জিজ্ঞাসু—আশ্রমের নামকরণ কি হবে বা plot-গুলোর registration কি নামে হবে ?
গুরুমহারাজ—নামকরণ আবার কি হবে – পরমানন্দ মিশন, বারেন্দা শাখা আশ্রম। এটা মূল মিশনের শাখা আশ্রম হিসাবে কাজ করবে। সবসময় যোগাযোগ রাখবি। এই আশ্রমটিতে এসে আমার সামনেরটা গঙ্গার তীরবর্তী স্থান বলে মনে হচ্ছিল। পরে দেখলাম এখানে অজয়-উত্তরবাহিনী রয়েছে। শাস্ত্রে উত্তরবাহিনী নদীকে গঙ্গার সমতুল বলেছে, তাই গঙ্গা মনে হচ্ছে। মহাপ্রভুর সময় এই সমস্ত অঞ্চলে ভরা জোয়ারের সময় গঙ্গার জল উজানে এই সমস্ত স্থান পর্যন্ত আসত। ফলে তখন এই নদীকে গঙ্গার খুব একটা তফাৎ দেখত না এখানকার মানুষ। আর কত বৈষ্ণবের আশ্রম এদিকটায় ছিল। অনেক উন্নত বৈষ্ণবের সাধনস্থল এই অঞ্চল।
চৈতন্য পরবর্তী সময়ে নিতাইচরণ গোস্বামী নামে একজন পরম বৈষ্ণব এই স্থানে কুঠিয়া করে সাধন-ভজন করতেন। তাঁর অন্তরে একটি বাসনা ছিল যে, চর্মচক্ষে মহাপ্রভুকে দর্শন করা তাঁর তো আর হোল না, তবু এইস্থানে অর্থাৎ তাঁর সাধনাস্থলে যেন মহাপ্রভু আসেন, রাত্রি কাটান এবং কৃষ্ণকথা আলোচনা করেন—এই সমস্ত সংকল্প তাঁর অন্তরে এতই তীব্র ছিল যে, জীবনের শেষ দিনগুলিতে তাঁর নিরন্তর প্রার্থনা ছিল, “আমি তো আর দেখতে পেলাম না প্রভু যদি আগামীদিনের স্থানীয় মানুষের সেই সৌভাগ্য হয়—তাহলেই আমার শান্তি।” এই আশ্রমে ঐ উচ্চকোটির মহাত্মার সংকল্প এখনও বিদ্যমান। এই যে তোরা এখানে মানবকল্যাণমূলক কাজের জন্য এই আশ্রমটা করেছিস বা যারা এই স্থানটি দান করেছে – তাদের সকলের উপর ঐ মহাত্মার আশীর্বাদ রয়েছে । উনি খুবই প্রসন্ন হয়েছেন। এখানে প্রবেশ করেই ওঁর প্রসন্নতা আমাকেও touch করেছে।
এইভাবে আশ্রম স্থাপনের মতো কোন একটা ঘটনা যখন ঘটে, তখন উপস্থিত সকলে ভাবে ঐ ওখানে একটা ঘটনা ঘটল। কিন্তু যে কোন ঘটনার পিছনে যে কার্যকারণ সূত্রটি রয়েছে তার খোঁজ কে রাখে ? আর রাখবেই বা কি করে—তাহলে তো তাকে কালদ্রষ্টা হতে হয় । যাইহোক, এখানকার আশ্রমটি হয়ে গেল, এবার আমাদের বোলপুরের সন্নিকট একটা জায়গা দেখতে হবে। কারণ বোলপুরকে কেন্দ্র করে আমাদের মিশনের একটি শাখা হবে। -” আমি অনেককেই বলেছি কিন্তু কেউ এখনও successful হয়নি। তোরা একবার চেষ্টা করতো ! বোলপুর তো তোদের নিকটস্থ জায়গা, এখান থেকে যোগাযোগ কর, কোপাই নদীর কাছাকাছি একটা ফাঁকা জায়গা দ্যাখ্—ওখানে আমাদের একটা শাখাকেন্দ্র হবে, di- vine plan-এ রয়েছে।
জিজ্ঞাসু—আমাদের এখানে বোলপুরের একজন Bank- employee রয়েছে, তিনি আমাদের আশ্রমের ব্যাপারে খুব উৎসাহী, ‘চরৈবেতি’ পত্রিকার গ্রাহক, স্বরূপানন্দ মহারাজের সঙ্গে বিশেষ পরিচয় আছে, ওনাকে কি একবার বলে দেখা যাবে ?
গুরুমহারাজ—হ্যাঁ, কথা বলবি, যদি ভদ্রলোক বোলপুরের বাসিন্দা হয় তাহলে তো ভালোই হবে। খোঁজ-খবর করতে পারলে অনেক পরিচিতি বেরোবে।
জিজ্ঞাসু—তাহলে ওনাকে একবার এখানে নিয়ে আসব —আপনি তো কালকেও থাকছেন ?
গুরুমহারাজ—হ্যাঁ, হ্যাঁ নিয়ে আসবি, আমি কথা বলব। ওখানে আমাদের আশ্রমের একটা কেন্দ্র হবে—জানিস্ ! বীরভূম শক্তিক্ষেত্র, ওখানে মায়ের বিশেষ বিশেষ লীলার প্রকাশ ঘটেছে। আমি বীরভূমের বিভিন্ন প্রান্ত খুব ঘুরেছি, কত অভিজ্ঞতা। কত ভালো লোক দেখেছি আবার সাধু-সন্ন্যাসী, কাপালিক ইত্যাদির বেশে কত ভণ্ড, বদমাস্দের দেখেছি। আবার কিছু সাধক যারা negative সাধনা করে শক্তিলাভ করেছে—এমনও দেখেছি। এরা মানুষের ক্ষতি করে, সমাজের ক্ষতি করে, এদের দ্বারা ভালো কিছুই হয় না । আমোদপুর রেল-ষ্টেশনের কাছে এক মায়ের আশ্রমে ঐরূপ একজন আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল–ভেবেছিল আমাকে হারাতে পারলে আমার শক্তি ওর মধ্যে transfer হবে কিন্তু তাই কি হয় ? আমি তো সদা-সর্বদা মায়ের কোলে থাকি, দেখলাম বরং ওর শক্তিই ধীরে ধীরে শূন্য হয়ে গেল। তারাপীঠেও এক তান্ত্রিক ভৈরব নামিয়ে আমার ক্ষতি করতে চেয়েছিল, কিন্তু উল্টো ঘটনা ঘটেছিল—তান্ত্রিকেরই মুখ পুড়ে গেল ধুনির আগুনে।
ওসব কথা থাক, বোলপুরের কথায় আসি – বোলপুর সাংস্কৃতিক পীঠস্থান। রবি ঠাকুর স্থানটিকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়ে গেছেন। পরবর্তীতে আমাদের মূল মিশনে বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন স্তরের লোক আসবে, তারা বোলপুর-শান্তিনিকেতন দেখতে চাইবে, কেউ পড়াশুনা করবে বা কোন training করবে তখন বোলপুরে একটা shelter প্রয়োজন হবে। এছাড়া ওখানে আর কি কি হবে, তা মা-ই জানেন, সে সব কালের গর্ভে নিহিত রয়েছে।
জিজ্ঞাসু—বোলপুরে কি শিক্ষাকেন্দ্র হবে ?
গুরুমহারাজ—আগে তো একটা আশ্রম হোক। তারপর মায়ের ইচ্ছায় যা হবার তা হবে। তবে রবীন্দ্রনাথ যে সমস্ত উদ্দেশ্য নিয়ে আশ্রমটি গড়ে তুলেছিলেন এখন সেইসব সংকল্প কি সিদ্ধ হচ্ছে ? ভালো বা যোগ্য উত্তরসূরির অভাবে অনেক ভালো সংকল্প পরবর্তীতে নষ্ট হয়ে যায়। আবার কোন মহামানব সেই ভালো সংকল্পগুলিকে ধরে নিয়ে কাজ করে। শান্তিনিকেতন বা শ্রীনিকেতনের যে বিভিন্ন শাখা—বিশেষত Art এবং Agriculture, এগুলির বিভিন্ন stream-এ কতই বা seat? ফলে খুব মেধাবী ছাত্র এবং বাঁকাপথে ধনীর ছেলেরা সেগুলি দখল করে নেয়। কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্ত বা গরীব মেধাবী ছাত্রদের জন্যও তো ভাবতে হবে। আগামীতে আমাদের বনগ্রামের অনাথ ছাত্রসংখ্যা অনেক বাড়বে। প্রতিবছর ছেলেরা ওখান থেকে বেরিয়ে আসবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে। এরপর তোতারা যাতে করে কম্মে খেতে পায় তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। যারা higher education করতে চায়—তারা করবে, কিন্তু যারা হাতে- কলমে কাজ করতে চায় তাদের জন্য বিভিন্ন vocational course-এর ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া অনেকের হয়তো fine-arts-এ ঝোঁক, কারও গান, কারও নাচ, কারও কারুশিল্প, হস্তশিল্প, বিভিন্ন হাতের কাজ ইত্যাদি শেখার প্রবণতা রয়েছে, তাদের তো provide করতে হবে। যারা পরীক্ষা দিয়ে শান্তিনিকেতনে chance পাচ্ছে তাদের এগুলি হবে আর বাকীরা বঞ্চিত হবে ? তাই parallel Institution গড়ে তোলা বা যে কোন ভাবে হাতে নাতে কাজ শেখার ব্যবস্থা তো করতেই হবে। আমি রায়না আশ্রমকেও বলেছি জায়গা দেখতে। ওখানে বিভিন্ন para-medical course-চালু করার কথা বলেছি। যাতে ছেলে-মেয়েরা এমন কিছু শেখে তার ফলে তারা গ্রাম-গঞ্জের গরীব রোগীদের সার্বিক চিকিৎসা করতে পারে। এই course-এর শিক্ষাই গতানুগতিক শিক্ষা হবে না, যে রোগী যে পদ্ধতির চিকিৎসায় তাড়াতাড়ি সারবে বা সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হবে, তাকে সেই পদ্ধতিতেই চিকিৎসা করা হবে। Homeo, Allo, Nataro, Hidro, আয়ুর্বেদিক সমস্ত রকমের pathy-র শিক্ষা দেওয়া হবে এবং যে রোগ যে পদ্ধতির চিকিৎসায় দ্রুত সারে, সেই রোগীকে সেই চিকিৎসা করা হবে। প্রয়োজনে মিশ্র pathy ব্যবহার করা হবে। মানুষের কল্যাণ আমাদের লক্ষ্য। কোন বিশেষ মত বা মতবাদ অথবা পদ্ধতিতে আটকে থাকতে আমরা আসিনি। সবসময় মনে রাখবে আমরা স্বাধীন, কোন ism-এ আবদ্ধ নই। মানুষের ভালোর জন্য যেটা প্রয়োজন সেটাই করবি তোরা। বাউলভাবে বাউলরা নারীর মতো সাজে, চুল রাখে, ঝুঁটি বাঁধে, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে একসাথে নিরাসক্তভাবে কাজও করে। মুখে আল্লা, হরি, রাম, কালী, গড় সবার স্তুতিগান গায়। এবারে খানিকটা এইরকমই ভাব ৷৷