জিজ্ঞাসু—জুডো, ক্যারাটে এইসব বর্তমানে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, কিন্তু এব্যাপারে ভারতবর্ষ তো অনেকটাই পিছিয়ে —ভারতীয়দের এরূপ উদাসীনতার কারণ কি ?

গুরুমহারাজ—ভারতবর্ষ উদাসীন তুমি কি করে জানলে ? বিদেশী মার্শাল art-এর cenema-গুলোতে চীনা, জাপানি, কোরিয়ান আর ইউরোপীয়ান বা আমেরিকানরা অভিনয় করে, কোন ভারতীয়রা অভিনয় করে না, এটা দেখে তোমার এই ধরণের চিন্তা মাথায় ঢুকেছে। বহির্বিশ্বে martial art-এর শিক্ষা প্রথম যায় ভারতবর্ষ থেকে। সন্ন্যাসী পরম্পরায় বা গুরু পরম্পরায় বহুকাল আগে থেকেই ভারতে এই বিদ্যা চালু ছিল। মহাকাব্য বা পুরাণের উন্নত চরিত্রগুলোকে দেখ— দেখতে পাবে এদের প্রায় সকলেই martial art-এ বিশেষ পারদর্শী ছিল, রাম, কৃষ্ণ, ভীষ্ম, অর্জুন, কর্ণ এরা কত যুদ্ধকলা বিশারদ, শরীরের কি অসাধারণ গঠনশৈলী এবং কত smart ও expert ! কিন্তু মজার কথা এই যে, এদের শিক্ষাগুরুরা সবাই ছিলেন সন্ন্যাসী কিংবা নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে যে, গুরুপরম্পরায় এই শিক্ষা বাহিত হ’ত। উপযুক্ত শিষ্য পেলে গুরুরা শিক্ষা দিতো, নাহলে দিতো না। কর্ণ এবং একলব্যকে অস্ত্রশিক্ষা না দেবার জন্য দ্রোণাচার্যের নামে কত কলঙ্ক রটে গেল। কিন্তু না শেখাবার পিছনে কারণ কি ছিল বলো তো—বিশেষ অস্ত্রশিক্ষা সাধারণত ব্রাহ্মণ এবং উপযুক্ত ক্ষত্রিয় ছাড়া আর কাউকে শেখানো হত না। এতে শিক্ষায় অপ-প্রয়োগ হবার সম্ভাবনা ছিল। তাই তৎকালীন অস্ত্রগুরুদের সঙ্কল্পই ছিল অস্ত্রবিদ্যা শেখাবে না। তাহলে বেচারা দ্রোণের কি দোষ বল ! পরশুরামও কর্ণকে অস্ত্রবিদ্যা শেখাতো না, যদি কর্ণ মিথ্যা করে তাকে ব্রাহ্মণের পরিচয় না দিতো। তখনকার দিনে যে কোন মানুষ সাধারণ অস্ত্রবিদ্যা শিখতে পারতো কিন্তু ব্রহ্মাস্ত্র, পাশুপত অস্ত্র, এইসব বিশেষ অস্ত্রের প্রয়োগবিধি সাধারণকে জানানো হোত না। ঐসব মারাত্মক অস্ত্র অধিগত হলে অহংকার জন্মাবে এবং শক্তি প্রদর্শনের অদম্য স্পৃহায় সে ঐসব ভয়ঙ্কর অস্ত্রের যেখানে সেখানে প্রয়োগ করে দেবে। বর্তমানে পরমাণু অস্ত্র নিয়ে গোটাবিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো যে control করতে চাইছে, সেটারও কারণ এটাই। তমঃপ্রধান বা তমঃ-রজঃপ্রধান দেশনেতার হাতে যদি পরমাণু অস্ত্র থাকে, তাহলে সে কথায় কথায় অন্যদেশে সেই অস্ত্র প্রয়োগ করে দেবে। কর্ণের সাধনালব্ধ একামি বাণটি প্রয়োগ করার জন্য দুর্যোধন কতবার যে আব্দার করেছিল তার ঠিক নেই। গোধন চুরি করার সময়েও বলেছিল ঐ অস্ত্রটা প্রয়োগ করতে। কিন্তু কর্ণ আদপে তো ক্ষত্রিয় আর তাছাড়া সে সাধকও ছিল, তাই ওর চরিত্রে ধৈর্য বা সংযম বিদ্যমান ছিল। স্থানে স্থানে হেরে যুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসেছে কিন্তু ঐ বাণটি প্রয়োগ করেনি। শেষে ঘটৎকচকে মারার জন্য বাধ্য হয়ে বাণটি ব্যবহার করতে হ’ল, আর সেই সুযোগে কূটকৌশলী কৃষ্ণের কৌশলে অর্জুন রক্ষা পেয়ে গেল।

যাইহোক এই বিদ্যা ভারত থেকে কিভাবে বহির্বিশ্বে ছড়াল তার ইতিহাসটা বলছি শোন :-

ভগবান বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর ২০০ বছর কেটে গেছে। চীনে তখন মিঙ্ বংশের রাজারা রাজত্ব করছে। তখনই ভারতীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা চীনে ধর্ম প্রচারের জন্য প্রথম যাতায়াত শুরু করেছিল। সময়টা আজ থেকে প্রায় ২২০০-২৩০০ বছর আগের ঘটনা। ভারতবর্ষে তখন সবে আলেকজাণ্ডার আক্রমণ করে গেছে, মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছে এইরকম সময়। তখন স্থলপথে চীনদেশ যাবার রাস্তা তিব্বতের লাসা হয়ে, কুয়েনলুন পর্বতমালার পাশ দিয়ে কিছুটা মরুভূমি অধ্যুষিত অঞ্চল পার হয়ে চীনের রাজধানীতে পৌঁছানো যেতো। কয়েক হাজার মাইল দুর্গম, পার্বত্য আর মরুভূমি অধ্যুষিত পথ। চীনে রাজতন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে থাকলেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে গোটা দেশ বিভক্ত ছিল। আর যেহেতু চীনে সমভূমির পরিমাণ খুবই কম তাই খাদ্যশস্য উৎপাদনও ওদেশে হোত খুবই নগণ্য। ফলে সাধারণ মানুষের অভাব-অনটন লেগেই থাকত। এইজন্যই বিভিন্ন জনজাতি তখন ছিল লুটেরা, যাযাবর ইত্যাদি। তাহলে বুঝতেই পারছো সেইসময় যে সমস্ত মানুষেরা পায়ে হেঁটে এইদেশ থেকে ওদেশে যেতো, তাদের সাথে খাদ্য-বস্ত্র এবং অবশ্যই সঙ্গে কিছু মুদ্রা থাকত শরীর রক্ষার জন্য। এইগুলির লোভে লুটেরারা পর্যটকদের মেরে ফেলতো। তাই তখনকার দিনে রাস্তাঘাটে বের হলে দলবদ্ধ ভাবে যেতে হোত এবং নিজেদেরকেও শুধু শাস্ত্রবিদ্যায় নয় শস্ত্রবিদ্যাতেও পারদর্শী হতে হোত। চোর, তস্কর, লুটেরা, হিংস্র জন্তু-জানোয়ার সবার হাত থেকে বেঁচে সে দেশে পৌঁছে বুদ্ধের বাণী প্রচারের জন্য তাই বৌদ্ধ শ্রমণেরা সকলেই martial art শিখত। প্রথমদিকে বৌদ্ধ শ্রমণদের মধ্যে এই বিদ্যার প্রয়োজন হয়নি। বুদ্ধের শিক্ষা ছিল শ্রদ্ধা, করুণা, প্রেম- অহিংসা। ভারতবর্ষ এবং এই উপমহাদেশে এই অস্ত্রগুলিতেই বেশ কাজ হচ্ছিল। কিন্তু দুর্ধর্ষ মঙ্গোলিয়ান দেশগুলিতে ঐ অস্ত্রগুলি কাজ করল না। শ’য়ে শ’য়ে বৌদ্ধ শ্রমণ মারা পড়তে লাগল। তখন শ্রমণেরা মহাসংগীতীর কাছে চীনদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের অন্তরায়ের কথা সবিস্তারে জানাল। মহাসংগীতী order দিল—“আত্মনোমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ কাজ করতে হবে, বাধা এলে বাধা দূর করো।” ব্যস্ অনুমতি পাবার সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে গেল শরীরচর্চার মহা মহা কেন্দ্র, আর সে কি Practice! চীনের সেইসময়কার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব, অরাজক অবস্থা প্রায় civil war-এর পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা যখন মার্শাল art-এ expert হয়ে ওদেশে ঢুকল, থামিয়ে দিয়েছিল ওদের civil war । বিভিন্ন ভারতীয় পরম্পরার সন্ন্যাসীসংঘ মারের চোটে ওদের ভূত ভাগিয়ে দিয়েছিল, ভূত অর্থে এখানে ভেগেছিল দুষ্কৃতীরা। গড়ে উঠল Saolin, Ninza প্রভৃতি সন্ন্যাসীদের martial art-এর শিক্ষাকেন্দ্র, ক্যারাটে, কুংফু এগুলো সবই প্রাচীন ভারতীয় বিদ্যা, ওদেশে গিয়ে হয়তো একটু পরিবর্তন হয়েছে বা কিছু addition, alteration হয়েছে।

কালক্রমে সাধারণ মানুষও ওইসব শিক্ষাকেন্দ্রগুলি থেকে martial art-এর পাঠ নিতে শুরু করল। সাধারণ মানুষদের মধ্যে যারা বদ বা লোভী তারা বাইরে গিয়ে Institution তৈরী করে নতুন নতুন শিক্ষাকেন্দ্র চালু করল। এটা ছিল তখনকার দিনে পরসা রোজগারের ভালো মাধ্যম। ফলে কিছুদিন পর থেকেই শুরু হোল গণ্ডগোল, সন্ন্যাসী পরম্পরা বনাম বাইরের যোদ্ধা। সাওলিনের বিভিন্ন সিনেমা বা ‘ব্রুস লি’-র সিনেমা এগুলোর বিষয়বস্তু থেকেও সেইসময়ের চিত্র বোঝা যায়। যাইহোক এবার সমস্যা শুরু হোল, একই রকম কৌশল দিয়ে সন্ন্যাসীরা বাইরের fighter-দের মোকাবিলা কি করে করবে ? শুরু হোল research, কুংফু দিয়ে ক্যারাটাকে রোখা গেল, কিন্তু কুংফুকে কি দিয়ে resist করবে ? সন্ন্যাসীরা গভীর সাধনা থেকে আবিষ্কার করলেন “তাই-চি”, “তাই বা তাও” মানে বাউল আর ‘চি’ মানে পথ অর্থাৎ “বাউল পথ”। তাও বা সন্ন্যাসীদের এটা একটা বিশেষ শিক্ষা—সাধারণ মানুষ এই বিদ্যা চট্‌ করে আয়ত্ত করতে পারবে না। কারণ এর জন্য বেশ কয়েক বছরের একান্ত নিষ্ঠা, সংযম ও সাধনা প্রয়োজন, আর তার সঙ্গে প্রয়োজন অটুট ব্রহ্মচর্য। রীতিমতো ধ্যান, প্রাণায়াম রপ্ত হলে তবে “তাই চি’-র পাঠ দেওয়া হয়। আগুনের সামনে বসে মনঃসংযোগ শিখতে হয়, ফাঁকা জায়গায় বাতাসের কথা বা তার ভাষা আয়ত্ত করতে হয়। প্রকৃতির পাঠশালায় সমস্ত পাঠ সম্পন্ন হলে তখন চোখ বন্ধ থাকলেও পারিপার্শ্বিক সমস্ত কিছু বোঝা যায়—প্রতিপক্ষ কেমন, কোন অস্ত্রে আঘাত আসছে, কোন অঙ্গে তা target হচ্ছে—এসব বোঝা যায়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুলে যাওয়ার একটা কথা চালু আছে না— এই ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম। সাধারণত এই বিদ্যা যারা শিখত তারা monk হয়ে যেতো। তবুও হয়তো কেউ কেউ বাইরে পালাতো। তারা আবার সমস্যা সৃষ্টি করত। Bruce Lee. এই ধরণেরই একজন, পরে ও অকালে মারা গেল। প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশ্বাস- ঘাতকতার তো একটা শাস্তি রয়েছে !

যাইহোক পরবর্তীকালে শুধু সন্ন্যাসী পরম্পরায় নয়, মার্শাল art শিখে সাধারণ মানুষেরাও সমাজে বিভিন্ন Institution করে জুডো, কুফু, ক্যারাটে শেখাচ্ছে। Survival Camp – নাম দিয়ে বিভিন্ন Private কোম্পানি ইউরোপ আমেরিকায় এইসব Institution তৈরি করে প্রচুর পয়সা রোজগার করছে। সরকারিভাবেও martial art- এর training দেওয়া হয় মিলিটারী বা কম্যাণ্ডোদের। বহুদেশ ter- rorist তৈরি করছে এসব training দিয়ে, পরে অবশ্য তারাই এর কুফল ভোগ করছে। কারণ terrorist দের training এত মারাত্মক যে, ১০ জন terrorist কম্যাণ্ডো একটা দেশকে বিশৃঙ্খল করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট ! ভাবো একবার । মন্ত্রীদের body guard হিসাবে যে Black cat-রা থাকে তারাও কম মার্শাল art বিশারদ নয়, এরাও কম্যাণ্ডো। কিন্তু terrorist কম্যাণ্ডোদের কাছে এরাও ১০ : ১।

তবে এখন যে martial art নিয়ে আজকাল এত ব্যবসা হচ্ছে এর খারাপ দিকও রয়েছে, bad utilisation হচ্ছে—এগুলো ভারতীয় ঋষিগণ আগেই বুঝেছিলেন। সেইজন্য তাঁরা গোপন শস্ত্র- বিদ্যা সব সময়তেই গোপন রাখতেন। উপযুক্ত শিষ্য ছাড়া শেখাতেন না। কর্ণ, একলব্য-র reference আগেই দিয়েছি, ওরা বীর ছিল, ওদের নিষ্ঠা বা গুরুভক্তিরও অভাব ছিল না, তবু উপযুক্ত গুরুরা ওদের শস্ত্রবিদ্যা শেখালেন না। দ্রোণাচার্য নিজের ছেলে অশ্বত্থামাকে যেসব বিদ্যা শেখাননি, তা শিখিয়েছিলেন অর্জুনকে, এটাই পরম্পরা। মারাঠাবীর শিবাজীকে martial art শিখিয়েছিলেন তাঁর গুরু সমর্থ রামদাস। মুঘলদের সাথে যুদ্ধে শিবাজী নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে একলাফে ১০/১৫ ফুট দূরের অশ্ব বা অশ্বারোহীকে টপকে পালিয়ে গিয়েছিলেন দু-একবার। সশস্ত্র আফজল খাঁকে নিরস্ত্র অবস্থায় শুধু বাঘনখ ব্যবহার করে মেরে দিলেন। শিখগুরু গোবিন্দ সিং অমরনাথ যাবার পথে হিমালয়ে নিভৃত স্থানে শক্তিলাভের জন্য তপস্যা করেছিলেন। তার মানে এটাই দাঁড়ায় যে, তিনি কোন সংঘের নিকট martial art-এর কায়দা-কানুন শিখেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে অসুর দমন করেছিলেন দেবী দুর্গা, আজও কোন কিছুতে জয়লাভের জন্য দেবীপূজার বিধান রয়েছে। দেবী দুর্গার প্রাচীন মূর্তিগুলি দেখেছ— দেবীর চোখে-মুখে প্রসন্নতার ভাব, কিন্তু দশহাতে ভয়ঙ্কর অস্ত্রসমূহ। এটাই তাই-চির রহস্য। তাইচি-র মাষ্টাররা, কখনও কোন পরিস্থিতিতেই উদ্বিগ্ন হ’ন না। সবসময় মাথা ঠাণ্ডা, কারণ ব্যবহারিক জীবনে সংযমের শিক্ষা রয়েছে, ধ্যান ও প্রাণায়ামের অভ্যাস রয়েছে। এঁদের এত মনঃসংযোগ যে, শুধু সামনে নয়—পিছনেও দেখতে পান। কোন অস্ত্রের আঘাত, কোন angle থেকে, কতটা hieght-এ আসতে পারে, তা বুঝে সেইমত defence করে বা attack করেন। তবে সবচাইতে মজার ব্যাপার হ’ল এই যে, তাইচিতে defence করার অর্থই হ’ল তা প্রতিপক্ষের কাছে প্রত্যাঘাত। প্রতিপক্ষ যে আঘাত যতজোরে হানার চেষ্টা করে, তাই-চি-র defence-এ সেই আঘাত ততটা জোরে প্রতিপক্ষকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়।

আমি একবার আশ্রমের ভক্তদের সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে উড়িষ্যার কোণারকে গিয়েছি। ওখানে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব্য-র সাথে গল্প করছিলাম। হঠাৎ একটা বড় ষাঁড় আমাকে পিছন থেকে running-এ শিং-এ করে ধাক্কা মারার চেষ্টা করল। কিন্তু ষাঁড়টা আমার শরীরের পশ্চাৎ ভাগে touch করার আগেই বা অন্যেরা কেউ সতর্ক করার আগেই আমার চেতনা আমার দেহকে এমন position-এ নিয়ে গেল যে, সেই অবস্থা থেকে ষাঁড় কেন বাঘের সাথেও লড়াই করা যায়। এখানেই বসে আছে এমন অনেকেরই চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটেছিল। ওরা দেখছিল যে, আমাকে ষাঁড়টা প্রচণ্ড জোরে পিছনে শিং দিয়ে ধাক্কা মেরেছে আর আমি মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছি—ওরা ছুটে কাছে আসার আগেই আমি ষাঁড়টার ঘাড়ে একটা ঘা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলাম। প্রয়োজনে ওর ঘাড়টা ভেঙেও দিতে পারতাম। কিন্তু দেখলাম ষাঁড়টা লজ্জিত হয়েছে তাই কিছু বলিনি। হিমালয়ে ঘোরার সময় তিব্বতে এক বৌদ্ধসংঘে আমি কিছুদিন তাই-চি শিখেছিলাম। তাতেই যা রপ্ত হয়েছে সমাজজীবনে চলাফেরায় সেটা আমার অনেকসময় কাজে লাগে।

জিজ্ঞাসু—ভারতবর্ষে বেশ কিছু উপদ্রুত অঞ্চল আছে, যেখান থেকে প্রায়ই কোন না কোন গণ্ডগোলের খবর পাওয়া যায়। যেমন উত্তরভারতের মীরাটে দাঙ্গা-হাঙ্গামার খবর প্রায়ই Newspa per-এ পাই। এর কি কোন বিশেষ কারণ রয়েছে ?

গুরুমহারাজ-দ্যাখো, আমি তো তোমাদের বারবার বলেছি যে পৃথিবীতে বা মহাবিশ্বে অকারণে কোনকিছুই ঘটে না, সবকিছুরই কার্য-কারণ সম্পর্ক রয়েছে। পুরাণে রয়েছে ময়নগরের কথা। বর্তমান ঐতিহাসিকগণের অনেকের ধারণা পৌরাণিক ময়নগরই আজকের মীরাট। মহাভারতে গল্প রয়েছে শ্রবণকুমার নামে একটি যুবক তার বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে সেবা-শুশ্রূষা করাটাকেই জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিল। পিতামাতাকে তীর্থদর্শন করানো পুত্রের কর্তব্য বিবেচনা করে, শ্রবণকুমার একটা লম্বা শক্ত লাঠি (বা বাঁক)-র দু’দিকে দুটি ঝুড়ি দড়ির সঙ্গে ঝুলিয়ে একটায় বৃদ্ধ বাবা ও অন্যটায় বৃদ্ধা মাকে বসিয়ে তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করাতো, আর তীর্থে প্রাপ্ত ভিক্ষান্নে তাদের প্রতিপালন করতো। তার এই ঘুরে বেড়ানোর জীবনে একবার কি অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছিল বলছি শোন। শ্রবণকুমার পিতা-মাতাকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একদিন ময়নগরে এসে হাজির। পথশ্রমে শ্রান্ত-ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত শ্রবণকুমার তাঁদের এক গাছতলার ছায়ায় রেখে পাশের কোন জলাশয়ে গেল তৃষ্ণা নিবারণ করতে। ভালো করে হাত-পা-মুখ ধুয়ে একটু জলপান করে শ্রবণকুমারও গাছতলায় ফিরে এসে একটু বিশ্রাম করতে লাগল। কিছুক্ষণ তন্দ্রাবস্থায় থেকে তন্দ্রা কাটার পর শ্রবণকুমারের মনে নানান চিন্তার উদয় হোল। সে ভাবতে লাগল বুড়ো বাবা-মার সেবা-শুশ্রূষা করে যে সে জীবন কাটাচ্ছে, এতে তার লাভ কি হোল ? তার তো এ জীবনে সুখ-সাধ কিছুই মিটল না। বুড়ো-বুড়ি তো খুবই স্বার্থপর। সারাজীবন সুখ-ভোগ করছে, এখনও ছেলেটাকে খাটিয়ে নিচ্ছে নিজেদের সুখ- সুবিধার জন্য, ছেলের সুখের কথা একবারও ভাবছে না। তাহলে তো ওরা স্বার্থপর—ওদেরকে বয়ে বয়ে বেড়ানোর তো কোন মানেই হয় না—ত্যাগ করাই উচিত। —ইত্যাদি নানান চিন্তা তার মাথায় আসতে লাগল, এরপর শ্রবণকুমার উঠে গিয়ে পিতা-মাতাকে উদ্দেশ্য করে অত্যন্ত রূঢ়ভাষায় ভাবনায় আসা কথাগুলি বলতে লাগল। পিতামাতা হঠাৎ করে পুত্রের এই অদ্ভুত ভাবান্তর লক্ষ্য করে প্রথমটায় আশ্বর্যান্বিত হয়ে গেলেও বুঝতে পারলেন এর পিছনে নিশ্চয়ই কিছু রহস্য রয়েছে। শ্রবণকুমারের পিতা বৃদ্ধ হলেও ছিলেন মহাজ্ঞানী। তিনি ভৌগোলিক- জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন এবং জানতেন যে, ময়নগর এলাকার জল পেটে পড়লে মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হয়। তাই তিনি পুত্রের কথার বিরোধ না করে তাকে কাতরকণ্ঠে বললেন “হ্যাঁ, বাবা শ্রবণ কুমার ! সত্যিই আমাদের ভারী ভুল হয়ে গেছে। তা তোমার জীবনের এতটা সময় যখন নষ্ট হয়ে গেছে, তখন আমার অন্তিম ইচ্ছা তুমি আমাদের এই বিদেশ-বিভুঁয়ে ফেলে রেখে যেওনা, আমাদেরকে এই দেশের সীমা পার করে রেখে দিয়ে এস। তারপর তুমি যেখানে ইচ্ছা চলে যেও, আমরা বাধা দেবো না।” শ্রবণকুমার ভাবল সেই ভালো ! এত করে যখন বলছে, আর এতকাল যখন এতটা কষ্ট করাই গেল এটুকু আর কি। আবার ভারবোঝা কাঁধে তুলে শ্রবণকুমার হাঁটা শুরু করল। ময়নগরের সীমানা পেরিয়ে কিছুটা আসতেই শ্রবণকুমারের মনোজগতে পরিবর্তন আসতে শুরু করল। পিতা-মাতার প্রতি রূঢ়বাক্য প্রয়োগের কথাও মনে পড়ে গেল। “ছিঃ ছিঃ কি অন্যায় কি অপরাধ করেছি !’ পিতা-মাতার চরণ স্পর্শ করে কাঁদতে লাগল শ্রবণকুমার । বারবার তাঁদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল। তখন পিতা তাকে শান্ত হতে বলে –ময়নগরের মাটি ও জলের রহস্য বোঝালেন, ঘটনা শুনে এবং বাস্তবে নিজের জীবনে তার প্রয়োগ হতে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল শ্রবণকুমার।

এটা ছিল মহাভারতে বর্ণিত একটা গল্প। দুর্যোধন ছিল ঐ এলাকার শাসক। দোর্দণ্ড প্রতাপ, নিষ্ঠুর, আর কি স্বার্থপর ছিল বলোতো দুর্যোধন ! না হলে পিতৃকুলের মানুষদের হত্যা করার নেশায় মেতে ওঠে ! তাতে ফল কি হোল —নিজের দিকটাই ধ্বংস হোল, বিপক্ষদের দিকটাই বরং থেকে গেল। এখন ঐসব অঞ্চলে রয়েছে বেশীরভাগ জাঠ আর মুসলমান, কিছু অন্য সম্প্রদায়ের লোকও রয়েছে। আমি তো প্রায়ই ওখানে যাই। এখানকার দীক্ষিত ব্যক্তিও রয়েছে ওখানে। দেখেছি ওখানকার মানুষের পেশীশক্তি বা বাহুবল যতটা ততটা কিন্তু মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেনি। Cultural বা সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ কমই রয়েছে, হৃদয়বৃত্তির বিকাশও বেশী পাবে না। আমার সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের মধ্যে অবশ্য নানান পরিবর্তন এসেছে, তাছাড়া তাদের পূর্ব সংস্কারও রয়েছে। মীরাটে চণ্ডোলা পরিবারের ছেলে রয়েছে, মোদী কোম্পানীতে চাকরী করে, খুব গোঁড়া পরিবার। আমার সাথে আলাপ হবার সময় ওদের family-তে নানান সমস্যা ছিল, এখন অনেকটা মুক্ত। কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছিল অর্থনৈতিক সমস্যা মিটলেই পরিপূর্ণভাবে অধ্যাত্মজীবনে আশ্রয় নেবে। কিন্তু কথা রাখেনি, বাসনা ছাড়তে পারল না। ভগবান বুদ্ধ বলেছিলেন ‘তৃষ্ণা’, মানুষের ‘তৃষ্ণা’ অর্থাৎ কামনা ও বাসনা মানুষের মেটেনা। তাই আধ্যাত্মিক রাজ্যের taste আর পাওয়া হয় না। ছেলেটির কাকুরও প্রথমদিকে রোজগার ভালো ছিল, কিন্তু কিছু বিপর্যয় আসায় অর্থকষ্ট দেখা দেয়। ভদ্রলোক হেমাঙ্গিনী- (Alcohol)তে আসক্ত ছিল, অভাবে পড়েও ওটা ছাড়েনি। আমি যাবার পর ওর পরিবারের লোকজন আমাকে একটা ব্যবস্থা করে দেবার জন্য ধরল। আমি দেখলাম ও যে কাজ করছিল সেটা ঠিক suit করছিল না—ওর অন্য কাজ করা সংস্কারে রয়েছে। ফলে News paper-এর লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ায় এখন সেইকাজ করে উন্নতি করেছে। কিন্তু পরে খবর নিয়ে জেনেছি ‘হেমাঙ্গিনী’-র অভ্যাসটা এখনও রেখেছে।

ওদের ওখানে একটা ঘটনা ঘটেছিল –বৃন্দাবন থেকে একজন গুরুদেব ওদের পাড়ায় আসত। ধনী লোকজনদের গুরুদেব, ফলে সাধারণের বাড়ী বড় একটা যেতো না। গুরুদেবের শিষ্যরা রটাতো যে গুরুদেবের “রাধাভাব” এবং সেই ভাবের সাধনায় তিনি সিদ্ধ। গুরুদেব নাকি নারী হয়ে গেছে, নারীর মত সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনকি মাসিক ঋতুস্রাবও হয়। ওদের বাড়ীর ছেলেটি আমার ভক্ত, seat- ing-এ এই সমস্ত আলোচনা ও বিজ্ঞান, এগুলির অন্যান্য রহস্য এবং বেশীরভাগটাই যে ভণ্ডামি ও বুজরুকি এসবও অনেক শুনেছে। বিশেষত বৃন্দাবনে ঘোরার সময় আমি কতজন প্রকৃত সাধু দেখেছি সে গল্পও বলেছি। তাই বৃন্দাবনের গুরুর কথা শুনে ওদের জিদ চাপল—ব্যাপারটা দেখতে হয় । যে সব বাড়ীতে সেই গুরুদেবআসত, ওরা তাদের সাথে যোগাযোগ করল গুরুদেবকে নিজেদের বাড়ি আনতে,বাবার শিষ্যরা লম্বা ফিরিস্তি দিল—গুরুদেবকে বাড়ী নিয়ে যেতে কি কি খরচা করতে হবে, তার আলাদা list দিল। A.C ঘরে গুরুদেবকে রাখতে হবে, এইসব ভোগ দিতে হবে ইত্যাদি। ওরা রাজী হ’ল, একটা শর্তে, রাত্রে গুরুদেবকে ওদের বাড়ী থাকতে হবে, সকলেই ওরা ঐ গুরুদেবের শিষ্য হয়ে যাবে। গুরুদেব রাজী, যতই হোক ওরা তখন Modi কোম্পানীর বড় বড় post hold করছে। বড়লোক শিষ্যই গুরুদেবের দরকার। সন্ধ্যে থেকে খাওয়া-দাওয়া, ভজন-কীর্তন সমস্ত অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে গেল। গুরুদেবের অন্যান্য শিষ্যরা একে একে বিদায় নিল। এবার বাড়ীর পরিবারের লোকজন আর গুরুদেব একা। ছেলেগুলো এত বদ্ যে, ওরা বাড়ীর মায়েদের সরিয়ে দিয়ে গুরুদেবের জন্য ব্যবস্থা করা বিশেষ ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। এইবার আসল মূর্তি ধারণ করল—“খোল কাপড়, তুমি নাকি রাধাভাবে সিদ্ধ হয়ে নারী হয়ে গেছ। দেখি তোমার নারী- রূপ ! এদিকে তোমার প্রতিদিনকার কামানো দাড়ি, গোঁফ, আর ওদিকে নারীত্ব এটা তো হয় না ! দেখি তোমার নারীত্ব !” এই বলে কাপড়ে টান। গুরুদেব প্রথমে ধর্মভয় দেখাল, পরে অভিশাপের ভয় দেখাল, ওরা ছাড়ার পাত্র নয়। বলল, “আমাদের গুরুদেবের কাছে এসব শোনা আছে, অভিশাপ দেবার অধিকার না থাকলে অভিশাপ আমায় না লেগে তা তোমার কাছেই ফিরে যাবে। তাই ওসব ভয় করি না, খোল কাপড়।” ওসবে কাজ হল না দেখে গুরুদেব কাঁদতে লাগল। অতবড় নামকরা গুরুদেব কাঁদছে দেখে ওরা কাপড় টানাটানি বন্ধ করে দিল। বলল, “বল আসল সত্যটা কি ?” গুরুদেব স্বীকার করল যে, সে রাধাভাবের সাধক ঠিকই, কিন্তু এখনও সিদ্ধিলাভ বা ঐসব কিছু হয়নি। ওদের পরম্পরায় পূর্বে কোন গুরুদেবের শরীরে ঐ ধরণের কিছু পরিবর্তন হয়েছিল। ঐ পরম্পরায় যে যখন গুরুদেব হয় সেও ঐ পূর্বের গুরুদেবের স্থিতিতে উন্নীত বলে চালিয়ে যায়। এসব শুনে ওরা বলল “তাহলে মিথ্যা বলে লোক ঠকাচ্ছ কেন ? যদি ভালো চাও তো এক্ষুনি এই স্থান ত্যাগ করে তোমার ডেরায় ফিরে যাও, আর কখনো এমুখো হবে না ?” গুরুদেব কাতরকণ্ঠে বলল “তাহলে এই রাত্রেই তোমরা আমাকে ট্রেনে একটা টিকিট কেটে চাপিয়ে দিয়ে এস।” ওরা তাই করল। ঐ গুরুদেব আর ঐ অঞ্চলে কক্ষনো আসেনি।

এবার কথা হচ্ছে ওরা যে এই কাজটা করেছিল, ওরা কি এটা অন্যায় করল ? এরজন্য কি ওদের পাপ হবে ? দ্যাখো, পাপ কি—তার সংজ্ঞা স্বামী বিবেকানন্দ দিয়ে গেছেন—স্বার্থপরতা, অজ্ঞানতা আর দুর্বলতাই পাপ। তাহলে কোন ঘটনা ঘটলে যে ব্যক্তি দুর্বল হ’ল (মানসিকভাবে), পাপ বলে যদি কিছু থাকে, তাহলে তা তাকেই বর্তাবে, সবলকে নয়। তবে আমি পাপ-টাপের কথা বলি না, আমি বলি যে বেশী ‘পাপ’, ‘পাপ’ করে সেই পাপী । পাপ আবার কি ন্যায়- অন্যায় আছে, ভালো-মন্দ রয়েছে। আর রয়েছে ভালো কাজের ভালো ফল, মন্দ কাজের মন্দ ফল। যাইহোক আমি দেখছি জানো —পরমানন্দ-র ছেলেরা তথাকথিত সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ওদের মুখোমুখি হলে হয় ঐ ধরণের ‘ঢঙী সাধু’-রা স্থানত্যাগ করছে, নয় ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে নিজের ক্ষতি করছে। তবে এখানকার ছেলেরা যদি অন্যায়ভাবে তাকে উৎপীড়ন না করে, সত্য দিয়ে তার সাথে মোকাবিলা করে, তাহলে সেই ‘ঢঙী সাধু’ যতই ক্রোধ প্রকাশ করুক না কেন—এদের কোন ক্ষতি হবে না।