[সিরডির সাইবাবা সংক্রান্ত আলোচনার আজ শেষাংশ]

… এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। এরপর যে চিত্র পাওয়া যায় তা হোলো __মহারাষ্ট্রের ‘শিরডি’ নামক স্থানে ফকিরবেশী এক মহাত্মা, মাথায় ফেটি এবং কাঁধে ঝোলা নিয়ে ধুনি জ্বালিয়ে সবসময় এক গাছতলায় বসে থাকতে দেখা যেতো। স্থানীয় মানুষ তাঁকে বিরক্ত করতো না বরং ভক্তি করতো। একবার এক রাজপুরুষের একটি ঘোড়া জঙ্গলে হারিয়ে যায়, সেই ঘোড়ার সন্ধান করতে করতে রাজপুরুষটি এসে ফকিরের সামনে হাজির। তিনি এসে দেখলেন ফকিরের ধুনির আগুন নিভে গেছে কিন্তু ফকিরটি মাটিতেই চিমটি ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে ফেললেন। এটা দেখে তাঁর খুবই কৌতূহল হোলো। তিনি ভাবলেন এই ফকির নিশ্চয়ই কোনো মহাপুরুষ, তাই তিনি ফকিরের সামনে এসে তাঁর দুঃখের কথা নিবেদন করলেন। ফকির তাঁকে বললেন, ঘোড়া হারানোর জন্য দুঃখ করার কোনো কারণ নাই, কারণ ঘোড়াটি তাঁর পিছনের গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটি পাগলের মতো দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখলেন সত্যিই ঘোড়াটি সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি অবাক-বিস্ময়ে করজোড়ে ফকিরবাবার সামনে নতজানু হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কে ’? ফকির উত্তর দিলেন, “আমি সাইবাবা”।

বাউল গানে আছে – “যিনি সহজ তিনিই সাঁই। সাঁই-এর উপরে আর কিছু নাই।” যাইহোক, তখন থেকেই লোকের মুখে মুখে সাইবাবার নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। শিরডিতে তাঁর আত্মপ্রকাশ হয়েছিল বলে তিনি ‘শিরডির সাইবাবা’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় বহু আর্ত, দুঃখী, পীড়িত মানুষ তাদের নানান সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে আসতো এবং তিনি তাঁর সাধন-বিভূতি প্রয়োগের দ্বারা সেই সমস্ত মানুষের দুঃখমোচন করতেন । এইরকম বহু ঘটনার কথা তাঁর জীবনচরিতে উল্লেখ রয়েছে। সম্প্রতি তাঁর জীবনী নিয়ে নাটক শুধু নয়, film-ও হয়ে গেছে।

জানো, সাধুসমাজে একটা কথা খুবই প্রচলিত রয়েছে যে, শিরডির সাইবাবা ছিলেন মহাত্মা কবীরের উত্তর শরীর ! এর কারণ হয়তো হোতে পারে – দুজনেরই জন্মবৃত্তান্ত অনেকটা একই রকমের অথবা অন্যান্য ক্ষেত্রেও কিছু মিল রয়েছে–সেইজন্যেই। তবে জানবে কোনো মহাপুরুষ যে পরিবারেই জন্মগ্রহণ করুন না কেন, সেই পরিবারের লোকেদের বা তাঁর পিতামাতাকে অশেষ দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। এখানে শিরডির সাইবাবার ক্ষেত্রেও এই রকম হয়েছিল।

তবে একথা জেনে রাখবে যে, শিরডির সাইবাবা যে শরীরটা নিয়ে লীলা করে গেছেন, তাঁর সেই স্থূল শরীরটি বর্তমানে না থাকলেও তিনি সুক্ষ্মশরীরে এখনও কাজ করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন যোগী, মহাত্মাদের বিপদ-আপদে শরীর রক্ষা করা বা তাঁদের সুবিধা-অসুবিধাগুলির ব্যাপারটা তিনি দেখেন।

একটা উদাহরণ দিয়ে বলছি শোনো__ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনকালে একবার এমন অবস্থা হয়েছিল যে, তিনি আর কিছু খেতে পারতেন না অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রের নীচে আর মনকে নামাতে পারতেন না ! সবসময় আনন্দময় কোষের ক্রিয়া চলতো, ঈশ্বরীয়ভাবে—তুরীয় স্থিতিতে বিরাজ করতেন। ‘হৃদয়’-এর মতো অমন যে সেবক– সেও faliure হয়ে গিয়েছিল ! কারণ ঐ অবস্থা থেকে মনকে কি করে নিচে নামাতে হয়, সে কায়দা তো আর হৃদে(হৃদয় নাথ মুখার্জি)-র জানা ছিল না, এটা যোগের আচার্যের কাজ। কিন্তু সেইসময় কোথা থেকে এক ফকির এসে হাজির হয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরে। তিনি ক’দিন ওখানে থেকে ঠাকুরকে খাবার সময় লাঠি হাতে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়াতেন। এইভাবে কয়েকদিন করার পর ধীরে ধীরে ঠাকুরের মন পার্থিব জগতে নেমে আসে এবং তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছিলেন। এই কাজ শেষ হোতেই সেই ফকির কিন্তু উধাও হয়ে যান। মাথায় পাগড়ি, হাতে চিমটাওয়ালা ঐ ফকিরই ছিলেন শিরডির সাইবাবা। ঠাকুরের শরীর রক্ষার জন্য গুরুকুল থেকে নির্দেশিত হয়ে তিনি ঐ কাজটি করে দিয়েছিলেন।

আর একবার ঋষিকেশে শিবানন্দ সরস্বতী মহারাজের নিজের শরীরে কুম্ভক ক্রিয়ার পর বায়ু আটকে গিয়ে এমন অবস্থা হয়েছিল যে, তাঁর প্রাণ-সংকটকাল উপস্থিত হয়েছিল ! তৎকালীন সাধুসমাজের সমস্ত মণ্ডলেশ্বর-যোগাচার্যদের ডেকেও কোনো ফল হয়নি। অবশেষে শিষ্য- ভক্তরা গুরুদেব শরীর ছেড়ে দেবেন ভেবে ধূপ-ধুনা জ্বালিয়ে নাম-গান করতে শুরু করেছিল। প্রায় তিন দিন পর ঐ ধূপ-ধুনার ধোঁয়ার কুণ্ডলীকে আশ্রয় করে এক মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছিল, যাঁর মাথায় পাগড়ি হাতে চিমটা ছিল। উনি প্রকট হবার পর শিবানন্দ সরস্বতীর শরীরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে চিমটার বাড়ি মারতেই শিবানন্দ “আঁক্” করে শব্দ করে পড়ে গিয়েছিলেন এবং ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেছিলেন। কিন্তু এই ঘটনার পর ফকিরবাবা আবার অন্তর্হিত হয়ে যান। এই ঘটনাটি বহু লোকের সামনেই ঘটেছিল। সেখানে শুধু যে শিবানন্দ সরস্বতীর শিষ্যরাই ছিলেন তা নয়—অন্যান্য পরম্পরার বহু সাধু-ব্রহ্মচারী—এমনকি সাধারণ মানুষও উপস্থিত ছিল। কারণ ঐ সময় বিখ্যাত যোগী-মহাত্মা শিবানন্দ সরস্বতীর প্রাণ-সংকটকাল উপস্থিত শুনে তাঁকে দর্শন করতে হাজার হাজার মানুষ ঋষিকেশে ওনার আশ্রমে এসেছিল। ফলে বহু মানুষের সামনেই ঘটনাটা ঘটেছিল।

এইরকম বহু ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায় যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শিরডির সাইবাবা এখনও সূক্ষ্মভাবে সাধু-মহাত্মাদের অর্থাৎ যাঁদের দ্বারা সমাজের কল্যাণসাধিত হবে—তাঁদের শরীর রক্ষা করে থাকেন বা তাঁদের সাধনে কোনো বিঘ্ন ঘটলে তিনি তা থেকে তাঁদের রক্ষা করেন ৷৷