[মধ্যমগ্রামে ক্যাম্প লাইফের কথা গুরু মহারাজ বলেছিলেন।বিগত আলোচনার আজ শেষাংশ]

… এই ঘটনার পর থেকেই তৃষাণ আমাকে একটু অন্য চোখে দেখতে শুরু করলো। তবে তখন ওর এই বিশ্বাস__ তো আবার অবিশ্বাস!! এই সময় থেকেই তৃষাণের সঙ্গে আমার একান্তে অনেক আলোচনা হোতো। অবশ্য ঐ সব ঘটনার আগে পর্যন্ত তৃষাণ আমাকে বিশেষ পাত্তা দিতো না, কারণ ওর ধারণা ছিল আমি খ্রীষ্টান_ শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে আমার বিশেষ কোনো শ্রদ্ধা নাই। আর যার শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে শ্রদ্ধাবোধ নাই__সেইরকম মানুষের সাথে তৃষাণ তখন মেলামেশা করতেই চাইতো না।

যাইহোক, এর পর থেকে তৃষাণ আর আমার সঙ্গ ছাড়েনি, যেখানে যেখানে আমাদের camp উঠে গেছে(অর্থাৎ রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন্ -এর কাজের জন্য), সেখানে সেখানেই তৃষাণ যোগাযোগ রেখে চলতো। এইসময় অর্থাৎ আমার চাকরি ছেড়ে দেবার কিছুদিন আগে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। সম্বিৎ, দেবেন্দ্র ও অন্যদের সকলেরই দর্শন হয়েছিল—২৫শে ডিসেম্বর ভগবান রামকৃষ্ণ সম্বিতের বাড়ি অর্থাৎ 10, Ballygange Circular Road-এ ওদের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। ফলে সম্বিতরা সকলে সকাল থেকেই বাড়িঘর সাজিয়ে খাবার-দাবার ready করে প্রস্তুত হয়ে বসে ছিল। বাকিরাও নির্দিষ্ট দিনে ওই বাড়িতে পৌঁছে গেছিলো। ফলে সবাই মিলে রামকৃষ্ণ আগমনের অপেক্ষায় সময় কাটাচ্ছিল।

এদিকে সেদিন আমার ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছিল–সেইটা বলি শোনো ! সেই সময় যেহেতু আমি ক্যাম্পের কর্মীদের head ছিলাম, তাই ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে সারাবছরের হিসাব-নিকাশ করে আমি বেশ কিছু টাকা হাতে পেতাম । আর প্রতি বছরেই 25th December-দিনটা এখানে ওখানে গিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে কাটিয়ে দিতাম। তবে বেশিরভাগ সময় গরীবদের বা খেটে খাওয়া মানুষদের মাঝে কাটাতাম। সেবারও ২৪শে ডিসেম্বর(১৯৭৬/৭৭ সাল) হিসাব করে প্রায় দুই/আড়াই হাজার টাকা(সেই সময়ের বিচারে প্রচুর টাকা) হাতে পেলাম। মায়ের জন্য কিছু টাকা রেখে দিয়ে, বাকী টাকা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। কখন ট্রেনে উঠেছি_তার‌ই খেয়াল ছিল না, হাওড়া স্টেশনে গিয়ে সকাল হোলো ! ওখানে কিছু টাকার কেক্ কিনে ভিখারিদেরকে, কুলীদেরকে ইত্যাদি অনেককেই দিয়ে দিলাম। তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে হাওড়া ব্রীজের উপর দিয়ে যাবার সময় আরও কিছু খাবার-দাবার কিনে পথশিশু, অসহায় বৃদ্ধ -বৃদ্ধা ইত্যাদি সকলকে খাওয়াতে খাওয়াতে এগিয়ে যেতে লাগলাম। এই করতে করতে কখন যে 10, Ballygange Circular Road-এ চলে এসেছি_তা বুঝতেই পারিনি। Liftman ডাকছে, ‘আসুন ! ক’তলা ?’ আমি বললাম ‘১১ তলা।’ ওখানে পৌঁছে দেখি ঘর সাজানো —সবাই যেন কারও প্রতীক্ষায় ! একমাত্র তৃষাণকে আমার বলা ছিল যে, দুপুরের পর আমি ওখানে যাবো। তৃষাণ ওদের বলে ছিল যে, তোমরা যাকে ঠাকুর বলছো_ সে ঠিক এসে যাবে। ওরা তো রামকৃষ্ণ আসবে বলে কেউ কিছু খায়নি – আমিও ওদের পাল্লায় পড়ে কিছুক্ষণ না খেয়ে থাকার পর সম্বিতের মাকে বললাম, ‘মা ! ওরা না খেয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য অপেক্ষা করুক__ আমার ক্ষিদে পেয়েছে, আমাকে খেতে দাও।’

মা(সম্বিত দার মা) তো অনেকক্ষণ থেকেই ওদের সকলকে খাবার জন্য সাধাসাধি করছিলেন ! এইবার সুযোগ পেয়ে আমার কথায় সায় দিয়ে খাবার বাড়তে শুরু করলেন। তখন ওরাই বা কি করে, বাধ্য হয়ে আমার সাথেই বসে খেতে শুরু করলো। তারপর সারারাত ধরে চললো আলোচনা!
সেদিন দেবেন্দ্র প্রথমটায় আমার সাথে খুব তর্ক-বিতর্ক করলো, তারপর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল। সম্বিতের মা ওদের কাছে আমার কথা আগেই শুনেছিলেন। উনি বললেন, ‘বাবা তোমার সাথে দেখা হয়ে– আলাপ হয়ে আমার খুব আনন্দ হোলো।’ আমারও সম্বিতের মাকে দেখে খুব আনন্দ হয়েছিল—যেন কত আপনার।

যাইহোক, এরপর থেকেই ধীরে ধীরে ওরা—বিশেষ করে তৃষাণ,সম্বিত, দেবেন্দ্র প্রমূখরা আমার অন্তরঙ্গ হয়ে গেল। আর তখন থেকেই পরবর্তী অধ্যায়ের কাজ অর্থাৎ আশ্রম পরিকল্পনাও শুরু হয়ে গেল।

মধ্যমগ্রামে থাকাকালীন এক জেলে বৌ আমাকে খুব যত্ন করে খেতে দিতো। একদিন হয়েছে কি, দুপুরবেলায় চায়ের দোকান থেকে আমি চা-বিস্কুট খেয়ে উঠে আসছি—এটা দেখেই ঐ মা আমাকে ডাকলো। আমি কাছে যেতেই বলল, ‘দুপুরবেলায় চা-বিস্কুট খেলেন _ তাহলে নিশ্চয়ই আপনি দুপুরে আর কিছু খাবেন না ! আমি খেয়াল করেছি_আপনি প্রায়‌ই এমনটা করেন। এমন করলে শরীর খারাপ করবে যে! আজ আপনি আমার বাড়িতে আসুন_আমার যা রান্না হয়েছে,তাই দিয়ে দুটি ভাত খেয়ে যাবেন।’

দ্যাখো, ঐ মহিলাটি গরীব মানুষ কিন্তু অন্তঃকরণ কত উদার ! দুপুরে আমার না খাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক খেয়াল করেছে ! হয়তো ভেবেছে_একা পুরুষ মানুষ থাকে (তখন গুরু মহারাজ মধ্যমগ্রামে বাজারের কাছে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকতেন), নিজে রান্না করে আর হয়তো আজকে খাবে না। এই ভেবে মা-টি আমাকে অনুনয় করতে লাগলো ভাত খাবার জন্য। ঐ মা-য়ের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলাম না—তার বাড়ি গিয়ে ভাত খেলাম। সে খুব খুব যত্ন করে আমাকে খেতে দিলো—আমিও চরম তৃপ্তি করে সব কিছু খেয়ে নিলাম।

জানো, এরপর ঐ জেলে বৌ আমার ঘরের চাবি চেয়ে নিল এবং রোজ আমার ঘরে দুপুরের খাবার দিয়ে আসতো। আমি যে বাড়িতে থাকতাম, সেখানকার বাড়িওয়ালা মাঝে মাঝে আমার রান্না করে দিতো। কিন্তু সে বেশি করে bill করতো। কিন্তু দেখো__ঐ ‘মা-টি সস্নেহে আমাকে খেতে দিতো এবং তা কোনো প্রত্যাশার বিনিময়ে নয় ‌ আর আমিও ওনার হাতে রান্না করা খাবার খুব তৃপ্তি করে খেতাম।

তবে জানো __আমার স্বভাবই এরকম যে, আমি যখনই কোনো খাবার খাই _খুব প্রসন্নচিত্তে খাই। যখন কোনো গান শুনি _খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি। আমি পণ্ডিত নই যে, গানের বিচার করবো _তাই কে গাইছে, কি গাইছে বিচার করি না, শুধু শুনে যাই এবং তার থেকে মজা নিই । আমি জানি _ ফুচকা খেতে এসে রাবড়ির স্বাদ আশা করা ভুল ! তাই ফুচকার স্বাদই প্রাণভরে গ্রহণ করি। আশ্রমের জগবন্ধুর মেঠো গানও খুব মন দিয়ে শুনি এবং আনন্দ পাই। ওর গানের কথায় হয়তো ভুল থাকে, হয়তো দেখা কোনো কোনো সময় সুরটা বেশী চড়া হয়ে গেল কিন্তু এইসব নিয়ে বিচার করি না —গানের আনন্দ গ্রহণ করি, আর এটাই আমার স্বভাব বা প্রকৃতি ৷৷