গুরুমহারাজ:—বারদীর ব্রহ্মচারী (লোকনাথবাবা ) একজন অত্যন্ত উন্নত সিদ্ধযোগী ছিলেন, হঠযোগের বিভিন্ন ক্রিয়ায় তিনি সিদ্ধ ছিলেন। ১৫০- এরও বেশী বয়স পর্যন্ত তাঁর দেহ যুবকের ন্যায় সুঠাম ও কর্মঠ ছিল। তাঁর দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি নিয়ে তাঁর জীবনীমূলক গ্রন্থে অনেক ঘটনারও উল্লেখ রয়েছে। একবার আদালতে সাক্ষি দেবার সময় তিনি তৎকালীন এক বিচারককে তাঁর অসাধারণ দূরদৃষ্টি প্রদর্শন করে অবাক করে দিয়েছিলেন।
ঘটনাটা বলছি শোনো _ একবার একটা খুনের ঘটনায় লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে সাক্ষী দিতে হয়েছিল। আদালতে বিপক্ষের উকিল তাঁর ১৫০ বছরের বেশী বয়স শুনে উপহাস করে বলেছিলেন যে, যার এতো বয়স_ সে কি করে আদালতে সাক্ষ্য দেবে ? কারণ এই বয়সে মানুষের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যায়, ফলে সাধুবাবা কি দেখতে কি দেখেছে তার কোনো ঠিক নেই। এই শুনে লোকনাথবাবা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ বিচারককে বলেন যে, ‘সেখান থেকে এক-দেড় মাইল দূরে অবস্থিত একটা গাছের গোড়া বেয়ে একদল পিঁপড়ে খাবার বা ডিম মুখে করে উপরে উঠছে, এটা তিনি এইখান থেকেই দেখতে পাচ্ছেন’। বিচারক হতভম্ব হয়ে ঘটনার সত্যতা জানতে দূরবর্তী গাছটিকে দেখে আসার জন্য আর্দালি পাঠান। আর্দালি ফিরে এসে ঘটনার সত্যতা জানালে আদালত শুদ্ধ লোক অবাক হয়ে গিয়েছিল। আর এই ঘটনায় বিচারক মহাশয় লোকনাথবাবার অলৌকিক ক্ষমতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হ’ন।
দীর্ঘায়ু হবার কারণে লোকনাথবাবা, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জীবদ্দশাতে শরীরে ছিলেন। এমনকি ঠাকুরের অন্তর্ধানের পরও বেশ কিছুদিন বেঁচে ছিলেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী লোকনাথবাবার কাছে খুবই যাওয়া আসা করতেন । তিনি তাঁর ভক্তদের কাছে লোকনাথবাবার অলৌকিকত্ব নিয়ে প্রচারও করতেন। এর অবশ্য কারণও ছিল, কারণ সাধন করাকালীন বিজয়কৃষ্ণের শরীর বেশ কয়েকবার অলৌকিক উপায়ে বারদীর ব্রহ্মচারী রক্ষা করেছিলেন। সেই বিজয়ই সাধনশেষে হিমালয় থেকে ফিরে এসে ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন— “নানা দেশ ঘুরলাম—বিভিন্ন সাধু-সন্ত দেখলাম, তাতে দেখলাম কোথাও দু’আনা, কোথাও চার আনা, কিন্তু এখানে একেবারে ষোলআনা ! এমনটি আর কোথাও দেখলাম না।”
যাইহোক, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে লোকনাথবাবার সরাসরি সাক্ষাতের কথা জানা যায় না। কিন্তু ঠাকুরের অনেক ভক্তের সঙ্গে লোকনাথবাবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। বিশেষতঃ যেহেতু বারদী বর্তমান বাংলাদেশে অবস্থিত, তাই তৎকালীন পূর্ববঙ্গের শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তেরা লোকনাথবাবার কাছে অনেকেই যেতো। সাধু নাগমশাইও ছিলেন পূর্ববঙ্গের লোক সুতরাং তিনিও দু-একবার লোকনাথবাবাকে দর্শন করতে গিয়েছিলেন। ঐ রকম একবারের কথা বলছি শোনো__নাগমশাই ছিলেন খুবই বিনয়ী এবং তিনি সবসময় দীন-হীন বেশে থাকতেন। ফলে ছেঁড়া-ময়লা কাপড়-চোপড়ে সব অঙ্গ ঢেকে তিনি একপাশে গুটিয়ে বসে আছেন দেখে, লোকনাথবাবা তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন— ‘তুমি এতো দীন-হীনভাবে থাকো কেন, তোমার গুরু বুঝি তোমায় অমনি থাকতে বলেছে, যেমন গুরু তার তেমনি চেলা!’ এই ধরণের আরও অনেক কথা তিনি বলতে লাগলেন আর উপস্থিত ভক্তরা সকলে হো-হো করে হাসতে লাগলো __কারণ ওখানকার(তৎকালীন বাংলাদেশের বারদী অঞ্চলে)অনেক মানুষই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানতো না, তাই তারা বেশ মজা পাচ্ছিলো। এদিকে নাগমশাই কিন্তু দুটো-একটা কথা শোনার পরই কানে আঙুল চাপা দিয়ে বসেছিলেন। যতক্ষণ না ব্রহ্মচারীবাবা কথা বলা বন্ধ করলেন ততক্ষণ তিনি কান থেকে আঙুল খোলেননি। নাগমশাই কানের চাপা খুললে, ব্রহ্মচারী তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি আমার কথা শুনে কানে আঙুল দিলে কেন ?’ নাগমশাই উত্তর দিয়েছিলেন ‘আপনি আমার গুরুদেবের নিন্দা করছিলেন, গুরুনিন্দা শোনা উচিত নয়, তাই আমি যাতে আপনার কথা শুনতে না পাই _ সেইজন্যই কানে আঙুল দিয়েছিলাম।’ ব্রহ্মচারী আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গুরুনিন্দা না শুনতে চাও তো স্থান ত্যাগ করলে না কেন ?’ নাগমশাই উত্তর দিয়েছিলেন যে, ‘আমি আপনার কথার মাঝখানে উঠে গেলে সেটা সভাকে এবং আপনাকে অপমান করা হোতো। তাই কানে আঙুল দিয়ে চুপ করে বসেছিলাম।’ এই কথা শোনার পর ব্রহ্মচারী খুব প্রসন্ন হোন, তিনি বলেছিলেন যে, ” শিষ্যকে দেখলেই গুরুকে চেনা যায়। এর গুরু নিশ্চয়ই মহাপুরুষ, তা ছাড়া এমন অসাধারণ চেলা হয় না।”
এইতো ছিল ঘটনা—যা তোমাদের বললাম। এতে বিরোধেরই বা কি হোলো আর মান-অপমানেরই বা কি হোলো ? নাগমশাই এতো বড় মহাপুরুষ যে, তাঁর সম্বন্ধে বলা হয়—মা মহামায়া তাঁর মায়াজাল দিয়ে নাগমশাইকে বাঁধতে পারেননি কারণ নাগমশাই দীনতায় ক্ষুদ্র হয়ে সেই জালের ফাঁক দিয়ে গলে গিয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে একবার বলেছিলেন যে, ‘তোদের বাঙাল দেশটা ধন্য হয়ে গেল একটামাত্র লোকের জন্য, সে হচ্ছে দুর্গাচরণ নাগমশাই।’ সুতরাং নাগমশাই ছিলেন উচ্চ আধ্যাত্মিক অবস্থার লোক। কই তিনি তো তাঁর জীবদ্দশায় কখনো তাঁর মান-অপমান নিয়ে কাউকে কোনো complain করেন নি ! তাহলে আজ এতো বছর পর এসব ফালতু point নিয়ে বিতর্ক আনতে চাইছো কেন !