জিজ্ঞাসু – পৃথিবীতে ‘অবতার’ অনেক, কিন্তু তাঁদের কর্মপদ্ধতি তো কখনই একরকম নয় ?

গুরুমহারাজ – হবে কেন ? অবতার শত শত হতে পারে, কিন্তু শরীরধারণ করে তাঁদের কাজের ধারা একইরকম হবে—তার কি কথা আছে ? বরং না হবারই তো কথা ! স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তাঁদের কাজের প্রয়োজন বদলায়, আর সেই অনুযায়ী তাঁরা তাঁদের কাজের কৌশলও বদলান। জগৎকল্যাণ করার জন্য কতভাবে কতজন কাজ করছে আর যাঁরা ঈশ্বরের অবতার বা বিশেষ শক্তির অধিকারী তাঁরা কি কৌশলে কখন কি কাজ করবেন তা মানুষ বুদ্ধি দিয়ে কখনই ধরতে পারবে না। তাই তুমি যে বলছ ‘একই রকম’ বা ‘ভিন্ন রকম’–এই একের মধ্যেই ভিন্নতা রয়েছে আবার ভিন্নতার মধ্যে ‘এক’ রয়েছে—তা তুমি ধরতে পারবে কি ? দ্যাখো, মানুষ সাধারণত বহির্মুখী, সে বাইরে অর্থাৎ তার নিজের বাইরে সুখ, শান্তি,আনন্দ, পরমার্থ সবই খুঁজতে যায় কিন্তু পায় না, তাই সে অপূর্ণ। এই অপূর্ণতার জ্বালাই তাকে আবার পরের শরীর নিতে বাধ্য করে। কিন্তু স্বরূপত সে পূর্ণ, তাই জ্বালা-মুক্তির জন্য তাকে তার ‘স্বরূপ’কে জানতে হবে, আর সেইজন্য তাকে নিজেরই অন্তর্জগতে ডুব মারতে হবে, অন্তর্মুখী হতে হবে। পূর্ণকে লাভ করলে পূর্ণ জ্ঞান হয় অর্থাৎ আত্মদর্শন করলে তবে তত্ত্বজ্ঞান হয়। তত্ত্বজ্ঞান লাভ হলে তবেই অবতারতত্ত্বকে ধরা যায়। একমাত্র তখন সেই অবস্থায় কেউ বলতে পারে যে, কোন অবতার কিজন্য এসেছিলেন, তিনি কোন শরীরে কি লীলা করে গেলেন ইত্যাদি। মানুষ জীববুদ্ধি দিয়ে কি ঈশ্বরের লীলা ধরতে পারে ? বামদেব তারাপীঠে কোন রোগী এলে হয়তো হঠাৎ করে তাকে চিমটা দিয়ে মারতে শুরু করে দিতেন, দেখা যেতো যে, তাতেই রোগীর রোগ সেরে গেছে, তাহলে এটা কি art, এর তত্ত্ব সাধারণ মানুষ কি করে বুঝবে ? তৈলঙ্গস্বামী কাশীতে গঙ্গার উপর আসন করে ভেসে থাকতেন, আবার ২/৪ দিন গঙ্গার জলে ডুবেও থাকতেন—কোন্ Material Science দিয়ে এসব ঘটনার ব্যাখ্যা করবে ? মনুষ্যবুদ্ধি বা জীববুদ্ধি দিয়ে কি শিবের বিচার হয় ? শিবকে বিচার করতে হলে জীবকে প্রথমে শিব হতে হবে। এবার কথা হচ্ছে জীব কি শিব হতে পারে ? নিশ্চয় হতে পারে আর হতেই তো হবে। এইজন্যই তো যাত্রা শুরু হয়েছে—মাঝের রাস্তায় শুধু হাট-বাজারের রঙ্গ-তামাশায় মত্ত হওয়া! রঙ্গ-তামাশা থেকে মন তুলে নিয়ে আবার destination-এর দিকে হাঁটা, চরৈবেতি, চরৈবেতি। তারপর নিজের মধ্যেই নিজেকে আবিষ্কার করে মানুষ, ভাণ্ডে-ব্রহ্মাণ্ড তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়। মানস সরোবরে ডুব দিয়ে কাক রাজহংস হয়। রুদ্রগ্রন্থি ভেদ হলে সাধক আর জীব থাকে না। শিবস্থিতি লাভ করে। তখন জীবই শিব হয়।

জিজ্ঞাসু—আচ্ছা, এত অবতার, মহাপুরুষ বেছে বেছে ভারতেই জন্মগ্রহণ করলেন, এত জ্ঞান দিয়ে গেলেন, তাঁদের কত তপস্যা, সাধনা, sacrifice তবু ভারতবর্ষের এই বেহাল দশা কেন ?

গুরুমহারাজ—দ্যাখো, কোন একটা বিশেষ কারণে ভারতের এই দুর্গতি নয়—এর পিছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে, বিভিন্ন sitting-এ সেসব নিয়ে আলোচনাও করেছি। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, বেদকে যদি জ্ঞানকাণ্ড এবং কর্মকাণ্ড এই ক্রমে ভাগ করা হয় তাহলে যতদিন ভারতবর্ষ বৈদিক জ্ঞানকাণ্ডকে ধরে ছিল ততদিন ভারতবর্ষের দুরবস্থা হয়নি, যখন থেকে ভারত জ্ঞানকাণ্ড ছেড়ে আচার-সর্বস্ব কর্মকাণ্ডকে আশ্রয় করল সেদিন থেকেই এই দেশের দুর্গতির সূত্রপাত, ভাগ্য বিপর্যয়ের শুরু। নাহলে ভারতবর্ষ কখনও ইংরেজদের পদানত হয়, না তার আগে গোটাকয়েক তুর্কী বা মোগল, পাঠান এসে ভারত দখল করে ? বহু মহাপুরুষকে সংকল্প করে শরীর নিয়ে তবেই ভারতবর্ষকে ব্রিটিশশাসন মুক্ত করতে হয়েছে। এরপর আরও তিন generation suffer করবে বা করছে, তারপর ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। আবার ভারতবর্ষ পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। আগে আগেও ভারতের বুকে নানান বিপর্যয় নেমে এসেছে—ভারতবর্ষ আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যেই তা কাটিয়ে উঠেছে, এবারও উঠবে। ভারতবর্ষের মানুষকে পুরোনো ঘটনা থেকে শিক্ষানিতে হবে যাতে এরকম ঘটনা আর কখনও না ঘটে।

কিন্তু ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো তো একবার স্বাধীনতার ৫০ বছর হয়ে গেছে, তোমার কি মনে হচ্ছে – এখানকার প্রায় ১০০ কোটি (এখন প্রায় ১২০ কোটি) মানুষের সবাই মাথা উঁচু করে হাঁটতে পারে, সবাই সত্য, ন্যায্য কথাটা সহজভাবে বলতে পারে ? ভারতবর্ষের সম্পদ সবাই কি সমানভাবে গ্রহণ করতে পারে ? গ্রামের মানুষ এবং শহরের মানুষ কি একই ধরণের সুযোগ-সুবিধা পায় ? এইরকম অসংখ্য বৈষম্য রয়েছে সমাজে। এখন প্রশ্ন, আজকেও এদেশের মানুষের শোষণ, নির্যাতন হচ্ছে কেন ? সব মানুষ স্বাধীন নয় কেন? কে দায়ী এই পরাধীনতার জন্য ? তোমার স্বদেশবাসীরাই নয় কি ! রাজতন্ত্রে, সমাজতন্ত্রে রাজা-জমিদারেরা সাধারণ মানুষকে শোষণ-নির্যাতন করেছে, পরাধীনতার সময় বিদেশীরা করেছে, আর আজ নেতা, আমলারা করছে, স্বদেশবাসীরাই তো করছে। তাহলে শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনার কোন জাত নেই, দেশী-বিদেশী নেই—এটা মানুষেরই মনোজগতের এক জঘন্য বৃত্তি। সমাজের সাধু-সন্তরা, বিভিন্ন মহাপুরুষ-মহাজনেরা মানুষের মনোজগতে যে জঘন্য বৃত্তিসমূহ রয়েছে তা পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন। সেই অর্থে আমিও যেন sweeper | তোমাদের মনোজগৎ থেকে নোংরাগুলো সাফ করার চেষ্টা করছি। তবে দুরবস্থা যতই হোক অধৈর্য হয়ো না – ভারতবর্ষের সুদিন আবার আসবে।

জিজ্ঞাসু — জীবনবিজ্ঞান অনুযায়ী জিন-ই বংশগতির ধারক এবং বাহক তাহলে মহাপুরুষগণ যে বংশে শরীর নেন কি করে সেই বংশের ধারাকে অতিক্রম করে উন্নত অবস্থায় চলে যান ?

গুরুমহারাজ—অবতারপুরুষের জন্ম বা কর্ম কি সাধারণের হিসাবের সঙ্গে মেলে ? যে কোন যোগীপুরুষ যোগাভ্যাসের দ্বারা তাঁর শরীরের অভ্যন্তরস্থ এমনকি বাইরের বহিরাকৃতিরও পরিবর্তন করতে পারেন আর এর জন্য পৃথক চেষ্টা না করলেও সাধন-ভজনের ফলে শরীরের এমনিতেই বহুবিধ পরিবর্তন হয়ে যায়। তাছাড়া জিন মানুষের বংশগতির কিছুধারাকে বহন করে, কিন্তু মানুষটির স্বভাব বা প্রকৃতি কেমন হবে তাতো নির্ধারণ করে না। ওটি নির্ধারণ করে তার জন্ম-জন্মার্জিত সংস্কার। একটা বাড়িতে একই পিতামাতার পাঁচটি সন্তান তো একই প্রকৃতির হয় না, আকৃতি অনেকটাই মেলে কিন্তু স্বভাব বা প্রকৃতি ভিন্ন হয়।

মানুষের শরীরে প্রায় তেত্রিশ কোটি জিন রয়েছে। তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর concept-টা বোধহয় এখান থেকেই এসেছিল। সাধারণত জীব বিবর্তনের ১০ কোটি বছরকে এক একটা genetic span ধরা হয়, অর্থাৎ এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির সম্পূর্ণ গুণ অর্জন করে পরিবর্তিত হতে সময় লাগে ১০ কোটি বছর। এই ভাবেই Homo Habilis থেকে Homo sapiens-এ আসতে ১০ কোটি বছর, আর Homo erectus থেকে Man পর্যন্ত মোট ২০ কোটি বছর সময় লেগেছে। তাহলে এই যে এত দীর্ঘসময় ধীরে ধীরে বিবর্তন- কাজ হয়ে চলেছে এটা কি সাংঘাতিক একটা প্রাকৃতিক ঘটনা ! কিন্তু দ্যাখো মানুষ হিসাবে আত্মপ্রকাশ সেও তো কয়েক কোটি বছর হয়ে গেল, তবু ৩৩ কোটি জিনের মধ্যে বিজ্ঞানীরা দেখেছে যে মাত্র২২ কোটি জিন ক্রিয়াশীল, বাকীরা ক্রিয়াশীল হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না, এর কারণ হিসাবে বিজ্ঞানীরা বলছে যে, উপযুক্ত ক্ষেত্র বা field পাচ্ছে না তাই মানবদেহের সমস্ত জিন ক্রিয়াশীল নয়। কার্যকারণ সূত্রের এটাই নিয়ম। কারণ বা field না থাকলে কার্য সংঘটিত হয় না। তাই যেমন যেমন দেহ বা field, তেমন তেমন gene-এর ক্রিয়াশীলতা। সেইজন্য একই বাড়ীতে পাঁচ ভাই-এর একজন কবি, একজন খেলোয়াড় অন্যজন অন্যকিছু পেশায় চলে যাচ্ছে। আধার অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ gene ক্রিয়াশীল হচ্ছে আবার অন্য অনেক gene প্রসুপ্ত থেকে যাচ্ছে।

যোগবিজ্ঞান অনুযায়ী মানুষের শরীর বা আধার যত শুদ্ধ বা পবিত্র হচ্ছে এবং তার চেতনা যত উন্নত হচ্ছে – সেই শরীরে তত অধিক সংখ্যক gene ক্রিয়াশীল হচ্ছে, high-quality gene-সমূহ যেগুলি বহুকাল সুপ্ত ছিল তারা যেন ঘুম ভেঙে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে পড়ছে। তাই এখন এমন ধারণা করা হচ্ছে যে, সমস্ত মানুষের শরীরেই হয়তো পূর্বাপর যে কোন মহাপুরুষের জিন বর্তমান। শুধু আধার ও চেতনা উন্নত নয় বলে সেগুলির ঘুম ভাঙেনি। এইজন্যই শাস্ত্র বলেছে—“সমস্ত জীবই-শিব হতে পারে, সমস্ত মানুষই দেবতা বা ঋষি হতে পারে।” আশাকরি এই কথাগুলির রহস্য এবার বুঝতে পারবে যে, নিজের শরীরের অভ্যন্তরস্থ উন্নত gene-এর জাগরণ ঘটলেই এই শরীরেই উন্নত চেতনার অধিকারী হওয়া সম্ভব।

জিজ্ঞাসু—নেশার দ্রব্য বা মাদক দ্রব্য শরীরের ক্ষতি করে জেনেও মানুষ—বিশেষত শিক্ষিতরা এগুলি গ্রহণ করে কেন ?

গুরুমহারাজ—জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারে মানুষ কি পেতে চাইছে জানো – আনন্দ । আনন্দ থেকেই এই সমগ্র জগতের সৃষ্টি, তাই মানুষ সহ সমস্ত জীবজগৎ পেতে চাইছে আনন্দ। কিন্তু মুস্কিল সঠিক way-টা কি এটা জানে না। তাই হচ্ছে গোলমাল, কিন্তু ‘গোলে’-র মধ্যেই যে “মাল” রয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। নেশার দ্রব্য থেকেও মানুষ আনন্দের taste পেতে চাইছে। গ্যাঁজা, চরস, আফিং, মদ, ড্রাগ ইত্যাদিকেই শুধু নেশার দ্রব্য ভেবো না — জগতে সবাই কোন না কোন নেশায় মত্ত হয়ে রয়েছে। কারও টাকার, কারও রূপের, কারও ইন্দ্রিয় চরিতার্থের নেশা, সম্রাটদের ছিল রাজ্যজয়ের নেশা। আবার সৃষ্টিধর্মী নেশা রয়েছে সাহিত্য, শিল্প, কলা, বিজ্ঞান ইত্যাদিতে—নতুন নতুন সৃষ্টি বা আবিষ্কারের নেশা। কিন্তু এগুলি সবই বহির্মুখী—এতে পরমানন্দ লাভ করা যায় না।

তবে নেশার সামগ্রী সাধারণত যেগুলি রয়েছে সেগুলির কারও কারও মধ্যে ঔষধিগুণ রয়েছে। আফিং, কোকেন, ধুতুরার বীজ, গাঁজা, সিদ্ধি এসব থেকে যে উপক্ষার পাওয়া যায় সেগুলি শরীরে নেশার কাজ করে, আবার ঐগুলিকেই processing করে ঔষধ বানানো যায়। আর শুধু ঔষধ নয়, বিভিন্ন দামী দামী অন্যান্য দ্রব্যও তৈরি করা যায়। পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর এবং দামী drug হেরোইন তৈরি হয় আফিং থেকে। আবার পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সুগন্ধি বা scent, যা ফ্রান্সে তৈরি হয়— “ফিরদৌস” তৈরি হয় আফিং থেকে। সাধারণভাবে যন্ত্রণা নিবারক ঔষধ হিসাবে আফিং-এর ব্যবহার তো রয়েছেই। তবে আমাদের হাতের কাছে এমন একটা নেশার সামগ্রী রয়েছে, যেটার সন্ধান ইউরোপ বা আমেরিকা পেলে লুফে নেবে। এটি হচ্ছে ধুতুরা। হিমালয়ান ধুতুরা আবার আরও সাংঘাতিক। নেপালে দেখেছিলাম গুহ্যেশ্বরী কালীমন্দিরের কাছে কয়েকজন সাধুকে, যাঁরা এই নেশায় অভ্যস্ত। এমনিতে সাধুরা সাধারণত গাঁজা বা ভাঙ-এর নেশা করে। সাধুরা নেশাকে সাধনার অঙ্গ হিসাবে নিয়েছে, নেশা করে ওরা মারামারি করে না। যারা করে তারা সাধু নয়। নেপালের ঐ অঞ্চলের সাধুদের নেশার কায়দাটা বলছি শোন। ওরা ধুতুরার কাঁটাওয়ালা পাকা ফলে ফুটো করে করে কয়েকটা ছোলা ঢুকিয়ে দেয় –তারপর যে কোন ভাবে ফুটো গুলো আটকে দেয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভিতরের রস পেয়ে ছোলাগুলি ফুলে ওঠে, ব্যস্ হয়ে গেল দ্রব্য প্রস্তুত। এবার ১০/১২ কিলো আটার সাথে ঐ রকমভাবে ধুতুরার রসে ভেজা ছোলা গোটাকয়েক যদি মিশিয়ে রুটি বানানো হয় তাহলে যতজন খাবে প্রত্যেকে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে—ভাবো একবার কি দারুণ action! আমি ঐ সাধুদের সাথে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিলাম তো। একদিন ভাবলাম দেখিই না খেয়ে কি হয় ! আমি গোটাকয়েক ছোলা সরাসরি মুখে পুরে নিয়ে পাশে চলে গেলাম, আর এর ক্রিয়া শরীরে কিরকম হয় তা লক্ষ্য করতে থাকলাম। দেখলাম অতি দ্রুত আমার স্নায়ুগুলি শিথিল হয়ে যেতে থাকল, প্রায় inactive-ই হয়ে গেল। এইজন্যই নেশার ঘোরে অসানে মানুষের পায়খানা, পেচ্ছাপ হয়ে যায়, মাথা ঘোরে বা পড়ে যায়, তবে ধুতুরার উপক্ষার ডাটুরিন পরিমাণ মত খেলে lung বা heart ভালো থাকে।

যা বলছিলাম, নেশার মধ্যে মানুষ আনন্দ পায়। কারণানন্দ চায় বলেই তো “কারণ গ্রহণ”। কিন্তু সাধারণ জীব স্বভাবতই অজ্ঞান, তাই সে জানে না প্রকৃত আনন্দ কি বা কিভাবে তার আস্বাদ পাওয়া যায়। ফলে বাহ্যিক যে কোন নেশার বস্তুতে মানুষ ধীরে ধীরে addicted হয়ে যায়। প্রকৃত ‘কারণে’-র আর সন্ধান করা হয়ে ওঠে না। মানবশরীরের মধ্যেই সেই ‘কারণ’ রয়েছে, যার অন্বেষণে মানুষ বহির্মুখী হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে-ওখানে। মানব মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রয়েছে সেই স্থান—শাস্ত্রে যাকে ‘মধুপর্ক’ বলা হয়েছে। নিয়মিত যোগাভ্যাসে মস্তিষ্ক থেকে যখন এর ক্ষরণ শুরু হয়ে যায়, তখন এমন নেশা লাগে যে, জাগতিক নেশার দ্রব্যসমূহ তুচ্ছাতিতুচ্ছ হয়ে যায়। সাধুদের গাঁজা খাওয়া বা তান্ত্রিকদের মদ্যপান করার প্রকৃত কারণ হচ্ছে এটাই যে, তাঁরা বাহ্যিক ঐ নেশার দ্রব্যগুলিকে গ্রহণ করে প্রকৃত নেশার বস্তুর সন্ধানে মত্ত হন, মগ্ন হন। আর সাধারণ মানুষ মদ, গাঁজা গ্রহণ করে addicted হয়ে যায়, আর শরীর নষ্ট করে, পয়সা নষ্ট করে, স্ত্রীকে মারধর করে, নানান অসামাজিক অপরাধে লিপ্ত হয়ে যায়।

রামপ্রসাদের গানে আছে “কারণ পান করি না আমি, সুধা খাই জয়কালী বলে।” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ practical করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন—কি ভাবে ‘কালী’ বলতে বলতে সমাধিস্থ হয়ে যাচ্ছেন, টলে পড়ে যাচ্ছেন, কথা জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। উপস্থিত জনেরা ধরতে যাচ্ছেন পড়ে যাবে বলে, আবার টাল সামলে খাড়া হচ্ছেন। তৎকালীন বহু মানুষের সামনে ঠাকুরের এই ভাব প্রত্যক্ষ করা গেছে। তখনকার বিভিন্ন লেখক ঠাকুরের এই ভাবকে ভাষার মাধ্যমে বর্ণনাও করেছেন। একটা ফোটো-ও রয়েছে ঠাকুরের ঐ রকম ভাবের। এই নেশা যে কি নেশা তা তো সাধক ছাড়া কেউ সন্ধান পায় না। তবে যাঁরা একবার এই নেশার সন্ধান পেয়েছেন, তাঁরা জানেন যে, অন্য নেশায় যেমন যতক্ষণ নেশা ততক্ষণ আনন্দ, নেশা কেটে গেলেই আবার দুঃখ, এখানে কিন্তু তা নয়, এই নেশায় আনন্দের বিস্মরণ হয় না, আনন্দের চ্যুতি ঘটেনা। সকল জীব এই অবস্থাই প্রাপ্ত হতে চাইছে—মানুষও নেশার বস্তুতে, বাহ্যিক বস্তুতে, স্ত্রী-পুত্রাদিতে, বিষয়ে, বৈভবে ইত্যাদি নানান কিছুতে এই নিরবচ্ছিন্ন আনন্দই পেতে চাইছে, কিন্তু পাচ্ছে না। তাই ক্লিষ্ট হচ্ছে। আনন্দ পেতে চায়, কিন্তু কৌশল না জানার জন্য ক্ষণিক সুখভোগ হবার পরই ‘ক্লেশ’ এসে স্থান দখল করে নিচ্ছে। নেশার মাধ্যমে আনন্দ লাভ করতে গিয়ে নিজেই নেশার বশীভূত হয়ে শেষে হয়ত মারাই পড়ছে।

তবে নেশাটা প্রাচ্যের দেশগুলিতে যতটা না সমস্যা, বর্তমানে পাশ্চাত্যে এটি প্রকৃতপক্ষে খুবই ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছে। এখানে তো ধূমপান, (বিড়ি, গাঁজাসেবন) তাড়ি, মদ, ভাঙ এগুলিরই চল্ বেশী, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে কিছুটা drug, হেরোইন ঢুকেছে। কিন্তু পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে যুবশক্তি শেষ হয়ে যেতে বসেছে। চোরাপথে এশিয়া বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ‘টন’ ‘টন’ হেরোইন ঢুকছে পাশ্চাত্যে আর ওখান থেকে চোরাপথে প্রচুর সোনা ঢুকছে এদেশে। সরকারিভাবে চেষ্টা চলছে এগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে কিন্তু পারছে না। পাশ্চাত্যে drug-culture প্রথমে ব্যাপকতা লাভ করে ‘হিপি’দের সময়ে, ‘হিপি’ আন্দোলন একসময় পাশ্চাত্যে সবচাইতে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে বহু যুবক-যুবতীকে arrest করে মেরে ধরে, বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে, বিভিন্ন সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে এই আন্দোলন স্তিমিত করা হয়। তবে বিচ্ছিন্নভাবে এখনও Punk, Cowboy, Hooligun ইত্যাদি নামে বেপরোয়া আইনভাঙা যুবক-যুবতী ওদেশে খুবই রয়েছে। যাইহোক এক সময়ে হুড় হুড় করে যুবক-যুবতীরা “হিপি” হতে শুরু করেছিল। বাঁধা বাঁধন হারা খোলামেলা জীবন, খোলামেলা বা ঢিলেঢালা পোশাক আর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা। এই সব নিয়ে আমাদের বলিউড বা টলিউড কিছু সিনেমাও করেছিল। বিংশ শতকের আশির দশকে এই আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করেছিল। ওদের শেষ করল আমেরিকান সংস্থা C.IA, কিভাবে সেটা বলছি। হিপিরা আমেরিকার Woodstock-এ একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন করেছিল। পাশ্চাত্যের বড় বড় ব্যবসায়ীরা sponsor করেছিল ব্যাপারটা। ভারতের Divine – Life Society-র সত্যানন্দ তখন আমেরিকায়। সে-ও আমন্ত্রিত হয়ে বা নিজেই উদ্যোগী হয়ে বিশাল উঁচু মঞ্চে বক্তৃতা দিয়েছিল। গোটা পৃথিবী থেকে ‘হিপি’ বা খোলা মনের মানুষেরা দলে দলে যোগদান করেছিল আমেরিকার ঐ শহরে। অনুষ্ঠানটা বেশ কিছুদিন চলার কথা কিন্তু আমেরিকান গভর্নমেণ্ট দেখল যে, তাদের দেশের অল্পবয়সী যুবক-যুবতীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ সংগঠনে নাম লেখাচ্ছে সুতরাং আর দেরি নয় ! সরকারী পুলিশ বাহিনী রে-রে করে ধেয়ে এল, উদ্যোক্তাদের arrest করে নিয়ে গেল, বাকিদের মেরে ধরে অনুষ্ঠানটাকেই নষ্ট করে দিল। এরপর সংগঠনগুলোও ভেঙে দিল বা নিষিদ্ধ করে দিল, ফলে হিপি মুভমেন্ট মুখ থুবড়ে পড়ল।

হিপিদের মত এখনও অনেক সংগঠন রয়েছে ইউরোপ, আমেরিকায়, যারা নিজেদের সংগঠনকে ধর্মীয় সংগঠন বলে চালায় এবং নেশার সামগ্রীকে আধ্যাত্মিক উন্নতির সহায়ক বলে মনে করে। কিছু সংস্থা আবার এই ব্যাপারটাকে কাজে লাগিয়ে বিজনেস্ শুরু করে দিয়েছে। ভালো পরিমাণ টাকা নিয়ে লোক ঠকায়। গাঁজা, চরস ছাড়াও বিভিন্ন ক্যাকটাস্ থেকে extract করা “কাকতুস্” ইত্যাদি একটু বেশী পরিমাণ খেলে মানুষ hallucination দেখে, অর্থাৎ মাথা ঝিমঝিম্ করে আর চোখে উল্টোপাল্টা দেখে। আমাদের আশ্রমের দীক্ষিত একটি ইউরোপীয়ান ছেলে টুলাইফ আমাকে বলেছিল ও এই ধরণের একটা সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছিল। প্রথমদিনেই ওর এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যে, আমার সাথে আলাপ হবার আগে পর্যন্ত ও ঐ সংগঠনটি ছাড়তে পারেনি। ঘটনাটা হয়েছিল কি প্রথম দিনেই ওকে ১৪টা tablet খাওয়ানো হয়। তারপর ওকে উঁচুর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে বলা হয়। ও প্রথমে দেখেছিল যে ছাদের সিলিং-এ কয়েকটা টিকটিকি ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারপর দেখতে থাকলো যে তারা সুন্দর রং-বেরঙের ডানাওয়ালা পরী হয়ে গেছে। এইভাবে যেদিনই ঐ society-তে ও যেত সেইদিনই ওর নানারকম মজার মজার visualization হ’ত। ভাবো একবার! শিক্ষিত মানুষ গুচ্ছের টাকা খরচা করে ঐ সমস্ত society-র membership নেয় শুধু নেশা করে কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকতে পারবে বলে, আর নেশার চোখে উল্টোপাল্টা দেখবে বলে। আমার সাথে আলাপ হবার পর আমি টুলাইফকে প্রকৃত রহস্যটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলতে ও ব্যাপারটা বুঝল তারপর সংগঠনটির membership cancel করে দিল।

তবে আমি এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলব – তোমরা যদি কেউ নেশা করতে চাও, তবে শিবকে আদর্শ করো। যদিও সাধুরা গ্যাজা ইত্যাদি নেশা করার সময় ‘ব্যোম ভোলে’ বলেই নেশা করে। কিন্তু শুধু মুখে বললে তো হবে না। শিবকে আদর্শ করো—শিব হয়ে ওঠো। ব্যোম ভোলানাথ নেশা করে–বউকে ভুলে শ্মশানে গিয়ে সাধনায় বসল সর্বত্যাগী হয়ে। আর শিশু ভোলা (সাধারণ মানুষ) নেশা করে—খারাপ কাজে প্রবৃত্তি আনার জন্য, ভালোটা ভুলে যায়। এমন বহু মানুষকে পাবে যারা মানুষ খুন করার আগে বা মারামারি করার আগে অথবা কোন খারাপ জায়গায় যাবার আগে বেশী পরিমাণে মদ খেয়ে নেয়। এইভাবে সাধারণ মানুষের ধারণাই হয়ে গেছে যে, নেশাখোর মানেই সে খারাপ লোক।

কিন্তু ভারতীয় ঋষি পরম্পরায় অথবা প্রাচীন শাস্ত্রাদিতে পাওয়া যায় সেখানে নেশার দ্রব্যাদিকে ভগবৎ-আরাধনার কাজে বা ভালো কাজে ব্যবহারের কথা বলেছে। চণ্ডীতে পাওয়া যায় দেবী মধুপান করেছেন শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের আগে। ঋষিরা যজ্ঞ করার আগে সোমরস পান করতেন। তাই সমস্ত কালোর মাঝেই আলো ফুটে উঠুক, সব খারাপের মধ্য থেকে ভালোটা বের করতে শেখো তোমরা, তোমাদের কাছে এই আমার প্রত্যাশা।