জিজ্ঞাসু ঔষধি সম্বন্ধে কি বলছিলেন ?

গুরুমহারাজ—ঔষধি দেহে প্রকাশিত বাহ্য রোগসমূহকে নিরাময়েসাহায্য করে। কিন্তু এটা মনে রাখবে ঔষধ সেবনে কখনই চিরস্থায়ী রোগমুক্তি ঘটতে পারে না, তা সে যেভাবে প্রস্তুত করা হোক না কেন ! দ্যাখনা বর্তমানে Medical Science তো উন্নত, কিন্তু এমন কোন ঔষধ কি আবিষ্কার হয়েছে যা খেলে মানুষের জীবনে আর কখনই কোন রোগ হবে না ? সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, এটা সম্ভব নয়। তাই ঔষধ প্রয়োগে বাহ্যরোগ নিরাময় হয় কিন্তু সেই সঙ্গে রোগ-ব্যাধি হওয়ার পিছনে আসল কারণটি কি অর্থাৎ root-টা খুঁজে বের করতে হবে। আর সেটি খুঁজে পেলেই অর্থাৎ রোগ-ব্যাধি সৃষ্টির কারণগুলি শরীরে- মনে প্রবেশ করতে না দিলেই শরীর ব্যাধিমুক্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ বলি—বর্তমানে গঙ্গাদূষণ রোধে কোটি কোটি টাকার বিভিন্ন project হয়েছে কিন্তু এসব সত্ত্বেও গঙ্গা কি একেবারে দূষণ মুক্ত হবে ? না, হবে না। এবার যদি এমন কোন ব্যবস্থা করা যায় যাতে কোন রকম দূষিত পদার্থ গঙ্গাতে ফেলা না হয়—তাহলে আপনা আপনিই গঙ্গা শুদ্ধ বা পরিশ্রুত থাকবে। যেখানে দূষণের সঙ্গে গঙ্গার কোন সম্বন্ধই নেই সেখানে দূষণমুক্তির কোন চেষ্টারও প্রয়োজন নেই। এখানে ব্যাপারটা সেই রকমই হয়।

সে যাইহোক প্রাচীনকালে ঔষধ নিয়েও ভারতীয় ঋষিরা গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন – যা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা নামে পরিচিত। এখানে জেনে রাখা ভালো যে, বর্তমান এ্যালোপ্যাথিক ঔষধ কিন্তু প্রাচীন আয়ুর্বেদিক ঔষধেরই অনুকরণে তৈরি করা হয়। কিন্তু ঔষধের Pro- cessing-এ আয়ুর্বেদিকের নিখুঁত নিয়ম মানতে না পারার জন্যইএ্যালোপ্যাথিক ঔষধের গুণগত মান কমে যায় এবং প্রয়োগে বিভিন্ন side effect দেখা যায়।

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দু’জন গবেষক ছিলেন চরক ও সুশ্রুত। তাঁদের প্রণীত গ্রন্থে বিভিন্ন গাছ-গাছড়া থেকে প্রাপ্ত ঔষধ প্রস্তুতির যে সুক্ষ্ম বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির উল্লেখ রয়েছে, তা পড়লে আজও মানুষকে অবাক হতে হয়। এছাড়া surgery-র ব্যাপারেও তাঁদের গবেষণা ছিল নিখুঁত। জীবক, ধন্বন্তরি এঁরাও ছিলেন সুযোগ্য উত্তরসূরি। কিন্তু পরবর্তীকালে সমাজ ব্যবস্থার ধাঁচ পাল্টানোর সাথে সাথে চিকিৎসকদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়ে যায়, ফলে যোগ্য আয়ুর্বেদাচার্যের অভাবে এই বিজ্ঞানচর্চা অবহেলিত হয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমানে আবার নতুন করে মানুষের চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার প্রতি পৃথিবীর মানুষের শ্রদ্ধা বাড়ছে। ফলে অচিরেই দেখবে এই চিকিৎসাবিদ্যার যোগ্য আচার্যগণ এসে গেছেন সমাজে, যাঁরা মানবকল্যাণের নিমিত্তই এই বিদ্যাকে কাজে লাগাবেন—অর্থোপার্জনের জন্য নয়। কারণ কোন বিদ্যাই পৃথিবীতে কখনই অবলুপ্ত হয় না, উপযুক্ত ক্ষেত্রের অভাবে ক্রিয়াশীল হতে পারে না এইমাত্র। Field প্রস্তুত হয়ে গেলেই সেখান থেকে কাজ শুরু হয়ে যাবে।

ব্যাপারটা কি জানো তো, প্রকৃতিতে যেমন রোগ বা রোগ- জীবাণুসকল আছে তেমনি এর প্রতিবিধানও প্রকৃতিতে আছে, শুধু খুঁজে পাওয়ার জন্যই গবেষণা। জামপাতার রস কয়েকদিন খেলে কঠিन আমাশয়ব্যাধি ভালো হয়, এমন কি রক্ত আমাশয়ও। ব্রাহ্মীপাতার রস নাকে কয়েক ফোঁটা দিলে বহুদিনের পুরোনো মৃগীরোগও সেরে যায়। খই-দই গাছ আছে- গ্রামে-গঞ্জে হয়, শিশুরা খেলার সময় যার পাতা তুলে ছেঁচে সেই রসটা দিয়ে দই পাতে (কারণ রসটা কিছুক্ষণ রাখলেই গাবুর মতো জমে যায়) – এই রসটা কয়েকদিন খেলেই মেয়েদের leuc orrhoea রোগ ভালো হয়ে যায়। এই রকম সাধারণ গাছ, যা হাতের কাছেই রয়েছে কিন্তু দুরারোগ্য ব্যাধিসমূহের অব্যর্থ ঔষধ। এর সাথে অনুপান থাকায় ঔষধ পথ্যেরও স্থান নিয়েছে। ফলে এককালে রোগ- আরোগ্য ও পুষ্টি দুটোই সম্পন্ন হয় এই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায়।

জিজ্ঞাসু—উদ্দালক শ্বেতকেতু, অর্জুন শ্রীকৃষ্ণ ইত্যাদি গুরু-শিষ্য ক্রমে যে জ্ঞানলাভ হয় তা না হয় বোঝা গেল কিন্তু গুরু-পরম্পরার প্রয়োজনীয়তাটা কি ?

গুরুমহারাজ—গুরুশক্তি তার পরম্পরার দ্বারাই বাহিত হয়। বংশানুক্রমে নয় পরম্পরাক্রমে। গুরু-শিষ্য এই পরম্পরাতেই সমগ্র জগৎ উপনিষদ পেয়েছে, গীতা পেয়েছে ও যাবতীয় জ্ঞানরাশি গেয়েছে। জিজ্ঞাসা-উত্তরের মাধ্যমেই সমস্ত রহস্যের উদ্ঘাটন করা হয়েছে। এমনকি তন্ত্রেও শিব ও শিবানীর জিজ্ঞাসা-উত্তরের মাধ্যমেই মানুষ পেয়েছে কৃষি, চিকিৎসা-সমেত বিশাল অধ্যাত্মতত্ত্বের ব্যবহারিক বা প্রয়োগ বিদ্যার সন্ধান। সুতরাং তোমার কথা অনুযায়ী যদি একজন গুরুদেব বা একজন কৃষ্ণ তার শিষ্যকে বা শিষ্যদের জ্ঞানদান করেন আর বহুকাল ধরে মানুষ সেটাই চর্বিত-চর্বণ করতে থাকে তাহলে বিবর্তনে তো ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাবে মানুষ। কিন্তু সেটা হবার নয়, প্রকৃতির নিয়ম রয়েছে, তার উপর রয়েছে মহাপ্রকৃতির নিয়ম। শ্রীভগবান যুগ- প্রয়োজনে শরীরধারণ করে মানুষকে যে আদর্শের সন্ধান দেন, যে শিক্ষা দান করেন, কালক্রমে তার মধ্যেও বিকৃতি এসে যায় –হয়তো মূল শিক্ষাটিই তখন বিকৃত হয়ে পড়ে এবং মানুষ আদর্শচ্যুত হয়ে যায়।

এই অবস্থায় চরম সংকটকালে আবার গুরুশক্তি ক্রিয়াশীল হয়ে কোন না কোন শরীর ধারণ করে উলটপালট অবস্থাকে ঠিক করে দেন, বিশৃঙ্খল অবস্থাকে সুশৃঙ্খল করে দেন। এটাই আধ্যাত্মিক গুরু পরম্পরা বা লোকোত্তর গুরু পরম্পরা। আর লৌকিক গুরুপরম্পরা যেটা, সেটা হল কোন গুরুদেব শরীর ছাড়ার পর তার ত্যাগী শিষ্যরা আবার পরবর্তীকালের মানুষের কাছে তাদের মূল গুরুদেবের ত্যাগ, আদর্শের কথা বলে তার জীবনকে তুলে ধরে — সাধারণ মানুষকে অধ্যাত্মমুখী করার চেষ্টা করে থাকে। নির্দেশ থাকলে তারা দীক্ষাদানও করতে পারে –এইভাবেই লৌকিক গুরুপরম্পরা তৈরী হয়।

তবে মানুষ সাধারণত নতুনকে গ্রহণ করতে চায় না। এটা আসে মানুষের মধ্যে যে জড়ত্ব ধর্ম আছে – সেখানে থেকে। জড়ের ধৰ্মই হ’ল জড়তা বা জাড্য অর্থাৎ যে অবস্থায় সে আছে সেই অবস্থাতেই চিরকাল থেকে যাওয়া। জীবনেও জড়ের ধর্ম রয়েছে—মানুষ কোন অবস্থাতেই চট্‌ করে নতুনকে গ্রহণ করতে চায় না। আবার কোনকিছুকে ধরলে চট্‌ করে ছাড়তেও চায় না। পরিবেশ বা পরিস্থিতি বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে যে নিজেকে adjust করে নিতে পারে, সেই ঠিক ঠিক বিবর্তনে গতিশীল। জীবনে জড়ের ধর্ম প্রকাশ পাচ্ছে মানেই তা পিছিয়ে পড়ার লক্ষণ, অগ্রগতির নয়। তাই বলছিলাম অতীতের গৌরবকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকা ভালো নয়। দেখছি তো মানুষ বর্তমানকে উপেক্ষা করে অতীতের চর্বিত-চর্বণ করছে আর ভবিষ্যতের জন্য রঙীন কল্পনার জাল বুনে চলেছে ! মানুষের মোহ ভঙ্গ করার জন্য শংকর লিখলেন মোহমুদগর। মুদগর দিয়ে মোহ ভঙ্গ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ক’জন মানুষ মোহমুক্ত হ’ল । আরে তুমি অর্জুনের কথা বলছিলে তো? অর্জুন স্বয়ং ভগবানের নিকট হতে যে শিক্ষালাভ করেছিল, যা আজও পড়ে বা উপলব্ধি করে মানুষের চেতনার উন্নতি ঘটছে আর সেই অর্জুনের এত শিক্ষা লাভ করে কি পরিণতি হল ? যুদ্ধ মিটলেই তো সে আবার সংসারে ফিরে গেল, সংসার করতে লাগল, পরে তাকে সাধনাও করতে হল- তাহলে হলটা কি ? আর রাজসূয় যা আদি বহু কিছু করে অবশেষে মহালস্থানের পথে হাঁটতে হাঁটতে যখন স্বর্গে পৌঁছাল তখন কি দেখল ? না দুর্যোধনরা আগেই সেখানে বসে আছে। সে যাইহোক অর্জুন যুধিষ্ঠির এদের গতি হল কোথায় ? না স্বর্গে। স্বৰ্গ তো মোক্ষধাম নয়, স্বর্গ থেকে পতন হয়, স্বর্গরাজ্য অন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, অধিকৃত হয়। স্বর্গরাজ ইন্দ্রেরই পতন হয় তো আবার অন্যান্য সভ্যদের কি কথা। স্বর্গবাস কিরকম জানো তো ? তোমার কিছু টাকা জমল তা নিয়ে দার্জিলিং বেড়াতে গেলে, টাকা ফুরিয়ে গেল—আবার ফেরো।

সবধর্মেই স্বর্গের কল্পনা রয়েছে। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হ’ল এই যে, স্বৰ্গকে অতিসুন্দর, মনোরম বানানোর জন্য এবং সেখানে বাস করা কত সুখের তা বলার জন্য নানারকমভাবে স্বর্গকে সাজানো হয়েছে। যে দেশে যেটার অভাব, জনগণ যার অভাবে কষ্ট পায় বা যে সমস্ত বস্তু বা বিষয়ের জন্য লালায়িত সেগুলি স্বর্গে খুবই সুলভ। আরবের মরুভূমিতে কোরান লেখা হ’ল, তাই বেহস্তে প্রচুর নদী, নরওয়ের স্বর্গ বর্ণনায় ৭টা বা ১২টা সূর্যের উল্লেখ রয়েছে। কারণ বেচারারা সারা বছরে ভালো করে সূর্যই দেখতে পায় না। এছাড়া সবদেশের সব মানুষ যা চায় তা তো সবধর্মের স্বপ্নেই প্রচুর রয়েছে। চিরযৌবনা নারী, প্রচুর মদ্য, নাচ-গান। কিন্তু যিনি অসাধারণ, যার অন্তঃকরণে ত্যাগ ও বৈরাগ্য এসেছে, তিনি এসব চাইবেন কি ? বলবেন ও স্বর্গে আমার দরকার নেই। হিমালয়ে ভ্রমণকালীন অনেক প্রাচীন সাধুদের সাথে আমার বিতর্ক হয়েছে। পাঠ হচ্ছে স্বর্গের মন্দাকিনী আর অসরা-সম্বলিত দেবরাজা ইন্দ্রের সভার বর্ণনা। আমি বিরোধ করেছি, বলেছি পুরাণের গল্প বাকাহিনী দুধে-জলে মেশানো। দুধকে নেব, তাই বলে জলকে নিতে পারব না। যাইহোক যা বলছিলাম, ভগবানের সান্নিধ্য বল, গীতার জ্ঞান বল, বিশ্বরূপ দর্শনই বল—এগুলোও আহামরি কিছু নয়। কারণ এসবকিছুর পরও সংসারেই ফিরে আসতে হচ্ছে – তীব্র ত্যাগ-বৈরাগ্যসম্পন্ন হয়ে জগৎকল্যাণে ব্রতী হওয়া যাচ্ছে না। আসলে বিশ্বরূপ দর্শন হল ব্রহ্মের বিরাটরূপ। কিন্তু এরপরও রয়েছে, হিরণ্যগর্ভ—ঈশ্বর— তুরীয় —ব্রহ্ম। অর্জুনের বিরাটরূপ দর্শন হ’ল কিন্তু আত্মদর্শন বা ব্রহ্মজ্ঞান তো হল না, ব্রহ্মজ্ঞানই ultimate । আত্মদর্শন না হলে ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার হয় না। আর তা না হওয়া পর্যন্ত জীবের সংশয়ও যায় না। জগৎ- সংসারের প্রতি মোহাদি থেকেই যায় আর সাধনারও অবসান হয় না। গুরু-শিষ্য পরম্পরার মধ্যে দিয়ে এই শিক্ষাই অনাদিকাল থেকে সমাজে অব্যাহত থাকছে। ‘চরৈবেতি’– ‘চরৈবেতি’, “উত্তিষ্ঠত জাগ্ৰত প্ৰাপ্য বরান্ নিবোধত।” যতক্ষণ না অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছােচ্ছ ততক্ষণ এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো, থেমো না।

চিরন্তন জিজ্ঞাসা—আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, কি জন্য এসেছি ? আর চিরন্তন উত্তর—তুমিই সেই, তুমিই সেই, তুমিই সেই। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় যুগে যুগে এই চিরন্তন মীমাংসাই হয়ে আসছে –শুধু নতুনরূপে, নতুন ভাষায়, নতুন আঙ্গিকে। শুধু স্থানভেদ, কালভেদ আর পাত্রভেদে বলার ধরণ পাল্টাচ্ছে, ব্যক্তির নামরূপ পাল্টাচ্ছে, এই মাত্র। গীতা যদি ভালো করে পড়ে থাকো দেখবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই কথাগুলিই বলেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে—যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে। এরপর থেকে আজপর্যন্ত বিভিন্ন গুরু তাঁর শিষ্যদের অন্যভাবে এই কথাগুলিই বলেছেন- মর্মার্থ বুঝিয়েছেন। আবার আজকে এই বনগ্রাম আশ্রমে আমি তোমাদেরকে বলছি, এটাই গুরুপরম্পরা। আর গুরুপরম্পরার কাজ হল সমাজের মানুষকে ভালোবেসে তাদের চেতনাকে চৈতন্যময়তার দিকে নিয়ে যাওয়া।

জিজ্ঞাসু—আপনার প্রিয় কুকুর দুটোই নাকি মারা গিয়েছে ?

গুরুমহারাজ—দ্যাখো, সবাই প্রিয়, তুমি কি আমার প্রিয় নও । আমি সকলকে ভালোবাসি বা বলতে পারো সকলকে না ভালোবেসে থাকতে পারি না। আমার শরীর ধারণই তো সকলকে ভালোবাসার জন্য, আর এই ভালোবাসা দিতে দিতে একদিন নিঃশেষ হওয়া – এটাই উদ্দেশ্য। তুমি হয়তো ‘রাজা’ আর ‘কালু’ কুকুর দুটোর কথা বলছ, হ্যাঁ দুটো কুকুরেরই উন্নত সংস্কার ছিল, যা আর পাঁচটা সাধারণ কুকুরের সঙ্গে মিলতো না। ‘রাজা’ পূর্বজন্মে সাধু ছিল, কোন একটা অন্যায় করার জন্য এই জন্মে শাস্তিভোগ হ’ল। তবে শীঘ্রই মানুষ হয়ে জন্মাবে এবং আমার কাছেই আসবে। আর কালু তান্ত্রিক ছিল, ওরও ভালো সংস্কার নিয়েই মানুষশরীরে জন্ম হবে এবং এখানে আসবে। তবে একটা হিপোপটেমাস বা হিপো’র মানুষ হয়ে জন্মানোটা ছিল আমার একটা experiment |

জিজ্ঞাসু—ব্যাপারটা যদি একটু বলেন ?

গুরুমহারাজ—হায়দ্রাবাদে ঘুরছি তখন। হায়দ্রাবাদের নিজাম শহরটাকে সাজিয়েছিলেন সুন্দরভাবে এটা বেশ বোঝা যায়। বিশেষত নিজামের মিউজিয়াম দেখলে সত্যিই অবাক না হয়ে পারবে না, কি নেই সেখানে ! যদিও British Museum এর অনুকরণে এটি করার চেষ্টা হয়েছে তবুও কত কোটি টাকা খরচা হলে তবে এইরকম collection হয়। যদি কখনও যাও তো এটা দেখে নিশ্চয়ই আনন্দ পাবে। যাইহোক ওখানকার Zoo-তে ঘুরছি, ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম এক রেলিংঘেরা জায়গায় কিছু মানুষ যেন খুব আগ্রহ সহকারে কিছু দেখছে। ওদেরআগ্রহের বিষয় কি জানতে আমিও রেলিং-এর ধারে ঝুঁকে দাঁড়ালাম। দেখি কয়েকটা জলহস্তী বা হিপো ওখানে রয়েছে। হঠাৎ ওদের মধ্যে একটা হিপো সোজা উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়াল, যেন কিছু খেতে চাইল। আমার কাছে অনেকগুলো কলা ছিল, আমি ‘প্রেমসে’ সেগুলো ওকে এক এক করে খাওয়াতে লাগলাম। ও দিব্যি খেয়ে চলল তারপর যখন সব কলা শেষ হয়ে গেল ও আর দাঁড়াল না, আমিও বিদায় নিলাম। কিন্তু এরপরেই ঐ হিপো-টা মারা যায়, আর এখানে মানুষ শরীরে জন্ম নেয়। প্রথম ওকে শিশু অবস্থায় দেখে তো আমি অবাক ! তারপর চিন্তা হলো আরে, এতো বড় হয়ে মহামুস্কিলে পড়বে । তখন ওর brain-cell গুলোর যাতে উন্নতি হয় তারজন্য বিশেষ ক্রিয়া করতে শুরু করলাম। ফলে এখন ধীরে ধীরে ও এখনকার সমাজে চলার মতো নিজেকে তৈরী করে ফেলেছে আর অসুবিধা হবে না। আমার ঐ রকমই আর একটা experiment হাস্নুহানা। যাইহোক নিজামের কথা যা বলছিলাম। মুঘলদের শেষদিকে ইংরেজ আমলের গোড়ায় ভারতে দুটো সম্মানজনক post সৃষ্টি হয়েছিল, একটা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার ‘নবাব’ পদ, অন্যটি হায়দ্রাবাদের ‘নিজাম’ পদ। নিজাম সম্বন্ধে নানা গল্প আছে বা ঐতিহাসিকেরা গবেষণা করে ওর সম্বন্ধে নানা বইও লিখেছে, তাতে জানা যায় যে, নিজাম খুবই কৃপণ লোক ছিল। ওতে লিখিত আছে যে, একবার তৎকালীন লাট ওয়ারেন হেস্টিংস নিজামের সাথে দেখা করতে গেছে বা হয়তো কিছু দরকারি কাজও থাকতে পারে। কথাবার্তা চলছে এমন সময় নিজামের পকেট থেকে কিছু বের করতে গিয়ে একটা ‘চৌয়ানি’ (সিকি) পড়ে গিয়ে বেশ খানিকটা মেঝেতে গড়িয়ে যায়। তাই দেখে নিজাম তার মোটা চেহারা নিয়ে অতি ব্যগ্রতা সহকারে সেই চৌয়ানির পিছন পিছন সারা ঘরময় ছোটাছুটি করতে শুরু করে দিল। হেস্টিংস এইরকম একজন নিজামের সামান্য একটা চৌয়ানির পিছনে বাচ্ছা ছেলের মতো দৌড়াদৌড়ি করা দেখে একেবারে অবাক। পরে যখন দু’জন আর্দালি সিকিটা কুড়িয়ে নিজামের হাতে ফিরিয়ে দিল, তখন শাস্তি। নিজাম আবার হেস্টিংসের সাথে কথা শুরু করল। ঘটনাটি মজার বলে হয়তো কোন ঐতিহাসিক এটি লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছে। কিন্তু আমি যা বলতে চাইছিলাম তা হল—কৃপণ-স্বভাবের নিজাম কি করে এত কোটি টাকা ব্যয়ে মিউজিয়ামটি সাজাল !