জিজ্ঞাসু—আমরা দেখি বৌদ্ধ এবং জৈন উভয় ধর্মাবলম্বীরাই অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী আবার পরবর্তীকালে গান্ধীজীও অহিংসপন্থী হলেন, এঁদের মধ্যে মূলত পার্থক্য কোথায় ?
গুরুমহারাজ—অহিংসা কথাটা আছে বলেই কি সব মত এক হয়ে গেল ? তুমি যা বললে তার মধ্যে প্রথম এবং দ্বিতীয় মতের প্রবক্তারা ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের লোক। আর তৃতীয়জন ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তি, ফলে এখানে তুলনা করাটাই বোকামি। তবে জানবে, ভগবান বুদ্ধই ছিলেন ঠিক ঠিক অহিংসক। অহিংসা মানে হীনতা বা দুর্বলতা নয়, সংযমের চূড়ান্ত প্রকাশ। বীর্য ও শক্তি থাকতেও তার প্রকাশ না ঘটিয়ে, প্রতিপক্ষকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করা—এটাই অহিংস নীতি। বুদ্ধ ছাড়া এই নীতির ঠিক ঠিক প্রয়োগ কোথায়, কে, কবে করেছে ? বুদ্ধের শিক্ষা ছিল সাংঘাতিক। আজও কোন বৌদ্ধ সংঘারামে গেলে তাঁদের আচার্যদের পাণ্ডিত্য অথচ শান্ততা তোমাকে মুগ্ধ করবে।
শিরডির সাঁইবাবার জীবনীতে রয়েছে যে, তিনি একবার তাঁর শরীরের ক্ষত স্থানের পোকা হয়ে যাওয়া অংশ থেকে পোকা পড়ে গেলে তা আবার যত্ন করে তুলে ক্ষতস্থানে রেখে দিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি গান্ধীজীকে খুবই অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু ভগবান বুদ্ধের মতো বা শিরডির সাঁইবাবার মতো অহিংসক হবার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়—গান্ধীজীর তা কতটা ছিল ? আর তাঁর নিজের যেটুকুও বা ছিল দেশের আপামর জনগণকে রাতারাতি অহিংসক বানাতে গিয়ে কি কাণ্ডটাই না হল ! ভারত স্বাধীন হবার পর দেশটার দিকে তাকিয়ে দেখো দেখি —দেখতে পাবে অহিংসক ভারতবর্ষের রক্তমাখা চেহারাটা। যেখানে ভাইয়ের রক্তে ভাইয়ের হাত বারবার কলুষিত হচ্ছে সারা দেশটা জুড়ে। এইজন্যই জ্ঞানীরা বলেছেন, “বৃক্ষ ফলেন পরিচীয়তে”।
গান্ধীজী কুষ্ঠাশ্রমে কুষ্ঠরোগীদের সেবা করেছিলেন এমন কথা শোনা যায় কিন্তু সেটা কেমন জানো—এখনকার মন্ত্রীদের রুপোর কর্নিক হাতে কোন বিল্ডিংএর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার মতো। ২৪ ঘণ্টাই কুষ্ঠরোগীর কাছে থেকে তাদের সেবা করার মতো কঠিন কাজ খুব কমই আছে। কথায় বলে না, ‘আগে মনে কুষ্ঠ, তারপর দেহে কুষ্ঠ’—ঘটনাটা কিন্তু সত্য। কুষ্ঠরোগীরা এত বিরক্ত করে এবং এমন বিশ্রী ভাষায় গালাগালি দেয় যে, সেবাকারীদের সেবা-করা সত্যিই মুস্কিল। ওরা আরও যা করে তা শুনলে তোমরা অবাক হয়ে যাবে—একটু সুযোগ পেলেই অজ্ঞাতসারে সেবাকারী বা সেবাকারিণীদের জামা-কাপড়ে ওদের কুণ্ঠের পুঁজ-রক্ত লাগিয়ে দেয়। সেবা করার সময় আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাই এত কথা বলতে পারলাম। যাইহোক যা বলছিলাম, সেই সময় গান্ধীজীর কুষ্ঠাশ্রমে বসে থেকে সেবা করার সময় কোথায় ? গোটা ভারতবর্ষব্যাপী অহিংস আর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের তখন জোয়ার চলছে, চারিদিকে মিটিং-মিছিল, এসবের নেতৃত্ব দেওয়া, ভাষণ দেওয়া—এইসব করতেই তো তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটে গেল । শেষ দিকটায় ‘সবরমতীকা সন্ত’ হয়ে কাটাতে চাইলেন কিন্তু ‘কাল’ সে সময় তাঁকে দিল না।
এবার জৈনদের কথা বলছি শোন, সকাল থেকে খমল সেবা আর উকুন সেবা করতেই তারা কয়েকঘণ্টা কাটিয়ে দিচ্ছে ! জৈনধর্মের প্রভাব ভারতবর্ষে যখন থেকে প্রবল হ’ল, তখন থেকেই জাতিটা যেন মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়ল। কর্মফলের দোহাই দিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকল মানুষ। না হলে ভারতবর্ষ বিদেশীদের পদানত হয়। ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্যই ধর্মপ্রাণতা কিন্তু সেই সনাতন ধর্মে এই ধরণের আঘাত আগে কখনই আসেনি। জৈনদর্শনে রয়েছে যে, আত্মা সমগ্র শরীর জুড়ে থাকে, অর্থাৎ বড় প্রাণীর বড় আত্মা, ছোট প্রাণীর ছোট আত্মা। তার মানে আত্মা ছোট- বড় হয়, তাহলে নিশ্চয়ই আত্মা হল বস্তু। এইসব চিন্তা ভারতীয় মূল ঋষিচিন্তার পরিপন্থী। কাজেই এই ধর্মমতের উত্থানের সাথে সাথেই ভারতীয় সমাজের Life Style ঠিকই থাকল কিন্তু ভারতবর্ষের ধর্মজগতে অর্থাৎ যেটা ভারতের প্রাণ, সেখানেই লাগল ঘা আর এতেই সর্বনাশটা হল। অপরদিকে বুদ্ধের শিক্ষা ও আদর্শ জীবন-গঠনকারী। আর বুদ্ধ-পরবর্তী স্থবিরগণকে দেখো, তাঁদের জীবনে ত্যাগ ও সাধনার তীব্রতার কথা শুনলে অবাক হয়ে যাবে। অবলোকহিতেশ্বর নামে একজন বোধিসত্ত্ব যিনি জগৎকল্যাণের কথা ভেবে ‘বুদ্ধত্ব’ প্রাপ্ত হয়েও তা নিতে চাননি। এঁদের ‘ক্ষপণ’ অবস্থা বলা হয়, যেমন বাবাজী মহারাজ। এঁরা যে শরীরে আছেন ঐ শরীরেই সপ্তভুবন পরিক্রমা করে বেড়াতে পারেন। ঐ বোধিসত্ত্বের ‘বুদ্ধত্ব’ না নেওয়ার ঘটনাটা বলছি শোন। অবলোকহিতেশ্বর যখন সাধনার চরমভূমিতে অবস্থান করছেন তখন একদিন অমিতাভ বুদ্ধ কুকুররূপে ওঁর সামনে প্রকট হলেন। কুকুরটির সারা গায়ে দগদগে ঘা আর তাতে পোকায় ভর্তি। এটা দেখেই অবলোকহিতেশ্বর তাড়াতাড়ি তাঁর আসন ত্যাগ করে কুকুরটার সেবাযত্ন করতে লেগে গেলেন। এবার পোকাগুলির জীবনধারণের কথা ভেবে নিজের শরীরে ক্ষতস্থান সৃষ্টি করে সেখানে সেগুলি রাখতে লাগলেন। এইরকম নিষ্ঠাপূর্বক সেবায় অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে ভগবান বুদ্ধ তাঁর সামনে প্রকট হলেন এবং বললেন, ‘তোমার মধ্যে বোধের সার করুণার আবির্ভাব হয়েছে এবং তুমি বোধিসত্ত্ব হয়েছ’। অবলোকহিতেশ্বর তখন ভগবান বুদ্ধের কাছে প্রতিজ্ঞা করলেন—যতদিন জীব-জগতের দুঃখ-কষ্ট থাকবে, ততদিন তিনি নিজের মুক্তি না নিয়ে বার বার জীবের দুঃখ দুর করতে জগতে আসবেন। তাই যাঁরা পূর্ণত্বপ্রাপ্ত হয়ে শান্ত-সমাহিত হয়ে রয়েছেন, তাঁরাই বুদ্ধ, আর যাঁরা ঐ অবস্থাপ্রাপ্ত হয়েও “বহুজনহিতায় ও বহুজনসুখায়”, কাজ করে চলেছেন তাঁরাই বোধিসত্ত্ব ।