জিজ্ঞাসু—দেবাসুরের সংগ্রাম চিরকাল ধরে চলছে বলা হয়, এটার দ্বারা কি মানুষের শুভ আর অশুভ প্রবৃত্তিকে বোঝান হয়েছে ?

গুরুমহারাজ—নিশ্চয়ই….। দেব, অসুর— এসব কি আলাদা প্রজাতি নাকি ! মানুষের মধ্যেই সব রয়েছে। প্রবৃত্তিমার্গ আর নিবৃত্তি মার্গ। মার্গ অর্থাৎ পথ – এখানে এগিয়ে চলার পথ। মানুষ বুদ্ধিপ্রধান, ইন্দ্রিয়জ কামনা-বাসনা পরিতৃপ্তির তাড়নায় যখন তার বুদ্ধি ক্রিয়াশীল হয়, তখন সেটা হয় আসুরিক—এটাই প্রবৃত্তি মার্গ। আর বিবেকচালিত বুদ্ধি যেখানে ক্রিয়াশীল—সেটাই দৈবী।

বোকা, অশিক্ষিত, অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা জগতের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়। এরা হয়তো জগতের ভালো কিছু করতে পারে না কিন্তু এদের দ্বারা মানুষের বা সমাজের বিরাট কিছু ক্ষতিও হয় না। এরা হয়তো সংঘবদ্ধ হয়ে চুরি-ডাকাতি বা ধর্ষণ করে ফেলল। ব্যস, এর বেশী ক্ষতি এরা করতে পারে না। কিন্তু সমাজে ব্যাপক ক্ষতি করে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা। সৃজনশীল বিবেকযুক্ত বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা ভালোকিছু আবিষ্কার করে, তার প্রয়োগ করে সমাজকে সুন্দর করতে চেষ্টা করে। কিন্তু বুদ্ধি যখন ধ্বংসাত্মক হয় তখন সেই বুদ্ধিযুক্ত ব্যক্তি রাবণ, দুর্যোধন বা কংস হয়ে উঠতে পারে। এই সময় তারও সঙ্গী- সাথীদের দেখলে কিছুটা জানা যায় ঐ ব্যক্তির মানসিক অবস্থান। রাবণ তার ঋষি-পিতার সঙ্গ করল না, রাক্ষসী-মা নিকষার মতে চলল, দুর্যোধন পিতামহ ভীষ্ম, মহামতি বিদুর এমনকি জননী গান্ধারীর মতামত নিল না—বুদ্ধি নিল শকুনি মামার। ধ্বংসাত্মক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির মূলে জেনে রাখবে অতি অবশ্যই সঙ্গদোষ ঘটেছে। আর সৃজনশীল বিবেক- বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির মূলে নিশ্চয়ই সাধুসঙ্গ, তাই তার মধ্যে দৈবীভাবের বিকাশ ঘটেছে। এসব সমাজ-বিজ্ঞানের রহস্য বলে দিলাম। crimi- nology-তে এসব ব্যাপারগুলো শেখানো হয়। সমাজে দেখবে কিছু শিক্ষিত, বুদ্ধিমান মানুষের চেষ্টায় হয়তো কোন সংঘ গড়ে উঠল, মানুষের সেবা করার বা ভালো কিছু করার উদ্দেশ্যও হয়তো প্রথম দিকে ছিল, কিন্তু কিছুদিন পরই দেখবে সেটা বিড়ি টানার, তাস খেলার আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে। আরও কিছুদিন পর দেখবে সেই স্থান থেকেই ছোট-ছোট চুরি- চামারি বা অপকর্মাদি হতে শুরু করেছে। এটা যখন ব্যাপক আকার ধারণ করে তখন দেখবে আবার কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি ঐ ক্লাব বা আখড়া ভেঙে ফেলছে। এই ভাবে party-politics-ও গড়ে ওঠে একটু বড় বা ব্যাপকতর আকারে, সেখানেও প্রথমটায় ত্যাগ, আদর্শ এসব থাকে, পরে দুর্নীতিসম্পন্ন ক্ষমতালোভীরা গদিতে বসে এবং নিজের স্বার্থ-সিদ্ধিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আখেরে সমাজের অকল্যাণই করে বসে। এইভাবে যুগে যুগে কত রাজা, কত রাজবংশের উত্থান হয়েছে আবার পতন হয়েছে। কিন্তু মানুষের বা সমাজের প্রকৃত কল্যাণ কে বা কারা করেছে ? যে কোন দেশে, যে কোন সময়ের ইতিহাস পর্যালোচনা কর—দেখবে সমাজের বা মানুষের কল্যাণ করেছে কোন না কোন মহাপুরুষ। এঁরাও যে সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন তা আপন কার্যসিদ্ধির জন্য নয়—বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়, তাই এইসব সংঘ থেকে বহুকাল পর্যন্ত মানুষ সেবা পায়—উপকার পায়। তবে এখানেও আধ্যাত্মিক জগতের অমোঘ নিয়ম রয়েছে। কোন চাপরাশপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি সংঘের প্রতিষ্ঠাতা হ’ন বা দৈবনির্দেশে যদি প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে তাহলেই তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। সেটা কালের বুকে স্থান পায় অন্যথায় দুই বা তিন generation-এর মধ্যেই সে সংঘ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু তাহলেও জানবে ঐ যে প্রথম ব্যক্তিটি আত্মসুখের ইচ্ছা ত্যাগ করে জগদ্ধিতায় কিছু করার সংকল্প গ্রহণ করেছিল—সেটার মূল্য আছে। হয়তো সেই মানুষটির মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠানটি ক্ষয়িষ্ণু হয়ে গেল, কিন্তু শুভশক্তির যে সংকল্প তা দীর্ঘকাল বাতাবরণে থেকে যায়। পরবর্তীকালে কোন শক্তিশালী মহাপুরুষ সেই সংকল্পকে আবার বাস্তবায়িত করেন।

আমি যখন Norway গেলাম ওখানে শান্তিবু আশ্রমে দেখলাম আনন্দ আচার্যের শুভ সংকল্প বিদ্যমান রয়েছে। উনি জগতে শান্তির জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন—এখন আবার কাজ শুরু হয়েছে। হয়তো আগামীতে ওঁর সংকল্পের সুফল পাবে পৃথিবী। কিন্তু এখানেও কথা রয়েছে—প্রকৃতি তো সব ভাবকে accept করে না। প্রকৃতির অনুকূল হলে তবেই তা accepted হয়। তুমি হয়তো ভাবছ-এটা করা ভালো। কিন্তু ভবিষ্যৎ পৃথিবীর নিরিখে হয়তো সেটার কোন মূল্য নেই। তোমার তো কালজ্ঞান হয়নি, ফলে তুমি জানো না ভবিষ্যৎ পৃথিবীর রূপরেখা। তাই তোমার সংকল্প আপাতভাবে শুভ মনে হলেও তা গৃহীত হবে না। যে সময়টার মধ্যে দিয়ে তোমরা অতিক্রম করছ—এই সময়টায় পৃথিবীর দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। গত শতাব্দীতে বহু মহাপুরুষ গোটা পৃথিবীতে শরীর নিয়েছিলেন ফলে দ্রুত বিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবী। আগামীতে যে সব মহাপুরুষ আসবেন, তাঁদেরকে High-tech মহাপুরুষ হতে হবে। এখনকার ছেলে-মেয়েদের দেখছ তো কেমন IQ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে ! ফলে এই সমস্ত ছেলে-মেয়েদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে গেলে তাঁদেরকে যুগোপযোগী হয়েই আসতে হবে। কেমন একটা নতুন নাম দিলাম—’High-tech মহাপুরুষ’। এইরূপেই আসতে হবে না হলে সমাজ তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

জিজ্ঞাসু—বর্তমানে যে কোন পরিবারে প্রসাধনী দ্রব্যের জন্য যে খরচ হয়, খাবার পিছনে বোধ হয় তার থেকে কম খরচ হয়—বিশেষত মেয়েদের মধ্যে সাজ-গোছের যে প্রবণতা, এটা কি নারীর instinct না natural ব্যাপার ?

গুরুমহারাজ—প্রকৃতিগতভাবে কিন্তু পুরুষ স্থির, নারী চঞ্চল, পুরুষ সুন্দর, নারী পুরুষের পূজারী। সুন্দর হয়ে ওঠার প্রবণতা নারীর সহজতা পুরুষের ভালোলাগার জন্য। এখানে শিব স্থির-কালী dynamic, কিন্তু কালীর চোখ রয়েছে শিবের চোখের দিকে। শিব যতক্ষণ প্রসন্ন ততক্ষণই কালীর বর্তমান নৃত্যের ছন্দ। যখনই শিবের চোখ সামান্য কুঞ্চিত হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে কালীর নৃত্যের ছন্দবদল। এইভাবেই মহাবিশ্বপ্রকৃতির প্রাগোৎপত্তি, উৎপত্তি, প্রবৃদ্ধি, রূপান্তর, ক্ষয় ও লয় হয়ে চলেছে। পশু বা পাখি-সমাজে দেখবে পুরুষেরা সুন্দর দেখতে, নারীরা অপেক্ষাকৃত অসুন্দর। সিংহ কত রাজকীয়, সিংহী কিন্তু দেখতে সুন্দর নয়, ময়ুর কত সুন্দর কিন্তু ময়ূরী বড় মুরগীর মত। মুরগি প্রজাতির পুরুষ মোরগ কত সুন্দর দেখতে—ইত্যাদি অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।

নারীরা পুরুষের পৌরুষে আকৃষ্ট হয় কিন্তু একটা সময়েই পুরুষ নারীর প্রতি দুর্বল হয় সেটা হয় প্রজননকালে। এই একটা ব্যাপারে নারীর মন পাবার জন্য পুরুষ তার পৌরুষ, তার সৌন্দর্য, তার মান- মর্যাদা, অর্থসম্পদ নারীর পায়ে বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। কত রাজার রাজসম্পদ সামান্য নর্তকী বা নগরবধূর পায়ে লুটিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। পশুসমাজ বা পাখিসমাজে নারীর মন পাবার জন্য পুরুষদের মধ্যে ভয়ঙ্কর মারামারি হয়। “স্বজাতি সংগ্রাম” বলে যে ডারউইনের তত্ত্ব রয়েছে তার দুটো কারণ — খাদ্যের দখল ও নারীর দখল। খাদ্যের দখলে পশুসমাজে প্রাণঘাতী লড়াই হয় না কিন্তু নারীর দখলে তা হয়। নারীর মন পাবার জন্য পুরুষ ময়ূর পেখম মেলে ময়ূরীকে ঘিরে ঘিরে নাচে। ইউরোপে এক ধরণের পাখি রয়েছে যাদের নারীরা প্রজননকালে সেই পুরুষকেই choice করে যারা বাসা তৈরী করে বাসাটিকে সুন্দরভাবে decoration করতে পারে। পুরুষ পাখিগুলি ঐ সময়ে প্রাণপণ চেষ্টায় ভালোভাবে বাসা বানানোর চেষ্টা করে, আর স্ত্রী-পাখির কাছে গিয়ে নেচে গেয়ে তাকে বাসা দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। স্ত্রী পাখিটি একস্থান থেকে সেখানে উড়ে গিয়ে বাসাটি পর্যবেক্ষণ করে ভালো না লাগলে আবার এসে বসে পূর্বের স্থানে। পুরুষটি বুঝতে পারে স্ত্রীর পছন্দ হয়নি, সে আবার চেষ্টা করতে থাকে। এই পাখিদের আবার নীলরঙ খুব পছন্দ। ফলে পুরুষ পাখিরা নীল কাগজ, নীল পেন, নীল রঙের রুমাল বা কাপড়ের টুকরো পেলেই মুখে করে তুলে নিয়ে গিয়ে বাসা সাজায়। আর বাসা সাজানো ভালো হলেই স্ত্রী পাখি ঝুপ করে উড়ে গিয়ে বাসায় বসে ও পুরুষটির সাথে ভাব হয়ে যায়। এইভাবেই পাখিরা জোড়া বাঁধে। পশুসমাজের মধ্যে এখনও দলপতি অর্থাৎ একটা দলের সর্দার অনেকগুলি নারী বা বাচ্ছাদের কর্তা হয়ে থাকে। কিন্তু পক্ষীসমাজে বেশীরভাগই দম্পতি হয়ে বা জোড়ায় থাকতে ভালোবাসে। তবে পশু বা পাখিসমাজে নারীর সাজার কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এটা এল মনুষ্যসমাজে। বহু প্রাচীনকাল থেকেই নারী সাজতে চেয়েছে, পুরুষের চোখে নিজেকে আকর্ষণীয় করার জন্যই শুধু নয়, এটা তাদের সহজতা বা প্রকৃতির সহজতা। এর জন্য সে বিভিন্ন অঙ্গরাগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে, তাই সেগুলি আবিষ্কার হয়েছে। প্রকৃতিতে একেবারে প্রথম দিকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থাকলেও পুরুষের শরীরের শক্তি বেশী হওয়ায় সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। শক্তিমান পুরুষ গায়ের বলে নারীকে দমিয়ে বা দাবিয়ে রাখতে চাইল ৷ খুব শক্তিশালী পুরুষ একাধিক নারীকে তার বশে রাখতে চাইল। এখান থেকেই শুরু হ’ল নারীর সুন্দরী হয়ে ওঠার বা পুরুষের চোখে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা শুরু হত অনেকগুলি রাণীর মধ্যে প্রধানামহিষী বা পাটরাণী হয়ে ওঠার। নারী বিভিন্ন কলাশিক্ষা (নাচ, গান) ইত্যাদি করতে শুরু করল শুধু এই জন্যই। আজও দেখবে শুধু বিয়ের সময় সুবিধা পাবে বলে পিতামাতারা মেয়েকে নাচ শেখায়, গান শেখায়, সেলাই শেখায়, রান্নাবান্না শেখায়। হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো প্রাচীন সভ্যতা, যা আজ থেকে প্রায় ৬/৭ হাজার বছরের পুরোনো- সেখানেও যে নারীমূর্তি পাওয়া গেছে তার কানে-গলায় অলঙ্কার, হাত- ভর্তি চুড়ি, সুন্দর করে চুল-বাঁধা। প্রাচীন মন্দিরগাত্রে যেমন ইলোরা, অজন্তা, কোনারকের সূর্যমন্দির ইত্যাদি স্থানে যে ভাস্কর্য রয়েছে সেখানে নারীদের সুন্দর অঙ্গসজ্জার নিদর্শন মেলে, কোথাও কোথাও শৃঙ্গাররতা মহিলাদেরই চিত্র রয়েছে।

তবে বর্তমানে যে বিভিন্ন কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন cosmetic বা beauty cream বিক্রি করছে, এগুলো কতটা স্বাস্থ্যসম্মত সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকায় সরকারি ব্যবস্থা খুবই কড়া আর আইন সাংঘাতিক কার্যকরী। ফলে ওখানকার cos- metic-এর গুণমান ভালো, আর এখানে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে ব্যবসাদাররা শাসন করে। ওরা টাকার বিনিময়ে সরকারি officer আর রাজনৈতিক নেতাদের purchase করে নেয় আর আজেবাজে ‘মাল’ অধিক মূল্যে চালিয়ে দেয়। নাহলে এদেশে ওষুধে ভেজাল হয় ? জীবনদায়ী ওষুধ হয়তো খুবই দামী, সেটাও ভেজাল। শোনা যায় নবদ্বীপে সব মালেরই duplicate হয়। সরকারি ব্যবস্থা strong থাকলে এগুলো হোত না। অসাধু ব্যবসায়ীদের ‘দণ্ড’ দেওয়া হয় না, তাই স্বাধীনতার ৫০/৫২ বছর পরও দেশের এই হাল !

প্রথম বিশ্বের দেশগুলি এখন খুবই হার্বাল বা গাছ-গাছড়ার product ব্যবহার করছে। আমাদের আয়ুর্বেদে এসব উল্লেখ রয়েছে, সেখান থেকেই বিভিন্ন cosmetic বানানো যায়, যাতে শরীরের সৌন্দর্য বাড়ে বা রঞ্জিত হয় আবার কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াও হয় না। ভারতীয় গাছ নিম-এর পেটেণ্ট নিয়ে আমেরিকা ঝামেলা বাধাচ্ছে। নিম সৌন্দর্য রক্ষায়, রোগপ্রতিষেধক ক্ষমতায় একটা অদ্বিতীয় হার্বাল । Beauty cream হিসাবে হলুদের জুড়ি নেই। চন্দনবাঁটা বা ঘষা-সুগন্ধি হিসাবেও অতুলনীয় আবার মস্তিষ্কের কোষকে এটি শান্ত ও ঠাণ্ডা রাখে। পাতিলেবু skin পরিষ্কার করে আবার skin-এর জীবাণু বা fungus নষ্ট করে। বিভিন্ন ঘাসজাতীয় গুল্মের মূল থেকেও সুগন্ধি করা যায়, তিলতেল খাদ্যহিসাবেও ভালো আবার বিভিন্ন সুগন্ধি মিশিয়ে এটিকে সুগন্ধি-তেল হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, কারণ এটি মস্তিষ্ককে ঠাণ্ডা রাখে। নিম, হলুদ আর চন্দন দিয়ে ভেষজ সাবান বাড়ীতে তৈরী করা যায়। আর এই সাবান মেখে স্নান করলে শরীরের genetic দুর্গন্ধ কয়েক বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাবে। আগেকার দিনে মেয়েরা লম্বা চুল রাখতো আর ভিজে চুল ধুনোর ধোঁয়ায় শুকিয়ে নিত। ধুনোর গন্ধ মনকে পবিত্র রাখে ফলে শরীরও সুস্থ থাকে, এখনও মেয়েরা এটা করতে পারে। কপালে চন্দনের তেল বুলিয়ে রাত্রে শুলে মাথা ঠাণ্ডা থাকে ও ভালো ঘুম হয়, শুধুনির শাক খেলেও রাত্রে ঘুম ভালো হয়। যে সমস্ত মেয়েদের অল্পতেই মাথাগরম হয়, রাতে ভালো ঘুম হয় না, তারা যদি রোজ জলনেতি করে, শোবার আগে চন্দনের তেল কপালে লাগায়, আর নিরামিষ ও সহজপাচ্য খাদ্য ব্যবহার করে, তাহলে খুবই সুফল পাবে। অন্যথায় ঐ রকম চলতে থাকলে ঐ মহিলা কয়েক বছরের মধ্যেই পাগল হয়ে যেতে পারে।

যাইহোক কথা হচ্ছিল নারীর অঙ্গরাগ বা শৃঙ্গার নিয়ে। পুরাণাদি শাস্ত্রে বা প্রাচীন কাব্য বা রাজকাহিনীগুলিতে রাণীদের শৃঙ্গার তো এক- একটা অধ্যায়। বিভিন্ন দাসীরা দীর্ঘক্ষণ ধরে রাণীদের সাজাতেই ব্যস্ত। আবার বৈষ্ণব মহাজনগণ অভিসারিকা রাধাকে মনের মত করে সাজাচ্ছেন। কালিদাস তার নায়িকাদের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে নারীর সাজসজ্জার বা অঙ্গরাগের খুবই বহর। তবে রাজতন্ত্রের সময় নারীদের যে সাজ-সজ্জার বাহুল্য, এটাও রাজার কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতার জন্য। কারণ তখন রাজাদের অনেক রাণী থাকত, তার উপর নর্তকী, বাঈজী, পরিচারিকা এসব এড়িয়ে এক-একটা রাণী কতটুকুই বা রাজাকে কাছে পেত ! তাই অঙ্গসজ্জা আর রূপচর্চা চলত যদি তার টানে রাজা আসে। তবে প্রকৃতির কথা যদি বল তাহলে প্রকৃতি কিন্তু নগ্ন, উন্মুক্ত। শুধু তার উপর পাহাড়, নদী, বৃক্ষ, ফুল, ফল, নানান বর্ণ-বৈচিত্র্যের আবরণ দিয়ে সজ্জিত। মরুভূমির রুক্ষ রূপ, সাগরের অনন্ত জলরাশি, বিশাল পর্বতের গাম্ভীর্য আর উদার আকাশের বিশাল বিস্তৃত নীলিমা মানুষের সৌন্দর্য-তৃষ্ণা মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট নয় কি ? রাত্রির আকাশে অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রাদির সমাবেশ, চন্দ্রের স্নিগ্ধতা, আর নিশীথিনীর নির্জনতায় আমি তো মগ্ন হয়ে যেতাম! আলাদা করে ধ্যান করতে হোত না, কখন যেন আত্মমগ্ন হয়ে যেতাম। এইরূপ ভাব পর্বতের সামনে, সাগরের সামনে, উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে যে কোন স্থানেই হোত। এগুলিই মানুষকে বিশালতার স্পর্শ দেয়। শুধু নারীর মধ্যে পুরুষের সৌন্দর্য খোঁজা—এটাতো নিজেকে সঙ্কুচিত করা—ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করা। নারী-প্রকৃতি, কিন্তু তার থেকে বেরিয়ে এসে বিশাল প্রকৃতির রূপ আস্বাদন কর, দেখবে আর ক্ষুদ্ররূপে মন ভরবে না। এই ভাবেই মানুষের চেতনার উত্তরণ হয়। ক্ষুদ্র থেকে বিশালতায়, তারপর রূপ থেকে অরূপের পথে যাত্রা। আর এটাই আধ্যাত্মিকতা। পরমানন্দ তোমাদের এই কথাই বলতে এসেছে—কোন কিছুতেই আবদ্ধ হয়ো না। যা দেখছ তা হয়ত ঠিক কিন্তু সর্বদা মনে রাখবে যে, এরও পরে আছে—আরও জগৎ রয়েছে—আরও পাবার রয়েছে। এটাই চরৈবেতি। যে যে অবস্থায় রয়েছ, সেই অবস্থা থেকেই যাত্রা শুরু কর—দেখবে ঠিক একদিন না একদিন অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গেছ।