জিজ্ঞাসু—মহাপ্রভুর বেশীরভাগ সময়ই তো উড়িষ্যায় কেটেছে তাহলে নবদ্বীপে বা গৌড়বঙ্গে তাঁর কি ভূমিকা ছিল ?
গুরুমহারাজ—মহাপ্রভু ভগবান—সাক্ষাৎ প্রেমস্বরূপ। পৃথিবীর সৌভাগ্য যে, তিনি এই ধরণীর ধুলায় কয়েক বছর কাটিয়ে গেছেন নরশরীর ধারণ করে। তাই তাঁর কথা এ ভাবে জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়—কারণ এর উত্তর দিতে গেলে যেটুকু বলা হবে সেটা দিয়ে কিন্তু মহাপ্রভুর মহত্ত্ব বর্ণনা করা যাবে না। এইটা মাথায় রেখেই কি বলছি শোন।
ভগবান বুদ্ধ তৎকালীন সমাজে আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জাগরণ এনেছিলেন। এর ফলে বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষ তার সুফল লাভ করেছিল। কিন্তু যা সবক্ষেত্রেই হয় এখানেও সেইরূপ ঘটতে থাকল। বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মাচার্যরা নিজেরাই চারিত্রিক বা বৈশিষ্ট্যগত আদর্শকে ধরে রাখতে পারলেন না। সংঘারামগুলিও চরিত্র হারাতে লাগল। প্রথমদিকে সমাজে অর্থাৎ সাধারণের কাছে এর খুব একটা প্রভাব পড়েনি—কিন্তু ধীরে ধীরে তা সমাজের মানুষকেও প্রভাবিত করতে লাগল। মানুষ সংঘারাম বা সংঘাচার্যদের প্রতি শ্রদ্ধা-বিশ্বাস হারাতে শুরু করল। বৌদ্ধধর্মের সবচেয়ে খারাপ রূপ প্রকাশ পেতেলাগল যখন থেকে যথেচ্ছ তন্ত্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল বিভিন্ন সংঘে। ভগবান বুদ্ধের শিক্ষা ছিল—ন্যায় সবার জন্য, ধর্ম সবার জন্য, সংখ সবার জন্য। এই সর্বসাধারণের অধিকারের দিকটাই মানুষকে সংঘমুখী করেছিল, এখন তার ব্যত্যয় হতে লাগল। এমন সময় এলেন শঙ্করাচার্য, তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদ সৃষ্টি করলেন। শঙ্করের পরম্পরা থেকে শুরু হল নারী ও শূদ্রের অধিকার হরণের পালা। রাজতন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্র বা ব্রাহ্মণদের অশুভ আঁতাত প্ৰতিষ্ঠা হওয়ায় সাধারণ মানুষ মূল স্রোত থেকে দূরে— বহু দূরে চলে যেতে লাগল। ব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে যে অপরাধ করলে কর্ণচ্ছেদ, শূদ্রের সেই একই অপরাধে মুণ্ডচ্ছেদ হতে লাগল। এই সময় থেকেই মুসলমানেরা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের রাজা হয়ে বসল। সাধারণ মানুষ বা আম-জনতা সব সময়ই রাজার ধর্মকেই মেনে নেয়। রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম। এখনও জনগণ নিজেদের সুবিধার্থে যে দল দেশশাসন করে, তাদেরকেই সমর্থন করে, পরে তাদের পরিবর্তে অন্য শাসকদল এলে জনগণ আবার সেই দলেরই সমর্থক হয়ে যায়। আর তখনকার দিনে সাধারণ মানুষ তো আরও অসহায় ছিল। ইসলামের ভাল দিক হচ্ছে ভ্রাতৃত্ব—pan-Islamic-brotherhood। আর এদিকে একবার মুসলমান হয়ে গেলে আর ব্রাহ্মণেরা তার বিচার করবে না, বিচার করবে মজহব। তাছাড়া এখনও যেটা হয়—রাজধর্ম গ্রহণ করলেই চাকরি পাওয়া যায়, সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। সুতরাং শত শত বৎসর ধরে অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করে কেন মানুষ হিন্দুসমাজে পড়ে থাকবে । দলে দলে হিন্দুরা মুসলমান হতে শুরু করল। স্থানে স্থানে অবশ্য জোর-জবরদস্তি করেও হিন্দুকে মুসলমান করা হয়েছে, কিন্তু জেনে রাখবে স্বেচ্ছায় মানুষ বেশী মুসলমান হয়েছে তৎকালী সমাজপতিদের অবিমৃশ্যকারিতার জন্য।
এইসময় নবদ্বীপে শরীর নিলেন শ্রীমন্মহাপ্রভু। মহাপ্রভু না এলে তখন সমস্ত গৌড়বঙ্গ থেকে রাঢ়বঙ্গের সকল মানুষই মুসলমান হয়ে যেতো। কিন্তু মহাপ্রকৃতির ইচ্ছা নয় যে তা হোক, তাই তাঁর আবির্ভাব। তিনি প্রেমের অবতার—অপার্থিব প্রেমের প্রবাহ নিয়ে তিনি যেদিকে যেতেন শুধু মানুষজন কেন—বৃক্ষ-লতা, পশু-পাখীও যেন কেমন হয়ে যেতো। তিনি সকল মানুষকে ধর্মাচরণের অধিকার দিলেন। তিনি বললেন একবার ‘হরিবোল’ বল। ধর্মান্তরিতরা ভাবত—তারা ধর্ম ছেড়েছে, এটা বোধ হয় মহাপাপ। ব্রাহ্মণরা তাদের তাই বলেছিল, গীতার শ্লোক বলে বুঝিয়েছিল, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়” ইত্যাদি। মহাপ্রভু বললেন—পাপ নেই, “একবার হরিনামে যত পাপ হরে, জীবের সাধ্য নেই, তত পাপ করে”। এ যেন সাধারণ মানুষের একবুক বেদনার মাঝে একটুকরো শান্তির প্রলেপ ! ধর্মান্তরিত যারা হয়েছিল তারা সুড়সুড় করে ফিরে এল, আর যারা হিন্দুধর্মের প্রতি সংশয়াচ্ছন্ন ছিল তারা পুনরায় ধর্মাচরণের অধিকার পেয়ে মূলস্রোতে থেকে গেল। তারা এখন সবাই বৈষ্ণব—গৌড়ীয় বৈষ্ণব। ব্রাহ্মণেরা কিন্তু তাদের সমালোচনা করতে ছাড়েনি, বলল— ‘জাত হারিয়ে বৈষ্ণব’, মহাপ্রভুকে নাম দিল “যজানে গোঁসাই”।
সেইসময় গৌড়বঙ্গের শাসনকর্তা ছিল হোসেনশাহ। অনেকের ধারণা আছে হোসেন শাহ বোধ হয় উদার ছিল—কিন্তু তা নয়। হোসেন শাহ কেন—কোন মুসলমান শাসকই হিন্দুদের কাছে কি করে উদার হবে ? তাদের পক্ষে সর্বধর্মের প্রতি উদার থাকা সম্ভবও নয়, ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে। আকবর যেটা করেছিল সেটা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। আর দারাসুকোর মধ্যে যে উদারতা লক্ষ্য করা যায় সেটা হয়েছিল ওনার সুফী পরম্পরায় দীক্ষা নেওয়ার জন্য। সুফীরা উদার, কোন ধর্মমতেরই বিরোধ করে না। যাইহোক গৌড়বঙ্গে তখন চরম অরাজকতা। পরপর ক্রীতদাসরা বাংলার সিংহাসনে বসছে। হাবসী অর্থাৎ আবিসিনিয়ার অধিবাসীরা তখন ক্রীতদাস হিসাবে মুসলমান শাসকদের সাথে আসত। বিশাল এবং শক্তপোক্ত শরীরবিশিষ্ট হাবসীরা অস্ত্রশিক্ষা করে সম্রাটদের দেহরক্ষী হিসাবে কাজ করতো। এরাই তখন পরপর বাংলার সিংহাসনে বসে বাংলায় একটা চরম অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। হোসেন শাহ তখন বিহারের সাসারামে। গৌড়ের অধিকারী সুবুদ্ধি রায় ছোটবেলা থেকেই হোসেনকে ভালোবাসতো। কিন্তু সেই হোসেনই সুবুদ্ধি রায়ের কনিষ্ঠতম স্ত্রীকে বের করে নিয়ে বিবাহ করে। তৎকালীন সময়ে জমিদার বুদ্ধিমন্ত ও সুবুদ্ধি রায়ের অধীনে যে সৈন্য ছিল তার সাহায্যেই হাবসী বিদ্রোহ দমন হয়। বিদ্রোহ দমন হলে হোসেন গৌড়বঙ্গে ফিরে আসে। সুবুদ্ধি রায় ও বুদ্ধিমন্ত এমনই উদার যে, হোক সে হোসেন শাহ, কিন্তু যেহেতু সে রাজা তাই সুরক্ষিত গৌড় এরা দু’জনে হোসেনের হাতে তুলে দিল। দ্যাখো, ইতিহাস বলছে বাঙালী হিন্দুরা কখনই বেইমান নয়। ইচ্ছা করলে ওরা হোসেনকে ঢুকতে না দিতে পারতো বা মেরে ফেলতে পারতো কিন্তু তা তারা করেনি। হোসেন কিন্তু সিংহাসনে বসেই সুবুদ্ধি রায়ের উপর চরম অবিচার করেছিল। তবে বুদ্ধিমান হোসেন ব্যাপারটা থেকে শিক্ষাও নিয়েছিল, ও তার উঁচুতলার সৈন্য বিভাগের কর্তাপদে বাঙালী নিয়োগ করত। এমনকি তার দেহরক্ষীরাও বাঙালী ছিল। যাইহোক হোসেন শাহ কিন্তু মহাপ্রভুর এই জনপ্রিয়তা বা তাঁকে কেন্দ্র করে যে জনজোয়ার বইছিল এটা ভাল চোখে দেখেনি। ও-ই চাঁদকাজী, জগন্নাথ রায়, মাধব রায় (জগাই, মাধাই) ইত্যাদিদের নির্দেশ দিয়েছিল যাতে মহাপ্রভুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলন ভেঙে দেওয়া হয়। মহাপ্রভু কিছুটা এখানকার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়েই নবদ্বীপ ত্যাগ করেছিলেন কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, তাঁর বেশীদিন নবদ্বীপে থাকা মানেই (তাঁর) followers-দের উপর অত্যাচারের পরিমাণ বাড়বে। তিনি উড়িষ্যায় যাবার পরও কিন্তু হোসেন শাহ মহাপ্রভুর বিরোধিতা করতে ছাড়েনি। কলিঙ্গরাজ যখন মহাপ্রভুর শিষ্যত্ব বরণ করল, তখন গুপ্তচর মারফৎ এ খবর হোসেনের কানে পৌঁছাল। হোসেন শাহ প্রথম থেকেই মহাপ্রভুর গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখছিল। এই ঘটনার পর ও ভাবল মহাপ্রভু হয়তো কলিঙ্গরাজের সৈন্য সাহায্য নিয়ে গৌড় আক্রমণ করবেন আর এখানকার জনগণের বা ছোট ছোট রাজাদের একটা support তো তিনি পাবেনই। এই ভয়ে ভীত হয়ে হোসেন শাহ কলিঙ্গরাজের শ্যালক বা ওখানকার সেনাপতির সাথে বিভিন্ন চুক্তি করতে লাগল। কলিঙ্গ সেনাপতিও মহাপ্রভুর প্রতি বিরক্ত ছিল- —কারণ তার ধারণা উনিই (মহাপ্রভুই) রাজার মাথা খারাপ করে দিয়েছেন, তাকে শিষ্য করে নিয়েছেন। রাজার এখন আর রাজকার্যে মন নেই, শুধু ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ’ করে আর কি করলে মহাপ্রভু সন্তুষ্ট হন, কত ভালোভাবে তাঁর সেবা করা যায়, সেই নিয়েই রাজা ব্যস্ত। ফলে কলিঙ্গ সেনাপতি হোসেন শাহের ষড়যন্ত্রে সামিল হ’ল। আর পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডারা তো মহাপ্রভুর উপর বিরক্ত ছিলই। এই ভাবেই মহাপ্রভুর মহাজীবনের উপর একটা বিরাট বিপর্যয় ঘনীভূত হয়েছিল।