জিজ্ঞাসু–ত্রিতাপ ক্লেশ কি ? এই ক্লেশ কিসে যায় ?

গুরুমহারাজ—ত্রিতাপ ক্লেশ হচ্ছে দেহের, মনের এবং চিত্তের ক্লেশ৷ অনেকে বলে আত্মার ক্লেশ কিন্তু আত্মার কোনো ক্লেশ নাই—আত্মা নির্লিপ্ত, আত্মা নিত্যমুক্ত-শুদ্ধ। মলিনতা, দুঃখবোধ এইগুলি যা কিছু ঘটে__তা দেহে, মনে এবং চিত্তে। ভগবান বুদ্ধদেব বললেন, দেহমল, মনোমল এবং চিত্তমল। উনি চারটি আর্যসত্য বললেন—দুঃখ আছে, দুঃখের হেতু আছে, দুঃখ নিবারণের উপায় আছে এবং পরিনির্বাণই হোলো সেই উপায়।

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, জীব যতক্ষণ না নির্বাণপ্রাপ্ত হৈচ্ছে বা আত্মাকে বোধে বোধ করছে__ ততক্ষণই ক্লেশ । কামনা রয়েছে, বাসনা রয়েছে অথচ ক্লেশ থাকবে না, তা কি করে হয় ? দুঃখের হেতু হোচ্ছে বাসনা। নির্বাসনা না হওয়া পর্যন্ত তো ক্লেশ থাকবেই।

জিজ্ঞাসু—তাহলে আমরা কিভাবে ক্লেশমুক্ত হব_গুরুজী ?

গুরুমহারাজ–বাবা ! আগে স্থির হয়ে বসতে শেখো_তারপর ত্রিতাপ জ্বালা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজবে ! আমার এখানে অর্থাৎ এই sitting-এ বসে যারা ভগবৎ প্রসঙ্গ শুনছে__দেখছি তো, তাদের অনেকেই ঠিকমতো করে বসতেই জানে না !

কোনো কিছু (বিশেষতঃ আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে তো বটেই) গ্রহণ করতে গেলে_ মেরুদও খাড়া করে বসতে হয়। পদ্মাসন, গোমুখাসন, সুখাসন ইত্যাদি যে কোনো আসনে যে যে আসনটায় comfortable অর্থাৎ যে সেই আসনে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে পারে___ সেইসব আসনে বসে সাধকের ধ্যান-জপ বা সৎপ্রসঙ্গ করা উচিত। পাতঞ্জল বলেছেন, ‘প্রযত্নশৈথিল্যম্ ‘। তন্ত্রে বলা হয়েছে – শরীরের ভাষাকে আগে ভালো করে শেখো ( ‘learn your body language’) ! যে আসনে বসলে শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহের relax অবস্থার সৃষ্টি হয় সেটাই তোমার জন্য উপযুক্ত আসন।

সাধারণতঃ আমি দেখি__ মানুষ মেরুদণ্ড ঝুঁকিয়ে বসতে যেন আরাম পায়_বিশেষতঃ একটু বেশি বয়সে। উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপনের কুফল-স্বরূপ এটা হয়। এই ধরনের ব্যক্তিদের আর কখনোই জ্ঞান হয় না। কারণ অধ্যাত্ম-বিজ্ঞান বলে Perinium থেকে Penial দুটো মেরু রয়েছে। এই মেরুদ্বয় যদি এক সরলরেখায় না থাকে, তাহলে শক্তি প্রবাহ ঊর্ধ্বগামী হবে না, আর তা না হোলে কখনই গুরুমস্তিষ্কের dormant কোষগুলো খুলবে না বা জাগ্ৰত হবে না—এটাই দেহবিজ্ঞান।

এরপর ‘অনন্তসমাপত্তি মনঃ।’ তন্ত্রের ভাষায়— ‘যোগী, তুমি তোমার মনকে অধ্যয়ন করো (Read your mind). ধ্যানী ধ্যানের গভীরে ডুবে আছে, মনে হোচ্ছে স্থির, কিন্তু মন গভীরে—আরো গভীরে ডুব মারছে—প্রচণ্ড dynamic এইভাবে অনন্তের বা বিশালতার স্পর্শ পাচ্ছে সাধক, তাই বলা হয়েছে “অনন্ত সমাপত্তি”।

খুব ছোটোবেলায় আমি বুদ্ধগয়ায় ঘুরতে ঘুরতে এক আমগাছের তলায় বসতেই কে যেন বলতে লাগলো —‘ধ্যান করো’, ‘ধ্যান করো, ধ্যান করো।।ভগবান বুদ্ধের এটাই শিক্ষা ছিল—ধ্যানের গভীরে পাবে অনাবিল শান্তি, বাইরে দেখো না – জগৎ দেখো না। রূপ, রস, শব্দ, গন্ধাদিতে মত্ত হয়ো না, কারণ ওসবে ‘মার’-এর হাত আছে। যাইহোক নির্দেশমতো ধ্যানের গভীরে ডুব দিতেই অনাবিল শান্তির আস্বাদন হলো।

প্রশান্ত মন নিয়ে নির্মল হৃদয়ে ওখান থেকে গয়ায় গেলাম। পাণ্ডাদের অত্যাচার এবং অনাচার দেখে আবার মন বিষণ্ণ হোলো। ওরা গদাধরের পাদপদ্ম স্পর্শ করতেও দিলো না। চলে এলাম ফল্গু নদীর ধারে এক নির্জন স্থানে, একটি বকুল গাছের নীচে বসতেই কে যেন বলতে লাগলো – “বিচার করো, বিচার করো’, বিচার করো। বেদান্তের শিক্ষা — বিচারের শেষে অপার আনন্দের স্বাদ পাবে—’হে পান্থ, বিচার করো। পাখীর গান শোনো __ সমস্তই মধুরম্__সবকিছুই সুন্দর, কারণ এটি ব্রহ্মের প্রকাশ। সুন্দর দৃশ্যাবলী দেখো—এগুলি সুন্দর, কারণ এসব ব্রহ্মের প্রকাশ । মধুরম্, মধুরম্ —‘রসঃ বৈঃ সঃ’। মন বিচারের গভীরে ঢুকে যেতেই বিমল আনন্দে আমার সমস্ত অন্তঃকরণ প্লাবিত হয়ে গেল ৷৷