জিজ্ঞাসু—Natural selection ব্যাপারটি কি ?
গুরুমহারাজ—ডারউইনের তত্ত্ব বলছ নাকি ? হ্যাঁ, nature বা প্রকৃতিতে যারা বেঁচে থাকার উপযুক্ত, তাদেরকেই nature select করে। ফলে সেই প্রজাতির প্রাণী বা উদ্ভিদেরা বেঁচে থাকে – বাকীরা অবলুপ্ত হয়ে যায়। অন্য প্রাণীর কথা থাক আমরা মানুষরতন নিয়ে কথা বলি, দ্যাখো আমি যদি প্রশ্ন করি পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকার se- lection-টা করে কে ? কোন ব্যক্তি না কোন বস্তু ? যদি উত্তর হয় প্রকৃতি, তাহলে জিজ্ঞাসা – প্রকৃতির কোন part ? এর উত্তরে semetic- রা বলেছিল এই সবকিছুর মূলে আল্লা বা God. কিন্তু এখানেই তো personified হয়ে গেল—মনে হচ্ছে God বা আল্লা যেন কোন person এবং সেই person চিরকাল বেঁচে থেকে এই মহাবিশ্বের কোথাও বসে সবকিছু কলকাঠি নাড়ছে, ভাঙছে ও গড়ছে। তাহলে একজন per- son কি সব সৃষ্ট জীবের ভাগ্যনিয়ন্তা থেকে কে জগতে থাকবে, কে অবলুপ্ত হবে এই সমস্তকিছু নির্ধারণ করবে ? -না person নয় impersonal, এটাকে বলতে পার Universal principle. যেটা হচ্ছে impersonal Brahma (ব্রহ্ম)। কিন্তু সমস্ত ধর্মমতেই person বা personified God এল কি ভাবে ? ‘এই মানুষেই সেই মানুষ আছে’- —বাউলগণ একথা বললেন। মানুষই ঈশ্বর হতে পারে—ঈশ্বরত্ব লাভ করতে পারে। Person-ই impersonal principle-সমূহ অধিগত হতে পারেন, নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন সাধনার দ্বারা। আবার সেই Universal principle থেকেই হয় অবতরণ হজরত মহম্মদ, যীশু, বুদ্ধ, চৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণরূপে। এই ভাবেই আধ্যাত্মিক জগতে impersonal prin- ciple আর personified God মিলেমিশে কখন যেন একাকার হয়ে গেছে। “মানুষের মাঝে আমরা দেখেছি মানুষের ঠাকুরালি”–Attain- ment of truth through untruth, Attainment of Ananda through Biroha (বিরহ)। পূর্ণই অপূর্ণের জ্বালা বুকে নিয়ে ছুটে চলেছে পূর্ণত্বের দিকে। এই অভিসার হয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে— জীবত্ব থেকে শিবত্বে, মনুষ্যত্ব থেকে ঈশ্বরত্বে। ধরা যাক এখানে person বা ব্যক্তি হ’লেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, তাহলে প্রশ্ন, যিনি স্বয়ং ভগবান, তাঁর আবার শরীর কেন ? উত্তর একটাই—লীলা আস্বাদনের জন্য। যদিও তিনি বা সেই principle যেখান থেকে অবতরিত—তা পূর্ণ, সবকিছু ভাব-অভাব সেই principle-এ রয়েছে, তবু তিনি ‘রাধাভাব’-এর আস্বাদনের জন্য শরীর নিলেন, ভগবান ভক্তভাব অবলম্বন করলেন। এটার কি কারণ, কেনই বা শরীরধারণ, কি এর প্রয়োজনীয়তা – এসব পণ্ডিতদের বই লেখার বিষয়, কচকচি করার বিষয়। প্রকৃতপক্ষে কোন কারণই নেই শুধু লীলা আস্বাদন। কিন্তু “ভগবানের অবতরণ” জাগতিক নিয়মের মধ্যে না পড়লেও Universal principle বা মহাজাগতিক নিয়মের মধ্যে পড়ে। কথায় বলে ‘লীলা বোঝা ভার’—সেটা মানুষের পক্ষে, কিন্তু মহাজাগতিক নিয়মে লীলার অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব সবই নিখুঁতভাবে রয়েছে। সেই নিয়ম পাঠ করতে পারেন যিনি, তিনি অতীতে ভগবানের কোথায় এবং কি কি লীলা কিভাবে হয়েছে তা ঠিক ঠিক বলে দিতে পারেন। আবার আগামীতে ভগবানের কি কি লীলা হতে চলেছে তাও নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারেন। রাম জন্মানোর আগেই রামায়ণ রচনার গল্প কিন্তু অলীক নয়। বাল্মীকির ন্যায় মহর্ষি তত্ত্বজ্ঞানী কালদ্রষ্টার কাছে ভবিষ্যৎ লীলা প্রকটিত হতেই পারে বা তিনি ভবিষ্যতের গহ্বর থেকে খুঁজে তা বের করেও আনতে পারেন।
এবার কথা হচ্ছে ভগবানের অবতরণ বারবার হয় ভিন্ন ভিন্ন লীলা আস্বাদনের জন্য। তাহলে কি এক ভগবান আর এক ভগবান থেকে পৃথক ? না তা নয়, ভগবানের লীলার পার্থক্য রাম আর কৃষ্ণ বা কৃষ্ণ ও রামকৃষ্ণের মধ্যে কিন্তু ভগবানত্বে কোন ভেদ নেই। ভগবানই বার বার যুগোপযোগী ভাবধারণ করে ভিন্ন ভিন্ন লীলাস্বাদন করে চলেছেন। সুতরাং ভেদ শুধু লীলায়। আর এই যে দেখছ পরিদৃশ্যমান জগৎ—এটি মায়ের জগৎ। মা জগদম্বা – The holy mother। এই জগৎসংসার তাঁর লীলাভূমি, যা কিছু ঘটে চলেছে সবই তাঁর লীলা। এই যে ব্রায়ন আর শান্তি বসে আছে, ওরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে। একসাথে থাকতে চায়—এটা আমার কাছে খারাপকিছু মনে হয় না। জগৎ থেকে আমার নিজের তো কিছু চাওয়ারও নেই—পাওয়ারও নেই। যেটা আছে সেটা হল “ভালোবাসা”। তোমাদের সকলকে আমি ভালোবাসি, তাই তোমরা যা পেলে খুশি হও আমি তাতেই আনন্দ পাই। আমি জানি এ জগৎ-সংসার মা জগদম্বার লীলাক্ষেত্র। তাই সংযোগ-সম্পর্ক যা কিছু ঘটছে তাও তাঁর লীলা। যেটা ঘটার সেটা ঘটবেই, তা যেভাবেই হোক না কেন। শুধু সময়ের অপেক্ষা। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এটাই বোঝালেন যে, সবকিছু ঘটেই রয়েছে শুধু কর্তব্যকর্ম হিসাবে তুমি যুদ্ধ কর।
কিন্তু সাধারণ মানুষ তো জ্ঞানী নয়, তারা কি করে ? জাগতিক বস্তু, বিষয় বা ব্যক্তিকে নিয়ে নানাকিছু কল্পনা করে, অনেক রঙীন স্বপ্ন দেখে, হয়ত কোন সমাজের শীর্ষস্থানীয় লোকের আদর্শকেও জীবনে গ্রহণ করে। এইসব করতে করতে ব্যক্তির মনোজগতে, ব্যক্তি, বিষয় বা বস্তুসমূহ সম্বন্ধে নানান project সৃষ্টি হয়, সে নিজেই এগুলো সৃষ্টি করে। এরপর ব্যবহারিক জীবনে সেই ব্যক্তি তার Loving aspect-দের নিকট হতে তার মনোজগতের project-এর রূপ বাস্তবে দেখতে চায়। আরও বুঝিয়ে বললে ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়াবে, ধর কোন ব্যক্তি বিবাহের পর পূর্বে তার স্ত্রী কেমন হবে তার একটা project মনোজগতে করে রেখেছে—এবার বিবাহের পর সে তার বাস্তবের স্ত্রীর সাথে মনোজগতের projected স্ত্রীর মিল খুঁজতে চাইছে। উল্টোদিক থেকে কোন নারীর মনোজগতে একটা ideal স্বামীর project সৃষ্টি হয়ে রয়েছে, এবার বিবাহের পর তার বাস্তবের স্বামীর সঙ্গে তা মিলছে না। তখন লেগে যাচ্ছে “তেরে কেটে তাক”, স্বামী হয়তো অফিসে বন্ধুদের কাছে দুঃখ করে বলছে : “স্ত্রীটা মনের মতো হল না”। “মনের মতো”- অর্থাৎ মনোজগতে যে স্ত্রীর project রয়েছে তার মতো বাইরেরটা নয় । আরে বোকা ; হবে কি করে ! এইভাবে সর্বক্ষেত্রে মনে মনে project তৈরী করে কষ্ট পায় মানুষ। জীবনে disharmony আসে। তাহলে মানুষের মনের অশান্তি, অসাম্য দূর করার রহস্য একটাই—কখনও স্বপ্ন দেখো না, আর কখনই মনে মনে কল্পনার জাল বুনে বুনে কোন project তৈরী কোরো না, যদি এই কথাগুলো পালন করতে পার তাহলে মনের অশান্তি থেকে মুক্ত হতে পারবে।
Natural selection এর পর হচ্ছে survival of the fit- test। এই জগতে যখন বেঁচে আছ তখন সুখে থাকো, স্বাচ্ছন্দ্যে থাকো, fittest হয়ে বেঁচে থাকো। এটাকেই বলা হচ্ছে Art of Life, Art of Living। বাঁচার কলা বা কৌশল—জীবন-ধারণের কৌশল শিখে নিয়ে বাঁচো বা জীবন অতিবাহিত করো। এটাই সাধারণ মানুষের প্রতি সাধুর শিক্ষা। এখানে বসে আছে জয়দীপ, ও জয়দীপের মতো হয়েই বিকশিত হোক, ব্রায়ান বিকশিত হোক ব্রায়ানের মতো। এই দুনিয়ায় যত কোটি মানুষ সবাই তার নিজের মতো, একজন কেন অপরের মতো হতে যাবে ? এটাই তো বোকামি! বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ, ধর্মনৈতিক আদর্শ বহু মানুষকে বা সব মানুষকেই এক ছত্রছায়ায় আনতে চায়, না এলে জোর করে। কিন্তু বোকারা এই জগতের বা জীবনের রহস্য জানে না। পৃথিবীতে যত মানুষ রয়েছে তাদের সকলের মনোজগৎ ভিন্ন ভিন্ন। কোন মানুষই আর একজনের মতো নয়। তাই কখনই সকল মানুষকে এক ছাতার তলায় আনা যাবে না। অনেকে হয়ত সাময়িকভাবে আসবে কিন্তু কোন না কোন ভাবে স্বার্থে ঘা লাগলেই কেটে পড়বে। এইজন্য আধ্যাত্মিক জগতে স্বাধীনতা আছে, এখানে সকলের ইষ্টমন্ত্র পৃথক। প্রত্যেকের মনোজগতের রহস্য বুঝে তার constitution অনুযায়ী পৃথক বীজমন্ত্র নির্ধারণ করেন গুরু। সকলের একমন্ত্র হলেই গণ্ডগোল —বুঝতে হবে দল পাকাবার তাল আছে, সুতরাং বেতালা হতে আর দেরি নেই।
আমি সকলকে এটা বোঝাই—তোরা প্রত্যেকে নিজের নিজের মতো হ’। অপরকে অনুকরণ করতে গিয়ে নিজেকে আর কত ছোট করবি! আপন আপন স্বভাব অনুযায়ী সকলে এগিয়ে চল, আমি সাহায্য করব। এটাকেই বলা হয়েছে ‘স্বধর্ম’ আর গীতা বলছে, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ”। তোমাকে perfection লাভ করতে গেলে স্বভাবের অনুকূল হয়েই বিকশিত হতে হবে। এক জন্মে না হলে আর একজন্ম, প্রয়োজনে জন্ম-জন্মান্তর ধরে হবে, কিন্তু স্বভাবের অনুকূল হয়েই হবে। স্বভাবের প্রতিকূল হয়ে কর্ম করলেই মুস্কিল। আবার নতুন প্রারব্ধ সৃষ্টি হবে, তারজন্য আবার নতুন কর্মফল ভোগ করতে হবে। এটা যেন চলার পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া—আবার উঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা। এইভাবে স্বভাব থেকে বিচ্যুত ব্যক্তির perfection বা পূর্ণতা আসতে বহুজন্ম লেগে যায়। এখানেই গুরুর ভূমিকা। গুরু তাঁর আশ্রিতের স্বভাবের অনুকূল সাধনপদ্ধতি বা কর্মপদ্ধতি নির্বাচন করে দেন, যাতে শিষ্যের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়। ভালো চাষি ক্ষেতে মুলো লাগিয়ে কখনই গাজরের আশা করে না। সে মুলোটাই কি করলে আরও মোটাসোটা বা পুষ্ট হয় তার জন্য সচেষ্ট হয়। জমিতে যদি বনতুলসী-জাতীয় আগাছা জন্মায় তাহলে চাষি নিড়েনি হাতে মারে কোপ। এতে দু’চারটে মুলোর শিকড় কেটে যায়। এইভাবে শিষ্যের পূর্ণতাপ্রাপ্তির জন্য শিষ্যের আগাছারূপ অভিমান ভাঙতে গুরু তাকে কিছু দণ্ড বা সাজাও দিতে পারেন। শিষ্য আহা-উহু করে ওঠে বলে “মলাম্—গেলাম”। কিন্তু আগাছা পরিষ্কার করার পর জমির মুলো যেমন পুষ্ট হয়ে ওঠে তেমনি আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও শিষ্যের জীবনে অজ্ঞান- অস্মিতা দূর করে দেন গুরু আর তার আধ্যাত্মিক জীবনে চলার পথ সুগম হয়ে ওঠে। এইজন্যই বলা হয়েছে ‘গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু, গুরুদেব মহেশ্বর।” গুরু ব্রহ্মা অনেকেই হয়। বীজমন্ত্র select করে কয়েক হাজার শিষ্য বানিয়ে ফেলতেও পারে। কিন্তু সেই বীজ থেকে অঙ্কুর বের করা বা তাকে ফুলে-ফলে সুষমামণ্ডিত করে তুলতে আর ক’জন পারে ? যাঁরা পারেন তাঁরা গুরুবিষ্ণু। কিন্তু গুরুদেব মহেশ্বর —এটা “কোটিতে গুটি”। ঈশ্বরকল্প সদগুরু ছাড়া গুরুদেব মহেশ্বর হতে পারেন না। এঁদের বক্তব্য – “কালা কালা পায়েগা তো খায়েগা। ” —ভার যখন নিয়েছি তখন আর ফেলে রাখা নয়। অজ্ঞান-অহংকার- অস্মিতা যার যা কিছু আছে সর্বনাশ করে, সর্ববন্ধন ছিন্ন করে, এক লক্ষ্যমুখী করে, তাকে পূর্ণতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। এই গুরুরা শুধু নিজের পরম্পরা নয় অপর পরম্পরার শিষ্যদেরও উদ্ধার করেন। কারণ অন্য পরম্পরার গুরু তো মাঝপথে তার শিষ্যদের ফেলে রেখে চলে গেছে। এদের উপায় কি হবে ? ঈশ্বরকল্প সদ- গুরুরাই সবার ভার নেন, “যোগক্ষেমং বহাম্যহম্। এইভাবেই যার যতটুকু হয়েছে তাকে সেই অনুযায়ী পথ দেখিয়ে সকলের চলার পথ সুগম করে দেন। আর বাকীদের দু’হাতে ঠেলে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যান। তাই গুরুর মহিমা বর্ণনা করা মানুষের সাধ্য নেই, শুধু প্রার্থনা করতে হয়—“গুরোঃ কৃপাহি কেবলম্”।