জিজ্ঞাসু —অনুগ্রহ করে আপনার ক্যাম্প লাইফে রায়নার কিছু ঘটনা আমাদের বলুন ?

গুরুমহারাজ—আমি তখন একটা কোম্পানীর under-এ Rural Electrification-এ কাজ করি। ফলে ঐ কোম্পানীর যেখানে যেখানে কাজ থাকতো, আমাদের পুরো দলটাকে সেখানে যেতে হোতো। তবে ঐ সময়ে আমার camp life-এর যে ব্যক্তিগত সাধন-জীবন___ তার খবর বেশীর ভাগটাই আমার সঙ্গের লোকেরাও জানতে পারতো না। সাধনজীবনের অনেক রহস্য সেইসময়ে আমার অধিগত হয়েছে। এক-একটা রাত কেটেছে _যেন জীবনের এক-একটা অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে ! ‘সিমেন্স’ কোম্পানীতে আমি প্রথমে ‘লেবার’ হিসাবে ঢুকেছিলাম, তারপর ক্রমে অ্যাসিস্ট্যান্ট লাইনসম্যান, লাইনসম্যান হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ‘হেডমিস্ত্রি’ হয়ে গিয়েছিলাম। ফলে আমার under-এ তখন বেশ কয়েকজন যুবক ছেলে কাজ করতো। আমি তাদেরকে খুব ভালোবাসতাম, তারাও আমাকে ভালোবাসতো। ফলে, আমাদের দলটার খুব সুনাম ছিল। যেখানেই কোনো ঝামেলা বা emmergency কিছু ঘটতো সেখানেই আমরা যেতাম এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কাজ তুলে দিয়ে আসতাম। আর এইসব কাজ করতে করতেই আমি সংগ্রহ করেছিলাম পরমানন্দ মিশনের ভাবীকালের কর্মীদের!

রায়নার হারু, মিহির, জগাদা এরা কেউ সোজা-সাপটা ছেলে ছিল না —সবাই যেন ছিল এক-একটা রত্ন ! এদেরকে বশে আনার জন্য আমাকে কম শক্তি ব্যয় করতে হয়নি ! মিহিরকে তো একদিন খেলার মাঠ থেকে জোর করে কাঁধে তুলে ক্যাম্পে নিয়ে এসেছিলাম।

যাইহোক, যেদিন রায়নায় কো-অপারেটিভের পাশে আমাদের ক্যাম্পের জন্য স্থান নির্দিষ্ট হোলো এবং প্রথম আমাদের কোম্পানীর মালপত্র ওখানে নামালাম __সেই দিনেই চায়ের দোকানে হারুদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। ‘হারু’-রা ওখানেই বসে আড্ডা মারতো। যুবক ছেলে দেখে আমিই ওদের সাথে আলাপ করলাম, চাও খাওয়ালাম। কোম্পানীর কি কাজে আমরা এখানে এসেছি _এইসব নানান কথা হোলো। আর যেহেতু গ্রামের মানুষের স্বার্থেই এই Electrification. সুতরাং মালপত্রগুলো রক্ষা করার এবং প্রয়োজনে গ্রামবাসীর সাহায্য ও সহযোগিতা যেন পাওয়া যায় _ তার আবেদন জানিয়ে সেদিনের মতো আলোচনা শেষ করা হোলো । চায়ের দোকান থেকে উঠে আমরা camp খাটানোর তোড়- জোড় শুরু করে দিলাম। ওরাও চলে গেল, তবে যাবার সময় ছোট্ট একটা মন্তব্য করে গেল, ‘দেখবেন জায়গাটা তো খুব খারাপ !’
সেই রাতেই আমাদের কোম্পানীর বেশ কিছু মালপত্র চুরি হোলো। পরে অবশ্য ওরাই আবার সেগুলো ফেরত দিয়ে দিয়েছিল।

ওদের একটা বড়ো দল ছিল। দলটার কাজ ছিল লোকের নানা রকম অনিষ্ট করে feast করা। হাঁস, মুরগী চুরি করার অদ্ভুত কৌশল ছিল ওদের। রাত্রে হাঁস বা মুরগীর ঘরে ওলের ডাঁটা ঢুকিয়ে দিয়ে খানিক নাড়াচাড়া করলেই হাঁস বা মুরগীগুলো সাপ ভেবে ভয়ে মরে যেতো। তখন ওরা ঘরের পাটা সরিয়ে সেগুলোকে বের করে নিয়ে পালাত। এইটা ওরা করতো, কারণ জ্যান্ত অবস্থায় হাঁস বা মুরগী চিৎকার করতে পারে আর তাতে বাড়ির মালিক জেগে যেতে পারে, কিন্তু ওগুলো মরে গেলে আর ডাকবে না, তাই এই কৌশল। আবার নিয়ে চলে যাবার সময় পাউস বেড়ালের মতো ‘আঁক ’–করে ডাকতে ডাকতে যেতো। যাতে সকলে মনে করে বেড়ালে হাঁস বা মুরগী ধরে নিয়ে গেছে— মানুষে নয়।

আমি তো এসব জানতাম না। একদিন অন্ধকারে মাঠে মাঠে ক্যাম্প-এর দিকে ফিরছি, হঠাৎ দেখি মাঠের মধ্যে একটা খাল থেকে জোনাকির মতো কয়েকটা আলো জ্বলছে আর নিভছে। আমি ভাবলাম দেখি তো কি ব্যাপার ! কাছে গিয়ে দেখি ওদের পার্টি, কোথা থেকে ৮/ ১০টা হাঁস-মুরগী ধরে এনেছে আর সেগুলোকে অন্ধকারেই ছাড়িয়ে মাংস বের করছে আর বিড়ি টানছে। দূর থেকে আমি ঐ বিড়ির আগুনগুলোই দেখতে পেয়েছিলাম। ওদের কর্মকৌশল দেখলে অবাক না হয়ে পারা যায় না, ঐ অন্ধকার রাত্রে ধারালো ছুরি চালিয়ে খচাখচ মাংস ready করছে কিন্তু কারও হাত কাটছে না। আমি খবর নিয়ে জানতে পারলাম এখান থেকে মাংস ready হয়ে চলে যাবে রায়না হাসপাতালে। সেখানকার রান্না ঘরের কর্মীদের ভয় দেখিয়ে বা লোভ দেখিয়ে ঐ মাংস রান্না করাতো। তারপর সেই রান্না মাংস দিয়ে ওদের feast হতো।
ওদের সঙ্গে আলাপের অনেক পরে আমার জগাদার সঙ্গে আলাপ হয়। ওর অনেক বদগুণের মধ্যে একটি ভালগুণ ছিল, ও খুব ভাল তবলা বাজাতো। ব্যস ভাব হয়ে গেল ওর সাথে। চলতো গান-বাজনার আসর। এর পর জগাদার মা-কে দেখলাম, যেন কত কালের চেনা- আপনজন ! তারপর ওখানে থাকাকালীন ওদের পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিলাম। গান-বাজনার সূত্র ধরেই সন্ধ্যামা-র সঙ্গে আলাপ ।

জগাদা সেই সময় আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে এখানে ওখানে যেতো। Camp-এ থাকাকালীন প্রতি রাত্রেই আমি বাইরে বেরিয়ে যেতাম। সারারাত কাটতো হয় কোন কবরস্থানে, নাহয় কোন শ্মশানে, কিংবা কোন মন্দিরে অর্থাৎ কোন নির্জনস্থানে। এই নিয়ে যাদব কংসবণিক নামে এক Night-guard আমার নামে উপরওয়ালার কাছে complain করেছিল। একজন Director ছিল ভট্টাচার্য, সে আমাকে খুব ঈর্ষা করতো যেহেতু ছেলেরা আমার কথা শুনত, আমাকে মান্য করতো। তার নির্দেশ অনেক সময় অমান্য করেছে ছেলেরা, পরে আমার কথায় সেই কাজটা করে দিয়েছে, এসব কারণে ভট্টাচার্যের আমার উপর রাগ ছিল। ও-ই কংসবণিককে যুক্তি দিল আমার নামে উপরওয়ালার কাছে report করার জন্য। Chairman যিনি ছিলেন, তিনি আমাকে জানতেন ফলে caseটা বেশী দূর গড়ায়নি। কিন্তু আমার দলের ছেলেরা ইচ্ছা করে high tension-এর কাজ চলাকালীন ভট্টাচার্যের মাথায় range ফেলে দিয়েছিল, এর জন্য পুলিশ কেস অবধি হয়েছিল আর যাদব কংসবণিকের নানারকম আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক ক্ষতি হয়েছিল। ফলে পরে ও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অন্যায় স্বীকার করেছিল।

বাঁকুড়ার জঙ্গলে এক তান্ত্রিক আছেন শুনে তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে গিয়েছিলাম। তান্ত্রিকের স্ত্রীও ছিলেন সাধিকা। ওখানে নানারকম কথা হতে হতে সামনেই যে ধুনি জ্বলছিল তার আগুনের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবস্থ হয়ে পড়ি। তান্ত্রিক এ অবস্থার কথা জানেন না । ফলে উনি খুব রেগে গিয়ে আমাকে চিৎকার করে ডেকেছিলেন, তাতেও সাড়া না পেয়ে ওঁর হাতের চিমটা আগুনে পুড়িয়ে আমার হাঁটুর উপর জানুতে চেপে ধরেছিলেন, তাতেও তো আমার হুঁশ আসেনি—হুঁশ আসার পর আমি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ি। ঐ জায়গাটা পুড়ে গিয়ে দগদগে ঘা হয়ে গিয়েছিল। জানুতে দাগটা এখনও আছে। তবে তান্ত্রিক-মা আমার খুব সেবা করেছিলেন, এই ঘটনার বহুদিন পর আর একবার ওখানে গিয়েছিলাম, দেখলাম তান্ত্রিক মারা গেছেন, মা আছেন। তিনি পুত্রবৎ আমাকে সেবা করেছিলেন, তাই তাঁর শরীর চলে যাবার আগে আমাকে যেতে হয়েছিল। আমাকে যদি কেউ এক গ্লাস জলও খাওয়ায় আমি তার ঋণ ভুলতে পারি না ৷৷