্ষ হবে। সমাজে যত অশান্তি-সংঘর্ষ, হানাহানি তার বেশীর ভাগের কারণ এটাই। যখনই কোন শক্তিশালী মানুষ ভাবছে বাকীদের তার স্বমতে আনবে তখনই গণ্ডগোল শুরু হচ্ছে। কখনই সবাই একমতে আসবে না, কারণ স্ব-ভাব ভিন্ন। কিছু মানুষ স্বার্থের জন্য, কিছু আদর্শের জন্য, ধর্মীয় বিধি-নিষেধের জন্য বা হয়তো আবেগ-উচ্ছাসের জন্য এক জায়গায় জড়ো হয়, গড়ে ওঠে মজহব বা সম্প্রদায় অথবা দল। পরে আবার তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়—এই রকমটাই চলছে।

কিন্তু প্রকৃত আধ্যাত্মিক গুরুরা কখনই শিষ্যের ক্ষতি করেন না বরং তাঁরা কি করেন তার পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার হয় না—এই কথাটা তুই বুঝতে পারবি না। সদগুরু যখন শিষ্যকে দীক্ষা দেন, তখন তার ১৬ জন্ম দেখে নেন। তিনি জানেন কোন্ শিষ্যের কিপ্রকৃতি, সেই প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি প্রতিটি individual-এর পৃথক পৃথক মন্ত্ৰ selection করেন। তাতে করে স্বভাব বা প্রকৃতি অক্ষুণ্ণ রেখে সে Perfection-এর দিকে এগিয়ে যেতে পারে। তিনি কখনই কোন বিরোধ করেন না আর শিষ্যরা যাতে বিরোধে না পড়ে তারও ব্যবস্থা করেন। আর সর্বোপরি সদগুরু কখনই কোন শিষ্যের দোষ ধরেন না। ভুল করলে হয়তো বকাবকি করেন কিন্তু তা অন্তরে পোষণ করেন না। কারণ তা করলে শিষ্যের অকল্যাণ হতে পারে, তাই তিনি দোষদৃষ্টি পরিহার করেন।