শ্রীশ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের সাথে শ্রীধরপুর (মেমারী) আশীষ মাস্টারমশাই-এর ঘটে যাওয়া কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো ৷ আমরা আগেই বলেছিলাম যে, শ্রীধরপুর (মেমারী) থেকে বনগ্রাম আশ্রম প্রায় ১৬ কিলোমিটার রাস্তা, কিন্তু স্কুল ছুটি হোলেই (আশীষ মাস্টারমশাই শ্রীধরপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন) উনি সাইকেল নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বনগ্রাম আশ্রমে চলে আসতেন এবং সন্ধ্যা অব্দি সিটিং শুনে তারপর পুনরায় শ্রীধরপুরে ফিরে যেতেন।

এটা ছিল ১৯৮৩/৮৪ বা আরো একটু আগের সময়কার ঘটনা ৷ তখন গ্রামগঞ্জের রাস্তাঘাটও অতোটা উন্নত ছিল না, ফলে তখন শ্রীধরপুর থেকে সাইকেল করে যারা বনগ্রাম আসতো [তখন ওখান থেকে নিয়মিত আসতো তপন মুখার্জি (যে পরে স্টেট ব্যাংকে চাকরি করতো), উমাপদ প্রামানিক (যিনি গুরুজীর চুল-দাড়ি কাটতেন এবং প্রতি বৃহস্পতিবার এসে আশ্রম-বালক এবং সাধু-ব্রহ্মচারীদের চুল-দাড়ি কাটতেন), তাছাড়া আশীষ মাস্টারমশাই এবং মাঝে মাঝে আরো দু-চারজন ওদের সঙ্গে বনগ্রামে আসতো।]— তাদের খুবই কষ্ট হোতো এবং অনেকটা সময় লেগে যেতো। বর্ষাকালে সাইকেলে আসার কথা ভাবাটাও কষ্টকর ছিল ৷ তখন সাধারণ মানুষের কাছে মোটরসাইকেলের ব্যবহার একেবারে ছিল না বললেই হয় ৷ তখন বনগ্রাম আশ্রমে মোটরসাইকেল নিয়ে আসতো — এমন হয়তো দু-তিন জন ছিল, যারা ‘রাজদূত মোটরসাইকেল’ ব্যবহার করতো এবং কোনো কোনো সময় গুরুমহারাজকে চাপিয়ে এখানে-ওখানে নিয়ে যেতো ৷

যাইহোক, সেই সময়কার কথা হচ্ছিলো যখন আশীষ মাস্টারমশাইরা শ্রীধরপুর থেকে সাইকেলে চেপে ১৬ কিলোমিটার পথ নিয়মিত যাওয়া-আসা করতেন। এমনই একদিন গ্রীষ্মের রৌদ্রের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে মাস্টারমশাই আশ্রমে ঢুকে সাইকেলটা অফিসের ঐদিকটায় রেখে গুরুজীর ঘর খোলা দেখে – ওনার সাথে দেখা করা এবং প্রণাম করার জন্য একেবারে গুরুজীর ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন ৷ অতোটা দূর থেকে সাইকেল চালানোর জন্য এবং বাইরে প্রচন্ড গরম থাকার জন্য মাস্টারমশাই খুব ঘামছিলেন ৷ গুরুজী ওনার ঘরের মাটির বেদীতে বসেছিলেন – ওনার হাতে ছিল একটা হাতপাখা (তখন আশ্রমে কারেন্ট যায়নি), যেটা দিয়ে উনি ঘরের মধ্যে বসে নিজে নিজেই বাতাস করে গরমের হাত থেকে একটু relief পাবার চেষ্টা করতেন ৷ প্রসঙ্গতঃ একটা কথা এখানে বলে রাখা যায় যে, গুরুমহারাজকে অনেকসময়েই ভক্তেরা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করার চেষ্টা করতো ৷ কিন্তু গুরু মহারাজ এতে ঘোরতর আপত্তি জানাতেন ৷ উনি বলতেন – “বেশিরভাগ মানুষই সেবা করতে জানে না ৷ প্রকৃতঅর্থে সেবা মানে হলো সাধনা I একনিষ্ঠ এবং অনন্যচিন্ত হয়ে সেব্যের প্রতি সেবকের একান্ত অনুরাগ এবং তাঁর সর্বাঙ্গীণ প্রীতি উৎপাদনের জন্য কাজ করে যাওয়া-ই সেবা I কিন্তু আমি দেখেছি মানুষ (নারী অথবা পুরুষ) আমার প্রীতি উৎপাদনের জন্য বা আমার কোনো প্রয়োজন মেটানোর জন্য কাজ করতে অগ্রসর হয়, কিন্তু অল্প সময়ের পরেই দেখি তার মন অন্যদিকে চলে গেছে। ফলে অন্যমনস্ক অবস্থায় তার কাজের নানান ভুল-ত্রুটি ঘটে যায় ৷ আমাকে অনেকেই হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে চায় (আসলে গুরুমহারাজ এতো বেশি ঘামতেন যে, যেকোনো ব্যক্তিরই ওনাকে দেখে কষ্ট হোতো। মনে হোতো ওনাকে একটু হাওয়া করি৷), কিছুক্ষণ ঠিকঠাক চলে – তারপরেই দেখি ঠকাস্ ঠকাস্ করে আমার গায়ে বা মাথায় ওর পাখা ঠুকে যাচ্ছে ! এতে আমার আরাম হবে কি – অস্বস্তি বেড়ে যায় ৷ তাছাড়া ওই ব্যক্তি জানতেও পারে না যে, একটুখানি সেবা করতে এসে আমার গায়ে পাখা দিয়ে ঠোকাঠুকি করার ফলে ওর নিজের কতোটা কর্মফল সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে ! এইজন্যেই আমি সচরাচর কারোকেই হাতপাখার বাতাস করতে বলি না বা কেউ করতে চাইলেও আমি নিষেধ করি। ”

যাইহোক, গুরুমহারাজের নিজের কথা থেকে আমরা অনেক কিছুই শিখতে পারলাম ৷ অবশ্য সবসময়েই অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি পদে আমরা তাঁর কাছে শিখতাম – এখনো শিখে চলেছি ৷ আমরা তো সত্যি সত্যিই ভালো কিছু জানতাম না, যেটুকু ভালো – তা ওনার কাছেই শেখা ! তাই তো সেই মহান মানুষটির স্মৃতিচারণ করতে বসলেই শুধু দুচোখে জল ভরে আসে – তার প্রেমের কথা স্মরণ করে এখনো আমরা তন্ময় হই, দু-চারজন গুরু-ভাইবোন জুটলেই তাঁর কথায় মশগুল হই ! আর একবার তাঁর কথা উঠলেই বাকি সবকথা ম্লান হয়ে যায়, তখন আর ‘আন্‌কথা’ ভালো লাগে না ৷ আমার ধারণা আমাদের সমস্ত গুরু-ভাইবোনেদের এই ব্যাপারে একইরকম অভিজ্ঞতা ৷

এখন আমরা আবার আগের কথায় ফিরে আসি। আশীষ মাস্টারমশাই সেদিন গরমের মধ্যে ১৬ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে ঘর্মাক্ত কলেবর হয়ে গুরুজীর ঘরে পৌঁছেছিলেন এবং তখন গুরুজী তাঁর ঘরের বেদীতে বসে একটা হাতপাখা নিয়ে নিজেই নিজেকে হাওয়া করছিলেন ৷ এই অবধি বলার পর আমরা যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম – কিন্তু আবার আমরা সেখানেই ফিরে আসছি ৷ মাস্টারমশাইয়ের ওইরকম গরমের মধ্যে কষ্ট করে আসায় এবং তার মধ্যে ওইরকম দরদর্ করে ঘাম হোচ্ছে দেখে__ গুরুজী তৎক্ষণাৎ নিজেকে পাখা করা বন্ধ করে মাস্টারমশাইকেই হাওয়া করতে শুরু করে দিয়েছিলেন ! (বাকি কথা পরের দিন)