জিজ্ঞাসু—আচ্ছা গুরুজী! অনেকে যে “শক্তি” মানে না ?

গুরুমহারাজ—যে কোনো একজন ব্যক্তির ‘মানা’ বা না ‘মানা’র উপর মহাবিশ্ব প্রকৃতির নিয়ম কি নির্ভর করে _বাবা ! সে তার নিজস্ব নিয়মেই চলে। তবে যারা জ্ঞানযোগী তারা বিচারমার্গী। ফলে ‘সব মায়া’ বলে তারা অনেক কিছুই উড়িয়ে দেয়—কিন্তু জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ শঙ্করাচার্যের জীবনকাহিনী থেকে জানা যায় যে, কোনো এক সময় শক্তি না মেনে তাঁর খুবই দুর্দশা হয়েছিল।

আচার্যের এমন দু-একটা ঘটনা বলছি শোনো। প্রথমবার কাশীতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শংকর। কাশী অন্নপূর্ণার ক্ষেত্র, আবার শিবক্ষেত্রও বটে। কিন্তু শুষ্ক জ্ঞানমার্গী শংকরের মুখে শুধুই শিবস্তোত্র। নতুন নতুন শব্দালঙ্কার যোগে উচ্চনাদে শিবের মহিমা বর্ণনা করছেন আর ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শক্তিকে অস্বীকার করায় এর ফল হোলো ওনার খ্যাঁট্(আহার) বন্ধ হয়ে গেছিল। যাই হোক, আহারবিহীন ভাবে তিনদিন কেটে গেল, শংকরের ভাগ্যে কোনো খাদ্যই জুটলো না। তবু শংকর তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন, শক্তিকে উনি স্বীকার করবেন না । সেদিনও তিনি নিত্যদিনের অভ্যাসমতো গঙ্গায় স্নান করতে গেছেন দশাশ্বমেধ ঘাটে, উনি দেখলেন_ এক মহিলা একটি মৃতদেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর সেই দেহটি রাস্তা জুড়ে শোয়ানো। শংকর বিরক্ত হয়ে মহিলাকে বললেন, ‘মৃতদেহটি সরিয়ে নাও।’ উত্তরে মহিলাটি অবিচলিত কণ্ঠে বলল, ‘ ঐ মৃতদেহকেই সরতে বলো।’ এর উত্তরে শংকর বললেন, ‘কি আশ্চর্য ! মৃতদেহকে বললে সে সরবে কেন—মৃত শরীরের তো প্ৰাণশক্তিই নেই !’ মহিলা হাসলো – তারপর বললো, ‘তুমি যে শক্তি মানো না—এই দ্যাখো আমি সরিয়ে নিচ্ছি।’ এই বলে অদৃশ্য হয়ে গেল ! হতবাক শংকর স্নান সেরে নিলেন আর সেদিনই তাঁর খাবার জুটলো।

আর একবার শংকরাচার্য গঙ্গার জল পান করার জন্য জলে নামতে যাচ্ছেন হঠাৎ ৫/ ৬ হাত দূরে পড়ে গেলেন। পড়ে গিয়েই তাঁর এমন অবস্থা হোলো যে, আর নড়বার শক্তি নেই। ‘জল’, ‘জল’ বলছেন কিন্তু একটুও নড়তে পারছেন না। অথচ ৫/৬ হাত দূরে গঙ্গার জল। এমন সময় এক বৃদ্ধা কাঁপতে কাঁপতে সেখানে এসে হাজির । বৃদ্ধা এসেই বলল, “ঐতো জল – ‘জল’-‘জল’ করছো কেন ? যাও পান করো।” অসহায় শংকর বললেন, “আমি যে শক্তিহীন !’ মহিলা বললেন, ‘তাহলে শক্তিহীন অবস্থাটা বুঝলে তো ! তুমি তো আসমুদ্রহিমাচল বেদান্ত প্রতিষ্ঠা করে বেড়াচ্ছো কিন্তু এইটা করার জন্য যে শক্তি-সামর্থের দরকার হয়েছে__ তা তুমি কোথা থেকে পেয়েছো ? তবে তুমি কেন শক্তি অস্বীকার করছো ?’

আচার্য শংকর ঐ সামান্য বৃদ্ধার এই ধরণের কথা শুনে একটু বিস্মিত হোলেন, তারপরেই দেখলেন যে_ সেই বৃদ্ধাও অন্তর্হিত এবং তাঁর আর তৃষ্ণাও নাই।

আরও একটা ঘটনার কথা বলি ! একবার বারাণসীতেই ভোরবেলায় শংকর স্নান সেরে ফিরছেন। দেখেন যে, এক চণ্ডাল মদ খেয়ে কতকগুলো কুকুরকে টানতে টানতে তাঁর দিকেই আনছে। একটু দূর থেকেই শংকর বললেন, ‘সরে যাও গায়ে পড়বে যে ! দেখছো না__ আমি স্নান করে শুচি হয়ে যাচ্ছি, আর তুমি অশুচি !’ চণ্ডাল সঙ্গে সঙ্গে বেদান্তের শ্লোক থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলে উঠল, “কে শুচি আর কে অশুচি ? ব্রহ্মে তো শুচি-অশুচি নেই—সঃ ব্ৰহ্ম নির্বিশেষঃ।” এই কথাগুলি শুনেই আচার্য শংকর নিজের পণ্ডিতভাব ছেড়ে দিয়ে সেই চন্ডালকে উদ্দেশ্য করে নমস্কার করে বললেন, “ধন্য এই বারাণসী—যেখানে চণ্ডালও বেদান্ত বলে !”

এর পরেই শংকর মহাদেব প্রকট হলেন – পাশে মা অন্নপূর্ণা। শংকর অন্নপূর্ণা- স্তোত্র লিখলেন, গঙ্গাস্তোত্র লিখলেন। শক্তি মানলেন শংকর এবং তাঁর মধ্যে যেসব অপূর্ণতা ছিল_ তা পূর্ণতা লাভ করলো।’

এইভাবে দেখা যায় __জ্ঞানীরা প্রথমে শক্তি মানে না কিন্তু পরে মানে। বামদেবও কাশীতে খেতে পান নি। এক বৃদ্ধা দিতে এসেছিল উনি ফেলে দিয়েছিলেন। মনে মনে অহংকার ছিল—মা অন্নপূর্ণা খাদ্য নিয়ে আসবেন, যেহেতু উনি মায়ের সাধক। ব্যস্ _ ওনার‌ও খ্যাঁট্(আহার) বন্ধ হয়েছিল, উনিও তিনদিন খেতে পেলেন না। কিন্তু ওনার তো বালকভাব, পরে মায়ের কাছে কাঁদতে লাগলেন এবং ✓রীমা ওনার সামনে প্রকট হয়েছিলেন।

দ্যাখো, মায়ের কাছে বালকের কোনো অপরাধই মারাত্মক হয় না। একটু-আধটু বকাবকির পরই মাফ্। খুব বদমায়েশি করলে তবেই মা খ্যাঁট্ বন্ধ করে দেন, তাও কিছুক্ষণের জন্য ! তারপর দেখা যায় _মা ঐ ছেলেকে যত্ন করে কোলে বসিয়ে খাইয়ে দে’ন। এখানেও সেইরকমটাই হয়েছিল!

বামদেবের ছিল বালকস্বভাব। একবার কলকাতার এক ধনীভক্ত খুব করে ধরলো —তার বাড়ি একবার বাবাকে নিয়ে যাবে। বামদেবের যাবার ইচ্ছা ছিল না, তবুও তারা নগেনকাকা কে ধরে রাজি করিয়ে একপ্রকার জোর করে নিয়ে গেছিল। সেই বাবু বামদেবকে নিয়ে গিয়ে খুব যত্ন করলো—খুব খাওয়ালো। তারপর ভাল বিছানায় শুতেও দিলো। রাত্রে বামদেব গোটা বিছানায় হেগে মাখামাখি করে রেখে দিলো। এই ঘটনার পর ঐ ধরণের বাবুরা আর কখনও বামদেবকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যাবার নাম করে নি।

এই ঘটনার অনেক পরে ওনার শিষ্যরা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘বাবা আপনি অমনি করে বিছানায় হেগে দিয়েছিলেন কেন ?’ বামদেব শিশুসুলভ সরলতায় উত্তর দিল, ‘কি করব বাপু ! বাবুরা ভাল খাওয়ালে, বেশী করে খেলাম, রাত্রে হাগা পেল আর সামলাতে পারলাম না, বিছানাতেই হয়ে গেল। তারপর হাতে করে পরিষ্কার করতে গিয়ে গোটা বিছানায় মাখামাখি হয়ে গেল।’

ত্রৈলঙ্গস্বামীর জীবনেও কাশীতে প্রথমদিকে ঐ রকমই ঘটনা ঘটেছিল। তবে পরবর্তীকালে জীবনের বেশীর ভাগ সময়ই উনি বারাণসীতেই কাটিয়েছিলেন। প্রায় ২৮০ বছর আয়ু ছিল তাঁর। এই বিশাল জীবনকালে তাঁর জীবনে কত ঘটনা যে ঘটেছে, জীবনীকাররা তার আর কতটুকু লিখেছেন ! অনাসক্ত বা নির্লিপ্ততার তিনি প্রতিমূর্তি। যেন সাক্ষাৎ মহাদেব। লোকে বলতো_ ‘কাশীর চলন্ত শিব’। একবার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, রাজা-রাণী রাজপ্রাসাদ থেকে ওনাকে দেখলো। লোক পাঠিয়ে নিয়ে গেল অন্দরমহলে। সোনার সিংহাসনে বসিয়ে নানান দ্রব্যাদি দিয়ে পূজা করল, দামী সোনার জরি-বসান শাল গায়ে জড়িয়ে দিল ও অলঙ্কার পরালো। পূজা শেষে ত্রৈলঙ্গস্বামী আবার হাঁটতে লাগলেন। চোরেরা দেখলো নাঙা সাধুবাবার গায়ে দামী শাল, অলঙ্কার–প্রণাম করলো। উনি দাঁড়িয়ে গেলেন। চোরেরা একে একে প্রণাম করে ওনার গা থেকে গয়নাগুলো খুলে নিল, শালটাও নিয়ে নিল। সাধুবাবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। সব নেওয়া হোতেই ওরা চলে গেল। ত্রৈলঙ্গস্বামীও হাঁটতে লাগলেন। কোন বিকার নেই, কোন বিক্ষেপ নেই। এটাই অনাসক্তি। সাক্ষাৎ শিব ছাড়া জগতে কি এটা সম্ভব !

মুখে ‘জ্ঞানী’ ‘জ্ঞানী’ বললেই হয় না বাবা—এই দ্যাখো সাক্ষাৎ জ্ঞানীর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ! জ্ঞানী তিনিই যিনি প্রকৃত অর্থে জানেন, ‘জগৎ মিথ্যা বা অনিত্য।’ কাজেই জাগতিক কোনো বিষয়ই তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।