আজ ১লা বৈশাখ – ১৩৯৭ সাল, শুভদিন ব’লে বনগ্রাম আশ্রমে অনেকে এসেছেন, আবার আসছেনও অনেকে ! ভক্তদের কেউ কেউ গুরুজীর পায়ে ফুল-বেলপাতা দিয়ে প্রণাম করছেন, কেউ ওনার গলায় মালা পরিয়ে দিচ্ছেন। গুরুমহারাজ সেগুলি তাড়াতাড়ি খুলে পাশে সরিয়ে রাখছেন। ভক্তদের মধ্যে থেকে কেউ একজন জিজ্ঞাসা করলেন – “বাবা, আপনি কি মালা-পরা খুব একটা পছন্দ করেন না ?”

গুরুমহারাজ:—কি বলবো বলো। আমার সন্তানেরা অনেকে দূরদূরান্ত থেকে আসে,মালা বাজার থেকে কিনে এনে আমাকে পড়াতে চায় ! তাদের এই ইচ্ছায় বাধা দেওয়া আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। তবে জানো, বেশিরভাগ সময়েই সেটা অত্যাচারে পরিণত হয়—এটা কষ্টের ! তার কাজে, তাদের গুরু কতোটা প্রসন্ন হোলো__এইভাব তো সবার থাকে না । সে তার নিজের বাসনা চরিতার্থ করার জন্যই এসব করে থাকে। আজকালকার দোকানে কেনা ফুল সাধারণত বাসি হয়।
দোকানদারেরা রঙ করে করে দীর্ঘদিন রেখে দেয় ! ফলে ভাইরাস,ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস এবং বিভিন্ন রকমের পোকামাকড়ও থাকে তাতে। একবার ঐ রকম রঙ করা রজনীগন্ধার মালা কে একজন আমাকে পরিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পরেই দেখি গলার কাছটা জ্বালা করছে, বেশ ফুলেও উঠেছিল ! কোনো বিষাক্ত পোকা ছিল বোধহয়, তাই ঐরকম হয়েছিল।

আবার অনেকে আমাকে এতক্ষণ ধরে প্রণাম করে যে, অন্য লোকে বিরক্ত হয়। অনেক মেয়েরা হয়তো ইচ্ছা করেই আমার পায়ে মাথা ঘষে ঘষে সিঁথির সিঁদুর লাগায়—এগুলো কি রকম অত্যাচার বলোতো ? তারপর আরও মুশকিলে পড়ি কখন জানো–হয়তো সিটিং-এ কোনো উচ্চস্তরের আলোচনা চলছে, সেই সময় কেউ এসে অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করলো বা জোরপূর্বক মালা পরালো অথবা জিজ্ঞাসাই করে বসলো, ‘গুরুজী কেমন আছেন ?’ তাকে উত্তর দিতে গিয়ে বা ঐ দিকে মনোনিবেশ করতে গিয়ে আগের আলোচনা দারুণভাবে ব্যহত হয়। কারণ আমিতো মুখস্থ কোনো কথা বলি না— একটা নির্দিষ্ট vibration থেকে ধরে নিয়ে কথা বলি। সেইসময় কেউ disturb করলে দুম্ করে সেখান থেকে অনেক নীচের level-এ নেমে আসতে হয়—এতে খুবই কষ্ট হয়।

সর্বোপরি অনেককে দেখি, আশ্রম থেকেই ফুল-বেলপাতা ছিঁড়ে নিয়ে এসে আমাকে দেয়। এটা আমার ভালো লাগে না। কত কষ্ট করে আশ্রমিকরা ফুল গাছ তৈরী করে—সে সব কথা না ভেবে ফুলগুলো ছেঁড়া কি মানুষের উচিত ? বাড়ীতে ফুলগাছ লাগিয়ে_ সেখান থেকে ফুল নিয়ে এলে সেটাকে আমি প্রসন্নভাবে গ্রহণ করি ! কারণ এর পিছনে ভক্তটির শ্রম এবং ভক্তি বা নিষ্ঠা মিশ্রিত রয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের এসব জ্ঞান নেই !জানতো কথায় আছে —মানুষ ব্ৰহ্মজ্ঞান চাইছে অথচ কাণ্ডজ্ঞানের অভাব।
তবে, আমার প্রকৃতি অনুযায়ী আমি সব ফুল পছন্দও করি না। সাদা রঙের ফুল এবং গেরুয়া বা হলুদ ফুল ভাল লাগে। গেরুয়া ফুল —যেমন চাঁপা, হিমালয়ান ধুতুরা। সাদা ফুলের মধ্যে পদ্ম আমি খুব ভালোবাসি। এছাড়া জুঁই, বেলফুল, বকুল, শিউলি এগুলি ভালোলাগে। কিন্তু রজনীগন্ধা ভালোলাগে না, ওটা যেন বিয়ে-বাড়ী আর মৃতদেহ সাজানোর ফুল বলে মনে হয়। কেন এমন হয় কি জানি–হয়তো বিদেশী ফুল বলে আমার সংস্কারে এই ফুলের বিশেষ কোনো impression-ই কাজ করে না। লাল ফুল আমার একদম ভাল লাগে না। কোনো কবি জবাফুলকে তামসিক বলে উল্লেখ করেছেন। আসলে লাল রঙ উগ্রতার প্রতীক। ঐ জন্য যেখানে কালীর উগ্ররূপ সেখানে জবার যেমন সমারোহ তেমনি রক্তের প্লাবনও(বলিদান) বেশী—দুটোই লাল।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একবার কোনো এক জায়গায় উগ্র কালীমূর্তির ছবি দেখে গৃহস্বামীকে বলেছিলেন—ছবিতে প্রতিদিন লাল জবা ফুল দিতে না পারলে সংসারের অনিষ্ট হবে। বিহারের রাজারাপ্পায় ছিন্নমস্তার মন্দিরে কত পাঁঠা আর মোষ যে বলি হয় তার ইয়ত্তা নাই—রক্তের ধারা বয়ে গিয়ে নীচে নদীতে মেশে। নেপালের দক্ষিণাকালিকার মন্দিরেও বিশেষ পূজার দিন প্রচুর বলি হয়—প্রায় ৭০-৭৫টা মোষ বলি হয়। আর প্রত্যেক শনি- মঙ্গলবার প্রায় প্রতি মিনিটে একটা করে বলি হয়। এই সব বীভৎসতা আমি নিজের চোখে দেখেছি, ফলে এই সব বিভিন্ন কারণে লাল রঙটাই আমার ভাল লাগে না।