গুরুমহারাজ:—প্রকৃত যোগী বা উন্নত সাধকেরা যত বৃদ্ধ হ’ন —তত তাঁদের জ্ঞান পরিপক্ক হয়। প্রকৃত সাধককে চেনা যায় তো বার্ধক্যে, এঁদেরকেই জ্ঞানবৃদ্ধ বলা হয়। ভারতবর্ষে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে, _’তেমাথা-র কাছে পরামর্শ নিতে হয়’—অর্থাৎ বৃদ্ধ বা অতিবৃদ্ধ ব্যক্তই, যাঁদের জ্ঞানলাভ হয়েছে। এঁরাই সেই “তেমাথা”।
মানব শরীরে রয়েছে সপ্তরসতত্ত্ব ! সেগুলি যথাক্রমে খাদ্যরস, রক্ত, মাংস, চর্বি, অস্থি, মজ্জা ও শুক্র ! মানবশরীরে এইগুলি cyclic order-এ একটা অন্যটায় পরিবর্তিত হোতে থাকে। তাহলে বুঝতেই পারছো—সবচাইতে বেশী শক্তিক্ষয় হয় শুক্র বা বীর্যপাতে ! কারণ সাতটি ধাপের পরিবর্তনের ফল এই শুক্র। যোগসাধনার ফলে সাধকের শুক্রক্ষয় রোধ হয় । তাই সাধারণ মানুষের মতো যোগীদের অযথা শক্তি ব্যয়িত হয় না। একবার বীর্যপাত হোলে একজন সুস্থ মানুষের শরীরের আবার সমপরিমাণ বীর্য তৈরী করতে মোটামুটি ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগে। ঠিকমতো খাদ্য গৃহীত হোলে শরীর আবার এই ক্ষয়টা খাদ্যরস থেকে সাতটি ধাপে পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন করতে করতে পুষিয়ে নেয় ঠিকই কিন্তু ঐ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই যদি রেতঃপাত হয়, তাহলে তখন মজ্জা থেকে শক্তির supply হয়_নতুন করে বীর্য উৎপাদনের জন্য !
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, অহেতুক এবং অতিরিক্ত বীর্যপাতের ফলে মানুষের মজ্জার ক্ষয় হয় ! এবার মজ্জা ক্ষয়িত হোলে, তখন শক্তির জোগান দিতে হয় অস্থিকে। ফলে এইভাবে যদি অনিয়মিত শক্তিক্ষয় চলতেই থাকে, তাহলে ধীরে ধীরে অস্থি দুর্বল হোতে থাকে। এইজন্যই দেখা যায় যে, একটু বয়স হলেই মানুষের শিরদাঁড়া বেঁকে যায়, বিভিন্ন অস্থির যন্ত্রণা শুরু হয়। মনে করো কেউ ৪৮ ঘণ্টার জায়গায় ২৪ ঘণ্টায় ২/৩ বার শুক্রস্খলন করলো, তাহলে শরীরের আভ্যন্তরীণ যন্ত্রগুলিতে যেন emergency declare হয়ে যায়। প্রত্যেকে তাদের নিজের নিজের কাজ ফেলে শুক্র-উৎপাদনে শক্তি ব্যয় করতে থাকে। ফলে মানুষের শরীরে আলস্য আসে, হয়তো অসময়ে ঘুমিয়ে যায়, কারণ ঘুমের মাধ্যমে মানুষের শরীরে আবার শক্তির সঞ্চয় হয়।
যাই হোক, এইভাবেই মানুষের অকারণ বীর্যপাতের ফলে প্রচুর শক্তিক্ষয় হয়। মজ্জার ক্ষয় যে শরীরে যত কম হয়, তার শরীর বেশী বয়স পর্যন্ত তত মজবুত থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে Life-Cell- এর সংখ্যা কমে যায়। ফলে দেখা যায় গায়ের চামড়া কুঞ্চিত হয়ে কিসমিসের মতো হয়ে যায়, মাংসপেশীও স্থানে স্থানে ঝুলে পড়ে । এটা যোগীদেরও হয় কিন্তু তাঁদের চক্ষু উজ্জ্বল থাকে, মেধা অটুট থাকে_যেটা বীর্যহীন মানুষের থাকে না। যোগীদের স্মৃতিশক্তি, ধীশক্তি যেন দিন দিন বেড়ে চলেছে বলে মনে হয়। ধীশক্তি থেকেই ধৈর্য এবং ধারণাশক্তি জন্মায়। যার এই ধীশক্তি থাকে না তারই বুদ্ধির ভীমরতি দেখা যায়। কোনো বৃদ্ধ একটু আগেই হয়তো খেয়েছে কিন্তু পরক্ষণেই বলে—”খাইনি তো”! কোনো জিনিস নিয়ে বলে- “নিইনি তো”! বৃদ্ধ বয়সে এইরকমটাই হয়। সেইজন্যই স্বামী বিবেকানন্দ সাধারণ মানুষের অবস্থা দেখে বলেছিলেন, “বজ্রাহত বৃক্ষ”। অথচ যোগীরা যেহেতু সংযমী জীবন-যাপন করে থাকেন, তাই বয়স বাড়লেও তাঁদের জীবনে—এমনকি চোখে-মুখেও বিরাজ করে এক অখণ্ড শান্তি, ফলে তাঁরা শান্ত ও সৌম্য হ’ন।
অসংযমী মানুষ বুড়ো হোলেই খিটখিটে হয়ে পড়ে। এমনিতেই দেখবে বদমেজাজী, খিটখিটে মানুষ মানেই অসংযমী হয় । অপরপক্ষে সংযমী মানুষ অনেকটা শান্ত বা ধীর-স্থির হয়।
আসলে Art of life বা Art of living অর্থাৎ জীবনের কলা বা বাঁচার কলাটা যে কি—তাতো আমরা বেশিরভাগ মানুষই জানি না। কিন্তু যাঁরা এটি জানেন এবং জীবনে যোজনা করেছেন__ তাঁরা পরমানন্দে বিরাজ করেন, অখও শান্তিতে থাকেন, অসীম ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে জীবনকে ঠিক ঠিক উপযোগ করতে পারেন। কিন্তু তা না করে সাধারণ মানুষ কি কষ্টটাই না পাচ্ছে! অহরহ ত্রিতাপ জ্বালায় ক্লিষ্ট হোচ্ছে, অশান্তির আগুনে দগ্ধ হোচ্ছে প্রতিটি মানুষ__ তবুও এই মায়াময় জগতে মহামায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হোতে পারছে না–এটাই মহামায়ার মোহিনী মায়া !!