জিজ্ঞাসু—তাহলে গুরুজী __এই জগৎ-সংসার নিয়ে যে স্বপ্ন দেখা বা কল্পনা করা, এগুলো কি ঠিক নয় ?

গুরুমহারাজ— দ্যাখো, আমি তোমার কথা বলতে পারি না (বলা উচিত নয়–তাই !) কিন্তু আমার কথা আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি। আমি এই জগৎ-সংসার নিয়ে কখনও স্বপ্ন দেখিনা, তবে জগৎ নিয়ে আমি কল্পনা করি। আমার মনে নানান ভাবনার উদয় হয় কিন্তু কখনও সেগুলো পেতে অর্থাৎ লাভ করতে ইচ্ছা করি না। কল্পনাকেও উপভোগ করা যায়, এও এক ধরণের enjoyment ! আমার এইরূপ অবস্থা হোলে তখন আমি কবিতা লিখি।

সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখে, কল্পনা করে আর সে সেইরকমটাই হোতে ইচ্ছা করে বা কল্পনার বস্তুসমূহকে পেতে ইচ্ছা করে। দুই রকম স্বভাব রয়েছে __জীব-স্বভাব আর শিব-স্বভাব! শিবের কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার নেই, যেহেতু সমস্ত ঐশ্বর্য তাঁর করায়ত্ত। স্বয়ং অন্নপূর্ণা যাঁর স্ত্রী– তিনি হোলেন শ্মশানবাসী, পশুচর্ম তাঁর বস্ত্র, ভূমি তাঁর শয্যা।

এক-এক সময় আমারও মনে প্রশ্ন জাগে সহজতাই তো জীবের ধর্ম, তাহলে মানুষ কেন সহজ না হয়ে এতো অসহজ, এতো জটিল ? তখন উত্তর পাই—”এই বিশ্বসংসার কালীর নৃত্য, কালীর খেলা। শিবের বুকে কালীর নৃত্য হয়ে চলেছে। এইজন্যই দেখবে—শান্ত, সমাহিত শিবের বুকে নৃত্যরতা বা গতিশীল কালীমূর্তি তৈরী করা হয়েছে। শিব Static — নির্গুণ ব্রহ্মের প্রতীক আর কালী Dynamic — সচল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অর্থাৎ শক্তির প্রতীক।

যাইহোক যা বলছিলাম, এই বিশ্বসংসার যেন শিবের বুকে কালীর নৃত্য—কালীর খেলা। তবে এখানে কালী নাচছেন শিবের চোখের দিকে তাকিয়ে—শিবের ভাল লাগছে কিনা সেটা দেখছেন। শিবের ভাল লাগছে তাই নির্দিষ্ট ছন্দে কালী নেচে চলেছেন। কালীর এই নাচের ফলে জগতে সু ও কু দুই হচ্ছে। তবে কি হোচ্ছে তাতে কিছু এসে যায় না কালীর। শিব প্রশান্ত আছেন এটাই শেষ কথা। এবার নাচতে নাচতে যদি কালী দেখেন শিব যেন কেমন অপ্রসন্ন—ভ্রু কোঁচকাচ্ছেন, কালী নাচের ছন্দ বদলে দেবেন। পুরাতন ছন্দকে withdraw করে নেবেন। এরফলে জগতে বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রলয় হয়ে যেতে পারে, তাতেও কিছু এসে যায় না। মানুষ কালীর এই রূপকেই সংহাররূপা, ভীষণা ইত্যাদি বলে বর্ণনা করেছে। কিন্তু কালীর কাজ শিবের প্রসন্নতা অর্জন, তাই ছন্দবদল – সেটাও যদি পছন্দ না হয় আবার বদলে দেবেন। এইভাবেই হয়ে চলেছে যুগ থেকে যুগে, কাল থেকে কালে কালীর নাচন।

কালীর নৃত্যের ছন্দে যতক্ষণ শিবের interest রয়েছে —ততক্ষণ কালী ঐ নির্দিষ্ট ছন্দে নাচছেন। আবার কালীর নৃত্যের ছন্দে যখন‌ই শিবের interest থাকছে না, কালী মুহূর্তের মধ্যে সেই খেলাঘর ভেঙে দিচ্ছেন। তাই মহাসাধক গান গেয়েছেন, ‘জীব যেন ‘পুতুল নাচ’-এর পুতুল!’ এই খেলায় বা এই নাচে কালীরও interest রয়েছে—কিন্তু সেটা শুধুই শিবের প্রসন্নতা অর্জনের জন্য।

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এইভাবেই শিব-শক্তির খেলা নিরন্তর হয়ে চলেছে। প্রতিটি জীবের মধ্যে, অণু-পরমাণুর মধ্যে, মানুষের মধ্যে এই একই তত্ত্ব বিদ্যমান। একই খেলা হয়ে চলেছে। শক্তি খেলা করে চলেছে। আর শিব নির্গুণ শান্ত সমাহিত হয়ে শুধু enjoy করে চলেছেন।